#তুমিই_আমার_পূর্ণতা,পর্ব ৯
#মেহরাফ_মুন (ছদ্মনাম )
আদ্রাফের সামনেই মুন দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রাফ যেন হতবাক। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার মনে হচ্ছে সামনে হাত বাড়িয়ে মুনকে ছুঁতে গেলেই মুন অদৃশ্য হয়ে যাবে। কারণ এই দুইবছর প্রতিটাদিনই মুন এমন করে আসতো আর আদ্রাফের করা ভুলগুলো ধরিয়ে দিতো, ওকে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে অনুসোচনায় পুড়তে দিতো তার কল্পনায়। হাত বাড়ালেই অদৃশ্য হয়ে যেত তখন মুনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। তাই এবারও একইভাবে আদ্রাফ হাত বাড়াতে নিলেই আবার কী মনে করে গুটিয়ে নিলো হাতটাকে। মুন সামনে থেকেই আদ্রাফের এই বাচ্চামো স্বভাব দেখে হাসি আর চেপে রাখতে পারলো না। সে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মুনের হাসি শুনেই আদ্রাফ ঘোর থেকে বেরিয়ে আসলো, তার মানে কী এটা আদ্রাফের ভ্রম নয়? মুন সত্যিই ওর সামনে! আদ্রাফ যেন অবাকের চরম পর্যায়ে! সে কোনোমতেই বলে উঠলো,
-‘তুমি?’
-‘হ্যাঁ আমি। কেন অন্য কাওকে আশা করেছিলেন বুঝি?’ মুন হাসি চেপে ধরে দু’হাত বুঁকের মাঝে গুটিয়ে বলে উঠলো।
আদ্রাফ যেন কথা বলতেই ভুলে গেল। এতদিন পর সে তার মুনপাখিকে দেখছে। তার মানে কী মুন তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছে! আদ্রাফের যেন খুশিতে তর সইছে না।
-‘ এই যে! কই হারিয়ে যাচ্ছেন কিছুক্ষন পর পর। না-কি কল্পনায় সংসার টংসার, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভেবে ফেলছেন?’
আদ্রাফের কাশি উঠে গেল এই কথা শুনে। ‘এই দুইবছরে লাজ-লজ্জা সব খেয়ে ফেলেছে এই মেয়ে। তখন তো কথাও বলতো মাথা নিচু করে আর এখন দেখি ভয়ও পায় না।’ আদ্রাফ নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো।
এইসব দেখেই মুনের হাসি যেন থামতেই চাইছে না।
ওকে কিছুক্ষন আগেই আদ্রাফের ব্যাপারে শুভ্র সব খুলে বলেছিলো। আর আদ্রাফের কালো অতীতের ব্যাপারেও বলেছিলো যে কেন সে নারী জাতিকে ঘৃণা করতো। মুন তবুও আদ্রাফের মুখ থেকে শুনতে চায়, সে আদ্রাফের এই বিশ্বাস ভঙ্গ করবে, দেখিয়ে দিবে সব নারী এক নয়। তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে শুভ্রর কাছ থেকে, শুভ্র তাঁকে এও বলেছে যে আদ্রাফ ওকে ভালোবাসে। এখন শুধু আদ্রাফের বিশ্বাস অর্জনের পালা। শুভ্র, মিম আর বাকিরা কেউই এখানে নেই, তারা সবাই অন্যদিকে ঘুরছে, এখানে শুধু মুন আর আদ্রাফই আছে। তারা এখন ছোট্ট দুইটা পাথরের ওপর বসে আছে। পাশেই ঝর্ণার পানির কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মুন আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে দেখল সে এক ধ্যনে সামনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। মুনও আর বিরক্ত করল না। সেও চুপচাপ বসে আছে অদূরেই তাকিয়ে।
– ‘কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে এই দুইবছর?’ আদ্রাফ আগের ন্যয় ঐদিকেই তাকিয়ে বলল।
মুন আদ্রাফের কথায় ওর দিকে তাকালো।
-‘ আপনার জন্য থাকতে পারছি ওই জায়গায়?’
আদ্রাফ এই কথার জবাবে আর কিছু বলতে পারলো না। আবারও আগের অপরাধবোধ জাগ্রত হওয়ায় ও লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।
মুন এটা বুঝতে পেরে নিজেকে নিজেই গালি দিল। কেন শুধু শুধু এসব বলতে গেল বেচারাকে? সবকিছু জেনেও আদ্রাফকে আবারও না চাইতে কষ্ট দিয়ে ফেলল।
-‘ জানো? এই দুইবছর ঢাকার পুরো আনাচে-কানাচে তোমায় খুঁজেছি কিন্তু পায়নি। আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম যে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। প্রতিদিন তুমি আমার কল্পনায় আসতে। আজকেও তোমাকে দেখার পর আমি মনে করেছিলাম এই দুইবছরের ন্যয় আজও এটা আমার ভ্রম, যেন ছুঁয়ে দিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবে।’
এই কথার জবাবে মুন আর কিছু বলল না।
—————————–
দুইমাস পর…
দিন চলে যায় নিজের মত করে। এখন সবকিছুই ঠিকঠাক। সেইদিনের পর থেকে মুনের সাথে আদ্রাফের সবকিছুই স্বাভাবিক। মুনও আদ্রাফকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আদ্রাফের সাথে এখন মিমের ফ্যামিলিরও ভালো রিলেশন। আদ্রাফের অফিসের আরেকটা শাখা রয়েছে চট্টগ্রামে। সে অফিসের কাজে চট্টগ্রামে আসলে মুন, মিমদের বাসায় আসে। সেইদিনের কথা আদ্রাফ আর ওর বাবা চট্টগ্রামে মিমের ফ্যামিলিতে মুনের ব্যাপারে বলেছে আর এতে আঙ্কেল, আন্টিও রাজী। উনারাও ভীষণ খুশি আর মিম তো বেজায় খুশি।
অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক মত হয়েই গেল মুন আর আদ্রাফের। এখন আর কোনো বাঁধা নেই।
বাসরঘরে বসে আছে মুন। এতদিন লজ্জা না লাগলেও তার এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে। আদ্রাফ এসেই মুনকে বলল, দু’জনে মিলে নফল নামাজ পড়ে নিতে। আর এদিকে মুন তো বেজায় রাগ। কই, মুন গোমটা দিয়ে বসে আছে, সিনেমার মত ঐটা তুলে বউকে দেখবে তা না করে উনি না দেখেই উঠে যেতে বলছে, হু। লাগবে না উনার দেখা, আমি রাগ করেছি ভীষণ। মুন মুখ ভার করে নামাজের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে চলে গেল ওযু বানাতে। আর আদ্রাফ মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার পানে।
নামাজ পড়ে উঠে আদ্রাফ রুমের বাইরে বের হয়ে গেল। মুনের এটা দেখে কান্না কান্না ভাব এসে গেল। বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে কতজনের কত আশা থাকে আর আদ্রাফ একটু সময়ও দিচ্ছে না। মুন আর কিছু না ভেবে ব্যালকনিতে চলে গেল, এখন সে কাঁদবে ভীষণ করে যে কেন আদ্রাফ ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলল না? তার ওপর নামাজ পড়েই রুম থেকে কেন বেরিয়ে গেল? আসুক ও, মুন আর কথা বলবে না আদ্রাফের সাথে । আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় চারদিকে সব স্পষ্ট।
মুন যখন ব্যালকনির গ্রিলে হাত রেখে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত তখনি ঠিক একজোড়া হাত তার গলায় কিছু একটা পড়িয়ে পাশেই সরে দাঁড়ালো । মুনের আর বুঝতে বাকি রইল না এটা কে? মুন মুখ ঘুরিয়ে ফেলল ঐদিক থেকে। সে ভীষণ রাগ করেছে আদ্রাফের উপর।
-‘আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর, মনে হচ্ছে যেন কারো সাথে অভিমান করেছে, একবার মেঘের আড়ালে চলে যায় তো আরেকবার বের হয়।’ আদ্রাফ বলে উঠলো।
মুন এই কথার জবাবে কিচ্ছু বলল না। মুখ ফিরিয়ে নিল।
-‘ কীভাবে এর অভিমান ভাঙা যায়, বলো তো মুনপাখি ?’আদ্রাফ আবারও বলে উঠলো।
-‘চাঁদকেই যখন সুন্দর বলছেন তখন উনার থেকেই জিজ্ঞেস করুন, আমাকে কেন?’
-‘ উহু, আমার পাশেই তো চাঁদ। তোমাকেই বলেছি, এই চাঁদকে তো প্রতিদিন দেখি কিন্তু আমার পাশের চাঁদটা সহ একসাথে তো এই প্রথম দেখছি দুইচাঁদ একসাথে।’
-‘সরেন এখান থেকে। কথা বদলাবেন না।’মুন মুখ ভার করে বলে উঠলো।
আদ্রাফ মুচকি হেসে মুনের গলার দিকে এগিয়ে আসতেই মুন চোখ-মুখ কিচে বন্ধ করে পিছন দিকে সরে গিয়ে কাঁপা কাঁপাভাবে বলে উঠলো,’আ আআমি এখনো প্রস্তুত না।’
অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো কিছুর আবাস না পাওয়াতে মুন এক চোখ খুলেই দেখতে পেলো আদ্রাফের হতভম্ব মুখটা। এরপর পরই আদ্রাফ উচ্চস্বরে হো হো করে পেট চেপে ধরে হেসে উঠলো।
মুন তো হতবাক। এখানে হাসির কী বলল সে। পরক্ষনে নিজের বলা কথাটা ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সে।
-‘সিরিয়াসলি মুনপাখি! আমি তোমার গলার ধারে কাছে যেতেও এখন তোমার প্রস্তুতি লাগবে।’ আদ্রাফ ওই অবস্থায় মুখে হাসি চেপে ধরে বলে উঠলো।
মুন তো বেক্কল বনে গেল।
-‘এই দেখো, তোমার গলাতে আমি এখানে এসেই এটা পড়িয়ে দিয়েছিলাম আর নামাজ পড়ে বাইরে বাবার রুমে এটার জন্যই গিয়েছিলাম। ওইদিন ভুলে ওখানে ফেলে এসেছিলাম।’
মুন নিজের গলার রকেটটা নিয়েই দেখল একটা লাভ এর ভিতর চাঁদ লেখা কোদায় করা। অসম্ভব সুন্দর রকেটটা। তার মানে কী আদ্রাফ মুন অর্থ চাঁদ বুঝাতে চেয়েছিল?
-‘পছন্দ হয়েছে চাঁদ?’ আদ্রাফ হাসিমুখেই বলে উঠলো।
-‘হ্যাঁ, ভীষণ।’
এভাবেই হাসি-খুশিভাবে তাঁদের প্রথম রাতটা কেটে গেল। সেদিনের পর থেকে সব কিছুই আরও সুন্দর ভাবে চলতে লাগলো। শুধু একটা জিনিসে মুনের ভীষণ রাগ কারণ আদ্রাফ আজ পর্যন্ত তাঁকে ভালোবাসি কথাটা একবারও বলেনি। হয়তো বা মনের কোথাও এখনো অতীতের বিশ্বাস ভাঙাটা রয়ে গিয়েছে, এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি।আদ্রাফের অফিস থেকে আসার সময় মুনের জন্য চকলেট, বেলি ফুল আনা আর মুনের কেয়ার, ভালোবাসা দিয়ে পরিবারটাকে আরও বেশি আগলে নিয়েছিল। এরপর খুশিটা আরও বেশি বেড়ে গেল যখন শুনলো মুন মা হতে চলেছে। আদ্রাফ তো সেই খুশি। এভাবেই আটমাস চলে গেল। এরপর আদ্রাফ আর টাইম পায়নি কাজের চাপে তাই মুনের আটমাস চলাকালীনই প্ল্যান করল লং-জার্নি দিবে কারণ মুন নিস্তব্ধ রাতের জার্নি বেশি পছন্দ করে। ওইদিন অফিস থেকে এসেই দু’জনে পুরো রাত গাড়ি করে ঘুরবে এই বলে গেল আদ্রাফ।
অফিস থেকে এসেই দেখল মুন রেডি। আয়নার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রাফ এসেই মুনের দিকে চেয়ে থমকে গেল, মুনকে প্রথমদিনের মতোই সুন্দর লাগছে।
-‘কী দেখো চাঁদ?’ আদ্রাফ বলল।
-‘ এই দেখেন না, কেমন লাগছে আমাকে। পোলা পেট, আগে থেকে মুটুও হয়ে গিয়েছি ভীষণ। ‘ মুন ইনোসেন্ট ফেস করে কান্না কান্না মুখ করে বলে উঠলো।
-‘ একদম না। তোমাকে তো একদম পরীর মত লাগছে।’আদ্রাফ আয়নায় মুনের পিছনে গিয়েই বলে উঠল।
মুন আয়না দিয়ে আদ্রাফের দিকেই তাকিয়ে বলে উঠলো,’তাহলে ভালোবাসি বলেন না কেন?’
আদ্রাফ কিছু না বলেই মুনকেসহ বের হতে বলে বেরিয়ে গেল। আদ্রাফের ভালোবাসি বলতে কোথাও একটা যেন বাধে নাহলে ও প্রচুর দেখতে পারে মুনকে। মুনও উঠে আদ্রাফের পাশের সিটে উঠলে আদ্রাফ গাড়ি ছেড়ে দিল।
কিন্তু কে জানে? আজকের রাতটাই ওদের সবকিছু এক নিমিষেই চুরমার করে দিবে। দেখা যাক কী হয়?
#চলবে ইনশাআল্লাহ