তোমাকে,পর্ব : 3.1,4.1

তোমাকে,পর্ব : 3.1,4.1
লেখনীতে: অনিমা হাসান
পর্ব : 3.1

চা খাবে?
চা, এখানে চা কোথায় পাবো ? তোমাদের এখানে কফি শপ গুলোতে চায়ের নামে যেটা পাওয়া যায় সেটা অতি অখাদ্য
অনিমা হাসলো তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট ফ্লাক্স আর দুইটা কাগজের কাপ বের করল I একটাতে সাবধানে চা ঢেলে মনিরের হাতে দিল I মনির আরেকটা কাপ ধরল , অনিমা সেটাতে চা ঢেলে নিজে নিল I তারপর একটা ছোট প্লাস্টিকের বক্স খুলে দুজনের মাঝখানে রাখল I মনির দেখল তার ভেতর ছোট ছোট সিঙ্গারা I অনিমা বলল
খাও একদিন একটু অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে কিছু হবে নাI তুমি তো বাসায় আসতে চাইলে না, না হলে তোমাকে হোমমেড স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াতে পারতাম I
– রক্ষা করো I এই ভালো I কাল রাতে সারোয়ার ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত ছিল I পোলাও কোরমা করে হুলুস্থুল অবস্থা I আমি এসব রিচ ফুড একেবারেই খেতে পারিনা I
– তুমি তো ভাত ই বেশি খেতে পারো না তার আবার রিচ ফুড I অনিমা হাসল
মনির একটা সিঙ্গারা তুলে মুখে দিল I ভিতরে আলু আর সবজির পুর দেয়া , মচমচে বেশ সুস্বাদু খেতেI
– তুমি এইগুলি বাসায় বানিয়েছে ?
– হ্যাঁ এদেশে তুমি দোকানে সিংগারা কোথায় পাবে ?
– ভালো হয়েছে
– অনিমা হাসলো I মনে আছে ক্যাম্পাসে থাকতে এটা ওদের রেগুলার খাবার ছিল I ক্লাস শেষে চা সিঙ্গারা না খেলে ভালোই লাগতো না I
– তোমার বাসার সবাই কেমন আছেন মনির? তোমার মা বাবা ভালো আছেন ?
– বাবা মারা গেছেন সাত বছর হয়ে গেল I মা এখন আমার সঙ্গেই থাকেন ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে
– তোমার একটা বোন ছিল না ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে পড়তো
– হ্যাঁ ওর বিয়ে হয়ে গেছে হাসব্যান্ড চার্টার্ড একাউন্টেন্ট কাছেই থাকে ফুলার রোডে I আমি যখন দেশে থাকি না মা আর তনুকে ওই দেখে রাখে
– তনু বুঝি তোমার বউ এর নাম ?
– না তনু আমার মেয়ে ভালো নাম তনিমা I অনিমা একটু অবাক হলো
– তোমার মেয়ের নাম তনিমা? কে রেখেছে এই নাম ?
– আমি

অনিমা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল I ওর খুব শখ ছিল মেয়ের নাম তনিমা রাখার I সেঁজুতি যখন জন্ম হয় অনিমার তখন অল্প বয়স 21 ও হয়নি I অযত্ন-অবহেলায় শরীরের অবস্থা ভাল ছিল না I ডেলিভারির পর অনিমা অজ্ঞান অবস্থায় ছিল I এদেশে বাচ্চা জন্মানোর সাথে সাথে নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় I আশিকের মাথায় কিছুই আসছিল না I পরে ওর বাবা মাকে ফোন করে সেঁজুতির নাম ঠিক করা হয় I অনিমা বলল
– খুব সুন্দর নাম I আর তোমার ছোট ভাই ওর কি ডাক্তারি পড়া হয়েছিল শেষ পর্যন্ত
মনির বেশ অবাক হল অনিমা এত কিছু মনে রেখেছে I আশ্চর্য তোI তারপর বলল
– হ্যাঁ পাবলিকে চান্স পায়নি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে I এখন একটা ক্লিনিক করেছে নিজের ভালোই চলছে
– তুমি নিজে পাবলিক মেডিকেলে চান্স পেয়েও পড়োনি খরচের কথা ভেবে আর ভাইকে প্রাইভেটে পড়লে ?
– ওই আর কি I
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে I অনিমা একটু চিন্তিত হল I এইরকম খোলা জায়গায় হঠাৎ বৃষ্টি নামলে বিপদI আশেপাশে কোন সেড নেই I পার্কিং পর্যন্ত যেতে হবে অনেকখানি হাঁটতে হবেI যদিও অনিমার কাছে ছাতা আছে কিন্তু এরকম খোলা জায়গায় ছাতায় কাজ হবে না I অনিমা বলল
– চলো যাওয়া যাক I বৃষ্টি নামতে পারে I
– তোমার তো বৃষ্টি খুব পছন্দ ছিল
– এখানকার বৃষ্টির দেশের মত নয় I টেম্পারেচার কমে যায় অনেক I বৃষ্টিতে ভিজে মজা নেই I

মনিরের যেতে ইচ্ছা করছে না I ও চা এর কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখল I হঠাৎ করে বহু বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেল I সেদিন ও দুজন এভাবেই বসে চা খেয়েছিল I শুধু অনিমা তখনএত দূরের ছিলনা I মনির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো I বলল চলো I

পর্ব 3.2

হেমন্ত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I চারিদিকে শীতের আমেজ I বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শীত একটু আগেই নামে I কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে ভোরের নরম রোদ কার্জন হলের লাল ভবনগুলোকে আরে মোহময় করে তোলে I ঘাসের উপর শিশিরের আবরণI

ক্লাস শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ I অনিমার পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে I আজ অনিমা একটা সাদা পোশাক পড়েছে I গারো নীল একটা শাল জড়িয়ে নিয়েছে উপরে I তারপর ও ওর একটু শীত শীত লাগছেI ক্লাসের মধ্যে হঠাৎ করে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না I তাই অনিমা ক্লাসে না ঢুকে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে গিয়ে বসলো I জায়গাটা একটু ঠান্ডা কিন্তু সকালের নরম রোদ গায়ে এসে পড়ায় বেশ আরামদায়ক লাগছেI

মনির ক্লাস থেকে বের হয়ে দূর থেকে ওকে দেখল I সেমিনার থেকে স্যার দুটো বই আনতে পাঠিয়েছেন ক্লাসের মধ্যেই I মনিরা আর রতন অনিমার পাশ কাটিয়েই সেমিনারে গেল I অনিমা টের পেল না I বই দুটো খুঁজে বের করে মনির রতনকে বললো
তুই নিয়ে যা আমি একটু পরে আসছি I রতন চলে গেলে মনির গিয়ে অনিমার পাশে বসলো
– কি ব্যাপার ক্লাস করছনা?
– দেরি হয়ে গেছে তাই আর ঢুকলাম না
মনির লক্ষ করল অনিমার মুখটা কেমন ফোলা ফোলা চোখগুলো ভেজাI
– তোমার কি মন খারাপ?
অনিমা ধরা গলায় বলল
– না তেমন কিছু না
কিছুক্ষণ ওরা দুজন চুপ করে বসে রইল I তারপর মনির বলল
– চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনি
– কি?
– চলই না
ওরা দুজন ডিপার্টমেন্টের পিছনের দিকে গেলI এখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গাI দেয়াল ঘেঁষে একটা চায়ের দোকানI সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা I মনির ওকে ওইদিকে না নিয়ে গিয়ে তার একটু পাশে নিয়ে গেল I ক্লাস চলছে বলে এখন এখানে কেউ নেই I
– এখানে দাড়াও
– এখানে?
– না, আর একটু এই পাশে
মনির ওকে যে জায়গাটায় দাঁড় করালো সেখানে একটা বিশাল শিউলি ফুলের গাছ I পাশেই একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ ও আছেI জায়গাটা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেশে আসছেI কিসের গন্ধ অনিমা ঠিক ধরতে পারল না I
– দাড়ালাম I এখন?
– এক মিনিট
মনির হাত বারিয়ে গাছের একটা ডাল ধরল I তারপর কয়েকটা ঝাঁকি দিল I অনিমা দেখল উপর থেকে শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে I কি অদ্ভুত সুন্দরI ওর চুল, গাল , মুখ বেয়ে সাদা আর কমলা ফুলগুলো পরছেI অনিমা দুই হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো ধরার চেষ্টা করল I ওর হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাচ্ছে ফুলগুলো I কি আশ্চর্য একটা মুহূর্ত I অনিমা তাকিয়ে দেখল মনির হাসছেI অনিমা বুঝতে পারল না কোনটা বেশী সুন্দর এই হাসিটা নাকি এই সকালটাI

মনির হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
– প্রতিদিন সকালে এসে আমি এই কাজটা করিI আজকেই করা হয়নিI ভালোই হলো তোমাকে দেখানো গেলI
তারপর একটু থেমে বলল
শোনো, আমাদের আশেপাশে এমন অনেক সৌন্দর্য অনেক ছোট ছোট আনন্দ লুকিয়ে আছেI তাদের খুঁজে নিতে হয়I এইসব ছোট ছোট আনন্দ গুলো আমাদের অনেক বড় বড় কষ্ট আর না পাওয়াকে ভুলিয়ে রাখতে সাহায্য করেI বুঝলে?
অনিমা মুগ্ধ হয়ে শুনলোI একটা মানুষ কি করে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে ও ভেবে পেল নাI তারপর একটু হেসে বলল
– থ্যাঙ্ক ইউ মনিরI তুমি আমার মনটা ভালো করে দিলে I আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীI অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোন স্মৃতি মনে করতে পারছিলাম নাI তাই মনটা খুব খারাপ ছিলI
– তুমি মন খারাপ করে থাকলে কি তোমার মায়ের ভালো লাগতো ? নিশ্চয়ই নাI ক্লাস করছ না এটা দেখলেও কিন্তু ভালো লাগতো না I
অনিমা হাসলো I মনির বলল
– নেক্সট ক্লাসটা কিন্তু খুব ইম্পর্টেন্টI পরীক্ষার আগে এভাবে ক্লাস মিস করো না I
মনির ঘড়ি দেখল ক্লাস শুরু হতে আরও 15 মিনিট বাকিI ও জিজ্ঞেস করল
– তুমি সকালে কিছু খেয়েছো?
– না
– আমিও খাইনিI চলো চা খাইI
– ওরা দুজন গিয়ে চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসল মুখোমুখি I মনির চায়ের কাপ আর একটা কাগজের প্যাকেট সিঙ্গারা এনে অনিমার হাতে দিলো I
অনিমা চায়ের কাপে চুমুক দিলI শীতের সকালে চা টা খেতে বেশ লাগছেI হঠাৎ করে অনিমার মনে হল এর চেয়ে সুন্দর সকাল ওর জীবনে আর আসেনি I

চলবে…..

লেখনীতে: অনিমা হাসান

তোমাকে
পর্ব 4.1

তুমি আর গান করো না অনিমা ? জানতে চাইলে মনির

গাড়ি ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে I বাইরে তুমুল বৃষ্টিI পার্কিং লটে পৌঁছনোর আগেই বৃষ্টিটা নামেI অনেকটাই ভিজে যায় ওরা I অনিমা বলে

তাড়াতাড়ি চল এই বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপ করবে
হঠাৎ করেই তাপমাত্রা নেমে গেছে পানি অসম্ভব ঠান্ডা I বৃষ্টির ফোঁটা তীরের মত এসে শরীরে লাগছে I
মনির এর মধ্যে কোন তাড়াহুড়া দেখা গেল না I আপন-মনে হাঁটতে লাগলো I যেন অনিমার কথা শুনতেই পায়নিI অনিমা আবার তারা দিল

মনির ভিজে যাচ্ছ তাড়াতাড়ি চলো
তুমি যাও আমি আসছি I আমার ভিজতে ভালো লাগছে I একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে
অনিমা আর কিছু বলল না I ওর পাশে হাটতে লাগলI যখন ওরা পৌঁছলো তখন দুজনেই একেবারে ভিজে গেছে I মনির ওর ওভারকোট গাড়িতে রেখে এসেছিল I অনিমা গাড়ির পেছনে থেকে তোয়ালে বের করে মনিরকে দিল I ভেজা স্কার্ফ গাড়িতে রেখে আরেকটা নতুন বের করে নিল I

গাড়ির ভিতরে বস অকারণে ভিজো না
দুজনেই গাড়ির ভেতরে বসলো I অনিমা ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে মনিরকে দিল

চা খাও I এভাবে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলবে I শুধু শুধু ভিজতে গেলে I
সমস্যা নেই তুমি ও তো ভিজলে
আমাকে তো আর জার্নি করতে হবে না I
ও কিছুনা আমার কিছু হবে না
অনিমা অপরাধীর মত করল
শুধু শুধু তোমাকে এখানে নিয়ে এসে কষ্ট দিলাম
মনির হাসলোI বলল
একটা খুব ভালো এক্সপেরিয়েন্স হল I থ্যাঙ্ক ইউ
মনির চায়ের কাপে চুমুক দিলI বৃষ্টিতে ভেজার পর গরম চায়ে চুমুক দেয়াটা মনে হয় এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি গুলির মধ্যে একটা I অনিমা বলল
একটু বসি কেমন? এতো বৃষ্টিতে ড্রাইভ করা একটু রিস্কিI তোমার দেরি হয়ে যাবে না আশা করি
না আমার আর কোন কাজ নেইI
হঠাৎ করেই মনিরের মনে হল এই রকমই একটা বৃষ্টির দিনে অনিমা ওকে একটা গান শুনিয়ে ছিল I সেদিন সেই গানের অর্থ টা ও ধরতে পারেনিI সত্যি কি অনিমা সেদিন কিছু বলতে চেয়েছিল ওই গানটার মধ্য দিয়েI জানা হলো নাI আরো অনেক কিছু জানার ছিলI অনেক প্রশ্ন ছিলI অনেক কিছু বলার ছিলI কিছুই হলো না I অনিমা বলল
বৃষ্টি কমেছে চলো রওনা দেয়া যাক
তখনই গানের কথাটা জানতে চাইলে মনির
নাহI গান ছেড়ে দিয়েছি বহু বছর
কেন ?
এমনিতেই অনিমা বিষন্ন কন্ঠে বলল
প্রসঙ্গ এড়াতে অনিমা বলল
একটা শুধুই গান শুনি I দাঁড়াও অন করে দেই
অনিমা গাড়ির প্লেয়ারে গান চালু করে দিল

মেখলা দাশগুপ্তের কিন্নরকন্ঠ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো

কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালো আসলেনা
এই মন কেমনের জন্মদিন চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতা গতিহীন
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারি
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই শুধু আমারই

অনিমা একটু অপ্রস্তুত হলI এই গানটা শুরু হবে জানলেও চেঞ্জ করে দিতেI এটা ওর অসম্ভব প্রিয় একটা গান I এখনো মাঝে মাঝে একা একা গায় I যাক মনির হয়তো লক্ষ্য করবে নাI শুধু একটা গান হিসেবে দেখবে I এর আগেও তো তাই হয়েছিল I অনিমা তো একটা গান গেয়েছিল ওর জন্য I সেদিন ও এমন বৃষ্টি ছিল I কিন্তু মনিরর গানের কথা বুঝতে পারেনিI কিংবা কে জানে হয়তো বুঝতে চাইনিI

মনির স্তব্ধ হয়ে বসে আছে I বহু বছর ও গান শোনে না I অনিমা চলে যাওয়ার পর ওর আর গান শুনতে ইচ্ছা করেনাI নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রাখে I আজকে এই গানটা শুনে বুকের ভেতর খুব লাগছে I

গানটা বেজেই চলেছে I বন্ধ করে দিতে একটু অস্বস্তি হচ্ছে I

…সেই মেঘবালিকার গল্প হোক
শহর জুড়ে বৃষ্টি হোক
রোদ্দুর হোক আজ শুধুই তার ডাকনাম
পাতা ভরা শব্দ টুকরোরা
কালবৈশাখীর মত মুখচোরা
সব ভিজে যাক শুধু বেঁচে থাক অভিমান
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারি
বেঁধে রাখতে পারলে তুমি ও হতে আমারই শুধু আমারই

অনিমা আর নিতে পারল না I হাত বাড়িয়ে গানটা বন্ধ করে দিল I

দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হল না I অনিমা ওকে হোটেল রেডিসনে নামিয়ে দিল I গাড়ি থেকে নামল না I কাঁচটা নামিয়ে শুধু বলল ভালো থেকো মনির
মনির জবাব দিল না শুধু মলিন হেসে একটু মাথা নাড়লো I অনিমা চলে গেল I মনির অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে I তারপর আপন মনে বলল

ITS NOT ERASED ITS BEEN REPLACED. তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল

এই জীবনে কি আমার তোমার থেকে কোনো মুক্তি নেই অনিমা?
*******
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে I অনিমা বাড়ি ফিরেছে অনেকক্ষণ I মনির বলেছিল ওর ফ্লাইট সাড়ে সাতটায় I এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাহলে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে I ফোন করবে না করবে না ভেবেও শেষপর্যন্ত ফোনটা করে ফেলল অনিমা

হ্যালো মনির পৌছে গেছো এয়ারপোর্টে?

হ্যাঁ এই কিছুক্ষণ আগে পৌঁছলাম

ঠিক আছো ? ঠান্ডা লাগেনি তো আবার?

না না আমি ঠিক আছি I কোন সমস্যা নেই

আর কতক্ষণ বাকি ?

আরও প্রায় ঘন্টা খানেক

কি করবে এতক্ষণ ?

তোমার সঙ্গে গল্প করা যায়

ঠিক আছে বল কি গল্প করতে চাও

তুমি গান ছারলে কেন ?

তুমি তো বলেছিলে গল্প করবে এখন দেখি ইন্টারভিউ নিচ্ছ

ইন্টারভিউ কোথায়? একটা প্রশ্ন করলাম শুধু

এটা লং স্টরি

আমার কাছে এক ঘন্টা সময় আছেI এর চেয়ে বেশি লং মনে হয় না

অনিমা হাল ছেড়ে দিলI বলল

আচ্ছা ঠিক আছে বলছিI বিয়ের পর প্রথম যখন এখানে শিফট করি আশিক খুব চাইতো আমি বিভিন্ন গ্যাদারিং এ গেট টুগেদার এ গান গাই I আমি গাইতাম ও প্রথম দিকে I কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে একসময় বিরক্তি এসে গেলI এমনিতেও আমার লোকজনের সামনে গান করতে ভালো লাগেনাI আমি সবসময়ই শুধু আমার খুব কাছের মানুষদের জন্য গান করতে চাইতামI

উনি নিজে কখনো তোমার গান শুনতে চাইতেন না

ও আসলে ছোটবেলা থেকে এখানেই বড় হয়েছেI বাংলা গান শোনে না বোঝে ও নাI আর আমার ইংরেজি গান গাওয়া হয় নাI

কিন্তু তোমার মেয়ে?
আসছি সে কথায়

সেঁজুতি জন্মের পর আমি অনেক গান করতামI জন্মের পর বললে ভুল হবে যখন থেকে ওর অস্তিত্ব জানান দিয়েছে তখন থেকেই আর নিজেকে একা মনে হতো নাI যখনি গাইতাম মনে হতো আমি ওর জন্য গাইছিI তিন বছর খুব ভাল চলছিলI এরপর যখনই আমি গান করতাম সেঁজুতি বলতো
আম্মু লাউডারI আমি প্রথমে বুঝতে পারিনিI এরপর দেখতাম টিভি দেখার সময় কিংবা কেউ কোন প্রশ্ন করলে ও একই কথাই বলতোI পরে জানতে পারলাম ওর sensorineural hearing loss হয়েছে I যখন পাঁচ বছর বয়স তখনো সম্পূর্ণভাবে শ্রবণ শক্তি হারায় I আমার গান ও সেই দিনই শেষ হয়ে যায় I

নিশ্চয় কোন ট্রিটমেন্ট আছে

খুব কমন কিছু না আমরা চেষ্টা করছিI খুব একটা আশাবাদী নই I

মনির একটু অসহায় বোধ করলো I ঠিক কি বলবে বুঝতে পারল না I

বাদ দাও ওসব কথা I তোমার কথা বল I নীলা কেমন আছে?

নীলা? তোমার তো ভালো জানার কথা I আমার সঙ্গে লাস্ট দেখা হয়েছিল প্রায় 4 বছর আগে I ও যেখানে ফ্যাকাল্টি হিসেবে আছে সেখানে একটা কনফারেন্স এটেন্ড করতে গিয়েছিলাম I ইনফ্যাক্ট অনার্সে পড়ে সেই প্রথম এবং সেই শেষ দেখা I তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই?

না I আমার কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই I জিজ্ঞেস করবে না করবে না করেও শেষ পর্যন্ত অনিমা জিজ্ঞেস করে ফেলল
আর তোমার বউ I তার কি খবর?
মনির একটু একটু হাসলI তারপর বলল
আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে I
সেকি
এতো অবাক হচ্ছ কেন?
মনির আরো কিছু বলল কিন্তু ফোনের ওপাশে শব্দের জন্য কিছু বোঝা গেল নাI
হ্যালো মনির আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না
অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে আমাকে যেতে হবে I তুমি ভালো থাকো অনিমা I
মনির ফোন নামিয়ে রাখল I এর বেশি আর কিছু বলা যাবে না I সবটা জানলে ও কষ্ট পাবে I এই ভালোI কিছু কথা না জানাই থাক I

চলবে…..
লেখনীতে: অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here