#তরঙ্গিনী পর্ব-৩৩
#আরশিয়া_জান্নাত
ছোট চাচীকে ছাদে দেখে রেবা এগিয়ে গেল তার কাছে। ছোট চাচী বলল, তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
রেবা অবাক হয়ে বলল, কেন চাচী? দরকার হলে ডেকে পাঠাতেন!
মেহেরুন হেসে বলল, ভাবলাম খোলা আকাশের নীচে বসেই বলি। তুমিতো এখানে রোজ আসোই।
আচ্ছা।
আচ্ছা রেবা আমাকে তুই কেমন ভাবিস?
হঠাৎ এই কথা কেন?
বল না আপন মনে করিস?
হুম করিতো।
আমি যদি তোকে কিছু বলি, মন খারাপ করবি? বা ভাববি ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি?
ছোটচাচী আপনি প্রথমদিন থেকেই আমার সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচারণ করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। কি হয়েছে খুলে বলুন না?
মেহেরুন স্নেহার্দ স্বরে বলল, রেবা একটা কথা কি জানিস মা, সহজ সরল মানুষরা খুব অবলা হয়। এদেরকে যে কেউ খুব সহজে পথভ্রষ্ট করতে পারে। আমাদের বড় ভাবী হচ্ছেন সেই ধাঁচের মানুষ। বলছিনা সে খারাপ, সে ভীষণ ভালো। তবে ঐ যে বললাম অবলা টাইপ হয়! সে যাই হোক আমি চাইছি একটা অহেতুক সমস্যা না তৈরি হোক। তোরা বরং ফ্যামিলি প্ল্যানিং কর। বড় ছেলের ঘরের নাতিনাতনী দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে বুঝলি। ভয় পাসনে, বাচ্চা সামলাতে তোর শাশুড়িরা এক্সপার্ট, তুই জাস্ট ভরসা করে নিয়ে ফেল।
কিছু কি হয়েছে চাচী? কেউ কিছু বলেছে?
বুঝিস তো আশেপাশের মানুষদের খেয়েপড়ে কাজ নেই। অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া ছাড়া!
হুম বুঝেছি।
অন্যভাবে নিস না, তোর শাশুড়ি তোকে কিছু বলবেনা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে টেনশন করবে। তাই আমিই বললাম তোকে। আল্লাহ যদি চায় একজন আসুক। সব ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে ঘরে বাচ্চা নেই তো, আমরাও একটু আনন্দ পাই ছোট অতিথির আগমনে,,, তুই কি রাগ করলি?
না চাচী তেমন না। আমরাও ভাবছিলাম এই বিষয়ে। আপনাদের ছেলে তো বাচ্চাপাগল।
আল্লাহ তোদের সহায় হোন।
মেহেরুন চাচীকে রেবা এজন্য বেশি পছন্দ করে। উনি সবসময় রেবাকে আগে থেকে সতর্ক করেন। ভালো বন্ধুর মতো পরামর্শ দেন। সম্পর্কে চাচীশাশুড়ি হলেও উনারা সবাই খুব ফ্রেন্ডলী। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রেবা কিছু একটা আঁচ করতে পারলেও সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে খবরটা কাউকে বলতে চাইছেনা। তবে যদি সন্দেহটা ঠিক হয় তবে এই বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কবির সাহেবরা দেশে ফিরেছেন আজ ৪ দিন হলেও এই বাড়ির কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করলেন না। বিষয়টা সবার কাছেই বিস্ময়কর হয়ে গেল। ইফতেখার চৌধুরী প্রথমে ভাবলো হয়তো ওরা একটু সময় নিচ্ছে, নিজেরাই খবর দিবে। কিন্তু বিষয়টা আর স্বাভাবিক লাগলোনা। তিনি নিজেই তার স্ত্রীকে নিয়ে বন্ধুর বাসায় রওয়ানা দিলেন। বন্ধুর সাথে দেখা করতে তো বাধা নেই। তাই আরাফও কিছু বললোনা। আরুশের কথা শোনার পর থেকে রুহি এক প্রকার প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছে, তাই এই ধোঁয়াশাপূর্ণ ঘটনায় সে বিশেষ প্রভাবিত হলোনা। সবাই আশা করে রেখেছে কারিয়ানের সাথেই রুহির কিছু একটা হবে, কবির সাহেব নিজেও এই বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এখন ফেরার পর কি এমন হলো যে আসার খবর পর্যন্ত দিলোনা। সবার মাঝেই অসহনীয় কৌতুহল। রেবা নিজেও বেশ চিন্তিত এই বিষয়ে।
আরাফ আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম কারিয়ানের সঙ্গে কথা বলুন। কি এমন হলো যে উনারা এমন করছেন? আপনি কি কথা বলেননি?
আরাফ কোচে হেলান দিয়ে বসে বলল, রেবা রিল্যাক্স! যা হবে ভালোই হবে। টেনশনের কিছু নেই।
আপনি এতো কুল থাকেন কিভাবে বলুন তো?আপনি জানেন রুহি কত সিরিয়াস কারিয়ানের ব্যাপারে? এখন যদি নেগেটিভ কিছু আসে ওর মন ভেঙে যাবে,,,,
ডোন্ট ওরি রেবা। আরুশ ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে।
মানে?
মানে হলো আমি কারিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছি। ওর এই বিয়েতে কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু সম্পর্কের খাতিরে ও কিছুই বলতে পারছেনা। আমার মনে হয় এসব কারণেই আঙ্কেলরা কেউ যোগাযোগ করছেন না। রুহিকে আরুশ হ্যান্ডেল করতে পারে তাই আমি ওকে সবকিছু বলেছি। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি এসবকিছুর মাঝে রুহি কিন্তু স্বাভাবিক আছে,,
হতে পারে ও শো করছেনা?
একেক মানুষের সাইকোলোজি একেকরকম। সে অনুযায়ী তাকে ট্রিট করলে অনেক কঠিন পরিস্থিতিও সহজে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা চলে আসে। আমার বোন কারিয়ানকে পছন্দ করে এর পেছনে অন্যতম রিজন হলো পারিবারিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠতা। ও একপাক্ষীকভাবে ভালোবেসেছে, কিন্তু কারিয়ানের তেমন ফিলিংস নেই। আমি চাইনা আমার প্রাণবন্ত বোনটা এমন কাউকে বিয়ে করুক যে তাকে কেবল দায়বদ্ধতা ভাবে।
কিন্তু বাবা মা কি মানবেন?
ওনাদেরকে আমি সামলে নিবো। সমস্যা নেই। আজ বন্ধুর বাসায় বন্ধু গেছে, বাবাকে বলে দিয়েছি বিয়ের টপিক না তুলে পরিস্থিতি বুঝে আসতে। আশা করি উনি যথেষ্ট বুঝদার। আমার চেয়ে উনিই সবটা ভালো বুঝবেন।
ওহ বুঝেছি।
আরাফ গাঢ় দৃষ্টিতে রেবার দিকে তাকালো। যেন খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।রেবা ওর এমন দৃষ্টি দেখে নড়েচড়ে বলল, কি দেখছেন এমন করে?
রেবা একটা সত্যি কথা বলুন তো, আপনার কিছু হয়েছে?
কি হবে?
আপনাকে কেমন যেন লাগছে, আপনি কি অসুস্থ?
নাহ আমি ঠিক আছি।
আপনার গতিবিধি আমার চেয়ে ভালো কেউ জানবে? জিজ্ঞাসা করছি মানে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছি,,
রেবা আচলের কোণ আঙুলে পেঁচাতে লাগলো। আরাফ উঠে এসে ওর কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মাঝেমধ্যে কি ইচ্ছে করে জানেন? আপনার মনের ভেতরে এমন একটা ডিভাইস সেট করে দেই যাতে আপনি যা ভাবছেন তা জানতে পারি!
এমনিতেই কি কম জানতে পারেন? আপনার সামনে মনে মনে কিছু ভাবতেও আমার ভয় লাগে, মনে হয় সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
বুঝেন যখন হাইড করতে চাইছেন কেন?
কনফার্ম হয়ে বলতে চেয়েছিলাম।
আপনার দু’টো সার্কেল মিস গেছে এরপরো কনফার্ম হলেন না?
আপনি জানলেন কিভাবে? আমি নিজেও কনফিউজড ছিলাম,,,
একজন মানুষ ইদানীং রাতে উঠে খাবার খুঁজে, হুটহাট ঝিম খিঁচে বসে পড়ে। একটু পরপর এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে। খেতে বসলে নাকমুখ কুঁচকে মাছ খায়। আমের আচারের বয়াম এক বসাতেই ফিনিশ করছে, এসব কি যথেষ্ট নয় চোখে পড়ার জন্য?
রেবা মাথা নীচু করে বলল, বেশি বুঝদার বর পেলে এই এক সমস্যা। সারপ্রাইজ দেওয়া যায় না!
আরাফ রেবার পেটে আলতো করে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে মোলায়েম কন্ঠে মৃদুস্বরে ডাকলো,
রেবা!
জ্বি
চলুন ডাক্তারের কাছে যাই? চেকাপ করিয়ে আসি?
আজকে এখন?
হ্যাঁ।
কিন্তু,
কোনো কিন্তু না। আমি এসব বিষয়ে এক বিন্দুও কম্প্রোমাইজ করবোনা জানেন তো,, আপনি রেডি হয়ে নিন।
হুহ!
এই শুনুন,,
জ্বি?
সত্যিই কি সে আসতে চলেছে?
হয়তো,,
রেবা! বিশ্বাস করুন যদি এটা সত্যি হয় আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা। এটা হবে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের খবর!
এখুনি না প্লিজ। আগে দেখি ডাক্তার কি বলে, তারপর নাহয়,,,
আচ্ছা বেশ। তবে আমার মন বলছে পজেটিভ আসবে। আমি ওর অস্তিত্ব তীব্রভাবে টের পাচ্ছি,,
রেবা ওর চুল এলোমেলো করে বলল, আপনি আসলেই ভীষণ কিউট! কেমন আদুরে কথা বলেন।
আমার তো আর তর সইছেনা সত্যি,,এখুনি আমার কোলে এসে যেত যদি!!
রেবা আরাফের কথা শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
আরাফ বলল, হেসে নিন বেশি করে। একটু পর আমিও অনেক হাসবো খুশির জোয়ারে ভেসে,,,
🌸🌸🌸🌸🌸
কফিশপে বসে রুহি বাইরের দিকে চেয়ে আছে। মনের অবস্থা কেমন সে বুঝতে পারছেনা। নিজেকে মনে হচ্ছে অনুভূতিহীন রোবটের মতো। এই যে তার এতো বছর একটা সুপ্ত মনোবাসনা ছিল, একটা মানুষকে ঘিরে কত স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। সেই মানুষটার সঙ্গে ওর ভাগ্যের ডোর লেখা নেই, এই কঠিন নিয়তি জানার পরও সে কত স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে, কফিশপে বসে পছন্দসই খাবার খাচ্ছে! প্ল্যান আছে আরেকটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে হেভি খাওয়াদাওয়া করবে। এসব কি কোনো সদ্য মন ভাঙা মেয়ের কাজ হতে পারে? রুহি চাইলেই ফ্রেন্ডদের আসতে বলতে পারতো, কিন্তু কেন জানি মন হৈ হুল্লোড় চাইছেনা। একা একাই উপভোগ করতে চাইছে সময়টা।
কফিশপ থেকে বের হবার সময় একজনের সঙ্গে ধাক্কা খায়, রুহি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলে, চোখে দেখতে পান না নাকি? এতো বড় দরজা দিয়ে ঢুকতে কেউ ধাক্কা খায়?
ছেলেটা ইতস্ততবোধ করে চারদিকে তাকিয়ে বলল, আ’ম এক্সট্রেমলি স্যরি। আসলে তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গিয়ে এক্সিডেন্টলি ঘটনাটা ঘটেছে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
রুহি তার মুখের দিকে তাকাতেই ছেলেটা হ্যাট টেনে মুখ আড়াল করলো। রুহিকে স্যরি বলে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল। রুহি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, চেনা চেনা লাগছে কেন? কে এই ছেলেটা?
আরেহ রুহি তুই এখানে?
জেরিনের ডাকে রুহির হুশ ফেরে। এমনি এসেছিলা, তোর কি খবর?
এই তো ভালোই। একাই আসছোস?
দোকা পামু কই বল?
সেটা না তুই তো একা কোথাও যাস না। সবসময় কেউ না কেউ থাকে।
হুম এখন তুই আছোস। কোনো কাজে আসছোস নাহলে চল কোথাও বসি?
শপিং করতে আসছি, ভালো হইছে তোরে পাইছি। চল আমার সাথে আগে শপিং করি।
আচ্ছা চল।
রেহানা মন খারাপ করে বসে আছেন, ইফতেখার চৌধুরীও মুখ গোমড়া করে রেখেছেন। পরিস্থিতিটা এমনভাবে উল্টে যাবে উনারা কেউ কল্পনা করেননি। মনে মনে সবাই ওদের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল, কত কল্পনা জল্পনা ছিল। সব মুহূর্তেই ধুলিসাৎ। রেহানা সান্ত্বনাস্বরে বললে, যা হয় ভালোর জন্যহয়। মন খারাপ করোনা।
মেয়েটাকে কি বলবো বলো তো? ওর জন্য খারাপ লাগছে,
আমরা সবাই মিলে ওকে সামলে নিবো সমস্যা নেই।কিন্তু তুমি এতো বিমর্ষ হলে তো হবেনা।
আসলে অনেক আশা করেছিলাম তো তাই মাআনতে কষ্ট হচ্ছে। যাই হোক আল্লাহ ভরসা।
কারিয়ানের বিয়ের খবর পেলে রুহি কেমন রিয়েক্ট করবে ,,, আমার মেয়েটা সহ্য করতে পারবে এটা?
আমাদেরই ভুল হয়েছে আসলে।
আমাদের কি দোষ ভাইসাহেবই তো সবসময় বলে এসেছেন রুহিকে উনারা নেবেন। এখন শেষ মুহূর্তে এসে….
দেখলে তো ও মুখ দেখানোর মতো হালে নেই। লজ্জায় বেচারা চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না। আসলে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে বাপ-মার ইচ্ছের দাম থাকেনা সবসময়। এখন তো আর আগের দিন নেই যেখানে বলবে সেখানেই বিয়ে করতে চলে যাবে,,
ওগো আমাদের রুহির মধ্যে। কিসের কমতি আছে যে ওকে কারো পছন্দ হবেনা? আমার মেয়েটি কোনদিকে নেই?
এভাবে বলোনা রেহানা। সবার চোখেসবার সৌন্দর্য ধরা পড়েনা। দেখবে ওর জন্য যার জোড়া বাধা আছে সে আসবেই। এখন ক’টা দিন এইসব বিষয়ে নিরব থাকো।
রেহানা চোখ মুছলেন।
চলবে,,,