তোমাতে রহিব বিলীন,পর্ব-০২
লেখনীতে- Ifra Chowdhury
ফোন ধরেই ধমকের সুরে বললাম,
‘এখন ফোন করেছিস কেন প্রিয়? ভার্সিটিতে জ্বালিয়ে শখ মিটেনি? এখন আবার কী চাই?’
প্রিয় নরম সুরে বললো,
‘আসলে তোর “মিশন অফ দ্যান লাভ” কতোদূর এগোলো সেটাই জানতে ফোন করেছি। তুই আসলেও একটা লঙ্কাবতী! কথা না শুনিয়ে লঙ্কার মতো জ্বলে উঠিস।’
‘প্রিয় থাপ্পড় খাস না। আমার হাতে সাতদিন সময় আছে তো, নাকি? তাই সাতদিন পর আমার সাথে যোগাযোগ করবি। এর আগে ফোন দিবি তো তোর পা ভেঙে তোদের বারান্দায় ঝুলিয়ে দিয়ে আসবো। ফোন রাখ বদ কোথাকার।’
আমার ধমকে প্রিয় কিছুটা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
‘তারমানে এই সাত দিন তোর সাথে কথা হবে না? প্লিজ এমন করিস না স্মিহা। তুই জানিস তো রুহি, সোহা তুই আর আমি একদিনও কথা না বলে থাকতে পারি না। এখন এই চ্যালেঞ্জের জন্য তুই আমাদের থেকে আলাদা থাকবি?’
‘ন্যাকামি করবি না একদম। এখন ঢঙ দেখানো হচ্ছে, তাই না? এমন একটা চ্যালেঞ্জ দেওয়ার আগে এসব ভাবতে পারিসনি? এখন আসছে আলগা পিরিত করতে।’
‘আচ্ছা আমরাও দেখবো তুই আমাদের সাথে কথা না বলে কীভাবে থাকিস। এখন বল্ পরাগ ভাইয়ের নাম্বার পেয়েছিস? আমার কাছে আছে, দিবো?’
‘না তার কোনো দরকার নেই ভাই। তোমরা আমার অনেক উপকার করেছো, আর করতে হবে না। যার নাম্বার, আমি তার কাছ থেকেই নিবো। এবার দয়া করে। ফোনটা রেখে উদ্ধার করো আমায়।’
এতোক্ষণ প্রিয়র কন্ঠটা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠ হলেও এখন বেশ উৎফুল্ল নিয়ে প্রিয় বললো,
‘তুই শিওর? যে তুই পরাগ ভাইয়ের কাছ থেকেই উনার নাম্বারটা নিবি?’
দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম,
‘জি শিওর। আল্লাহ হাফেজ।’
ফোনটা রেখেই আইস ব্যাগ এনে মাথায় রাখলাম। রাগে আগুন বের হচ্ছে মাথা দিয়ে। ওরা কেউ এখন সামনে থাকলে নিশ্চয় খুনাখুনি টাইপ কিছু হয়ে যেতো। কিন্তু রাগের বশে বলে তো দিলাম যার নাম্বার, তার কাছ থেকে নিবো। আদৌ কি এটা সম্ভব!
ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই পরাগ ভাইয়ের খোঁজে নেমে পরলাম। উনার সেই রেড জোন এড়িয়াতেও খোঁজ করলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না।
‘কী ব্যাপার লোকটা কি আজ আসেনি? উনি না আসলে নাম্বারটা পাবো কীভাবে? ‘
নিজের মনেই প্রশ্ন আওড়ালাম। এমন সময় রুহি এসে আমায় বললো,
‘এই শুনেছিস? পরাগ ভাইয়ের নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। ‘
‘মরে গিয়েছে?’
আনমনেই প্রশ্নটা করলাম রুহিকে।
‘ছিঃ স্মিহা, এসব কী বলছিস তুই? একটা মানুষের এক্সিডেন্টের খবর শুনে কেউ এমন কথা বলে? বুঝলাম মানুষটাকে তুই সহ্য করতে পারিস না; তাই বলে তার মৃত্যু কামনা করবি তুই?’
রুহির কথায় হুশ এলো আমার। আমি থতমত গলায় বললাম,
‘আরে আজব মৃত্যু কামনা কেন করবো? তুই ভুল বুঝছিস আমি এসব মিন করিনি। আর ঐ কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে, স্যরি।’
রুহি আমার কথায় বেশ ক্ষেপে গিয়েছি বুঝতে পারছি। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। আসলেই আমার মাথায় রাগ আর জেদ ছাড়া কিছুই নেই। না হলে এমন একটা মুহুর্তে কেউ এসব বলে? নিজেরই নিজের উপর ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে।
রুহির কাছ থেকে আর কোনো ইনফরমেশন পাবো বলেও মনে হচ্ছে না। তাই এগিয়ে আসলাম ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের দিকে। প্রধান ফটকের দুইপাশে সারি সারি গাছ। তার মাঝে বেঞ্চ বিছানো। প্রায় সময় বন্ধুদের আড্ডা হয় এখানে। পাশেই খালি একটা বেঞ্চ পেয়ে বসে গেলাম। যতোদূর চোখ যায় ততদূর অবধি তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। জানি না হুট করে মনটা এতো উতলা হয়ে উঠেছে কেন? বুকের মধ্যে বেশ ফাঁকা অনুভব করছি। মনে হচ্ছে কাউকে আজ খুব করে মিস করছি। কিন্তু কাকে?
প্রশ্নটা মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করার আগেই সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। কাউকে কড়া গলায় বলছে,
‘বিয়ে করবি ভালো কথা। সেটা ঘটা করে আমায় কেন জানাতে হবে তোকে? আমি কি তোর বিয়ের ঘটক? ফাজিল কোথাকার৷’
ধমকের দাপটে আমি আৎকে উঠলাম। পাশ ফিরে তাকিয়েই দেখি আমার থেকে প্রায় পাঁচ কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে পরাগ ভাই।
একদম ধবধবে ফর্সা একটা মানুষ। অথচ কথা বলে কী বিশ্রীভাবে। শুনেছি লম্বা মানুষদের বুদ্ধি নাকি হাঁটুর নিচ অবধি থাকে। উনাকে দেখে তার প্রমান পেলাম। বুদ্ধি থাকলে এতো শিক্ষিত হয়েও কি কেউ কারো সাথে এতো বাজেভাবে কথা বলতে পারে? আবার ঠোঁটের নিচে টোল পড়ছে। ছেলেদের গালে অথবা ঠোঁটের নিচে টোল পড়বে কেন? এসব তো মেয়েদের থাকবে। যেমন মেয়েদের মতো ফর্সা, তেমন টোল! যত্তসব!
আমাকে একা একা বিড়বিড় করতে দেখে পরাগ ভাই দু’ কদম এগিয়ে আসলেন আমার দিকে।
আমি দেখেও না দেখার ভান করে আকাশের দিকে তাকালাম।
পরাগ ভাই এসেই বললেন,
‘কী ব্যাপার ক্লাস রেখে এখানে বসে আছো কেন? বয়ফ্রেন্ডের চক্কর টক্কর আছে না কি?’
আমি আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে উনার দিকে বেশ ভালোভাবে তাকালাম। আমার এমন তাকানো দেখে উনি গলা ঝেড়ে বললেন,
‘বাব্বাহ মিস লঙ্কাবতী আজ আমায় এতো ভালো করে পরখ করছো যে? মনে ধরেছে নাকি?’
কথাটা বলেই উনি উনার শার্টের কলারটা একটু উঁচিয়ে ধরলেন।
আমি বেশ নরম গলায় বললাম,
‘দেখে তো আপনাকে বেশ ভদ্র ঘরেরই ছেলে মনে হয়। তা আপনার ব্যবহার এতো বস্তিমার্কা কেন পরাগ ভাই?’
আমার কথায় উনার উজ্জ্বল মুখটা কেমন চুপসে গেলো। তবুও প্রতিবাদী কন্ঠে বললেন,
‘শোনো স্মিহা, কারো সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করতে হলে তার সবদিক দেখেই মন্তব্য করতে হয়। তুমি মেয়ে বলে আজ কিছু…’
আমি উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলা আরম্ভ করলাম,
‘মেয়ে বলে আজ কিছু কী? মারধর করতে পারলেন না এই তো? কিন্তু আপনার একেকটা কথা মারের চেয়েও বেশি লাগে।’
কথাখানা বলেই উনার সামনে থেকে সরে আসলাম। এখন পিছন দিকে তাকালে নিশ্চয় দেখতে পেতাম একজোড়া চোখ অবাক চাহনিতে আমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।
__________
রাতের নিস্তব্ধতা বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে আমার দুঃশ্চিন্তা। দেখতে দেখতে দু’দিন চলে গেলো। অথচ এখনো আমি প্রেমের ‘প’ টাও করে উঠতে পারিনি। আজ অহেতুক উনার সাথে দুর্ব্যবহার করে এলাম। আমি জানি না উনার সাথে দেখা হলেও আমার মাথাটা বিগড়ে যায় কেন!
নাম্বারের আশা ছেড়ে দিলাম। আমি ইহকালে কী পরকালেও হয়তো উনার মুখোমুখি হয়ে নাম্বার চাইতে পারবো না। এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে সোশ্যাল মিডিয়ার কথা মাথায় এলো। একুশ শতকে এসেও নাম্বারের জন্য প্রেম আটকে থাকবে এমনটা হতে পারে না। আমি তাড়াতাড়ি ফেসবুক লগ ইন করলাম।
উনার নামটা বেশ ভালো করেই আমার মনে আছে। তাই খুব দ্রুত পরাগ ভূঁইয়া নামটা সার্চ করলাম। কিন্তু এরপর যা দেখলাম তা দেখাই পুরাই শকড হলাম আমি। পরাগ ভূঁইয়া আইডি থেকে প্রায় চার মাস আগে রিকুয়েস্ট এসে রয়েছে। আমিই দেখিনি।
হুট করে মনটা খুশিতে ভরে গেলো। তাড়াতাড়ি করে রিকুয়েস্ট কনফার্ম করতে গিয়ে থেমে গেলাম আমি।
কিছু একটা ভেবে আমার ফেইক আইডি দিয়ে উনাকে রিকুয়েস্ট পাঠালাম। দশ মিনিটের মাথায় রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হলো।
উনার এতো তাড়াতাড়ি রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা দেখে আবার রাগ উঠে গেলো আমার। অথচ দরকারটা আমারই। তবুও কারো ছ্যাচড়ামি সহ্য হয় না। কোনো ছেলে যদি দশ মিনিটের মাথায় কোনো অপরিচিত মেয়ের রিকুয়েস্ট কনফার্ম করে তাহলে তাকে ছ্যাচড়াদের কাতারে ফেলা খুব একটা ভুল হয়নি বোধহয় আমার।
এসব দেখে টেক্সট করার মুডটাই চলে গেছে।
বাইরে খুব জোরে হাওয়া বইছে। হয়তো এক্ষুনি ঝুম বৃষ্টি নামবে। আমি মন শান্ত করার জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মেইন রোডের পাশেই বাসা হওয়ার সুবাধে রাতের নিয়ন আলো দেখতে পাই। সেই সাথে সারাক্ষন গাড়ির হর্ণেও খুব বিরক্ত হই। কিন্তু আজ রাস্তায় গাড়ি কম। হর্ণটাও সেই প্রেক্ষিতে কম শোনা যাচ্ছে। রাতও হয়েছে বেশ। আমার চোখ জোড়া ঘনকালো মেঘেদের দিকে তাকালো। খুব জোরে মেঘগুলো দৌঁড়াচ্ছে। ইশ আমিও যদি মেঘেদের মতো চোখের পলকেই ছুটাছুটি করতে পারতাম খুব ভালো হতো!
হঠাৎ করে এমন একটা আক্ষেপ এলো মনে। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে রাস্তার সোডিয়াম আলোর দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম আমি।
একজোড়া দম্পত্তি মাঝ রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছে। হয়তো বৃষ্টিতে ভিজবে বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। এটাই কি তবে প্রেম?
হুট করে প্রেম শব্দটা মাথায় আসতেই মনে প্রশ্ন এলো, পরাগ ভাই না এক্সিডেন্ট করেছিলেন?
তাহলে তখন উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন কীভাবে?
প্রশ্নটা মাথায় আসার সাথে সাথেই একরাশ বিরক্তি আমায় জাপটে ধরলো। রাস্তায় এক জোড়া সুখি দম্পত্তিকে দেখে আমার কেন ঐ রাগী, বদমেজাজি, কাঠখোট্টা টাইপ মানুষটার কথা মাথায় এলো?
আমার একরাশ বিরক্তিকে দূর করতে আকাশের বুক ছিঁড়ে এক ঝলকা বৃষ্টি এসে আমায় ছুঁয়ে গেলো। আমার চোখজোড়া আবার সেই দম্পত্তির দিকে গেলো কী এক অদ্ভুত শান্তিতে তারা পাশাপাশি হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে। হঠাৎ করেই মনের গোপন কুঠুরিতে ঘন্টা বেজে উঠলো।
আমি বুঝতে পারি, ধীরে ধীরে প্রেম নামক রোগটা আমায় গ্রাস করে ফেলছে।
চলবে…