তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ১১ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

একটা পার্সেল এসেছে মীরার নামে। প্রাপকের জায়গায় কোনো একটা অনলাইন পেজের নাম। আশ্চর্য হলো মীরা। কে দিল এই পার্সেল! বাসার সামনে থেকে পার্সেলটা রিসিভ করে সে ভেতরে ঢুকে যায়। চারপাশটা ভালো করে পরখ করে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। একটা কাঁচি নিয়ে পার্সেলটা খুলতে থাকে। মীরার মনে হচ্ছে তুর্য দিয়েছে এই পার্সেল। কিন্তু সে তো বলেছিল আজ শপিং করাতে নিয়ে যাবে তাকে। তাহলে হঠাৎ পার্সেল কেন? মীরা পার্সেল খুলে চরম অবাক হয়। এই পার্সেলে একটা জামদানী নীল শাড়ি, চুড়ি দু রকমের, অনেকগুলো কিটক্যাট চকলেট, এক গুচ্ছ লাল গোলাপ, সাথে একটা চিরকুট। এতকিছু একসাথে! মীরা একটা একটা বক্স থেকে বের করে। শেষে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে।
“শুনেছি বিয়ে নাকি দ্বিতীয় জন্ম। আপনাকে সে-ই দ্বিতীয় জন্মের শুভেচ্ছা মিস। আপনি চিরসুখী হোন। সব প্রশ্নের উত্তর হয়না মিস। আমাদের আর দেখা হবে না। ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখে থাকুন, আনন্দে থাকুন। – আহান।”
মীরা থমকে গেল। এই পার্সেলটা তাহলে আহান দিয়েছে? কি বলল সে! সব প্রশ্নের উত্তর হয়না। তাদের আর দেখা হবে না? এতো সহজে সব শেষ হয়ে গেল। কেউ জানলো না। কেউ বুঝলো না। শুধু দুটো মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো। গোপনে গোপনে অনুভূতি প্রেরণ হলো। তবুও স্বীকারোক্তি মিললো না। উত্তর মিললো না। অনুভূতি গুলো গোপনেই রয়ে গেল। মীরার চোখ ছলছল করছে। সব শেষ তাহলে। কিচ্ছু করার নেই আর। জিনিসগুলো সব গুছিয়ে আলমারিতে রেখে দিল সে। ভারক্লান্ত মন নিয়ে বেডের এক কোণে বসে রইলো। এভাবে চলতে থাকলে জীবনকে সে গোছাতেই পারবে না। অনেক হয়েছে৷ নিজেকে গোছাতে হবে৷ আবার সেই আগের মীরা হতে হবে৷ যে মীরাকে তুর্য পছন্দ করে।


সময়টা তখন জমকালো সকাল। ঘড়ির কাটায় দশটা বাজলো। তুর্য তার বাইকের উপর বসে মীরার জন্য অপেক্ষা করছে তাদের বাসার সামনে। একটু পর পর হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মীরা গেইট দিয়ে বের হলো। তুর্যর চোখ পড়ল মীরার দিকে। বাইক থেকে নেমে গেল সে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। একরাশ মুগ্ধতা ভর করেছে তার চোখে। এক মায়াবতী মানবীর দেখা পেয়েছে সে। মীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তুর্যর দিকে। তুর্যর চোখ মীরাতেই স্থির! মীরা ভ্রু কুচকালো। হাত নাড়িয়ে তুর্যর চোখে বলল, “তুর্য ভাই! কি হলো।”
তুর্যর ধ্যান ভাঙে। মুচকি হেসে মীরাকে বলে, “আমি দিনের বেলায়ও পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছি।”
মীরার বোধগম্য হলো না তুর্যর কথা। সে জিগ্যেস করলো। “কি?”
“তুই হলি আমার সেই পূর্ণিমার চাঁদ!”
মীরা চুপ। ঠোঁট চেপে শুকনো ঢোক গিলে নিল সে। তাড়া দিয়ে বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে তুর্য ভাই।”
তুর্য বাইকে উঠে বসলো। পিছনে মীরাও বসলো। বাইক স্টার্ট দিল তুর্য। গন্তব্য শপিংমল।
.

ফেনীর অনেকগুলো গতিশীল মার্কেট এর মধ্যে একটা মার্কেটে এসেছে মীরা আর তুর্য। ওরা মার্কেটের ভিতরে প্রবেশ করে। তুর্য প্রথমে মীরাকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যায়। বিয়ের শাড়িটা এখনো কেনা হয়নি। মীরাকে সাথে নিয়ে কিনবে বলে ওটার কাছেও যায়নি। শাড়ির দোকানে গিয়ে বসল দু’জন। তুর্য বলল ভালো মানের শাড়ি দেখাতে। ওরা অনেকগুলো শাড়ি বের করে দেখাতে লাগলো। তুর্য একটা একটা করে দেখছে সব। কপাল কুচকে শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু বিরক্ত নিয়ে বলে, “ভালো মানের শাড়ি দেখান। সবচেয়ে উন্নত ও দামী শাড়ি যেন হয়।”
মীরা বাঁধা দিয়ে বলে, “এতো দামী লাগবে না তুর্য ভাই।”
মীরার কথায় তুর্য ধমক দিয়ে বলে, “অ্যাঁই! তোর সমস্যা কি? আমার বউকে আমি কেমন শাড়ি পড়াবো তা আমি বুঝবো। চুপচাপ বসে থাক।”
মীরার মুখ চুপসে যায়। একটুপর দোকানদারেরা ভালো শাড়ি দেখালো। তুর্য ওখান থেকে সুন্দর একটা লাল বেনারসি শাড়ি বেছে মীরার মাথায় টাঙ্গীয়ে ধরলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মীরার দিকে। মীরা সরু চোখে তুর্যকে দেখছে। তুর্য বলল, “এই শাড়িতে তোকে খুব মানাবে মীরু।”
মীরা চোখ নামিয়ে ফেললো। তুর্য শাড়ীটা প্যাক করে দিতে বলল। সাথে আরও দুটো শাড়ি সে পছন্দ করলো। সবগুলো নিয়ে মীরাসহ শাড়ির দোকান ত্যাগ করলো সে।

শাড়ির দোকান থেকে তুর্য মীরাকে নিয়ে আসে একটা পাঞ্জাবীর দোকানে। তুর্য মীরাকে বলেছে ওর জন্য পাঞ্জাবী পছন্দ করে দিতে। একটা একটা পাঞ্জাবি পড়ে মীরার সামনে এসে দাঁড়ায় তুর্য। কিন্তু মীরার একটাও ভালো লাগে না। তুর্য হতাশ হয়ে যায়। একটাও ভালো লাগছে না মীরার? কিন্তু কেন? সে কি দেখতে এতোই খারাপ যে তাকে একটা পাঞ্জাবিতেও মানাবে না? দুঃখ পায় তুর্য। খুঁজে খুঁজে সে আরও একটা পাঞ্জাবি বের করে। আর ওটাই পড়ে মীরার সামনে আসে। মীরা তুর্যকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখছে। গাঢ় সোনালী রঙের পাঞ্জাবিতে তুর্যকে দারুণ মানিয়েছে! কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তুর্যর দিকে তাকিয়ে রইলো মীরা। তুর্য ঘাবড়ে গেল! এটাও কি ভালো লাগেনি? মীরা মুচকি হেসেই বলে, “এটাই নাও তুর্য ভাই! এটায় তোমাকে নায়ক নায়ক লাগে।”
মীরার কথায় তুর্য কেশে উঠল। মীরা ভাবলো, কি এমন বলল সে? তুর্য নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মীরার উদ্দেশ্য বলল, “সত্যি বলছিস? এটায় ভালো লাগছে? নাকি এমনিই বললি?”
“এমনি কেন বলব? সত্যি বলছি বিশ্বাস করো। এটাই বেস্ট।”
মুচকি হাসলো তুর্য। যাক! একটা হলেও তো মীরার পছন্দ হয়েছে। আরও টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে বিল মিটিয়ে মীরাকে নিয়ে মার্কেটের বাহিরে চলে আসে তুর্য। হঠাৎ কি মনে করে তুর্য মীরাকে বলল, “তুই এখানেই থাক, একটা জিনিস দেখেছিলাম। নিতে ভুলে গেছি।”
মীরা কপাল কুচকে বলল, “সব নেওয়া হয়েছে!”
“উঁহু! ওটা স্পেশাল! ওয়েট কর, আসছি।”
মীরাকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেই তুর্য চলে গেল মার্কেটের ভিতরে। মীরা শপিংব্যাগগুলো নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

.
প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো অতিবাহিত হলো। কিন্তু তুর্য এখনো এলো না। মীরার খুব চিন্তা হতে লাগলো! পিছন ফিরে বারবার দেখছে তুর্য এসেছে কিনা। কিন্তু তুর্যর কোনো পাত্তাই নেই। মীরার মনে এক অদ্ভুত ভয় হচ্ছে! সামনের দিকে ফিরে আকাশের পানে তাকালো মীরা। সূর্য মাথার উপর থেকে একটু হেলে পড়েছে। বাসায় যেতে হবে তাদের। সবাই খুব চিন্তা করবে নাহলে। মীরা ওখান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেলো। রাস্তার ওপারে চলে যেতে নেয়। যাওয়ার পথেই হঠাৎ বিকট শব্দে মীরার সারা শরীর কেঁপে উঠে! কানে এতো জোরে আওয়াজ হয় যে ও কানে দু’হাত দিয়ে রেখেছে। মুহুর্তেই পিছনে তাকালো সে। মীরা দেখলো মার্কেটের ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। কত মানুষ ছোটাছুটি করছে। এ দৃশ্য দেখে মীরার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। ছটপট করতে লাগলো মীরা।
“তুর্য ভাই!!” এইটুকুই মুখ দিয়ে বের হয়েছে তার। চোখে মুখে আতংকের ছাপ। মীরার হাত থেকে শপিংব্যাগগুলো পড়ে গেল। সে দৌড়ে চলে যেতে লাগলো মার্কেটের ভিতর। কিন্তু পারলো না। দু’জন লোক এসে তাকে আটকিয়ে দিল। তারা মীরার দুহাত ধরে আছে। মীরা চিৎকার করছে। বলছে, “ছাড়ুন, তুর্য ভাই! আমার তুর্য ভাই ভেতরে। আমি তুর্য ভাইয়ের কাছে যাব।”
ওনাদের মধ্যে একজন বললেন, “আপনি এখন ওখানে যেতে পারবেন না আপু। বি*স্ফো*রণ হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস আসছে। আমরা পুলিশকেও খবর দিয়ে দিয়েছি। আপনি যাবেন না। আপনার প্রাণের ঝুঁকি আছে।”
মীরা কেঁদে কেঁদে বলল, “আমাকে যেতে দিন, আমার তুর্য ভাই ওখানে একা। প্লিজ ছাড়ুন আমায়।”
মীরা কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে গেল। কি থেকে কি হলো! মীরা চিৎকার করে ডাকল।
“তুর্য ভাই! তুর্য ভাই! প্লিজ বেরিয়ে এসো।” আবারও চোখ দিয়ে বর্ষণ হচ্ছে মীরার। চারদিক থেকে মানুষের কাঁন্নাকাটি, চিৎকার হাহাকার। ধোঁয়া উড়ছে আকাশে। মীরার পুরো দুনিয়াটাই উলোট পালোট লাগছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরিশেষে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মীরার নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। কেউ কোথাও নেই। শুধু মানুষের চিৎকার শোণা যাচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here