তোর_মনের_অরণ্যে,৩২,৩৩
সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩২.
সোহা ব্যাঙ্গালোর ছেড়েছে আর প্রায় দশ দিনের বেশি হতে চলেছে। এর মধ্যে একবারও আমনের সাথে সোহার কোনো যোগাযোগ হয়নি। এমনিতেও এইরকম ইমার্জেন্সি মিশনে সোহার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। হটাৎ করে ওদের পাঁচ জন কে জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি থেকে চলে যেতেই প্রথমে আভা চৌধুরী ও সম্রাট চৌধুরী একটু চিন্তায় ছিলেন তবে আমন বোঝাতে চিন্তা মুক্ত হন। তারা এইরকম পরিস্থিতির সাথে এই প্রথম পড়েছে। তাই চিন্তিত হয়ে গেছিলো। অ্যাস বাড়িতে দুই তিনেক থাকে তাই তার কাজের কথা জানলেও এই মুহূর্তের সাথে পরিচিত নয়।
তবে এই দশ দিনে আমন সব সময়ে তার কাজে ব্যস্ত ছিল। সোহার এখানকার মিশনে উঠে পড়ে লেগেছিল। যাতে সে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে পারে। আর তাছাড়াও এখানে এমন অনেক কিছুই আছে যা সোহা জানে না। আর আমনও এই মুহূর্তে সব কিছুই জানাতে চাইছে না তাই সে সোহার এই অনুপস্থিতির সময়ে তার সব কাজ গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে । তবে এই সময়ে আমন এমন অনেক পরিস্থিতি ও সত্যের মুখোমুখি হয়েছে যে সে কখনও ভাবতেই পারিনি। এখন সব কিছুই তার কন্ট্রোলে আছে শুধুমাত্র সোহার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে আমন তারপরেই শুরু হবে আসল খেলা।
আমন অফিসে এসে নিজের কেবিনে ঢুকতেই দেখতে পায় সামনেই চেয়ারে মণিকা বসে আছে। এটা দেখেই আমনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে কোনো রকম কথা ছাড়াই ভিতরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে মণিকার এর তীক্ষ্ণ মোহিত দৃষ্টিতে তাকায়। এদিকে মণিকা আমনকে আসতে দেখেই খুশি হয়ে যায়। এতদিন পরই যে তার কার্য্য সিদ্ধি হতে চলেছে এতেই সে খুশি।
-“হাই আমন ।
-” হেই মণিকা তুমি যে এখানে এসেছ আমি খুশি হয়েছি। আমন বলে ওঠে ।
-“তুমি ডেকেছ আর আমি না এসে থাকতে পারি আমন। আমি ভাবতেও পারছি না তুমি নিজে থেকে আমাকে এখানে ডেকেছ। সত্যি এটা আমার কাছে অনেক খুশির। মণিকা আনন্দে বলে ওঠে।
-” হ্যাঁ আসলেই তোমার সাথেতো আমার সেই ভাবে কখনো কথা হয়নি তাই ভাবলাম তোমার সাথে কিছু টাইম স্পেন্ট করা যাক। আমন মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।
-” আমিতো সবসময়েই তোমার সাথে সময় কাটাতে চাই আমন। মণিকা একটু লজ্জা পাওয়ার মত করে বলে ওঠে।
-“হ্যাঁ আমিও এখন একটু ফ্রি আছি তাই অবশ্যই তোমার সাথে সময় কাটানো যায়। এর আগেও তোমার সাথে বিজনেস ডিল ছাড়া কোনো কথা হয়নি। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভালো বন্ডিং আর সেখানে আমরা কেনো বা পিছিয়ে থাকবো। তাই ভাবলাম তোমার সাথেও আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়া উচিত। আমন মণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।
-“সম্পর্ক! হ্যাঁ আমন আমাদের মধ্যেতো সম্পর্ক আছে। আমাদের বাড়ি থেকেতো আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। মণিকা লজ্জা ভাব নিয়েই বলে ওঠে।
-” হ্যাঁ আসলেই আমাদের বাড়ি থেকে সব কিছুই ঠিক করে রেখেছে সেখানে আর বাঁধা দিয়ে কি লাভ বলো আমি ভেবে দেখলাম বড়রা যা ঠিক করে আমাদের ভালোর জন্য। তাছাড়া তুমিও আমাকে পছন্দ করো। কি তাইতো পছন্দ করোতো মণিকা? আমন তির্যক চাহনি দিয়েই জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-” আমন আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি আর শুধু পছন্দ করিনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি অনেক। এটা তোমাকে আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছি। মণিকা বলে ওঠে ।
-” তাই তুমি আমাকে ভালোবাসো?
-“হ্যাঁ আমন আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে পারি সব কিছুই। মণিকা বলে ওঠে ।
-“বাহ মণিকা তুমি আমাকে এত ভালোবাসো আর আমি কিনা সেটাই বুঝতে পারিনি। আমন বলে ওঠে ।
-” কোনো ব্যাপার না আমন এখনতো বুঝতে পেরেছ আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তাছাড়া তুমিও আমার সাথে সেই জন্য তো দেখা করেছ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতেও চাইছ। মণিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে আমন এর পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে।
আমন শুধু একবার তার আর মনিকার অবস্থানটা দেখে নেয়। মণিকা একদম তার পাশে এসে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমন চোখ বন্ধ করে আবারো চোখ খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মণিকার দিকে। আমনের এই দৃষ্টিতে যে কেউ ঘায়েল হয়ে যেতে পারে। আর সেখানেতো মণিকা আগের থেকেই লাট্টু হয়েছিলো আমনের প্রেমে তাই আমনের এই দৃষ্টি মণিকাকে আরো বেশি করে আকর্ষণ করে আমনের দিকে।
-“হ্যাঁ মণিকা আমিও এখন সেটাই চাই আমাদের সম্পর্কেও একটা নাম হোক। আমন বলে ওঠে ।
-” ওহ আমন আমি আজকে খুব খুশি শেষ মেস তুমিও আমার সাথে সম্পর্ক গড়তে চাও এই দিনের জন্য আমি কতদিন থেকে ওয়েট করে আছি। আজকে আমি খুব খুশি আমন খুব।
মণিকা উত্তেজনার বশে আমনকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই আমন হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় মণিকাকে। মণিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমনের দিকে। আমন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মণিকা বুঝতে পারে সে বেশি তাড়াহুড়ো করছে। এমনিতেও সে জানে আমন এমন পছন্দ করেনা তাই নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। আমন কোনো কথা বলেনা।
-“তুমি একটু বসো আমার কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে নিয়েই আমরা বেরোব আজকে একসাথে লাঞ্চ করবো। আমন হেসে বলে ওঠে।
-” হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তোমার কাজ সেরে নাও না আমি তোমার জন্য সব সময়ে অপেক্ষা করতে রাজি আছি। মণিকা বলে ওঠে ।
-“ওকে ।
আমন মণিকার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফাইলে মুখ গুঁজে দেয়। কিছুক্ষণ পর সামনে থেকে ল্যাপটপ টেনে নিয়ে আমন ল্যাপটপ অন করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা যুগল বন্দি হাস্যউজ্জ্বল ছবি। আমন আর সোহার একসাথে একটা ছবি। যেটাতে আমনের পিঠের উপরে চেপে সোহা রয়েছে তার হাত দুটো আমনের গলা জড়িয়ে রেখেছে। আর আমন সামনে থেকেই ছবি তুলেছে। এটা কয়েকদিন আগের ছবি যেদিন তারা একসাথে সারা দিন ঘুরেছে আমন এক দৃষ্টিতে ল্যাপটপ এর স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে তার কাজ শুরু করে।
-“আচ্ছা মণিকা তোমার মায়ের নামটা যেনো কি? আমন কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-” মম এর নাম তো সোনিয়া মল্লিক । কেনো আমন তুমি জানতে না বুঝি? মণিকা বলে ওঠে।
-“উম! আচ্ছা মণিকা তোমার মামার বাড়ি কেউ নেই? না মানে আমিতো কখনো তোমার মামাদের ব্যাপারে শুনিনি তাই জিজ্ঞেস করছি আর তাছাড়াও আমি তোমার ব্যাপারে কিছুই জানিনা। তাই এখন থেকে জেনে নিচ্ছি। আমন একবার মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।
-” না না আমন আমার মামার বাড়ির তো কেউ নেই আমি শুনেছি মম একাই আর আমার মম এর বাবা মা ও নেই কোনো এক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তবে শুধু এক আংকেল আছেন উনি মমের অনেক ক্লোজ । মণিকা বলে ওঠে ।
-” আংকেল? আমন ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে।
-“হ্যাঁ ইমরান আংকেল। আংকেল বাপির ও ফ্রেন্ড। আমাদের বাড়িতেও প্রায় আসেন। মণিকা হেসে বলে ওঠে।
-“ইমরান আংকেল আর তোমার মম অনেক ক্লোজ তাইনা?আমন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে ওঠে।
-” হ্যাঁ । আমন কোনো সমস্যা? মণিকা আমনের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-“না আসলেই একটা পাজেল সল্ভ করছিলাম। আমন বাঁকা হেসে বলে ওঠে।
-” কিসের পাজেল আমন? মণিকা জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-” এত তাড়া কিসের সময়ে হলে জানতে পারবে। চলো আমরা বের হই। আমন রহস্যময় হেসে বলে ওঠে।
আমনের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে মণিকা আর বেশি কিছু ভাবেনা আমনের কথা নিয়ে সেও আমনের সাথে বেরিয়ে যায়। আমন ও মণিকা একসাথে লাঞ্চ করে মণিকা কে বাড়িতে ড্রপ করে আমন বেরিয়ে যায় তার কাজে।
————-
আমন বাড়িতে ফিরতে দেখে তার মম আর ড্যাড কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী আমনকে দেখতেই তার দিকে দুজনেই তাকিয়ে থাকে। আমন তার মম ড্যাডের তাকানো দেখে বুঝতে পারে তাঁরা কেনো এই ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে । এতক্ষণে যে সবার কাছে আজকের ব্রেকিং নিউজ ছড়িয়ে গেছে সেটা আর তার বুঝতে বাকি নেই এটা ভেবেই মনে মনে বাঁকা হেসে ওঠে। তবে বাইরে থেকে একদম স্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে আছে।
-“আমন বেটা আমরা এটা কি শুনছি? এটা কি ঠিক? সম্রাট চৌধুরী জিজ্ঞেস করে ওঠে।
-” কি শুনেছ ড্যাড? আমন একদম স্বাভাবিক বলে ওঠে যেনো কিছুই জানে না এমন ভাব।
-“সাজিদ ফোন করেছিলো। আজকে নাকি তুমি আর মণিকা একসাথে টাইম কাটিয়েছ নিজেদের মতো করে আর… ।বলেই থেমে যায় সম্রাট চৌধুরী।
-“তুই নাকি মণিকার সাথে রিলেশনে যেতে চাইছিস? আভা চৌধুরী জিজ্ঞেস করে ওঠেন।
-“হ্যাঁ তোমরা ঠিক শুনেছ। আর তোমরাওতো তাই চাইতে যে মণিকা আর আমার সম্পর্ক হোক। সেই জন্যতো আমাকে না জানিয়ে বিয়ের কথা বলে ছিলে। তাহলে এখন এত অবাক হচ্ছো কেনো? আমন তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে।
আমনের কথা শুনে আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী চুপ করে যান। তারা আমনের কথা বলার টোন বুঝতে পারে। আমন যে এখনও তাদের ওই একটা কাজের জন্য তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছে সেটা আর তাদের বুঝতে বাকি নেই। তবে তারা আজকে এই খবর শুনে চমকে গেছে। যেই ছেলে মণিকার সাথে তার বিয়ের কথা শুনে একমাস তাদের সাথেই কথা বলেনি ঠিক করে কত রাগ ছিলো এই নিয়ে আর সেই ছেলে কিনা নিজের থেকে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এমনটা যে কি করে সম্ভব হলো সেটাই বুঝতে পারেনা তারা। আমন বসে বসে তার বাবা মায়ের অবাক দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে। এর মধ্যেই আমন এর ফোন তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে ওঠে। আমন ফোন বের করতে দেখে অ্যাস কল করছে। এটা দেখেই তার ভ্রু কুঁচকে যায় তবে খুশি ও হয়। আমন ফোন রিসিভ করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ওপার থেকে উত্তেজিত কন্ঠ ভেসে আসে।
-“ভাই ভাই সোহা কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যাস এর কথা শুনেই আমন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় । সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় কপালে ভাঁজ পড়ে যায়।
-” খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা মানে? কিসব বলে যাচ্ছিস তুই তোর মাথা ঠিক আছেতো? আমন কিছুটা কঠিন ভাবে বলে ওঠে।
-“ভাই আমি ঠিক বলছি সোহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আজ তিন দিন হচ্ছে ওর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আমরাও কোথাও ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। অ্যাস কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে।
-“তিন দিন থেকে ওর খোঁজ নেই আর আজকে তুই আমাকে জানাচ্ছিস। আমন এবার রাগে হুঙ্কার ছেড়ে বলে ওঠে।
-“ভাই সোহা কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। আর ও প্রায় এমন গায়েব হয়ে যায় তবে সেটা কিছুক্ষণ বা একদিনের জন্য। ওকে কেউ আটকে রাখতে পারেনা তাই আমরা অত চিন্তা করেনি কিন্তু দুইদিন হয়ে যাওয়ার পরও ওর কোনও খোঁজ পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই ওর কোনও বিপদ হয়েছে। আমরা ভিতর থেকেও কোনো খোঁজ পাচ্ছিনা ওর। অ্যাস কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে।
অ্যাস এর কথা শুনে আমনের বুকের ভিতর ধক করে ওঠে যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় এক অজানা শঙ্কা তাকে গ্রাস করতে থাকে। অদ্ভূত এক বাজে অনুভূতি হতে শুরু করে । তার মাথায় যেনো কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তার কানে একটাই কথা বেজে যাচ্ছে সোহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমন ধাপ করে বসে পড়ে। অ্যাস এর কথাও তার কাছে আর পৌঁছায় না। সোহা নিখোঁজ সোহাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সোহার বিপদ। এটাই শুধু আমনের মাথায় ঘুরছে। এদিকে আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী আমনের হটাৎ এমন প্রতিক্রিয়া দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। আমন মাথায় হাত চেপে বসে আছে। তার পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ একদম চুপচাপ পুতুলের মতো করে বসে থাকে। তারপরেই হঠাৎ করেই সোহার কথা মাথায় আসতে উঠে দাঁড়িয়ে উপরে তার রুমের দিকে দৌড় দেয়।
চলবে….. ❣️
#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩৩.
আমন রুমে বসে আছে তার চোখে মুখে এক উৎকন্ঠা এক অজানা আশংকা যন্ত্রণা ফুটে আছে। এই কয়েক মিনিটের মধ্যে তার পৃথিবী থমকে গেছে। যখন অ্যাস এর থেকে শুনলো যে সোহাকে পাওয়া যাচ্ছে না তখনই তার মনে হয়েছিলো তার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকার পর সোহার খুঁজে না পাওয়ার কথা তার বিপদের চিন্তা মাথায় গ্রাস করতেই সে রুমে দৌড় দেয়। সব যদি ঠিক ঠাক তাহলে সে জানলেও জানতে পারে সোহা ঠিক কোথায় আছে।
আমনকে এখন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে পুরো। রুমে এসেই ল্যাপটপ নিয়েই বসে পড়ে। ট্র্যাক লোকেশন এর একটা ফোল্ডারে ঢুকেই সেটা কে অ্যাক্টিভ করে দেয়। প্রসেসিং শুরু হতেই আমনের বুকের মধ্যে এক ভয় গ্রাস করে নেয়। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে প্রসেসিং এর। প্রায় পাঁচ মিনিট পর প্রপার প্রসেসিং অ্যাক্টিভ হতে আমন ট্র্যাক লোকেশন এর সাথে সাথে ক্যামেরা অ্যাক্টিভ করে। লোকেশন ট্রাক হয়ে গেছে সিগন্যাল পাওয়া গেছে। নর্থ সাইটে লোকেট হয়ে আছে। পুরো লোকেশন প্রসেস হতে ম্যাপ ক্লিয়ার হয়ে যায়। লাদাখ । খারদুং-লা পাস লাদাখ এর লেহ জেলায় অবস্থিত। এখানেই লোকেশন দেখাচ্ছে । ইতি মধ্যে ক্যামেরা অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার তেমন ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না আবছা হয়েছে রুমের মধ্যে বাইরে থেকে হালকা আলোর ছিটে রুমে আসছে। আমন পরিষ্কার বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ও ভালো করে কিছু দেখতে পেলো না। ক্যামেরা অন রেখেই লোকেট হওয়া জায়গা দ্রুত গতিতে সার্চ করলো। সাথে সাথে আরো বেশি আতঙ্ক গ্রাস করে নেয় আমনকে। যে জায়গায় লোকেশন দেখাচ্ছে সেখানে চারদিকে বরফে আবৃত্ত জায়গা ।
আমনের মনে শুধু এখন একটাই প্রশ্ন সোহা ঠিক আছেতো এমন একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় এমনি কারোর ভয় না থাকলেও আবহাওয়ার জন্য সোহার অবনতি ঘটতে পারে। না আমনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এখনই। কিন্তু আমনের একটা কথা কিছুতেই আসে না যে সোহা এই জায়গায় গেলো কিভাবে? এই জায়গার একদিকে কাশ্মীর আর অন্য দিকে চীন এর বর্ডার এমন একটা সাংঘাতিক জায়গায় কে নিয়ে গেলো সোহাকে আর কেনো বা নিয়ে যাওয়া হলো। আমন তার প্রশ্ন এখন সাইটে রেখে ঝটপট তার পদক্ষেপ নিতে থাকে। আমন হাই কমিশনের অফিসে কন্ট্রাক্ট করে ওখানে সোহার ব্যাপারে নিয়ে কথা হয়। হাই কমিশন অফিসে ও সব চিন্তায় ছিল সোহাকে নিয়ে এই মুহূর্তে এমন খবর তারা দ্রুত লাদাখ এর অফিসারদের সাথে কথা বলে নেয়।
আমন তার টিম সাজিয়ে নেয় পুরোপুরি ভাবে। তাকে এক মুহূর্ত দেরি করলে চলবে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে লাদাখ পৌঁছাতে আজ তিনদিন হয়ে যাচ্ছে সোহা কি অবস্থায় আছে কেউ জানে না। আমনের কাছে এক একটা সেকেন্ড ও যেনো বছরের ন্যায় লেগে যাচ্ছে। আমন উপর মহলের কথা বলে দ্রুত তার তিন রেডি করে নেয় তবে পুরো ব্যাপারটাই আমন সিক্রেট রাখতে বলে।
-“কোথায় আছিস তোরা? আমন প্রশ্ন করে ওঠে।
-” দিল্লীতে আছি। অ্যাস উত্তর দেয়।
-“ঠিক আছে তোরা দ্রুত নিজেদের তৈরী করে নে আমি দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। আমন বলে ওঠে ।
-” কোথায় যাবো ভাই? অ্যাস প্রশ্ন করে ওঠে।
-“সোহাকে ফিরিয়ে আনতে। আমন নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়।
আমন ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ট্যাব এর সাথে কানেকশন করিয়ে রেখেছে সে প্রতি মুহূর্তে অ্যাক্টিভ থাকলো ক্যামেরার দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে যদি কিছু পাওয়া যায়। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে থেকে দিল্লিতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। তার কাছে এখন এক একটা মিনিট ও খুবই দামী এক মিনিট এর এপার ওপারে যা কিছুই ঘটে যেতে পারে।
————–
প্রায় আড়াই ঘণ্টার সফরে দিল্লী পৌঁছায় আমন। সোজা হাই কমিশনের অফিসে ওখান থেকে তার সমস্ত কাজ কম্পিলিট অর্ডার নিয়ে নেয়। বাইরে আসতে দেখা হয় অ্যাস নীহার আকাশ সানিদের সাথে তারা নিজেদের মধ্যে অপরাধ বোধে ভুগছে। আমন এক পলক তাকিয়ে নেয় তাদের দিকে তবে তেমন গুরুত্ব দেয়না তার এখন একটাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর সেটা হলো সোহাকে উদ্ধার করা।
-“চলো হাতে একদম টাইম নেই। ওদের সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে আমন।
-” ভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি? সোহা কোথায় আছে তুমি জানো? অ্যাস ভাঙা গলায় বলে ওঠে।
আমন এক পলক নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে নেয় কান্না করে গলা ভেঙে গেছে চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। আমন ওদের দিকে দেখে নেয় ।
-” লাদাখ । বলেই আমন এগিয়ে যায়।
অ্যাস নীহার আকাশ সানি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমনের পিছন পিছন এগিয়ে চলে। আমন সামনে কয়েকজন অফিসারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। অ্যাস নীহার আকাশ সানি ওরাও এগিয়ে যাচ্ছে আমনের পিছন পিছন। আমনের প্রত্যেকটা কথায় তাদের কানে আসছে। আমনের প্ল্যান আর অর্ডার শুনেই তারা বোঝে আমন এমনি এমনি সিনিয়র অফিসারের পদে নেই আর হটাৎ করেই এমন একটা ব্যবস্থা ও নিতে পারেনা সে যতো সিনিয়র অফিসার হোক না কেনো সরাসরি হাই কমিশনের সাথে কথা বলার ক্ষমতা সবার থাকে না। সেখানে আমন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কথা বলে সব কিছুর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাহলে তাদের কি এখনও আমনের বিষয়ে আরো কিছু জানার বাকি আছে।
আমন সাথে তার টিম অ্যাস নীহার আকাশ সানি আর কিছু অফিসার ও আছে তারা সবাই একসাথে প্রাইভেট হেলিকপ্টার করে দিল্লী থেকে রওনা দেয় লাদাখ এর উদ্দেশ্য। এখন প্লেন এর ঝামেলা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে অনেক সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাবে যেটা এখন তাদের কাছে নেই। তারা সরাসরি হেলিকপ্টার করে স্পটে পৌঁছে যেতে পারবে। ইতি মধ্যে হয়তো সেখানে লাদাখের অফিসাররাও রওনা করেছে। তাই টাইম নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে। আমন তার লোকেশন অনুযায়ী বলে দিয়েছে ঠিক কোথায় আছে সেই অনুযায়ী তাদের বাহন এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যে প্রতিটা মিনিট আমন ছটফট করে গেছে। হেলিকপ্টারে ওঠার পর থেকে এক মিনিটের জন্য ও তার নজর ট্যাব থেকে সরেনি সে একভাবে ক্যামেরা দিকে তাকিয়ে ছিল যদি একবার সোহাকে দেখা যায়।
অ্যাস সানি আকাশ নীহার সারাটা রাস্তা আমনের এই অস্থিরতা দেখে গেছে। আমন বাইরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক দেখলেও তার ভিতরে যে তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা অ্যাসের বুঝতে বাকি নেই। তার ভাই যে সোহাকে মারাত্মক ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা বুঝতে পারে। সোহার জন্য তাদের ও আজ তিনদিন খাওয়া ঘুম মাথায় উঠে গেছে সারাদিন এদিকে ওদিকে খুঁজে গেছে কিন্তু কোথাও পাইনি তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমনের সোহাকে খুঁজে পেয়ে যাওয়াটা তাদের কে ভাবিয়েছে তবে এখন তারা এই বিষয় নিয়ে নয় সোহাকে চিন্তিত হয়ে আছে। সবাই এখন একটাই প্রে করে যাচ্ছে যেনো সোহা ঠিক থাকে তার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।
————
প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায় তাদের গন্তব্যে লাদাখ লেহ জেলার খারদুং-লা তে। আমন এবার তার প্রপার লোকেশন দিতেই তারা পৌঁছয়। উপর থেকেই নিচেই দেখা যাচ্ছে চারিদিকে সাদা বরফে আবৃত্ত হয়ে আছে চারিদিকে জঙ্গল আর মাঝে একটা ছোটো কটেজ মত দেখা যাচ্ছে। আমন বাকি অফিসারদের সাথে কথা বলে কিছুটা দূরেই হেলিকপ্টার ল্যান্ড করায়। কটেজের আসে পাশে কত জন লোক আছে তারা জানে না বেশি থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে তাই রিস্ক না নিয়েই তারা কিছুটা দূরেই ল্যান্ড করে।
আমন হেলিকপ্টার থেকে নেমেই ওখানকার অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করে ওরাও তাদের আসে পাশে ছিল ওদের সাথে কথা হওয়ার পর এগিয়ে যায় কটেজের দিকে। যতো এগিয়ে যেতে থাকে। ততই আমনের বুকের মধ্যে এক অদ্ভূত যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। কেমন একটা ভয় গ্রাস করছে। সে জানে না ওখানে গিয়ে সোহাকে কি অবস্থায় পাবে। কটেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে সামনেই অফিসাররাও আছে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আমন চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই ভিতরের দিকে ঢুকে যায়। সাথে অ্যাস নীহার আকাশ সানি ।ওদের এমন ভাবে ভিতরে ঢুকতে দেখে ভিতরে থাকা গার্ড দেওয়া লোক গুলো আমনদের দিকে তেড়ে আসে। আমন কয়েকটাকে মেরে শুইয়ে দেয়।
-“ভাই তুমি ভিতরে যাও এগুলোকে আমরা হ্যান্ডেল করে নিচ্ছি। সানি চিৎকার করে বলে ওঠে।
আমন একবার দেখে নিয়ে কোনও কথা না দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়। এদিকে আকাশ সানি অ্যাস নীহার সবাই মিলে গার্ডদের ফাইট করছে ততক্ষণে অফিসাররা ও এসে গেছে আকাশ সানি গার্ড গুলো কে অফিসারদের হাতে ছেড়ে তারাও বাড়ির ভিতরে চলে যায় দৌড়ে।
আমন দৌড়ে প্রত্যেকটা রুম চেক করতে থাকে। কোথাও সোহা নেই তবে ট্যাব এর দিকে তাকাতেই দেখে সিগন্যাল এখানেই দিচ্ছে। আমন দ্রুত এগিয়ে যায় কোনার শেষের রুমের দিকে। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আমন দ্রুত কোমর থেকে গান বের করে তালাতেই শুট করে দেয়। মুহূর্তে তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে রুমের। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আছে আবছা হয়ে আছে চারদিকে। আমন মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে রুমের মধ্যে হাতড়ে সুইচ অন করে। আলো জ্বলে উঠতেই আমন এবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নেয় ।সাথে সাথে তার পুরো শরীর জমে যায় সামনের দিকে তাকিয়ে । পা থমকে গেছে বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। আমন পুরো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। কি এক অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুকের মধ্যে রক্তক্ষরন শুরু হয়েছে। আমন এর চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। অ্যাস নীহার আকাশ সানি তারাও দৌড়ে আসে। রুমের ভিতরে ঢুকতে তাদেরও আমনের মত অবস্থা তারাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। অ্যাস এর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অ্যাস এর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
-“সোহা….
সামনে পড়ে আছে সোহার নিথর দেহ । রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর। সোহার চোখ মুখ পুরো সাদা ফ্যাকাশে রক্ত শূন্য হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
চলবে…… ❣️
ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।