দৃষ্টির অগোচরে,২৫তম_পর্ব,২৬তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৫তম_পর্ব
স্নিগ্ধ যখন ই ছুরিটা নিয়ে সমীরের উপর হামলা করবে তখনই তৌহিদ পিস্টলটা তার মাথার পেছনে ঠেকিয়ে বলে,
– ইউ আর আন্ডার এরেস্ট স্নিগ্ধ। তোমার গেম শেষ।
অবাককর ব্যাপার স্নিগ্ধের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে উলটো বিকৃত হাসি দিয়ে বললো,
– ফোনটা রিসিভ করুন অফিসার।
তখন ই ফোনটা বেজে উঠে তৌহিদের। ফোনটা রিসিভ করতেই শুনতে পেলো,
– স্যার মতিজিল ১ এ একটা খুন হয়েছে, ব্যাংক “…” এর উত্তরা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার দিহান আহমেদের। স্যার বুকের ছোরা মারা হয়েছে। হয়তো পকেটমার বা ছিনতাইকারীর কাজ।
তৌহিদের চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো, তার কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে স্নিগ্ধের পিছু নিতে যেয়ে ভুলেই গিয়েছিলো টার্গেট একজন নয় বরং অনেকে। এদিকে সমীর নেশায় বুদ হয়ে পড়ে রয়েছে তার ঘরে কেউ এসেছে কি না সেটাও তার মাথায় নেই। সে ভোশ ভোশ করে ঘুমাচ্ছে। স্নিগ্ধের চোখ চকচক করছে, তার মুখে বিকৃত হাসি। সেই হাসিতে রয়েছে তৌহিদের প্রতি বিদ্রুপ। স্নিগ্ধের হাসি দেখে মেজাজটা আরোও খারাপ হয়ে গেলো। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সজোরে ঘুষি মেরে দেয় সে স্নিগ্ধের নাক বরাবর। স্নিগ্ধ টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে আছড়ে পরে৷ তার নাক,ঠোঁট বেয়ে উষ্ণ রক্ত বেরিয়ে এলো। কিন্তু তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সজোরে হাসতে লাগলো স্নিগ্ধ। আর বলতে লাগলো,
– তোমরা তাকে ধরতেই পারবে না। কারণ সে তোমাদের চেয়ে সবসময় দু কুদম এগিয়ে থাকে।
বলেই উম্মাদের মতো হাসতে লাগলো। এতো ভয়ংকর হাসি শুধু মানসিকভাবে বিকৃত কোনো ব্যাক্তির ই হতে পারে। তৌহিদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। যদি স্নিগ্ধ এমন হয়ে থাকে তবে স্নিগ্ধের পেছনে যে মাথা কাজ করছে সে কতোটা বিকৃত!!
ইন্টারোগেশন রুমের ২২০ বাল্বের নিচে বসে রয়েছে স্নিগ্ধ। তার মুখের হাবভাব স্বাভাবিক। এতো মার খাবার পর ও সে মুখ খুলে নি। তৌহিদ ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– স্নিগ্ধ তোমার মাস্টারমাইন্ড টি কে?
– কেনো শামীম ভাই বলে নি?
– আমি আবার জিজ্ঞেস করবো, তোমার মাস্টারমাইন্ড টি কে?
– কখনো ছায়া ধরেছেন! চেষ্টা করেছে ধরার? ছায়া এমন একটা জিনিস যা ধরা যায় না। ঠিক তেমনই সেও এমন একজন মানুষ যাকে ধরার ক্ষমতা আপনার অন্তত নেই।
বলেই বিকৃত স্বরে হাসতে লাগলো স্নিগ্ধ। দুদিন আগে নুশরাতকে নিয়ে শামীমের কাছেই গিয়েছিলো তৌহিদ। অবশেষে শামীম মুখ খুলতে রাজী হয়েছে। শামীম স্নিগ্ধের হাতে মরতে চায় না।
সাল২০১১, জানুয়ারি মাস
আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘১০ ব্যাচের ভর্তি চলছে। এইচএসসি ১০ ব্যাচ আজ ভর্তি হচ্ছে ভার্সিটিতে। তখন মাহির, অনিক, দিহান এবং নাহিদ মাস্টার্সের ফার্স্ট ইয়ারের শিক্ষার্থী। আলতাফ, সমীর অনার্স ফোর্থ ইয়ার এবং শামীম, ইশান এবং রাজীব থার্ড ইয়ারে পড়ে। তাদের দশজনের গ্রুপটি নয়জনে রুপান্তরিত হয় কারণ তাদের দশম সদস্য ফাহাদ দেশের বাহিরে চলে যায়। তাই দশজনের গ্রুপটি নয়জনে রুপান্তরিত হয়। ভার্সিটিতে নতুন ভর্তির দিন সব সিনিয়ারদের মতো এই গ্রুপের নজর ও ছিলো জুনিয়রদের উপর, কারণ ক্লাস শুরুর পর থেকেই টানা একবছর এই কচি জুনিয়রদের র্যাগ দিয়ে নিজের মনোপূর্তি করার সুযোগ পাবে তারা। তাই অডিটোরিয়ামের সামনের গাছতলায় চা হাতে আড্ডা মারছিলো গ্রুপটি। এরই মাঝে নাহিদের চোখ অডিটোরিয়ামের দরজায় আটকে যায়৷ সে সম্মোহনী চাহনিতে তাকিয়ে তাকে সেদিকে। মাহির তাকে ধাক্কা মেরে বলে,
– কি মামা, চোখ তো যেনো চুম্বক হয়ে গেছে? সরছেই না?
– দোস্ত আমি মনে হয় প্রেমে গেছি।
– কি কস ব্যাটা?
বেশ অবাক হয়ে মাহির কথাটা বলে৷ তখন নাহিদ আঙুল দিয়ে তাদের অডিটোরিয়ামের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে বলে। একটা সাদা সালোয়ার কামিজ পড়া মেয়ে দরজার কাছে ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। গোল গাল, হলদেটে বর্নের মেয়েটি, উচ্চতা খুব হলে পাঁচফুট এক হবে, চুল গুলো বেনুনী করে একপাশে ফেলে রেখেছে। চোখের উপর তার ছোট চুল গুলো বারবার পড়ছে। শীতের শীতল পরশে মেয়েটির গাল লাল হয়ে আছে। নাহিদ মেয়েটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এতোদিনের ভার্সিটির জীবনে যেনো এই প্রথমবার প্রেম করতে বেশ ইচ্ছে হচ্ছিলো। সমীর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
– ভাই, ভাবী তাহলে ফিক্স কি বলেন?
– একদম, আর শোন যত ফার্স্ট ইয়ার আছে তাদের জানিয়ে দিবি মেয়েটাকে আমার ভালো লাগে।
বলেই নাহিদ উঠে দাঁড়ালো। তার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ছে। লাভ এট এ ফার্স্ট সাইট হয়তো একেই বলে। নাহিদ দ্রুত অয়া ফেলিয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ালো। হুট করে এভাবে কেউ সামনে আসায় বেশ চমকে গেলো মেয়েটি৷ কাঁপা স্বরে বললো,
– জ্বী?
– তোমার নাম কি?
– জ্বী?
– নাম? বাংলা বোঝো না নাকি?
– ইশানী।
– ফার্স্ট ইয়ার?
– জ্বী ভাই
– আমি নাহিদ, নামটা মনে রাখবা। মাস্টার্স ফাস্ট ইয়ার। কেউ যদি তোমাকে কিছু বলে আমাকে জানাবা, মনে থাকবে?
– হু
ইশানী মাথা নেড়ে ছোট করে হু বললো। নাহিদের এমন ব্যবহারে বেশ ভয় পেয়েছে সে। ভার্সিটিতে ভর্তির আগে সিনিয়রদের র্যাগ বিষয়টা তাকে বেশ ভাবাতো। নাহিদ কে দেখে স্বস্তির বদলে ভয়টা যেনো গাঢ় হয়ে গেলো। নাহিদ মুখের হাসি টেনে উলটো পথে হাটা দিলো। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে। রাতে কাউকে র্যাগ দিবে না সে।
ক্লাস শুরু হবার পর যেনো ইশানীর জন্য ব্যাপারগুলো জটিল হয়ে গেলো। ক্লাসের একটি ছেলেও তার সাথে কথা বলতে চায় না। সর্বোচ্চ এড়িয়ে চলে। সে কারোর সাথে কথা বলতে গেলেও তারা ভয়ে কথা বলে না। ধীরে ধীরে ইশানী জানতে পারে কারণটা কি! কারন হলো নাহিদ এবং তাদের গ্রুপ। নাহিদ প্রায় প্রতিদিন তার সাথে কথা বলার বাহানায় তাকে যেখানে সেখানে ডেকে পাঠায়। ইশানী যেখানে যায় নাহিদ এবং তার গ্রুপ সেখানে উপস্থিত থাকে। যদি কোনো ছেলের সাথে সে কথাও বলে তব্বে সেই রাতে ৩-৪টা অবধি ছেলেটাকে অহেতুক র্যাগ খেতে হয়। সারা ভার্সিটি মুখে মুখে কথাটা ছড়িয়ে গিয়েছিলো। ফলে নাহিদ এবং তাদের গ্রুপের ভয়ে কেউ তার সাথে কথা অবধি বলতে চাচ্ছে না। ইশানীর মনে নাহিদের প্রতি যে ত্রাশ জন্মেছিলো তা এখন ঘৃণাতে পরিণত হচ্ছে। তার ভার্সিটি জীবন পুরোপুরি নরক বানিয়ে দিচ্ছে এই মানুষগুলো। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা ব্যাতীত কোনো উপায় ও নেই। কারণ ভার্সিটিতে তাদের সব ধরণের ক্ষমতা রয়েছে। দিন যেতে থাকে, ইশানীর কোনো মতে ফার্স্ট ইয়ার প্রায় শেষের দিকে। সেই সময়ে যেহেতু নতুন বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তি হবে সেহেতু র্যাগের চাপ ও কমে এসেছে। তখন ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের তানজীম নামক একটি ছেলে সুযোগ বুঝে ইশানীকে তার মনের কথা বলে। ছেলেটি ইশানীকে পছন্দ করলেও ভয়ে কখনো বলতো না। ইশানীর সাথে তার দেখা হলে মাথা নিচু করে সরে আসতো। কিন্তু এখন তারা দ্বিতীয় বর্ষে উঠবে তাই র্যাগের টেনশন ও নেই৷ ইশানীর কাছেও এই একটা বছর দম আটকা লাগছিলো। যখন ছেলেটি সাহস দেখিয়ে তাকে মনে কথা বলে তখন সেও পিছ পা হয় নি। ব্যাপারটা প্রথমে বেশি কেউ জানতো না। কারণ কলেজে তারা একে অপরের সাথে দেখাও করতো না। সবসময় হয় ফোনে কথা বলতো নয় ভার্সিটিদ বাহিরে দেখা করতো। তানজীম নামক ছেলেটা যেনো ইশানীর জীবনে রংধনুর মতো এসেছিলো। এদিকে নাহিদ এবার সিদ্ধান্ত নিলো সে ইশানীকে মনের কথা বলবে। যদিও সবাই জানে ইশানীকে সে ভালোবাসে, ঘটা করে বলার কিছু নেই। তবুও কখনো ইশানীকে সেভাবে মনে কথা বলা হয় নি তার। সে যখন ইশানীকে মনের কথা বলার প্লেন ছিলো তখন তাদের এক বিশিষ্ট জুনিয়ার তাকে ইশানী এবং তানজীমের ব্যাপারটা জানায়৷ কথাটা শুনতেই রাগে ফুসতে থাকে নাহিদ। তার নাকের নিচে এতো কিছু হচ্ছে অথচ সে জানেও না। তার মাথা যেনো তগবগ করে ফুটছে। মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কি করবে বুঝেই উঠতে পারছে না। তখন মাহিরের মাথা থেকে একটা বুদ্ধি বের হয়। ভয় এমন একটা জিনিস যে ভয় দেখিয়ে সব করা সম্ভব। তারা তানজীমকে ভয় দেখিয়ে কার্য হাসিল করবে বলেই ঠিক করলো।
দিনটি শুক্রবার,
তানজীম সেদিন টিউশনী করিয়ে মাত্র হলে ফিরেছে। তানজীমের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো স্নিগ্ধ। রুমে ঢুকতেই তানজীম বললো,
– দোস্ত, শামীম ভাই তোকে রুমে ডেকে পাঠিয়েছে
– শামীম ভাই?
– হ্যা দোস্ত
– আচ্ছা, খাবার খেয়ে যাবো।
বলেই হাতের প্যাকেটটা সে টেবিলে রাখলো। প্যাকেটটা দেখে তানজীম তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কি রে?
– ইশানীর জন্মদিন তাই ওর গিফট। বেশ দামী একটা পারফিউম কিনেছি। ওর এটা ভালো লেগেছিলো।
– তুমি মামা বাঘের মুখের শিকারে চোখ দিছো। দেইখো আবার, বাঘের তাড়া না খাইতে হয়।
– আরে ধুর! এতো ভয় পাইয়ে লাভ আছে?
– দেখো এই ইস্যুতেই না ডাকছে! তুই চাইলে আমি তোর সাথে যাইতে পারি। আফটার অল আমার চাচাতো ভাইও আছে ওখানে আছে।
– আমি কি ওই নাহিদ দের ভয় পাই নাকি? মাইরে তো আর ফেলবে না। দেখাই যাক কেনো ডাকছে।
বলেই হাসতে শুরু করে তানজীম। ছেলেটার হাসি সত্যি নিস্পাপ। স্নিগ্ধ ও আর কথা বাড়ায় না। যতই হোক সে তো জানে ওখানে কেনো তানজীমকে ডাকা হয়েছে।
রাত ১০টা,
খাবারের পর শামীমের রুমে যায় তানজীম। গাজা, সিগারেটের গন্ধে ঘরটা ভরে গিয়েছে। শামীমের রুমে কখনোই র্যাগ দেওয়া হয় না। তাই তানজীমও প্রথমে ভয় পায় নি। কিন্তু ঘরে গিয়েই যখন দেখলো সেখানে ছয়জন জড়ো হয়ে রয়েছে তখন একটু ভয় বুকে বাসা বাঁধতে লাগলো। সবার চোখ গুলো লাল হয়ে রয়েছে। নেশায় চোখ অবধি খুলতে পারছে না। নাহিদ, আলতাফ, মাহির, শামীম, ইশান, রাজীব। নাহিদ গাঁজার স্টিকে টান দিচ্ছে। তানজীমকে দেখে নাহিদ হাতের ইশারায় তাকে ঢাকলো। সামনে রাখা টুল দেখিয়ে বসার ইশারা করলো তাকে। তানজীম টুলে বসলে মাহির সিগারেট এগিয়ে দিলো৷ তানজীম মাথা নেড়ে বললো,
– ভাই আমি খাই না সিগারেট।
– বাহ বেশ ভদ্র বাচ্চা তো তুই! তা কি খাবি বল? আজ তোকে আমরা আপ্পায়ন করবো।
এর মধ্যেই সেখানে দিহান এবং অনিক উপস্থিত হয়। সমীর সে সময় কিছুদিনের জন্য নিজের বাড়ি যায় তাই সে সেই রাতে উপস্থিত ছিলো না। তানজীম শুকনো ঢোক গিলছে। কারণ তার সামনে এক দল হিংস্র নেকড়ে। নাহিদ এবার উঠে দাঁড়ালো। তানজীমের ঘাড় শক্ত করে আকড়ে ধরে নিজের মুখের কাছে এনে বললো,
– আমার জিনিসকে নিজের করে ভেবে নেওয়াটা কি তোমার উচিত ছিলো? কি ভেবেছো জানবো না?…..
চলবে
দৃষ্টির অগোচরে
২৬তম_পর্ব
তানজীম শুকনো ঢোক গিলছে। কারণ তার সামনে এক দল হিংস্র নেকড়ে। নাহিদ এবার উঠে দাঁড়ালো। তানজীমের ঘাড় শক্ত করে আকড়ে ধরে নিজের মুখের কাছে এনে বললো,
– আমার জিনিসকে নিজের করে ভেবে নেওয়াটা কি তোমার উচিত ছিলো? কি ভেবেছো জানবো না? কলেজের একটা পাতা নড়লেও আমার কানে খবরটা আসে। তোরা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমলীলা করবি আর এতো জরুরী কথাটা আমি জানবো না এটাও সম্ভব?
নাহিদের চোখ লাল হয়ে আছে, চোয়াল শক্ত। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। মুখ থেকে বাজে তীব্র গন্ধ নাকে আসছে তানজীমের। তানজীমের নাহিদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার গলা শুকিয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে একটা হিংস্র পাশবিক অমানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদ গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে আছে। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। তানজীমের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নাহিদের রাগ যেনো আরোও বেড়ে গেলো। সে তানজীমের চুলের পেছন থেকে ঘাড়টা জোরে ধরে তার কাছে নিয়ে আসলো। তীব্র কন্ঠে বললো,
– উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? সারা কলেজকে বলেছিলাম এই মেয়েটার দিকে নজর না দিতে। বলেছিলাম? তুই জানতি না? বল জানতি কি না?
– জ্বী ভাই
– তাহলে এতো বড় সাহস হয় কি করে তোর?
নাহিদ পশুর মতো গর্জন করছে। তানজিম এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও আর যেনো চুপ করে থাকতে পারে নি৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– সাহসের তো এখানে কিছু নেই ভাই, আমি ওকে ভালোবাসি। ইশানী ও আমাকে ভালোবাসে। এটাই যথেষ্ট না। আপনি তো ওর জীবনে এই একটা বছর বিষিয়ে দিয়েছেন। সে নিজের ইচ্ছেমতো শ্বাস ও নিতে পারছিলো না।
তানজীমের কথা শেষ হতে না হতেই মাহির তাকে সজোরে থাপ্পড় মেরে দেয়। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আছে। মাহির আবারো মারতে যেতে নেয় তখন অনিক তাকে থামায়। তারা মানসিক নির্যাতন করলেও এই প্রথম শারীরিকভাবে কাউকে আঘাত করছে। তানজীম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁটটা মুছে আবারো চেয়ারে সোজা হয়ে বসে। রুমে তখন তারা আটজন এবং তানজীম একা। রুমের দরজা বন্ধ। নাহিদ আবারো তানজীমের চোখে চোখ রেখে বলে,
– কি ভয় হচ্ছে?
– না, ভয় হচ্ছে না।
তানজীমের নির্ভীক দৃষ্টি দেখে নাহিদের রাগ আরোও বেড়ে গেলো। সজোরে থাপ্পড় মেরে বললো,
– পাখা জগাইছে? বেয়াদবি করোস তুই? হ্যা? আমার চোখের দিকে তাকা
তানজীম এবার আবারো নাহিদের চোখে তাকালো। ধীর কন্ঠে বললো,
– আমি বেয়াদবি করি নি ভাই! বরং আপনারা আমাকে অন্যায়ভাবে ভয় দেখাচ্ছেন।
নাহিদ এবার তানজীমের মুখোমুখি বসলো। ইশান, রাজীব এবং আলতাফ কিছুক্ষণ তানজীমের সাথে চিল্লায়, হুমকি ধমকি দেয়। শুধু তাই নয় অকথ্য ভাষায় ও গালি দেয়। তানজীমকে ভয়দেখানোর প্রচুর চেষ্টা করে তার। তাকে র্যাগের নামে চেয়ার সরিয়ে হাওয়াই চেয়ার এবং নানা রকম শারীরিক কষ্ট দিতে থাকে। তবুও যখন নাহিদ তানজীমকে জিজ্ঞেস করছিলো,
– নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছিস? কেনো এই শাস্তিগুলো তোরে দেওয়া হয়েছে? তুই চাইলে ক্ষমা চাইতে পারিস। যদি বলিস আর কোনোদিন ইশানীর ধারেও ঘেষবি না তাহলে আমরা তোকে এখন ই ছেড়ে দিবো।
– আমি তো ভুল করি নি ভাই, ক্ষমা কিসের জন্য চাইবো।
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলে তানজীম। আলতাফ এবার এলোপাথাড়ি তানজীমকে লাথি মারতে লাগে। তানজীম তখন ফ্লোরে ছিটকে পড়ে। তখন অনিক তাকে থামিয়ে বলে,
– তোরা কি ওকে মারবি নাকি?
– লাথির ভুত কি কথায় মানবে?
– পাগল নাকি! আমি এসবের মধ্যে নেই কিন্তু।
– তাইলে বাইরে যা, তোর এখানে কি কাজ?
যখন নাহিদ, মাহির, আলতাফকে কথায় বোঝাতে অপারগ হয়েছিলো অনিক, তখন রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। নেশায় বুদ সাতটা জানোয়ার ঝাপিয়ে পড়ে তানজীমের উপর। তখন নেশার তালে তারা কি করছে না করছে তাও জানে না। চর, লাথি, ঘুষি যার গায়ে যত জোর আছে সব প্রয়োগ করা শুরু করলো তার। তানজীমের রক্তমাংসের দেহটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো। মিনিট পনেরো পর, তারা ক্লান্ত হয়েছে বসে পড়লো। তখন আলতাফ মাহিরকে বললো,
– কি রে এবার ভয় করছে? নাকি এখনো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলবি?
– ভাই একটু পানি হবে?
ক্ষতবিক্ষত শরীরটা ব্যাথায় যেনো নড়তে পারছিলো না। আকুতির স্বরে কথাটা বলে তানজীম। শামীম তাকে পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়। তানজীম পানিটা ঢগঢগ করে খায়। ততক্ষণে আবার ও গাঁজা ধরায় দিহান। আরেকদফা গাঁজার নেশা করে আবারো হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পরে তানজীমের উপর। তারা কেনো মারছিলো ছেলেটাকে, নেশার চোটে মনেও নেই সেটা! কে কতোটা আঘাত করেছিলো তানজীমকে সেটাও মনে নেই তাদের। এলোপাতাড়ি পিটিয়ে যাচ্ছে তারা ছেলেটাকে। একটা সময় রক্ত বমি করে তানজীম তখন শামীম চিৎকার করে উঠে,
– আর মারিস না, একেবারেই মরে যাবে৷ এবার থাম। ভাই এবার থামুন।
বলে মাহিরকে থামায় শামীম। তানজীম তখন নিথর শরীরটা নিয়ে মাটিতে রক্তের পাশেই পড়েছিলো। তার নীল শার্টটা কালো গিয়ে রক্ত। নাক মুখ থেকে রক্ত পরছিলো। এদিকে ঘড়ির কাঁটা একটার কাছে এসে ঠেকেছে। এতোক্ষণ তানজীম না আসায় স্নিগ্ধ খানিকটা চিন্তায় পড়ে যায়। তাই সে ঠিক করে তানজীমকে খুজতে শামীমের ঘরে যাবে। শামীমের ঘর তখন ভেতর থেকে আটকানো। স্নিগ্ধ এসে নক করতে থাকে, ধীর গলায় বলে,
– ভাই আমি স্নিগ্ধ, একটু খুলেন না দরজাটা।
মিনিট বিশেক পর ইশান দরজাটা খুলে। স্নিগ্ধ তানজীমকে খুজতে থাকে। সে উকি ঝুকি দিতে লাগলে ইশান ধমকের স্বরে বলে,
– কি খুজতেছিস?
– ভাই তানজীম? ও এখনো রুমে আসে নি। অনিক ভাই বললো আপনাদের রুমেই আছে।
– হু, ভালো করছিস তুই আসছিস। ওর শরীরটা ভালো না। চল হাত লাগা, রুমে নিয়ে যাবো ওকে
বলেই যখন ইশান সরে দাঁড়ালো তখন মাটিতে তানজীমের নিথর শরীরটা দেখতে পায় স্নিগ্ধ। শিউরে উঠে স্নিগ্ধ দৃশ্যটা দেখে৷ দৌড়ে গিয়ে তানজীমের কাছে যায় সে। গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে স্নিগ্ধ। কিন্তু তানজীমের কাছ থেকে কোনো সারা পায় না সে। তারপর নাকে হাত দিতেই স্তদ্ধ হয়ে যায় সে। দিহানের দিকে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে বলে,
– ভাই ওর শ্বাস চলছে না। আপনারা ওকে মেরে ফেলেছেন?
স্নিগ্ধের কথায় টনক নড়ে তাদের। এতোক্ষণ পর নেশার ঘোড় টা কাটে তাদের। হুড়মুড় করে তানজীমের নিথর শরীরটার কাছে এসে বসে। পানি দিয়ে তার জ্ঞান আনার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তানজীম তখন না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। নাহিদ, মাহির, আলতাফ, রাজীব, ইশান, শামীম এবং দিহানের মাথায় হাত পড়ে যায়। তাদের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন। এই ঘটনাটা একবার বের হলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে সবার। রাস্টিকেট তো খুব কম শাস্তি, জেল বা ফাঁসিও হতে পারে। নাহিদ তোতলাতে তোতলাতে বলে,
– আমরা ইচ্ছে করে ওকে মারি নি। আমরা তো সামান্য চড় থাপ্পড় মারছিলাম, যাতে ও ভয় পায়। সত্যি বলছি।
ভয়ে যেনো তাদের মাথাই কাজ করছে না। তখন মাহির একটা ফন্দি আঁটে। এবং স্নিগ্ধকে ভয় দেখায়, যদি সে এই কথাটা কাউকে বলে তবে ওর অবস্থাও তানজীমের মতোই করবে তারা। মাহিরের প্লান অনুযায়ী রাত ৩.৩০টার দিকে যখন হোস্টেল সবথেকে শান্ত থাকে তখন তারা তানজীমের নিথর শরীরটা নিয়ে হোস্টেলের ছাঁদ যায়। মাহিরদের হোস্টেলের ঠিক পেছনে একটা পুকুর রয়েছে। বিল্ডিং এর পেছন সাইট এবং পুকুরের দূরত্ব নেই এর কাছাকাছি। লাশটা নিয়ে ছাঁদে পৌছানোর পর তারা ছাদের রেলিং থেকে তানজীমকে ধাক্কা দেয়। ফলে তানজীমের লাশটা ঠিক পুকুরে পড়ে। স্নিগ্ধ চাইলেও এই ঘটনাটা কাউকে বলতে পারে না। পরদিন পুকুরের পানিতে তানজীমের লাশ ভেশে উঠে। নিজেদের পারিবারিক ক্ষমতার চোটে ছেলেটার খুন আত্নহত্যার রুপ দেওয়া হয়। দিহানের বাবা পোস্ট মর্টাম রিপোর্ট অবধি বদলিয়ে দেয়। স্নিগ্ধ ও নিজের মুখে তালা দিয়ে রাখে। এতো হাসি খুশি ছেলেটা এভাবে আত্নহত্যা করবে এটা কেউ মানতে পারছিলো না। আন্দাজ সবাই ই করছিলো কিন্তু ক্ষমতার সামনে সবাই অপরাগ। তানজীমের বাবা-মা একবার কেস ও করতে গিয়েছিলো এই ছেলেদের বিরুদ্ধে কিন্তু মাহিরের বাবা তার ক্ষমতা দেখিয়ে সব ধামাচাপা দিয়ে দেন৷ ধীরে ধীরে এই গ্রুপটির মাঝে দ্বন্দ বাঁধতে থাকে। এদের বন্ধুত্ব পুরোই নষ্ট হয়ে যায়। মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়। এরা পাশ করে বের হয় কিন্তু এদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না।
শামীমের বলা শেষ হলে তৌহিদ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– তানজীমকে তোমরা মেরে ফেলেছো তাই স্নিগ্ধ তোমাদের মারছে? কিন্তু এতে স্নিগ্ধের কি লাভ?
– স্নিগ্ধ শুধু পেয়াদা, পেছনে সেনাপতি আরেকজন। কেউ ওকে দিয়ে কাজগুলো করাচ্ছে। আমি বাঁচার জন্য ওকে এতোদিন সাহায্য করে এসেছি। ও ইশানকে খুন করেছে, মাহির ভাইকেও ওই মেরেছে। ওর যখন যা প্রয়োজন সব আমি করেছি। আমি ওর সারর স্নেহার ক্রেডিট কার্ড দিয়েও ওই পারফিউম গুলো ওর্ডার করতো৷ আমি ওর সার্টিফিকেট চেঞ্জ করিয়ে দিয়েছি। নতুন কলেজে এডমিশন করিয়ে দিয়েছি। ও আমাকে যা যা করতে বলেছে আমি তাই করেছি। কিন্তু আমি জানি ও আমাকে বাঁচতে দিবে না।
– কিন্তু ও তো তোমাকে এখনো মারে নি, তাহলে এতো ভয় পাচ্ছো কেনো?
তৌহিদের প্রশ্নে শামীম চুপ করে থাকে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
– কারণ স্নিগ্ধ নিজেও এই খুনের সাথে জড়িত।
– মানে?
– কারণ স্নিগ্ধ নাহিদকে তানজীম এবং ইশানীর ব্যাপারে জানিয়েছিলো। এই কথাটা আমরা আটজন বাদে কেউ জানে না। তাই আমি যতই ওকে সাহায্য করি না কেনো ও আমাকে মেরে ফেলবে।
– তোমার সেফটির দায়িত্ব আমার।
বলেই উঠে দাঁড়ায় তৌহিদ। নুশরাত ও সেখানে উপস্থিত ছিলো। একটা খুনির হয়ে সে কেস লড়েছে ভাবতেই তার গা ঘিনঘিন করছে। নুশরাতকে চুপ করে থাকতে দেখে তৌহিদ বলে,
– বিশ্বাস করাটা দোষের নয়, কিন্তু সামনের মানুষটা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখছে কি না সেটাই সমস্যা।
নুশরাত কোনো উত্তর দেয় না। শুধু চুপ করে হাটতে থাকে।
বর্তমান,
স্নিগ্ধের সামনে তৌহিদ বসে রয়েছে। স্নিগ্ধ হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– আপনার ক্যালকুলেশনটাই গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে স্যার। আপনি ভেবেছেন শামীম ভাই আমাকে বলবে আর আমি তার কথা মেনে সমীর ভাইকে মারতে যাবো। যেখানে সমীর ভাই হোস্টেলেই ছিলো না সেখানে আমি কেনো সমীর ভাইকে মারবো? আপনাকে ডেকে ওই শুয়োর সব বলবে সেটা আমি আগেই জানতাম। আমার শুধু সাত নম্বর মানুষটার খোঁজ লাগতো। সেটা অনিক না দিহান এটুকুই জানা বাকি ছিলো৷ আপনি যখন তাদের সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিলেন তখন ই আমি খোঁজ পেয়ে গেছি নাহিদ বাদে আর কে সেই খুনে জড়িত৷ হাহাহা, কাঁচা গেমটা খেললেন
– তুমি তো নিজেও তাদের মতোই দোষী।
তৌহিদের এমন কথায় বেশ চমকে উঠে স্নিগ্ধ। চোখ গরম করে বলে,
– আমি কিছু করি নি, আমার তো সত্য বলার সাহসটা ছিলো না। আমি ওদের মতো নই। ওরা আমাকে ভয় দেখিয়েছিলো। যে ভয়টা আমি ওদের দেখাচ্ছি।
– ওরা তো তোমাকে ভয় দেখায় নি স্নিগ্ধ। তুমি ইচ্ছে করে চুপ থেকেছিলে৷
– মিথ্যে কথা! ওই শুয়োর এটা বলেছে তাই না? ও মিথ্যে বলছে আমি কিছু করিনি আমি কিছু করি নি।
স্নিগ্ধ চিৎকার করছে, পাগলের মতো বিলাপ করছে। স্নিগ্ধের মানসিক অবস্থার বিপর্যয় হতে শুরু করলেই তৌহিদ ইন্টারোগেশন বন্ধ করে দেয়। কারণ একমাত্র স্নিগ্ধ ই জানতো খুনি কে!
ইন্টারোগেশন রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে যেতেই দেখে নুশরাত সেখানে বসে রয়েছে। নুশরাতকে দেখে তৌহিদ মুচকি হাসি দেয়। তারপর বলে,
– রাতে ঘুম হয়েছিলো?
– উহু, অনেককিছু মাথায় ঘুরছে। কে এই খুনি? যে এক এক করে এদের মারছে। যদিও এরা মৃত্যুর যোগ্য কিন্তু এভাবে আইন নিজের হাতে নেওয়ার কোনো মানেই হয় না।
– দাঁড়াও কিছু দেখাচ্ছি।
বলে একটা ফাইল খুলে তৌহিদ। সেখান থেকে একটি ছবি বের করে নুশরাত কে দেখায় সে,
– এই মেয়েটার নাম ইশানী। সেদিন স্নিগ্ধের কলেজের পুকুরপাড়েও এই মেয়েটার সাথেই আমার দেখা হয়েছিলো। আমার ওয়াইল্ড গেজ এই মেয়েটাই সবকিছুর সাথে জড়িত। পারফিউমের রহস্যটাও এই মেয়েটা কেন্দ্রিক ই
– আচ্ছা তানজীমের কোনো ছবি আছে?
– হ্যা, এই যে।
নুশরাত কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার কেনো যেনো ছবিটা চেনা চেনা লাগছে। কারো কারো চেহারাই এমন থাকে, যে দেখলেই মনে হয় সে অনেক আগ থেকেই পরিচিত। তানজীমের চেহারাটাও ঠিক তেমন। তৌহিদ তখন বললো,
– স্নিগ্ধ আমাদের কাছে তাশের এক্কা। খুনি যদি জানতে পারে ও আমাদের কাছে বন্দি, কোনো না কোনো একটা হুড়োহুড়ি করবেই।
তৌহিদের কথা শেষ না হতেই…….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি