তরঙ্গিনী (পর্ব-৬) #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী (পর্ব-৬)

#আরশিয়া_জান্নাত

পরদিন দুপুরেই আরাফ জরুরী কাজে ঢাকায় ব্যাক করলো। আমি সাথে ফিরতে চাইলে সে বলল আরো কিছুদিন থাকতে পরে এসে নিয়ে যাবে। আরাফ যাওয়ার পর প্রথমে মনে হয়েছে ভালোই হলো কটা দিন স্বস্তিতে কাটানো যাবে। নিজের বাড়িতে আসলেও বরের জন্য সর্বদা তটস্থ থাকতে হয়েছে কখন কি লাগে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না আরো কত কি। তাই দায়িত্বের ছুটি পেয়ে বেশ ফুরফুরেই লাগছিল‌। দুদিন আরামসে ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে শাওয়ারে নিলাম। তারপর বই নিয়ে ছাদে যাই, সূয্যি মামা ততক্ষণে পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে। আমি আমার কোমড় ছাড়ানো চুল সারা পিঠময় ছড়িয়ে বেশ আয়েশ করে বইয়ে ডুব দিলাম। চন্দ্রনাথ” বইটা শেষ করার পর মনটা কৈলাসের জন্য কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেল। আকাশপানে চেয়ে দেখি সূর্য ডুবে যাচ্ছে, ধীরে সুস্থে হাতখোপা করে নীচে নেমে আসলাম। হঠাৎ মনে পড়ল আরাফকে এই দুইদিন আমি একবারো কল করিনি! কে জানে কি ভাবলো সে? হন্যি হয়ে রুমে গিয়ে ফোন হাতড়ে দেখি অনেকগুলো মিসড কল। এই দুটো দিন আমি এতোটাই ঘুম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। মা কোনোমতে ঘুমের মাঝেই উঠিয়ে দুবেলা মুখে তুলে খাইয়েছে। আমার এই অভ্যাসটা অনেক পুরনো। পরীক্ষা শেষ হলেই টানা ঘুম দিতাম। এসময় পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে ছুঁতে পারেনা। কোথায় খাওয়া কোথায় কি! সব চুলোয় যাক, অনলি ঘুম ইজ রিয়েল,,,

অনেকগুলো বকা শোনার প্রস্তুতি নিয়ে আরাফকে কল করলাম। কিন্তু আরাফ রিসিভ করলো না। ২য় বার কল করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতেই আরাফের কল এলো। রিসিভ করতে আরাফ সালাম দিয়ে বলল, ঘুমের রাণীর ঘুম ভাঙলো অবশেষে? আমিতো ভেবেছি আরো দু’দিন লাগবে! তা ম্যাম ভালো আছেন তো?

জ্বি ভালো আছি আপনি ভালো আছেন? সেদিন ঠিকঠাক পৌঁছেছিলেন?

জ্বি আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থভাবেই পৌঁছেছি।

বাসায় সবাই ভালো আছেন?

হুম। ঐখানে সবাই ভালো আছেন?

জ্বি ভালো। আপনি কবে আসবেন?

কেন মিস করছেন বুঝি?

নাহ সেটা বলিনি।

তার মানে মিস করছেন‌না? অবশ্য করবার ফুরসত কই আপনার। আপনিতো ঘুমের রাজ্যে আসীন হয়ে আছেন।

ঘুম নিয়ে কথা শোনাবেন না প্লিজ, আমার ভীষণ লজ্জা হয়।

রেবা?

জ্বি।

আরাফ গাঢ় কন্ঠে বলল, আপনাকে আমি ভীষণ মিস করছি,,,

আমি কি চলে আসবো? ভাইয়াকে বলি টিকেট করতে?

নাহ। আমি আপনাকে নিতে আসবো। আপনি মনমতো বেড়িয়ে নিন। আর শুনুন নিজের যত্ন নিবেন, অবেলায় শাওয়ার নিবেন না। ভালোমতো চুলের পানি ঝরাবেন। আর হ্যাঁ গায়ে কা‌ঁথা জড়িয়ে নিবেন মাঝরাতে আপনার হিম লাগে,,

আমি ফোনের এপাশ হতে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লাম। আরাফ ফোন রাখার পর ভাবতে লাগলাম মানুষটা কত কেয়ারিং। আমার কত যত্ন করে। সবকিছু নোটিস করে রেখেছে। আমি হঠাৎ করেই আরাফকে মিস করতে শুরু করলাম। তার হাসিমুখ, মুগ্ধ চোখ, কারণে অকারণে নিকটে আসা। সবকিছুই মানসপটে ভেসে উঠে। আরাফের মতো হাজবেন্ড পাওয়া সত্যিই অনেক মেয়ের স্বপ্ন।
তার শূন্যতার একরাশ বিষন্নতা নিয়ে আমি ফের ঘুমাতে গেলাম


বহুদিন পর ফেইক আইডিতে লগিন করে তৌকিরের আইডি স্ক্রল করছিলাম। তৌকিরের হাসিমুখ, আর সুখময় স্ট্যাটাসের ভীড়ে কোথাও আমার অস্তিত্ব নেই। আমি কমেন্টগুলো পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম কোথাও কি ভুলেও আমি নেই? বেহায়া মনটা যেন আশা করছিল তৌকিরের মন খারাপ দেখবে, তার অনুপস্থিতির একটা হলেও মনের ভাব থাকবে। অথচ সেভুলে যায় মানুষটার কোথাও সে নেই,,,
তৌকির বাবা হতে চলেছে, জীবনের প্রবাহমান ধারায় সুখী মানুষের ন্যায় এগিয়ে যাচ্ছে। সে তো কোনো ফল পাচ্ছে না? ন্যাচার টেকস রিভেঞ্জ! কোথায় সেই রিভেঞ্জ? ওরা তো সুখে আছে, ভালো আছে। তবে আমি কেন ভালো‌নেই? আমি কেন সময়ের স্রোতে ভাসতে পারিনা? মিথিলাও তো ভালোবেসেছিল একজনকে, সে পর্যন্ত বলে গেল মুভ অন করতে। আমার একারই বুঝি মুভ অন করতে সমস্যা হয় আর কারো হয় না?
চোখের কোণ ভরে আসে নোনাজলে। পরিণীতার” মতো আমারো জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, আমায় কেন ভালোবাসলে না তৌকির?
আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মরি, কান্নায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তৌকিরকে দেখলে এখনো আমার বুকে অসম্ভব যন্ত্রণা হয়। এই মানুষটা আমার নেই এই কথাটা এখনো মানতে পারি না আমি। আমার ইচ্ছে করে আবারো তার পায়ে পড়ে বলি, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না। আমি বাঁচতে পারবো না।

তৌকির কি আবারো বিরক্তকির চেহারা করে বলবে, এসব ন্যাকামি ছাড়ো রেবা! এই পৃথিবীতে কোনো মেয়ে তার প্রাক্তনের জন্য মরে নি। তুমিও মরবে না।

সত্যিই তো মরিনি, মরলে যে পরিবারের অসম্মান হবে। আমরা মেয়েরা যে অল্পতেই কলঙ্কিনী হবার খেতাব পেয়ে যাই। আমার মা কে আমি সেই বোঝা চাপিয়ে কিভাবে ঝুলে পড়তাম বলো? এতোটা স্বার্থপর আমি হতে পারিনা বলেই মরিনি!

রেবা? এই রেবা দরজা খোল। এই দিনেদুপুরে দরজা আটকে কি করছিস? রেবা?

আমি মায়ের ডাকে চোখমুখ মুছে লগাউট করলাম। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করে দরজা খুলে সরে এলাম। মা ভেতরে ঢুকে বললেন, তোর মালিহা আন্টি বলছিল তোকে নিয়ে যেতে, আজ বিকেলে একটু ঘুরে আসব। তুই রেডি থাকিস।

আচ্ছা।

তুই আবার তৌকিরের একাউন্ট ঘেটেছিস তাই না?

আমি দু’ঠোট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। চোখ বেয়ে না চাইতেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মা আমায় বুকে নিয়ে বললেন, মা রে আমি বুঝি তোর কষ্ট। তোর ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। এখন আমাদের হাতে আর কিছু নেই। বেঈমানের বিচার আল্লাহ ঠিকই করবে, বলেই মাও কাঁদতে লাগলেন।

তারপর শক্ত গলায় বললেন,রেবা তুই আমায় ছুঁয়ে ওয়াদা কর ওর আইডি আর দেখবি না? কর ওয়াদা আমি তোর কাছে অনুরোধ করছি। তুই আমায় কথা দে ঐ জা*নোয়ারের কোনো খবর আর নিবি না।

আমি মায়ের বুকে থেকেই ওয়াদা করলাম আর কখনো তৌকিরের আইডি ঘাটবো না। ওর কোনো খবর নিবো না।

🥀🥀🥀🥀🥀🥀🥀

এক সপ্তাহ পর আরাফ আসে আমাকে নিতে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে রুমে আসতেই সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, উফফ কি যে অশান্তি লাগছিল এই কয়দিন আপনাকে না দেখে। এখন বুকটা ঠান্ডা হলো। আপনি কেমন নিষ্ঠুর রেবা? এমন ইন্টারনেটের যুগে ভিডিও কল না করে ছিলেন! দেখুন ভালো করে আপনার শোকে ১৫০০ গ্রাম ওজন কমে গেছে আমার।

আমি তার কথা শুনে হাসতে লাগলাম। সে আমার দিকে চেয়ে বলল, আপনি হাসছেন? আমার কষ্ট শুনে আপনার হাসি আসছে? হাহ! যার জন্য একটা রাত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি সে তো আমার ভাগের ঘুম নিয়ে দিনের পর দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এখন তো তার হাসি আসবেই!

আপনি ভালোই ঢং করতে পারেন। এখন ফ্রেশ হয়ে নিন আমি আপনার জন্য খাবার পরিবেশন করি।

না আপনি এখন কোথাও যাবেন‌না। আপনাকে আমি প্রাণভরে দেখব। দেখা শেষ‌ হলে তারপর যাবেন।

আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে বললাম, আপনিও না কিসব যে বলেন।

আরাফ আমার কথা কানেই শুনলো না যেন, আয়েশ করে বেডে হেলান দিয়ে বসলো। তার সেই চেনা দৃষ্টি- পলকহীনভাবে চেয়ে থাকা।

আমি অস্বস্তিতে বললাম, এভাবে তাকানোর কি আছে, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

সে বাঁকা হেসে বলল, তাই তো আরো বেশি সুন্দর লাগছে। একজন বলেছিল মেয়েদের লজ্জামাখা মুখ দেখতে ভীষণ আকর্ষনীয় হয়। আমার মনে হয় সে মোটেও ভুল বলেনি। এই রেবা একটু তাকান তো এদিকে,

আমি মুখ তুলতেই সে ফোনে ক্লিক করলো। অস্ফুট কন্ঠে বলল, দারুণ!!

আমি জানি না এই মানুষটার চোখে আল্লাহ কোন রহমত দিয়েছে যে আমায় তার এতো পছন্দ হয়। আমি আহামরি নই এ আমি জানি, উনার মতো সুদর্শন কেউ আমায় এতো পছন্দ করবে এ আমি কখনোই ভাবিনি। আসলে তৌকির আমায় শেষদিকে এতোটাই অপদস্থ করেছিল, আমার বয়সটা নিয়ে কটাক্ষ করেছিল আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার রূপ লাবণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমার মাঝে আর অন্যকে আকৃষ্ট করার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আরাফের আচারণ, আমার জন্য বলা শব্দাবলী, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। আমি নিজেকে আরাফের চোখে খুঁজে পাই। এই মানুষটাকে আমি ভীষণ সম্মান করি। আমি অবশ্যই আমৃত্যু তার সম্মান রক্ষা করবো। কিন্তু ভালোবাসতে পারবো কি না জানিনা। হয়তো পারবো,,,


শাশুড়ি মায়ের সাথে উনার রুমে বসে আছি। বাবা শুয়ে আছেন। একটু আগে তার প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। আমি উনাকে তেঁতুল পানি খেতে দিয়ে উনার ঘাড়ে ভেজা টাওয়েল জড়িয়ে দিলাম।
মা বক্স থেকে মেডিসিন বের করে বললেন, বুঝলে বৌ মা তোমার শ্বশুর কেবল বয়সটাই হয়েছে, কাজকর্ম এখনো বাচ্চার মতো। বাচ্চাদের যেমন ধরে ধরে সব করাতে হয় তাকেও তেমন করতে হয়। সে জানে তার হাই প্রেশার, তাও একটু বিবেচনা নাই। কত করে বলি কিছু নিয়ম মেনে চলো, না সেসব কানেই তুলবেনা।

বাবা বললেন, বৌমা তোর শাশুড়িকে থামতে বল তো। তার কথায় আমার প্রেশার আরো বেড়ে যায়,,

হ্যাঁ এখন তো বলবাই। আমার কথা তো ভালো লাগবে না। ভালো কথা শুনতে কারোই মজা লাগেনা। ধরো এটা খাও।

বাবা আমার দিকে চেয়ে বললেন, তোকে কষ্ট দিলাম মা। আমি এখন ঠিক আছি তুই যা তোর ঘরে গিয়ে রেস্ট কর।

আমি প্রেশার মেপে বললাম, বাবা মা যা বলছে তা কিন্তু মিথ্যে নয়। আপনাকে এখন থেকে নিজের প্রতি যত্নশীল হতেই হবে। আপনি এখন থেকে রোজ নিয়ম করে হাঁটবেন। এখন থেকে আমিই আপনার তদারকি করবো।

মা হেসে বললেন, একদম ঠিক হবে, আমার কথার তো দাম নেই। দেখবো এবার বৌমাকে কিভাবে এড়াও।

রেবা চলে যাওয়ার পর তার শ্বশুর বলল, বৌমাকে এমনিই আমার ভয় লাগে, ও চুপচাপ থাকে তো মনে হয় এই বুঝি রেগে গেল! কে জানে আমার জীবনে বোধহয় আমার রাগী মা টা ফিরে এসেছে,,,,

হাহাহা আমিও তাই ভাবছিলাম। তবে মেয়েটা বড় লক্ষি বুঝলে। আমার ছেলের পছন্দ বলে কথা! ও যদি খুঁজে না আনতো আমরা চিরুনি-তল্লাসী করেও এমন হীরের টুকরো আনতে পারতাম না।

তা যা বলেছ। ছেলের উপর আমার বিশ্বাস ছিল। ও ভুল কাউকে চুজ করবেনা। আল্লাহ ওদের সুখী করুন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here