ধূসর পাহাড়,পর্ব_০৩
লেখিকা আমিশা নূর
তিন অক্ষরের শব্দটা অরণ্যের মনে উথাল-পাতাল সৃষ্টি করে দিয়েছে। খু-ব সুক্ষ্ম ভাবে একদল শীতল বাতাস গা ছুয়ে দিলো। তার কর্ণে এখনো শব্দটিই বাজছে।কুা…য়া…শা।চাঁদের হালকা আলোতে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে মেয়েটার কপালে চুল এসে পড়ে পড়েছে।খু–ব সুন্দরভাবে চুলের দলদের সরিয়ে দিলো।অরণ্যের মনে হচ্ছে কুয়াশা শ্বাস-প্রশ্বাস টাও খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা কুয়াশা নইতো?
~কু..য়া..শা..??(কানন)
~জ্বী…
খুব নম্রভাবে উত্তর দিলো কুয়াশা।কিন্তু কাননের ভয়ার্ত চেহেরা দেখে কিছুটা অবাক হলো।তার নামের মধ্যে ভয় পাওয়ার কী আছে?
~দোস্ত ঐটা এফএম রেডিও’র কুয়াশা না।(অধ্রী)
~জা..নি আমি।শু..শু..ধু ভয় পাচ্ছি একটু।
~আমি পেত্নী বা প্রেতাত্মা নই।আমি তোমাদের মতোই সিম্পল মানুষ।
~অসম্ভব!তুমি সিম্পল হতেই পারো না। আমরা কোনোদিন সুইসাইড করতে চাইনি কিন্তু তুমি তো ট্রাই করছো।
অরণ্যের কথা শুনে কুয়াশা আবার বিরক্ত হলো।বড্ড কথা বলে তো ছেলেটা,কী দরকার বার-বার সুইসাইড সুইসাইড করার?আজিব।অরণ্যের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
~দোস্ত আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে।চল না কোথাও গিয়ে বসি।(রৌদ্রময়)
~হুম,চল।রেললাইনের ওপাড়ে যায়।বাতি পোকা আছে ঐখানে।(অধ্রী)
~বাতি পোকা?(কুয়াশা)
~হুম,জোনাকিপোকা কে ও বাতি পোকা বলে।অধ্রীর কথাগুলো এমনই। শুদ্ধ-চলিত সব কিছু মিক্স।তাই ওকে আমরা মিক্সার বলি।(রৌদ্রময়)
~এ চুপ করতো।তুই কী হ্যা?পড়ুয়া,হিংসুটে, বান্দর। কালা বিলাই।
~দেখেছো এখনো কেমন করে কথা বলছে।
হাটার সময় খুনসুটি ঝগড়া চালিয়ে যাচ্ছে তারা।তাদের কথোপকথন শুনে কুয়াশা’র নিজের বান্ধুদের কথা মনে পড়ে গেলো।সেও তার বন্ধুদের সাথে এভাবেই হাসি-ঠাট্টা করতো।কিন্তু কুয়াশা তো নিজ থেকে তাদের সাথে কথা বলে আজ এক মাস!আজকে কী ওরা সবাই কল করছে তার ফোনে?কে জানে?হয়তো করবে নয়তো না।তবে সে জানে সামাইরা তাকে কল করবেইৃ
~কুয়াশা তুৃমি আগে এখানে এসেছো?
অধ্রীর প্রশ্নে কুয়াশা ভাবনার ইতি টানলো।মাথা নেড়ে “হ্যা” সূচক উত্তর দিলো।তারা এখন রেললাইনে দাড়িয়ে আছে।আপাতত ট্রেন আসবে না।রেললাইনে দাড়িয়ে শীতল হাওয়া অনুভব করছে।চারিদিকে জোছনা’র হালকা আলো।এর আগেও কুয়াশা অনেক বার এই জায়গায় এসেছে তবে একা!বড্ড একা ছিলো তখন।কিন্তু এখনও তো একাই আছে তাহলে কেনো তার আগের মতো অনুভূতি হচ্ছে না।তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় তাকে জানান দিচ্ছে,”এই মানুষগুলা তার বড্ড আপন হবে!খুব কাছের মানুষ হবে।খু—-ব!”
পাঁচজন সারি করে রেললাইনে দাঁড়িয়ে আছে।প্রজাপতির মতো হাত মেলে আাকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।কুয়াশার ইচ্ছে করছে এখনি প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেতে।খুব হিংসে হয় তার প্রজাপতি নিয়ে।কতো সুখি তারা!যখন যেখানে খুশি পাখা মেলে উড়ে যেতে পারে।কিন্তু কুয়াশা?তার তো বাড়ি থেকে বের হতেই হাজার’টা কৈফিয়ত দিতে হয়।কুয়াশা অধ্রীর বা’পাশে হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে।তার ডানপাশে রৌদ্রময়।কুয়াশা’র পাশে রয়েছে কানন।আর সবার শেষে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য!দৃশ্য’টা একপলক দেখে মনের মধ্যে ছবি তুলে নিলো।পারমানেন্ট পিক!কখনো মুচে যাবে না ছবি’টা।কক্ষনো নাহ!
~আহ, শান্তি!
এমন পরিস্থিতিতে কাননের মন্তব্য শুনে সবাই হেসে উঠলো।কুয়াশা মুচকি হাসলো।মুচকি হাসি’টা অরণ্যের চোখ এড়ালো না।খুব সুন্দরভাবে টুল পরেছে বা’গালে।অরণ্য চাইছে সময়’টা এখানেই থেমে যাক।স্তব্ধ হয়ে যাক চারিদিক।এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছে।ঝিঝি পোকারা যেন তার অনুভূতি’কে স্বাগত জানাচ্ছে।
~গোপাল তোর কাছে চুইংগাম আছে?
অধ্রীর কন্ঠে দুজনের ভাবনার অবসান ঘটলো।তারা আবার হাটতে শুরু করলো।জোনাকি পোকাদের কাছে যাচ্ছে তারা।
~না নেই।
~দেয় না ইয়ার।
অধ্রীর আকুতি-মিনতি দেখে কানন তার জ্যাকেট থেকে একটা চুইংগাম বের করলো।কারণ কানন জানে চুইংগাম না খেলে অধ্রীর পেটের ভাত হজম হয় না! এবারে কুয়াশা ভালো করে লক্ষ্য করলো কাননের জ্যাকেট।জ্যাকেট’টা ভিতরে কয়েকটা পকেট।জলের বোতল রাখার জন্য কয়েকটি ফিতা।চুইংগাম রয়েছে একটা থলেতে।নিখুঁত আর্ট! প্রত্যেক’টা মানুষেরই নিজের অভ্যাস নিয়ে এক একটা প্রতিভা থাকে।কাননই যেন তার অন্যতম উদাহরণ।
~খাদকিনি খেয়ে আছিস নি?(রৌদ্রময়)
রৌদ্রময়ের কথা শুনে আরেকটি ঝটকা খেলো সে।মনের মধ্যে প্রশ্ন’টা উড়াউড়ি করছে তাই না পারতে বলেই দিলো: “খাদকিনি?”
~হ্যা।ছেলেরা যদি খাদক হয় মেয়েরা তো খাদকিনিই হবে।
কুয়াশার চোখ বড় হয়ে গেলো।এরা প্রত্যেকেই আলাদা!অদ্ভুত!রৌদ্রময়ের কথানুযায়ী তো চুন্নি হবে চুন্না! তাহলে কী সতিন হবে সতান?
~সতিন কী সতান হবে?
কুয়াশার প্রশ্ন শুনে সবাই হেসে উঠলো।কুয়াশা পুরাটাই বোকাবনে গেলো এবং মন’টা সাথে সাথেই খরাপ হয়ে গেলো।কেউ যদি তার প্রশ্ন নিয়ে হাসাহাসি করে তার মোটেও ভালোলাগে না।
~হ্যা।সতানই হবে।
~তোমরা কী জানো,তোমরা কতোটা অদ্ভুত?
কুয়াশা’র কথা শুনে সবার হাসি থেমে গেলো।অধ্রী কুয়াশা’র গাল টেনে বললো, “হয়েছে মন খারাপ করো না,আমরা সবাই এমনিই।বন্ধুরা সব এমনই হয়!”
কুয়াশা অবাক হলো।শুধু অবাক নই যথেষ্ট অবাক হলো!অধ্রী কীভাবে বুঝলো তার মন খারাপ?তার পরিবারের কেউই তো বুঝে না!কুয়াশা থেমে গেলো।অরণ্য পেছনে ফিরে দেখলো কুয়াশা আর হাটছে না।কুয়াশা’র কাছাকাছি গিয়ে বললো,”অধ্রীর বুঝার ক্ষমতা বেশি!যে কারো সাথে কিছুক্ষন থাকলেই বুঝে নে মানুষ’টা কেমন।আর আপনার চেহেরা দেখে বুঝাই যাচ্ছে আপনার মন খারাপ।” মুচকি হেসে
কথাটি বলে অরণ্য পা-বাড়ালো।এই প্রথমবার অরণ্যকে বিরক্ত লাগলো না তার।কতো সুন্দর করে মুচকি হাসতে পারে তা উনার থেকেই শিখা উচিত।কিছুসময় কুয়াশা নিজের সাথে বোঝাপোড়া করলো।এই মানুষদের সে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারে!
৩.
জোনাকি পোকার রাজ্যে চলে এসেছে তারা।চারিদিকে আলো ছড়িয়ে আছে।তাদের মাথা উপর গোল করে ঘুরছে জোনাকিপোকার দল।মনে হচ্ছে কোনো “তাজ” পরে আছে।এর আগে কোনোদিন জোনাকিপোকা দেখেনি কুয়াশা।আজকে যেন তার জীবনটাকে নতুনভাবে অনুভব করছে।এই প্রথমবারের মতো তার আফসোস হচ্ছে কেনো সুইসাইড করতে যাচ্ছিলো এতো সৌন্দর্য ছেড়ে।সবার মুখে হলুদ-সবুজের আলো ছড়িয়ে গেছে।এই দৃশ্যটিও সে মনে বন্ধি করে নিলো। হঠাৎ ক্যামেরা’র ফ্লাশে কুয়াশা চোখ বন্ধ করে নিলো। ক্যামেরা কোথা থেকে এলো?
চলবে..