ধূসর পাহাড়,পর্ব_০২

ধূসর পাহাড়,পর্ব_০২
লেখিকা আমিশা নূর

ভূওওওওওওত

কাননের ভয়াহত কন্ঠ শুনে রৌদ্রময়রা পেছনে ফিরে তাকালো।ভয় পেয়ে তিনজন দৌড়ে রেললাইনের কাছাকাছি গেলো।

~কী হলো কানন?(অরণ্য)

~দোস্ত তোরে ভূতে ধরছে?(অধ্রী)

~ভ.. ভ..ওও…ত..(কানন)

~আরে কী ভূত?কই ভূত?

যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে কথাটি বললো রৌদ্রময়।কাননের দিকে তাকিয়ে দেখলো কানন রেললাইনের দিকে আঙ্গুল দেখাচ্ছে।কাননের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখলো রেলপথে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে সাদা গাউন আর কাধের এক পাশে সাদা ওড়না নেওয়া।ঘন কালো চুলগুলা নিচু করে ব্যান্ড দিয়ে বাধা। মেয়েটার পেছন দিক’টা দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, মেয়েটা কী সুইসাইড করতে যাচ্ছে?কয়েক মিনিট পর তো ট্রেন আসবে।ট্রেন আসলে তো মেয়েটা নিশ্চিত মারা যাবে।মরতে চাই নাকি?এই ধরনের নানা প্রশ্ন অরণ্যের মাথায় খিলবিল করছে।

~আরে ধুর কানন বাচ্চা। ঐটা ভূত না।মেয়ে মেয়ে মানে পেত্নী।(রৌদ্রময়)

~কীহ?(কানন)

কাননের ভয় আরো বেড়ে গেলো।সে শুনেছে পেত্নীরা মানুষ দেখলেই রক্ত শুষে নেয়।

~উফ,কেনো ভয় দেখাচ্ছিস ওকে??কানন শুন ঐটা একটা মেয়ে।(অধ্রী)

~কী… কী প্রমান আছে ঐ..ঐটা মেয়ে?

~আরে গাধা ভূতের চুল খোলা থাকে কিন্তু ওর চুলগুলা অর্ধেকে বাধা।আর দেখ চুল উড়ছে না।পেত্নীদের তো বাতাস ছাড়াই চুল উড়ে।

কানন এইবারে ভালো করে লক্ষ্য করলো। হ্যা ঠিকই তো চুল বাধা আর উড়ছেও না।তারমানে এইটা মেয়েই।অধ্রীর কথা সে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করলো।

~অরণ্য?

~হু?হু..

~কী হয়েছে তোর এভাবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?(অধ্রী)

~দোস্ত আমার মনে হয় মেয়েটা সুইসাইড করতে চাইছে।

~হুয়াট?(রৌদ্রময়)

~আমার সিক্সসেন্সও তাই বলছে।দোস্ত ট্র…এএ..ন আসছে।

ঝকঝকা ঝক শব্দ করে ট্রেন ছুটি আসছে।আকাশে হরেকরকমের আলো দেখাচ্ছে।তারমানে বারোটা বেজে গেছে৷নতুন বছরের আগমন হয়েছে।কিন্তু এই মেয়েটা তো এখনি ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে মারা যাবে। নাহ এই মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।

~এএএ….ই মেয়ে?এএএএই মেয়ে?

~দোস্ত এই মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। (রৌদ্রময়)

~হুম হুম।

মুখে দু’টা চিপস ভরে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বললো।রৌদ্রময় বিরক্ত নিয়ে কাননের দিকে তাকালো।টেনশনে মানুষের গলা দিয়ে খাবার নামে না কিন্তু তার বন্ধু’টা দিব্যি খাবার খেতে পারে।রৌদ্রময় তার বা’পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো অরণ্য ট্রেনের দিকে ছুটে যাচ্ছে।সেও কী সুইসাইড করতে যাচ্ছে?রৌদ্রময় মনেমনে ভাবলো।

~কানন অরণ্যও কী সুইসাইড করবে?

~কে জানে?করলে তাতে ভালোই হব্বে।আমি চল্লিশা’র সময় ভালোমতো খেতে পারবো।

~চুপ করতো মাথামোটার দল।অরণ্য মেয়েটাকে বাচাঁতে গেছে।চল ওদের কাছে যাই।(অধ্রী)

ট্রেন মেয়েটার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। অরণ্য দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে টেনে নিচে ফেলে দিলো।ট্রেন ততক্ষণে ওদের পেরিয়ে ঝনঝন শব্দ করে চলে গেলো।অধ্রীরাও ওদের কাছে এগিয়ে এলো।

~আ..হহ।(মেয়েটি)

~অরণ্য কী করছিস তুই?এই মেয়ে তুমি ব্যাথা পাওনি তো?লাগেনি তো কোথাও?

আদুরে কন্ঠে কথাগুলো বলে মেয়েটাকে টেনে তুললো।অধ্রী খুবই দয়ালু একটি মেয়ে।সামান্য একটা মশা’র জন্যও তার মন খারাপ হয়।অপরিচিত একটা মেয়ের জন্যও তার খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে হাত ধরে দাড় করালো। জামার নিচের ময়লাগুলো ঝেড়ে দিলো।

~এই মেয়ে তুমি কী পাগল?এভাবে রেললাইনে কেউ দাড়িয়ে থাকে?মরতে গেলে বাসায় একটা ভালো দড়ি খুঁজে মরো।

~অরণ্য..

ধমক দিয়ে বললো অধ্রী।মেয়েটা উঠে দাড়ালো। তার চোখে জল স্পষ্ট।মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা রেগে আছে।কিন্তু কাঁদছে কেনো?

~জ্বী? আপনারা কিছু বলছেন?আর আমাকে আপনি পেলে দিলেন কেনো?

এতো মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে অরণ্যের রাগ বরফের মতো গলে গেলো।কিন্তু মেয়েটা বলছে কী?অরণ্য রেগে গেলে অনেক জোরে কথা বলে আর মেয়েটা কীনা শুনতেই পাচ্ছে না?উল্টো প্রশ্ন করে যাচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতে কানন আরেকটা চিপসের প্যাকেট খুললো।

~হ্যা?তুমি এতক্ষণে কিছু শুনো নি?

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো অধ্রী।সাথে সাথে ইশারায়ও বুঝিয়ে দিলো।মেয়েটা মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিলো।এবারে মাথায় হাত দিলো অরণ্য।

~না ভাইয়া আমি আপনাদের কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছি।প্লিজ আরেকটু বড় করে বলবেন?

অধ্রীকে “ভাইয়া” বলে সম্মোধন করায় সবাই হেসে উঠলো।মেয়েটা এবারে মনে হলো আরো রেগে গেলো।নিশ্চিত সে এখন মনেমনে বলছে”কী আজিব মানুষজন ফিসফিস করে কথা বলে আবার কোনো কারণ ছাড়াই হাসে”।মনেমনে ভাবলো অরণ্য।মেয়েটা মাথা চুলকিয়ে হাত নিয়ে আসার সময় বোকাবনে গেলো।

~কী হলো?

ইশরায় জিজ্ঞেস করলো অরণ্য। মেয়েটা কান থেকে দুটো তুলা বের করলো।অরণ্যরা সবাই ভ্যচকা খেলো।

~সরি আসলে কানে তুলা গুঁজে রেখেছিলাম। যাতে কেউ পেছন দিকে ডাকলে না শুনি।সুইসাইড করতে যাওয়ার সময় প্রিপারেশন নিয়ে গেছিলাম আর কি।আর আপনি আমাকে টেনে ফেলে দিলেন কেনো?

~দোস্ত একটু পানি দিবি আমায়?

টেনশনে পড়ে কাননের কাছ থেকে পানি চাইলো অধ্রী।হাতকাটা জ্যাকেট’টা খুলে ভেতর থেকে পানি বের করলো কানন।কাননের পানি রাখার স্টাইল দেখে ওর বন্ধুরা অবাক হলো না কিন্তু মেয়েটা অবাক হলো।ওদের চারজনকে খুটিয়ে দেখতে লাগলো।প্রথমেই চোখ গেলো বয়কাট চুল ওয়ালা দেওয়া মেয়েটার দিকে।হ্যা,এইটা তো মেয়ে!ইশ সে ছেলে মনে করেছিলো,প্রথমে চারটা ছেলে দেখে ভয় পেলেও এখন মনে সাহস এসেছে।তারপর রৌদ্রময়কে দেখলো।উচ্চতা,প্রায় ৫’১১” হবে,ওদের মধ্যে উনিই লম্বা, গায়ের রং ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না।

কানন!এই ছেলেটা তখন থেকে খাচ্ছে, পেট’টা একটু বড়, সবার চেয়ে খাটোও।বাকি তিনজনের ড্রেসআপের সাথে এর কোনো মিল নেই।কিন্তু বাকি তিনজনের ড্রেসআপ বাইক রেসারদের মতো।আচ্ছা ওরা কী বাইক রেসার?

~এক্সকিউজ মি?আপনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেন নি।

অরণ্যের কথা শুনে তার দিকে তাকালো।৫’৯” এর কাছাকাছি হবে।বডি সিক্সপেক হবে কীনা ডাউট। তবে যে ছেলেটা রাগী তাতে তার(মেয়েটি) সন্দেহ নেই।কীভাবে কথা বলে?

অরণ্যের দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকালো সে।সে তখন থেকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।কী দরকার ছিলো তাকে বাঁচানোর?কেউ তো তাকে ভালোবাসে না,বাঁচতে চাই না সে এই নিষ্টুর দুনিয়ায়। এর আগে অনেক বার মরতে চেয়েছে কিন্তু সাহস হয়নি।তাই আজকে সে রেললাইনে চোখ বন্ধ করে,কানে তুলা গুজে রেখেছিলো।আর এই ছেলেটা?বিরক্তিকর দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকালো সে।

~এই নাও পানি খাও।

জলের বোতল এগিয়ে দিলো অধ্রী।ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করলো।আকাশে এখনো আতশবাজির আলো দেখা যাচ্ছে।তারমানে এখনো বারোটা।

~নাম কী তোমার?মরতে যাচ্ছিলে কেনো?(অরণ্য)

অরণ্যের প্রশ্ন শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না মেয়েটা।এই মূহুর্তে ছেলেটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।অধ্রী বিষয়টা বুঝলো।

~অরু তুই কথা বলিস না।(অধ্রী)

~কেনো?(অরণ্য)

~হুদাই।আচ্ছা তোমার নাম কী?

চার শব্দের প্রশ্নটা সহজ হলেও এই মূহুর্তে যেনো খুব কঠিন তার কাছে। কিছুতেই বলতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু না বললেও অনেকটা অপমানজনক হবে।তাই সে শীতল কন্ঠে বলল “#কুয়াশা”।

তিন অক্ষরের শব্দটা অরণ্যের মনে উথাল-পাতাল সৃষ্টি করে দিয়েছে। খু-ব সুক্ষ্ম ভাবে একদল শীতল বাতাস গা ছুয়ে গেলো। তার কর্ণে এখনো শব্দটিই বাজছে।কুা…য়া…শা।চাঁদের হালকা আলোতে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে মেয়েটার কপালে চুল এসে পড়ে পড়েছে।খু–ব সুন্দরভাবে চুলের দলদের সরিয়ে দিলো।অরণ্যের মনে হচ্ছে কুয়াশা শ্বাস-প্রশ্বাস টাও খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা কুয়াশা নইতো?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here