তরঙ্গিনী (পর্ব-৯) #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৯)

#আরশিয়া_জান্নাত

রান্না নিয়ে আমার একটু বিড়ম্বনা আছে, এমনিতে খারাপ রান্না করিনা। তবে এভাবে একদম একা রান্না করা হয়নি কখনো। তাই অনেকটা ভয়ই লাগছে। পাবদা মাছের দোপেয়াজা, আলু দিয়ে মুরগির মাংস, ডিম ভুনা আর চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ। অনেক সাবধানে এ সব রান্না করে আরাফকে খেতে ডাকলাম। তিনি এসে বললেন, বাহ আমার বৌ দেখি একাই একশো।
আমি তার প্লেটে ভাত তরকারী দিয়ে বললাম, আগে খেয়ে দেখুন সব ঠিকঠাক আছে কি না।

আরাফ বেশ আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলো, আমি তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছি।

হঠাৎ আরাফ চিৎকার করে বলল, ইয়া আল্লাহ!

আমি ভীষণ চমকে গেলাম, সে উপরের দিকে তাকিয়েই বলতে লাগলো, আমি বেঁচে গেছি আল্লাহ। তোমার দরবারে লাখ লাখ শোকর। আমাকে এই ছয়মাস অনাহারে থাকতে হবে না। আমার বৌ অসাধারণ রান্না করে। আল্লাহ তুমি উনার রান্নার পারদর্শিতা এমনি করে বজায় রাখো,আমিন।

আমি হতভম্ব হয়ে খানিকক্ষণ সময় নিলাম, ফাজলামিটা বুঝতে পেরে বললাম, আপনি এতো নাটকবাজ! আমার তো কলিজায় পানি ছিল না। এমনভাবে ইয়া আল্লাহ বলে চিৎকার করেছেন। উফফ বুকটা এখনো ধকধক করছে।

আরাফ হোহো করে হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, আপনি আসলেই খুব ভালো রেধেছেন, আর এমন রিয়েকশন না দিলে আমাকে প্রথমবার রান্না করে খাওয়ানোর স্মৃতি নাতি নাতনীদের বলতে বলতে হাসতে পারতেন?
আমি চাই যখন আমি থাকবো না তখনো আপনি আমার কথা ভেবে আনন্দিত হন। খিলখিল করে হেসে উঠেন যখন তখন।

আমি মাথা নীচু করে বললাম, এমন কথা না বললে কি হয় না? আপনিই তো বলেন আমাদের দীর্ঘদিনের সফর, তবে থাকবো না মানে কি?

এ না থাকা খুব স্বল্প সময়ের বিচ্ছেদ হবে, আমার আমানত আমার কাছেই ফিরে আসবে।

আপনি প্লিজ এসব কথা রাখুন, আমাদের পথচলা সবে শুরু হলো। এখুনি ওসব ভাবতে হবে না।

রেবা!

জ্বি

আপনি কি জানেন আপনার মন অনেক নরম? এজন্যই আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
বলেছিলাম না এক প্লেটে খাবো, আসুন শুরু করুন।

আমি খানিকটা অস্বস্তিতেই তার সঙ্গে খেতে শুরু করি, সে খুব যত্ন করে আমায় কাটা বেছে দিলো, মাংসের হাড় ছাড়িয়ে দিল। মাঝেমধ্যে গালে লোকমা তুলে দিল। সাথে টুকটাক কত গল্প। আমি তার প্রতিটা স্টেপ খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করলাম। মানুষটাকে যত দেখি ততোই অবাক হই। একটা মানুষ এতো ফ্রেন্ডলী হয় কিভাবে? এতো যত্ন, এতো আপনবোধ। কত সাবলীলভাবে আমার সঙ্গে এডজাস্ট করে‌ নিচ্ছে। উনার জায়গায় অন্য কেউ হলে কি এতো ধৈর্য ধরতে পারতো? অধিকারের খাতিরে হোক কিংবা জৈবিক চাহিদায় কখনোই মানুষটা আসেনি। আমাকে সময় দিয়েছে তাকে বোঝার, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা তার কাছে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। আমি আজীবন তার দাসী হয়ে থাকলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞতার শোধ হবেনা। মানুষটাকে আমি সম্মান তো করিই, এখন মনের মাঝে নতুন একটা অনুভূতিও বেড়ে উঠছে হয়তো,

আচ্ছা আরাফ সাহেব কি টের পাচ্ছেন আমি তার প্রতি মুগ্ধ হচ্ছি?

আরাফ অফিসের কাজে বের হবার পর আমি বাগানবাড়ির চারপাশটা দেখতে বের হই। এক পাশে নানারকম শাক সবজির বাগান, অপরপাশে ফলের বাগান,বেশিরভাগই আম আর লিচুর। গেটের শুরুতে সব ফুলের গাছ। বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছেন আমার দাদী শাশুড়ি। রহিম চাচার কাছে শুনেছি দাদীজান অনেক শখ করে এখানে বাড়ি করেছেন, বড় গাছগুলি সব তার হাতেই রোপণ করা।

বৌমা ডাবের পানি খাবেন? এই গাছের ডাবের পানি অনেক মিষ্টি, পাড়তে বলি?

আচ্ছা।

রহিম চাচা লোক এনে ডাব পাড়ালেন। আমি খেয়ে দেখি আসলেই অনেক মজা। পুকুরঘাটে বসে ডাব খাচ্ছিলাম তখন একটা অল্পবয়সী মেয়ে এসে আমার কদমবুসি করলো। আমি তাকে আটকে বললাম, করো কি! পা ছুঁতে নেই।

ভাবীসাহেবা আমি লতা। আমার বড় চাচা এখানে কাজ করে। চাচা বলছে আপনি যতদিন আছেন আপনার সাথে সাথে থাকতে।

তুমি রহিম চাচার ভাতিজি?

হুম

পড়াশোনা করো?

হ্যাঁ। ক্লাস এইটে পড়ি।

আচ্ছা! ভালোই হলো আমার একটা সঙ্গী হলো। বসো ডাব খাও।

অনেক জোরাজুরির পর লতা ডাব নিলো। রাতে আরাফ আসার আগ পর্যন্ত ও আমার সাথেই ছিল। দিনটা মন্দ কাটে নি।
🌸🌸🌸🌸🌸

হ্যালো ভাবী কেমন আছ?

ভালো আছি তোমরা কেমন আছ?

ভালোই তবে তোমাদের খুব মিস করছি, রুহি তো দিনে একশো বার তোমার কথা বলে।

আমিও তোমাদের মিস করছি। রুহি কি সাথেই?

ভাবী আমি এখানেই আছি, ফোন লাউড স্পিকার করা। (রুহি)

ওহ! মা বাবা ভালো আছেন?

হুম ভালো। আচ্ছা ভাবী বাগানবাড়ি ভালো লেগেছে?

অনেক সুন্দর এটা, তোমাদের এক্সাম শেষ হলে চলে এসো। আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডা দিবো। অনেক মজা হবে।

আমিও তাই ভাবছি, এবার শীতে আমরা সবাই যাবো।

আচ্ছা।

জানো ভাবী জিহাদ ভাইয়া এসেছে। তোমাকে ছবি দেখিয়েছিলাম না? সেজ চাচার ছেলে?

ওহ হ্যাঁ ও যে ইন্ডিয়ায় পড়ছে, হঠাৎ এখন এলো যে? ছুটি হলো নাকি?

আমরাও তো অবাক বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এলো।

বলেনি কিছু?

নাহ, গতকাল ভোরে এসেই যে রুমে গেছে আর বের হয় নি। কি হলো কে জানে। সবাই তো টেনশনে পড়ে গেছে।

চিন্তা করো না। হয়তো একটু রেস্ট নিচ্ছে।

হুম হতে পারে। কি হয়েছে জানলে তোমায় জানাবো। আচ্ছা ভাবী রাখি পরে কথা হবে।

আচ্ছা সাবধানে থেকো। আল্লাহ হাফেজ।

আমি ফোনটা রেখে ভাবনায় পড়ে গেলাম। যতদূর জানি জিহাদ বছরে একবার আসে, হঠাৎ অফ সীজনে কেন এলো, কোনো সমস্যা নয় তো?

আরাফ তুড়ি বাজিয়ে বলল, চোখ মেলে ঘুমাচ্ছেন নাকি ঘুমের রাণী?

সবসময় ঘুমাই নাকি আমি?

নাহ সবসময় ঘুমান না, তবে যখন ঘুমান দুনিয়ায় আর থাকেন না। তা কি ভাবছিলেন?

আমি তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে টেবিলে রাখলাম। তার জন্য টাওয়েল আর টিশার্ট বের করে বললাম, পিহু কল করেছিল। ওদের কথাই ভাবছিলাম।

ওহ আচ্ছা!

কথা হয়েছিল মায়ের সাথে?

হ্যাঁ রোজই তো হয়।

হুম। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি চা করে আনি,

রেবা শুনুন?

জ্বি?

টাইটা খুলে দিন তো একটু, গিট্টু লেগে গেছে বোধহয়।

আমি অবাক হয়ে বললাম টাইয়ে কারো গিট লাগে?দেখি

আমি তার কাছে গিয়ে টাইয়ের নাট খুলতে শুরু করলাম।
সে টিপ্পনী কেটে বলল, নাগাল পাবেন‌ নাকি টুল এনে দিবো?

আমি এতোটাও শর্ট নই হুহ!

হাইট কত শুনি?

৫’৪” আপনার থেকে মাত্র ৭ইঞ্চি শর্ট!

সে আমার মাথাটা তার বুকে চেপে মাপার ভান করে বলল, আসলেই তো মাত্র ৭ইঞ্চি শর্ট। এটা কোনো পার্থক্য হলো?

আমি তার ছলনা বুঝতে পেরে বললাম, বললেই হতো জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, টাই- হাইট এসব নিয়ে টানাহেচড়া কেন?

আরাফ সম্মতি পেয়ে আরো শক্ত করে ধরে বলল, ইচ্ছতো করে আপনাকে একদম বুকের পিঞ্জিরাতে রেখে দেই। কিন্তু যেই রাগী আপনি বলতে সাহসে কুলোয় না।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম আমার রাগ দেখলেন কবে? আমি এই পর্যন্ত রাগ দেখিয়েছি?

দেখাতে হয় নাকি? নাকের ডগা দেখলেই বোঝা যায় কে কত রাগ নিয়ে বেঁচে আছে?

মানে? নাকের ডগায় আবার রাগ দেখা যায় কিভাবে?

আরেহ জানেন না? যাদের‌ নাকের ডগায় তিল থাকে, তারা অনেক রাগী হয়।

আমি নাকে হাত দিয়ে বললাম, ধুর এসব কুসংস্কার। আপনি এসব বিশ্বাস করেন নাকি!

আলবাৎ করি, ডেমো দিবো? আপনার থুতনীতে তিল আছে মানে আপনার শাশুড়ি আপনাকে অনেক আদর করে। এটা মিলেছে‌না?
তারপর আপনার ডান কপালে তিল আছে, মানে আপনি ভাগ্যবতী। হাতে তিল আছে আপনার রান্না মজা আর বুকে তিল থাকা মানে স্বামী সোহাগী। চেক করে দেখুন আমি নিশ্চিত আপনার ওখানেও অবশ্যই তিল আছে ,,,,,, বলেই থমকে যায় আরাফ।

আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই তার কথায়। সে আমতা আমতা করে বললো, আরেহ আমি তো এখনো ফ্রেশ হইনি, বলেই ছুটে পালালো।

আমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ভাবছি সে এসব কি বলে গেল; তিল নিয়ে এতো কিছু বিশ্বাস করে কেউ! ডেমোগুলো নিছক কাকতালীয় নয় তো কি! আচ্ছা সত্যিই কি বুকে তিল থাকলে স্বামী সোহাগী হয়? চেক করা উচিত? ধুরর কিসব ভাবছি আমি।


একটু পর পর জোরে বজ্রপাত হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি নেই। দমকা হাওয়ায় চারদিকে শো শো শব্দ হচ্ছে। বাতাসের দাপটে সবকয়টা জানালার পাট জোরে জোরে ধাক্কা খাচ্ছে, তাহেরা আর রহিম চাচা সব জানালা বন্ধ করেছে, আমিও আমার রুমের জানালা বন্ধ করে বসে আছি। আরাফ হয়তো পথেই আছে, তাই আরো বেশি ভয় লাগছে। হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমি অস্থিরভাবে পায়চারী করছি আরাফ সহীহ সালামত না ফেরা অবধি শান্তি লাগবে না। উফ কোথায় তিনি এখনো আসছে না কেন? এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম গর্জন হেনে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি আসা মানেই এজ ইজুয়াল কারেন্টও চলে যাওয়া! আমি বিরক্তিতে অন্ধকারে ফোন হাতড়ে বেড়াচ্ছি, উফ এখানেই না ছিল এখন কোথায় গেল?

হঠাৎ মনে হলো দোতলার করিডর দিয়ে কেউ দৌড়ে গেছে, আমি গলা ছেড়ে বললাম, লতা? তুমি এই অন্ধকারে দৌড়াচ্ছ?

কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে করিডর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি, এই বিশাল বাড়িটা এখন কবরের চেয়ে কম লাগছে না। আমি এমনিতেই ভীষণ ভীতু, তার উপর চারদিকে অন্ধকার। বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরছি পড়ে বুকে দম দিয়ে এগোচ্ছি আর ডাকছি তাহেরা? লতা? রহিম চাচা? কে কোথায় আছেন? সবাই গেলো কোথায়? একটু আগেও না সবাই ছিল? সিড়ি ভেঙে নীচে নেমে দেখি এখানেও কেউ নেই। এতোক্ষণ মনে বিশ্বাস ছিল নিচে সবাই আছে, এখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে এবার অতিরিক্ত ভয়ে আমার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।

এখানে কোনো‌ অশরীরি আত্মা নেই তো? দেখা গেল ওটাই সবার কান বন্ধ করে দিয়েছে। তাই আমার ডাক কেউ শুনতে পাচ্ছেনা। আরাফ আপনি কোথায়? প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসুন না আমার ভীষণ ভয় করছে।
তখনি খুব জোরে একটা বজ্রপাত হলো আমি চিৎকার দিয়ে দৌড় দিলাম দরজার দিকে। হঠাৎ কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেলাম, ধরে দেখি ভেজা চপচপে ঠান্ডা শরীর। সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here