#তুমিই_আমার_পূর্ণতা,পর্ব ৩
#মেহরাফ_মুন (ছদ্মনাম )
পরদিন যতাক্রমে মুন রেজিগনেশন লেটার নিয়ে অফিসে হাজির। এর মধ্যেই ও যা ভাবার ভেবে নিয়েছে।ওর টাকার প্রয়োজন ছিল তবে এভাবে নয়।
অফিসে ঢুকেই জানতে পারলাম আজকে ফারহান আদ্রাফ স্যার কয়েকদিন আসবে না, অফিসের কিছু কাজে বাইরে গিয়েছেন আজ সকালে-ই । আর আমারও ভালো এতে। এর ভেতরই যা করার করতে হবে আমার। আমি ম্যানেজার আঙ্কেলের হাতে লেটারটা দিলাম। আঙ্কেল অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকল। বোধহয় মুনকে এখনো বুঝতে পারেনি।
-‘ ভালো থাকবেন আঙ্কেল। এতদিন মেয়ের মত করে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন এটার ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।’
-‘কিন্তু মা এভাবে হুট করে এমন সিদ্ধান্ত! তোমার তো চাকরিটার ভীষণ প্রয়োজন।’
-‘দরকার হলে খেটে-ই খাব। মানুষের বাসায় কাজ করে খাব, তবুও নিজের সম্মান নিয়ে কথা বলতে দিব না কাওকে।জানেন আঙ্কেল আমি ছোটকাল থেকেই অনাথ। কোনোদিন বাবা-মা কী জিনিস, এর মর্ম বুঝিনি। তাই তো কেউ একটু মা বলে কথা বললেই বাবার অনুভূতি আসত আমার। আপনাকেও আমি বাবার মতোই ভাবি। সবসময় মনে রাখব আপনাকে।আর একটা অনুরোধ আঙ্কেল, স্যার এই কয়দিন অফিসের খবর নিলে আমি চলে যাওয়ার কথাটা বলিয়েন না, উনি যেদিন অফিসে আসবে ওইদিন-ই বলিয়েন।আসি আঙ্কেল, ভালো থাকবেন।’
ম্যানেজার ছলছল চোখে মুনের যাওয়া দেখে থাকল। কিছুই বলতে পারল না। আজ-কালকার ছেলে-মেয়েরা তো বাবার ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল, প্রতিদিন তাঁদের টাকা চায়, বন্ধুদের সাথে আজ এখানে যাবে কাল ওখানে যাবে, বাবার টাকা দিয়েই সব ফুর্তি করবে । এত ছেলেমেয়েদের ভীড়ে মুনের মত এমন মেয়ে পাওয়া আজকাল ভাগ্যের ব্যাপার।
————————–
আমি রুমে এসেই মিমের পাশে বসলাম। মিম ওর ব্যাগ গোছানোর পাশাপাশি আমারটাও গুছিয়ে রেখেছে। সত্যিই এই মেয়েটা না থাকলে আমার যে কী হতো!আমি ভাগ্যবতী এমন একটা মেয়েকে পেয়ে। কাল রাতেই মিম পুরোপুরি ভেবে আমাকে বলেছিল ওর সাথে চট্টগ্রাম চলে যেতে। কারণ এখানে থাকলেই যেকোনভাবে আমি আদ্রাফের মুখোমুখি পড়ব-ই। তবুও মনের ভেতর কিছু কচকচানি রয়ে গেছিল। মিম আমাকে অন্যমনস্ক দেখেই বলে উঠেছিল,
-‘মুনপাখি শোন, আমার টিউশনে আমি তোর কথাগুলো শুনে দুপুরেই ছাত্রীর মায়ের কাছে কল করেছিলাম। বলেছি আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি একেবারের জন্য। তখনই উনি আমাকে বিকালে যেতে বলেছিল উনার বাসায়, তুই ঘুম ছিলি তাই আর ডাকিনি। আগের মাসের টাকাগুলো উনি যেকোনো কারণে দিতে পারেনি আর এই মাসের টাকাসহ এখন মোট ২-মাসের টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আর জানিস-ই তো এই টিউশনগুলো আমি শখের বশেই করতাম। আমার খরচ তো আমার বাবাই পাঠিয়ে দেয়। কালকে যাওয়ার সময় আমি তোর হোস্টেল ভাড়া দিয়ে দিব। আর বাবা-মাকে কল করে বলেছি আমি তোর কথা। উনারা সব শুনে বলেছে তোকেসহ আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ঢাকা-শহরে না কি তোকে কে দেখবে, একা একটা মেয়ে। এবার সব ক্লিয়ার মুনপাখি তোর?আর কোনো প্রশ্ন আছে তোর? এবার হাস একটু। মুখটাকে এমন হুতুমপেঁচার মত কেন করে রাখছিস? তুই জানিস, তোকে হাসলে কী স্নিগ্ধময়ী, মায়াবতী লাগে?’
–
–
হটাৎ মিমের ধাক্কায় নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
-‘কিরে মুন, কই হারিয়ে গেছিলি? এতক্ষন ধরে ডাকছি তোকে। তোর কোনো খবর-ই নেই। কী এত ভাবিস?’
-‘ভাবছি, তুই না থাকলে আমার যে কী হতো? হয়তো বা আমার কোনো অস্তিত্ব-ই থাকত না। এই মুন এতদিনে শেষ হয়ে যেত।তোর মত বোনের মত বান্দবী পেয়ে আমি ভাগ্যবতী রে।’
-‘আরে দূর পাগলী।তুই জানিস? তোর চেয়ে আমি বেশি ভাগ্যবতী তোকে পেয়ে। জানিস?আমার লাইফে তুই আসার আগে বাবা আমার জন্য পুরো মাসের টাকা একসাথে পাঠায় দিত কিন্তু আমি সেগুলো বন্ধুদের সাথে এখানে-ওখানে গিয়েছিলাম ৫দিনেই শেষ করে ফেলতাম তারপর আবার টাকার কথা বলতাম আর বাবাও একটা মাত্র মেয়ে হিসেবে যখন তখন টাকা দিয়ে দিতো। এই নিয়ে মায়ের রাগের শেষ ছিল না কারণ মেয়ে যখন যেটা খুঁজে তখন দিলে না কি বেশি অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে, বাবাও আমাকে অনেক বোঝাত কিন্তু কথাগুলো আমি কানে তুলতাম না। তুই আমার পাশে আসার পর আমি আস্তে আস্তে চেঞ্জ হতে শুরু করেছিলাম কারণ তোকে দেখতাম সবসময় কোনো কাজ থেকে টাকা পেলেই ওগুলো কোন কোন কাজে লাগাবি তা আগে থেকেই হিসাব করে রাখতি। বাড়তি টাকা কোথাও খরচই করতি না। তখন বুঝলাম ‘জীবন একেকজনের জন্য একেকরকম’। আমরা একই বয়সের হয়েও ২জন দুই-মেরুর। তুই কত পরিশ্রম করিস আর আমি বাপের টাকা উড়ায় বন্ধুদের সাথে।এরপর আমিও তোর দেখাদেখি টিউশন নিলাম। বাবা থেকে বাড়তি টাকা আর নিতাম না। বন্ধুদের সাথে এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা ছেড়ে দিয়েছি, গেলেও হিসাব করে। বাবা-মাও আমার চেঞ্জ এর কারণ ধরতে পারেনি। কাল রাতেই বললাম তোর কথা। এইদিক দিয়ে কিন্তু আমি তোর চাইতে ভাগ্যবতী, মুন।’
আমি একটা মুচকি হাসলাম। সত্যিই জীবন একেকজনের জন্য একেকরকম।একেকজন একেকভাবে জীবনটাকে উপভোগ করে।
-‘মুন শোন, আমরা কিন্তু একই ভার্সিটিতে ট্রাই করব অনার্সে। বুঝছিস? তুই টেনশন করিস না, আমি বাবাকে বলে রেখেছি। এখন শুধু যাওয়ার পালা।’
আমি মিমের দিকে আবারো তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলাম। এই মেয়েটা আমাকে নিয়ে এত ভাবে কেন!আল্লাহ’র কাছে হাজারো শুকরিয়া আমি মিমকে পেয়ে।
-‘আচ্ছা মিম, আমাদের টিকেটের কী খবর? কয়টার?’
-‘আরে এসবের জন্য আমি আছি, তোর এক্সট্রা টেনশনের দরকার নেই। আর টিকেট নিয়ে ফেলেছি রাত ১১টার।’
—————————–
হোস্টেলের সব ভাড়া পরিশোধ করে সবাইকে বিদায় দিয়ে ব্যাগ নিয়ে আমি আর মিম বেরিয়ে গেলাম হোস্টেল থেকে ৯:৩০ টাই। রিকশা করে স্টেশনে যেতে আধ-ঘন্টার মত লাগবে। আর হাতে ১ঘন্টা থাকবে। মিমের মতে আগে-বাগে গিয়ে বসে থাকাই ভালো।
যেতে যেতেই দেখে নিচ্ছি প্রিয় শহরটাকে। যেই শহরে ছোটকাল থেকেই সব স্মৃতি। এই শহরটাকে ছেড়ে থাকতে পারবো তো? ফারহান আদ্রাফ আপনাকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। আপনার জন্যই আজ আমি প্রিয় শহরটা ছেড়ে যাচ্ছি। ভালোই তো ছিলাম এতদিন।
–
–
-কিছুক্ষন হলো বাসে বসলাম। প্রায় যাত্রীরা নিজের আসন বাছায় করে বসে পড়ল। আস্তে আস্তে সব সিট্ সম্পূর্ণ হলো। বাসও নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাল।
আমি জানালা দিয়ে শেষবারের মত প্রিয় শহরটা দেখে নিলাম। কত স্মৃতি এই শহরে। বাস যতই এগোচ্ছে ততই মনে হচ্ছে নিজের সবচেয়ে আপন কিছু হারিয়ে ফেলছি। নিজেরই অজান্তে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমার জীবনটা এমন কেন হলো!
বাকি জার্নিটা এভাবে করতে পারব না কারণ আমার বাসে এভাবে লং-জার্নির অভ্যাস নেই আর ফার্স্ট থেকেই সিটে ঘুমানোর তেমন অভ্যাসও নেই। পাশেই মিম কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনছে। আমি জানি আর আধঘন্টা পর ও ঘুমিয়ে পড়বে গান শুনতে শুনতে। এরপর ওকে পাওয়াই যাবে না।
ব্যাগ থেকে একটা গল্পের বই বের করলাম। ঐটা দিয়েই আপাতত এই লং জার্নির বিরক্তি কিছুটা হলেও গুছবে।
——————————-
চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সকাল হয়ে আসে।বাস স্টেশনে ওদের নিতে এসেছেন মিমের বাবা। মিম বাস থেকে নামার সাথে সাথেই বাবাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।আর ওর বাবাও এতদিন পর নিজের আদরের দুলালীকে দেখে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে এটি একটি।
‘মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর বাবা মেয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়।’
আমারও বাবা থাকলে এমন একটি সুন্দর মুহুর্ত হতো।আপসোস! আমার কেউই নেই এই দুনিয়ায়। না, ভুল বললাম, মিম আছে আমার, ও আছে বলেই আজ আমি আরেকটা নতুন জীবনের স্বাদ পেলাম।আবারও সুন্দর করে পথ চলার সুযোগ পেলাম।
-‘কিরে, মা? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? আসো এখানে।’
আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম আঙ্কেলের সামনে।
-‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?’
-‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো মা। তুমি কেমন আছো, মা। মিম থেকে তোমার কথা অনেক শুনেছি।’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আঙ্কেল।’
এবার চলো।বেশি দেরি করলে মিমের মা আমার আস্ত রাখবে না, অনেকদিন পর তাঁর মেয়েকে নাকি দেখবে। মিম, মুন চলে আসো গাড়িতে। আমরা ২জনেই বাসার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠে পড়লাম।
আরেকটা নতুন সকালের সূচনা হলো চট্টগ্রামে।মুন কী পারবে তাঁর জীবনে এগিয়ে যেতে ? যার থেকে এত পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাঁর থেকেই বাঁচতে? ফারহান আদ্রাফই যখন জানতে পারবে মুন আর ওই শহরে নেই, তখন ওর অবস্থায় বা কেমন হবে? না কি ভুলে যাবে মুনকে না কি ভুলতে পারবে না?
#চলবে ইনশাআল্লাহ।