#তুমিই আমার পূর্ণতা,পর্ব ১
#মেহরাফ_মুন (ছদ্মনাম )
‘আপনাকে সেরোগেসির মাধ্যমে আমাদের অফিসের ফারহান আদ্রাফ স্যারের বাচ্চার মা হতে হবে।৯মাস পর উনার বাচ্চা উনি নিয়ে যাবে,বিনিময়ে ২০লাখ দেওয়া হবে আপনাকে।’ বলল ম্যানেজার।
মুন হতভম্ব। অফিসে এসেই এমন কিছু শুনতে হবে তা ও ভাবতেই পারছে না।কী বলছে এটা ম্যানেজার সাহেব। আর স্যার? উনিও বা কেমন? এতদিন এই অফিসে কাজ করে তো এমন মনে হয়নি বসকে।উনি যথেষ্ট ভালো একটা মানুষ। যথেষ্ট সুদর্শনও বটে। আর উনার বাচ্চার প্রয়োজন হলে বিয়েও তো করতে পারে, শুধু শুধু আমাকে কেন টানছে এর ভিতর! হ্যাঁ আমি এতিম, টাকার প্রয়োজন। তাই বলে এভাবে টাকার লোভী তো নাহ। এমন প্রস্তাব দেওয়ার মানে টা কী। মুন দাঁড়িয়ে থাকার ব্যালেন্সটা ঠিক রাখতে পারল না, পড়ে যেতে নিলেই ম্যানেজার ধরে ফেলে।
আমি ঠিক থাকতে পারছি না এইটা শুনে। ম্যানেজারকে আমি বাবার মত দেখতাম। আর উনিও আমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। আর আজ এই বিশ্বাসটা উনি ভেঙে দিয়েছেন। এতদিন যে সম্মানের সাথে বসকে দেখতাম সেই বসের প্রতি একরাশ ঘৃণা এসে জমল সাথে ম্যানেজারের প্রতিও।আমি নিজেকে যতাসম্ভব শান্ত রেখে ম্যানেজারকে বললাম,
-‘এসবের মানে কী?’
-‘আমি তোমাকে আমার মেয়ের মতোই ভালোবাসি মা। আর তোমাদের বসকেও নিজের ছেলের মত ভালোবাসি। ওকে ছোট থেকেই দেখে আসছি, অনেক রাগী আর বদমেজাজি। যেটা করবে বলবে ঐটা যেমন করেই হোক করেই ছাড়বে। আর যথেষ্ট ভদ্রও। নিঃস্বন্দেহে ও অনেক বুদ্ধিমানও। অফিসের অনেক শত্রুকে কীভাবে এক হাতে হ্যান্ডেল করত।সবাইকে শ্রদ্ধাও করে অনেক।কিন্তু ওর হটাৎ এই সিদ্ধান্তকে আমি মানতে পারছি না। এটা অন্যায়। ও আমার কোনো কথাই ফেলে না কিন্তু এই কথাটার কোনো প্রতিত্তুর আমি করতে পারছি না, সেই সাধ্য যে আমার নেই, মা। তোমার ডিটেলস সব অফিসে আছে। তোমার টাকার দরকার আর ওর বাচ্চার দরকার ।আমি বলব কী রাজী হয়ে যাওয়াই ভালো।এবার বাকিটা তোমার ইচ্ছে, মা ।’ বলল ম্যানেজার আঙ্কেল।
আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল।
আমি সাথে সাথেই বেরিয়ে আসলাম ওই অফিস থেকে। করব না আর চাকরি। কালই রেজিগিনেশন লেটার দিয়ে চলে আসব ওই অফিস থেকে।
রাস্তা দিয়ে হাটছি আর ভাবছি এসব। কিন্তু এই চাকরিটা যে আমার একমাত্র সম্বল ছিল। এত কম পড়ায় কেউই চাকরি দেয় না, এই একটা মাত্রই এত বড়ো অফিসে চাকরিটা ফেলাম। কী ভেবে দিয়েছে এটাও জানি না। ওই অফিসে সব উচ্চশিক্ষিত লোক তা উনাদের কথার ধরণেই বোঝা যায়। আমাকে দিয়েছিল প্রিন্টারের কাজ, কারণ এই একটা কাজই তুলনামূলক সহজ ছিল আর তেমন পড়া নিয়েও না।
তবুও সন্তুষ্ট ছিলাম এই চাকরি নিয়ে কিন্তু এখন কীভাবে চলব আমি!
ফারহান আদ্রাফ আমার অফিসের স্যার। দেখতে-শুনতে ভীষণ ভালো।সুদর্শনও বটে,সবার সাথেই ভালো আচরণ করেন।বয়স ছাব্বিশ-সাতাশই হবে। উনার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাবার অফিসেই বসেছিলেন পড়ালেখার পাশাপাশি। সেই থেকেই এত বড়ো বিসনেসটা উনিই সামলিয়েছেন।আস্তে আস্তে এই চারবছরে অনেক বড়োও করে ফেলেছেন এই বিসনেসটা। অনেক বুদ্ধিমানও বটে।এই চারবছরে উনাকে যারাই দেখে আসছেন উনারাই বলে
খারাপ কোনো কিছুর রেকর্ড নেই উনার চরিত্রে।কিন্তু
আজকে এটা কী হলো। উনি বিয়ে করবে বললেই অনেক মেয়ে হাজির হবে তা অফিসের মেয়েদের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম। তবে শুনেছি উনি মেয়ে জাতিকে বিস্বাস করেন না কোনো এক কারণে ছোট থেকেই, এমনকি ঘৃণাও করে অনেক। কিন্তু তাই বলে আমার জীবন কেন জড়াতে চাচ্ছেন উনি।
আমি মুন। আমার বাবা-মা কে এটাও জানি না। আমি বড়ো হয়েছি অনাথআশ্রমে। ওখান থেকেই ইন্টার পর্যন্ত পড়তে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবে ওখানের নিয়ম অনুসারে আটারো বছর পার হওয়ার পর আমারও বের হয়ে যেতে হলো। চারমাস আগেই আমার আটারো বছর পূরণ হয়েছিল। ওখান থেকে বেরিয়েই কই যাব ভাবতে ভাবতে মেয়েদের একটা ম্যাচে উঠেছিলাম। ম্যাচে উঠার আগে কিছু অগ্রিম টাকা দিতে হয়, কিন্তু আমার ওই অল্প টাকাটাও ছিল না। অনেক কষ্ট করে ম্যাচে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। বলেছিলাম আমাকে ১ মাস সময় দেওয়ার জন্য।তারপর লেগে গেলাম টিউশন অথবা যেকোনো ধরণের চাকরির খোঁজে। কিন্তু এই শহরে টিচারের অভাব নেই, তাই এত অল্প পড়াতে টিউশন পাচ্ছিলাম না। অনেক খোঁজার পর ম্যাচের আমার পাশের ব্যাডের মিম এই চাকরিটার খোঁজ দিয়েছিল।
এদিকে ম্যাচের অনেক টাকা বাকি রয়ে গেছিল। শেষবারের মত উনি আমাকে ১মাসের টাইম দিয়েছিল। আবার এদিকে অ্যাডমিশন টেস্ট আর অনার্স এ ভর্তির তারিখের শেষতারিখ চলে আসছে। আর এদিকে আমি টাকা জোগাড় করতে পারলাম না এখনো। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। কিন্ত এখন এই চাকরিটাও যদি ছেড়ে দিতে হয় কই যাব আমি। এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসলো, পেট গুলিয়ে আসছে, সকালে তেমন কিছুই পড়েনি পেটে খুশিতে। কারণ আজকে চাকরির ১মাস পূর্ণ হয়েছে আর বেতন দেওয়ার দিন ছিল। এই বেতন দিয়ে অনেক কিছু করব ভেবে রেখেছিলাম আর কী কী করব এটার হিসাবও করে রেখেছিলাম। কিন্তু অফিসে গিয়েই এমন একটা কথা শুনতে হবে কোনোদিন ভাবতে পারিনি।একসময় মাথাটাই ঘুরিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি সেন্সলেস হয়ে পড়ছিলাম।একসময় রাস্তার পাশেই লুটিয়ে পড়লাম।
———————–
অন্যদিকে ফারহান আদ্রাফ গাড়ি নিয়েই বের হয়ে গিয়েছেন অফিস থেকে মুন বের হওয়ার সাথে সাথেই।ও উপরের তলার কাছের জানালা দিয়েই দেখেছিল মুনের তাড়াহুড়ো করে বের হওয়াটা। মুনকে ফলো করার জন্যই ড্রাইভিং আস্তে করছে ও।
ফুটফাট দিয়ে হাঁটা মুনকে অন্যমনস্ক লাগছে, হয়তো কিছুক্ষন আগের বিষয়টা নিয়েই ভাবছে ও । কিন্তু ও জানে শেষপর্যন্ত মুন রাজী হবেই এই শর্ত দিয়ে না হলেও অন্য আরেকটা শর্ত দিয়েই।কারণ ওর এখন টাকার ভীষণ দরকার। ড্রাইভিং করার ফাঁকে ভাবছে, মেয়েজাতিকে ও বিশ্বাস করতে পারবে না কোনোদিন। নাহলে মুনকে ও নিজের জীবনের সাথে একেবারেই আবদ্ধ করে ফেলত। ওর যে ছোটকাল থেকেই একটা ঘটনার জন্য মেয়েজাতির উপরে সব বিশ্বাস টুনকো হয়ে গিয়েছে।এইভাবে ওর যে মন মানে না, কিন্তু মন না মানলেও করতে যে হবেই। যে সম্পর্কে শুরুতেই কোনো বিশ্বাস থাকবে না সেই সম্পর্ক কিভাবে পূর্ণতা পাবে? এই বাচ্চাটার ভেতরেই ও মুনের অস্তিত্ব দেখবে।এসব ভাবতে ভাবতেই একসময় খেয়াল করল মুন ফুটফাতেই লুটিয়ে পড়েছে। দ্রুতভেগে গাড়িটা চালিয়ে মুনের পাশে যেতেই দেখল মুন সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।ততক্ষনে মানুষ ঘিরে ধরেছে ওকে। কয়েকজন পানি ছিটাও দিচ্ছে, কিন্তু মুনের কোনো সাড়া নেই। ফারহান দ্রুতভেগে ওখানে গিয়ে মানুষকে সরিয়ে দিয়ে মুনকে কোলে নিতে গেলেই কয়েকজন আটকে দেয়।
ওরা বলে,
-‘আপনি কেডা ? এভাবে হুটহাট একটা মেয়ে মানুষকে কোলে-ই বা ক্যান নিতাছেন?’
আদ্রাফ জানে এদের সাথে কথায় লাগলেই আর ছুটতে পারবে না। মুখ ফসকেই ওর জবাব বের হলো,
-‘অতি কাছের একজন।’
এটা বলেই ও মুনকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। ওই লোকগুলোও আর কিছু বলল না।
আদ্রাফ গাড়িতে উঠেই ওর ড্রাইভিং সিটের পাশে মুনকে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আর অন্যহাতে মোবাইল নিয়ে প্রথমেই ওর কাছের বন্ধু শুভ্রকে কল দিল। শুভ্র কল ধরতেই আদ্রাফ বলল,
-‘কই তুই?হাসপাতালে আছিস?’
ঐদিক থেকে শুভ্র ‘হ্যাঁ’ বলতেই আদ্রাফ কল কেটে দিল। তাঁর এখন অন্যকোনোদিকেই খেয়াল নেই, তাঁর একমাত্র খেয়াল মুনের দিকেই। মোবাইল রেখেই মুনের মাথা নিজের এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে ড্রাইভিং করতে লাগল। তাঁর এখন দ্রুতই পোঁছাতে হবে।
হাসপাতালে পৌঁছার পর গাড়ি থেকে নেমেই মুনকে কোলে নিয়েই ওর বন্ধু শুভ্র এর ক্যাবিনের সামনে গিয়েই কল দিল। সব মানুষ তাকিয়ে আছে কিন্ত আদ্রাফের সেদিকে খেয়াল নেই।
শুভ্র ক্যাবিন থেকে বের হয়েই বন্ধুর কোলে মেয়ে দেখেই অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেল। এটা কীভাবে সম্ভব? আদ্রাফের কোলে মেয়ে!যে ছেলে মেয়ে জাতিকে সয্যও করতে পারে না সেই ছেলের কোলে মেয়ে! শুভ্র আদ্রাফের কাছে এসেই বলার জন্য মুখ খুলল,’আরে দোস্ত, এটা কী দেখ….’
কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আদ্রাফের গম্ভীর মুখোশ্রী দেখে চুপ হয়ে গেল। তাঁর এতক্ষন হুসই ছিল না রোগীকে দেখার বন্ধুর কথা ভাবতে গিয়ে।
তাঁর আগে মেয়েটাকে দেখেই তাঁর মুখ অটোমেটিকলি ‘হা’ হয়ে গেল। এই মেয়ে এখানে কীভাবে? তাঁর ওপর আদ্রাফেরই কোলে।
#চলবে কী?