#তরঙ্গিনী (পর্ব-৫)
#আরশিয়া_জান্নাত
মা বলল, একটা কথা বল তো তোর দুলাভাই আর ভাইয়া তাদের বৌকে ভালোবাসে কি না?
বাসে তো। অনেক ভালোবাসে, আপাকে দেখো না একটা দিনের জন্য একা ছাড়ে না। আর ভাইয়া তো ভাবি বলতে অজ্ঞান।
আচ্ছা। শোন এই সেমাইটা তোর ভাবী বানিয়েছে, আর ফিরনি টা তোর আপা করেছে। আমি এই দুটোতে লবণ মিশিয়ে দিচ্ছি। তুই গিয়ে তোর ভাইকে সেমাই দিবি আর দুলাভাইকে ফিরনি দিবি। অবশ্যই যার যার বৌয়ের সামনে। তারপর বাইরে এসে তাদের রিয়েকশন আমাকে বলবি। ঠিকাছে?
তুমি এতো লবণ দিয়েছে ওরা খাবেই না, অযথা নষ্ট করবে।
যা বলছি কর না।
আমি প্রথমে সেমাই নিয়ে ভাইয়ার রুমে গেলাম ভাইয়া সেমাই দিতেই বলল, তুই বানিয়েছিস?
আমি বললাম না, ভাবি বানিয়েছে।
তারপর আড়ালে দাড়িয়ে দেখলাম ভাইয়া বেশ আয়েশ করেই খেতে খেতে কাজ করছে। শেষ করে বলল, রুমা তুমি দারুণ সেমাই বানাও, শুধু চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছ বোধহয়।
ভাবী তৎক্ষণাৎ বললেন আয়হায় মাকে বলতে হবে এই সেমাই কাউকে যেন না দেয়। তুমিও না এতোক্ষণ ধরে খাচ্ছ কিছু বললেনা। রেবা সবাইকে দিয়ে ফেলল কি না!!
ভাইয়া তাকে আটকে বলল, তুমি বসো আমি গিয়ে বলছি। এতো অস্থির হবার কি আছে? রিল্যাক্স।
আমি পরম তৃপ্তিতে আপার ঘরে ফিরনি নিয়ে গেলাম, আপা তখন ছোটন নিয়ে শুয়ে আছে, দুলাভাই পাশে বসে পেপার পড়ছেন। আমি তাকে ফিরনি দিতেই বললেন শ্যালিকার রান্না ফিরনি নসীব হলো বুঝি?
আপা বলল, না তোমার পুরনো বৌটাই বানিয়েছে।
আমি ফের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম, দুলাভাই খেতে খেতেই বলল, লবণের মতো ভালোবাসার গল্প ভালোই মনে রেখেছ তুমি।
লবণ পড়েছে নাকি? বেশি??
একটু হয়েছে আর কি। তবে মানতেই হয় তোমার রান্নার জবাব নেই।
আমি হাসিমুখে মায়ের কাছে এসে বললাম, উনারা দুজনই খেয়েছেন মা! সাথে প্রশংসাও করলেন। ওরা আসলেই বৌ পাগল হাহাহা!!
এমন সময় ভাইয়া এসে বলল, মা সেমাইয়ে লবণ পড়েছে বোধহয়। ওটা তুমি আর কাউকে দিও না। বেচারি কত ভালোবেসে রান্না করেছে একটু ভুল হয়ে গেছে বকিও না ওকে।
মা হেসে বললেন আচ্ছা।
তারপর আপা এসে বলল, মা ফিরনি টা কাউকে দিও না ওতে জন্মের লবণ হয়েছে। তোমাদের জামাইতো পুরো বাটি শেষ করেছে আমি বললাম চেখে দেখতে দাও, দিলোই না। শেষে বাটি থেকে খেয়ে দেখি মুখে দেওয়ার জো নেই। কেমন পাগল দেখেছ!
আমি দুলাভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম এমন অখাদ্য খাওয়ার দরকার কি ছিল?
দুলাভাই হেসে বললেন, বুঝলে রেবা তোমার আপার সাথে আমি ১২বছর সংসার করছি। সে রান্নার বিষয়ে কতটা সিরিয়াস সে আমি ভালো জানি। যে মানুষটা আমার জন্য এতো কষ্ট করে যত্ন নিয়ে রান্না করে, তার রান্নায় আমি কখনোই বিস্বাদ পাই না। আমি উপাদান না দেখে তার ডেডিকেশনটা দেখি। তাই তার রান্না আমার সবসময় পছন্দ।
আমি মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। মা বলল, কি বুঝলি?
কিন্তু মা সবাই তো আর এক হয় না। সরাসরি বলাটা তো অন্যায় না?
অন্যায় না মানছি, কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া কি ন্যায়? প্রকৃত পুরুষ কখনোই তার প্রিয়তমার রান্নাকে হেয় করেনা। মজা না হলে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলবে, কেউই তো জন্মের আগেই শিখে আসেনা। ধীরে ধীরে সব শেখে। কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে দেখার বিষয় সঙ্গী তাকে কতটুকু উৎসাহ দিচ্ছে।
আমি কৌতুহলী হয়ে বললাম, মা উনাকে পরীক্ষা করি?
করতেই পারিস,
না থাক যদি রেজাল্ট নেগেটিভ আসে আমার অনেক খারাপ লাগবে।
মা মন খারাপ করে চলে গেলেন। হয়তো আমার আরাফের প্রতি লো কনফিডেন্ট দেখেই তার মন খারাপ হয়েছে।
।
।
আরাফ সন্ধ্যায় ভাইয়াদের সাথে বের হলো। আমি মিম আর ছোটনকে নিয়ে খেলছিলাম। পাশেই আপা আর ভাবী সিরিয়াল দেখছে। মা বসে বসে বই পড়ছেন।
একটু পরেই আরাফ অনেককিছু নিয়ে ফিরল। সে সবার জন্য শপিং করেছে, সাথে ফুচকাও কিনে এনেছে।
আরাফ বিনীত স্বরে বলল, আপনাদের জন্য কিছু উপহার এনেছি, জানিনা পছন্দ হবে কি না ছোট ভাই ভেবে গ্রহণ করুন।
মা বলল, এতোকিছু আনতে গেলে কেন বাবা? ভালোবেসে এনেছ পছন্দ না হবার কি আছে।
সবাইকে যারযার ব্যাগ দিয়ে আরাফ রুমে গেল। আমি বসে বসে তাদের দেখছি আর মুখে ফুচকা ঠুসে ভাবছি আমার জন্য কিছুই আনলো না?
ভাবী আমার মনের খবর টের পেলেন যেন। তিনি আমায় ফিসফিস করে বললেন, তোরটা কি আর বড় ভাইবোনের সামনে দিবে বেকুবনী? ফুচকা খাওয়া রেখে যা গিয়ে দেখ কি এনেছে।
আমি উঠে গিয়ে দেখলাম জনাব বেলকনীতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অযথাই এটা ওটার শব্দ করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। ফুলহাতা শার্ট ইন করে ফরমাল লুকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে পেছন থেকে মন্দ লাগছে না। বরং বেশিই সুন্দর লাগছে। সে আমার দিকে ফিরে দু’হাত বুকের উপর ভাঁজ করে গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মনোযোগ দিয়ে আমায় পর্যবেক্ষণ করলো যেন, কি গভীর সেই দৃষ্টি। আমি বিছানা ঠিক করার বাহানায় তার আড়াল হলাম। সে ভেতরে এসে বলল, আলমিরায় কি আছে দেখেন।
আমি অতি উৎসাহে আলমিরা খুলতেই দেখি একটা তেলাপোকা! দরজা খুলতেই উড়তে শুরু করেছে। আমি উড়ন্ত তেলাপোকা ভীষণ ভয় পাই, তাই চিৎকার করে লাফাতে শুরু করেছি। তেলাপোকা বাবাজী আমার আশেপাশেই উড়তে লাগলো। আরাফ একটা কাপড় দিয়ে ওটাকে ছিটকে বাইরে বাইরে ফেলে। আমি ততক্ষণে আচলে মাথা ঢেকে কাঁপছি।
আরাফ ধীরে আমার ঘোমটা তুলল। ভয়ে আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে, সে আমার কপালের এলোচুল সরিয়ে চিবুক তুলে বললো, এতো ভীতু আপনি জানতাম না তো!
আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালাম তার দিকে, সে গাঢ় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, গেছে?
হুম
উফফ বাঁচা গেল।
রেবা!
জ্বি?
আপনি জানেন আপনি অসম্ভব মিষ্টি একটা মেয়ে? আপনাকে দেখতেই আদর লাগে।
আমি লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেলাম। মানুষটা যে এখনো আমার কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, ঘনঘন চোখের পলক পড়ছে। আমি যে হন্যি হয়ে একজোড়া মুগ্ধ নয়ন থেকে পালানোর পথ খুঁজছি বলা বাহুল্য। সে আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, সবসময় এমন পালাই পালাই ভাবে থাকেন কেন হুম? আমি বাঘ না ভাল্লুক?
আমি আঁচল মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আরাফ আলতো করে আমার চোখের পাতায় অধর ছোঁয়ালো। আমার পুরো শরীরে শিহরণ খেলে গেল। তারপর হঠাৎ সরে গিয়ে বলল, আমার একটা জরুরী ফোন করতে হবে।
সে চটজলদি রুম থেকে বেরিয়ে গেল আমি অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আলমারী বন্ধ করতে গিয়ে দেখি দুটো শপিং ব্যাগ। একটাতে আকাশী আর কলাপাতা রঙের কম্বিনিশনের তাঁতের শাড়ি আরেকটায় গাঢ় বেগুনী রঙের কাজ করা সালোয়ার-কামিজ।
মানুষটার রুচির প্রশংসা করতেই হয়!
🌸🌸🌸🌸
আরাফ বাড়ির বাইরে এসে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। রেবা তাকে কি ভাবলো কে জানে! ঐ সময় ঘোমটা তোলার পর কি যে হলো! ভয়ে ওর চোখ, ঠোঁট যখন কাঁপছিল, তাকে অসম্ভব মোহনীয় লাগছিল। তাও ভাগ্য চোখের পাতায় চুমু খেয়েছি, নয়তো মন যে বদ! শেষে মুখ দেখানোর পথ থাকতো না। আল্লাহ আমি জানিনা আমি তোমার শুকরগোজার হবো নাকি আফসোস করবো? রেবাকে এতো সুন্দর না বানালে কি হতো? ওকে দেখলেই আমার দৃষ্টি সরে না। মনে হয় সারাক্ষণ চেয়ে থাকি। ওর মায়াময় মুখটার দিকে চেয়ে অনায়েসে জীবন পার করতে পারবো। ও যখন শব্দহীনভাবে আসে ওর উপস্থিতি আমি তীব্রভাবে টের পাই। ওর নিরবতা আমাকে আরো আগ্রহী করে। মেয়েটা কি চৌম্বক দিয়ে তৈরী? ওর আশেপাশে থাকলেই অজানা আকর্ষণ টেনে নিয়ে যায় ওর কাছে। বিয়ে করা বৌ বলেই কি এমন নাকি রেবাই বিশেষ? এমন তো নয় রেবার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে সে আগে দেখেনি। ইনফ্যাক্ট ওর চেয়ে অধিক রূপবতী বহু মেয়েই তার আশেপাশে থাকে, ছিল। কই তাদের বেলা তো এমন হয় না। চোখ আটকেছে তবে মন তো আটকায় নি।
পরক্ষণেই আরাফের মন বলল আরেহ তুই তো ভুল করছিস না। বৈধভাবে বিয়ে করা বৌয়ের প্রেমে পড়েছিস। এতে এতো অস্বস্তির কি আছে?
তুই তো পর কাউকে স্পর্শ করিস নি। ওকে ভালোবাসার অধিকার তোর ১০০% আছে।
আরাফ তবুও শান্ত হতে পারল না, মনে মনে বলল, রেবা আমি সাধু সন্যাসী নই। রক্তে মাংসে গড়া সাধারণ পুরুষ। আমায় মার্জনা করুন।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে আরাফ আগে আগে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। রেবা ধীরে সুস্থে এসে দেখে আরাফ ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
পরদিন বিকেলে রেবার বান্ধবী মিথিলা আসে রেবার সঙ্গে দেখা করতে। মিথিলার বিয়ে হবার পর অনেকদিন দেখা হয়নি, এবার সৌভাগ্যক্রমে দেখা হলো। মিথিলা তো রেবাকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। এমন চঞ্চল মেয়েটা রেবার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের বান্ধবী ভাবতেই অবাক হলো আরাফ। মিথিলা আসার পর থেকেই পুরো বাড়িতে হৈ হৈ রব পড়ে গেল। রেবা তাকে ধরে নিজের রুমে বসিয়ে বললো, তোর সাথে আমার অনেকবড় ঝগড়া আছে।
মিথিলা ডোন্ট কেয়ার মুডে বলল, কি ঝগড়া শুনি?
তুই মাকে কি কি বলেছিস সত্যি বল?
আমিতো একটা কথা বলিনা, দুনিয়ার কথা বলি। কয়টা মনে রাখবো বল?
একদম ফাজলামী করবি না। ওর বিষয়ে কি কি বলেছিস?
ওহ তৌকির হালারপোর কথা? বেশ বলেছি, তুই অন্ধ হতে পারিস আমি না। আমি তো শুরু থেকেই বলেছিলাম ঐ হালা হ্যাংলা। হুদাই প্রেম করে সময় নষ্ট করছোস। ওর পিছে না পড়ে থেকে যদি একটা কুত্তাকেও সময় দিতি তোর ভক্ত হয়ে যেত।
রেবা মলিন গলায় বলল, এভাবে বলিস না দোস্ত।
তোর সামনে তো আবার কিছুই বলা যায় না। তুইতো ওর মধ্যেই আছোস ঐদিকে তৌকির ইনিংস খেলে ফেলছে। প্রথম মাসেই উইনার।
তোর মুখের ভাষা দেখ! এভাবে কেউ কথা বলে?
দেখ আমার মুখ সবসময়ই পাতলা, বিয়ের পর আরো লাগাম ছুটে গেছে। যাই হোক অতীত বাদদে। বল কেমন আছিস? সংসার কেমন চলে?
চলছে আর কি!
একটা কথা বলি চেতিস না, তোরে দেইখা মনে হচ্ছে না কিছু বদলাইছে। তুই এখনো এক্সের ভাবনায় আছিস তাই না? শোন নূর অতীত বদলায় না, আর ভবিষ্যত মরিচীকা। বর্তমানটাই আসল। এটাকেই ভালোমতো সাজিয়ে তোল। বর্তমান হেলায় ফেলায় কাটালে- না অতীত মধুর হবে! না ভবিষ্যত ভালো হবে। তাই বলছি স্বামী সংসারে মন দে। এটাই এখন সব। তোর বর তো মাশাআল্লাহ নায়কের চেয়ে কম না। এমন বর রেখে ঐ ছ্যামড়ার জন্য কেমনে কান্দস? তোর আসলেই রুচির দূর্ভিক্ষ।
সত্যি বলবি মিথি তুই কি আসাদ ভাইকে ভুলতে পেরেছিস? এই যে অনায়েসে আমায় বলছিস তোর ও কি মনে পড়েনা?
মিথিলা হাসলো, হেসে বলল, একটা কথা কি জানিস নূর সময় অনেক বড় প্রতিষেধক। সে ঠিকই সব বদলে দেয়। একটা সময় আমরা যাকে মূলবিন্দু ভাবতাম, যাকে ছাড়া অস্তিত্ব থাকবেনা বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, ভাগ্যের পরিহাসে তার থেকে সরে নতুনকেন্দ্রে বৃত্ত আঁকি, দিব্যি সুখেই বেঁচে থাকি। জীবনের এই বাস্তবতা যারা মেনে নিতে পারেনা তারা ছন্দপতনে হারিয়ে যায়। আমি তাকে ভুলে গেছি তা নয়। তবে আগের মতো অতো মনেও পড়েনা। ফুরসতই বা কই! কতদিক সামলাতে হয়,,,
রেবা নিরব রইলো। মিথিলা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বলল, নূর আমি মন থেকে চাই তুই মুভ অন কর। ঐ টক্সিক মেমোরিজ থেকে বেরিয়ে আয়। জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা, অযথা সময় নষ্ট করে পরে আফসোস করিস না।
চলবে,,,
(সবাইকে ইদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা। আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের ভালো কাজ কবুল করুন। ইদ মোবারক)