তরঙ্গিনী (পর্ব-১১) #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী (পর্ব-১১)

#আরশিয়া_জান্নাত

পদ্মার তীরে গড়ে উঠা রাজশাহী শহরটা ভীষণ সুন্দর একটা শহর। শুনেছিলাম এই শহরের বায়ু বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম দূষিত। এ শহরের রাস্তাগুলোর দু’পাশ গাছগাছালিতে ভরা, দৃষ্টিনন্দন সাজে সজ্জিত। বিশেষ করে স্ট্রিট ল্যাম্পপোস্টগুলো অনেক সুন্দর। আমি বিভোর হয়ে সব দেখতে লাগলাম। আরাফ বললো, ম্যাডাম আপনি কি ঠিক করেছেন বলুন তো? প্রতিটা লং ড্রাইভে হয় ঘুমোবেন নাহয় বাইরে চেয়ে থাকবেন? পাশে যে একজন আছে সে কথা ভুলে গেলেন,,,,

আমরা কোথায় যাচ্ছি বলুন তো?

গেলেই দেখবেন। রেবা আপনার প্রিয় গান কোনটা?

আমি গান শুনি না,,

সিরিয়াসলি?

হুম।

আপনি দেখছি রেয়ার পিস! গান শুনেনা এমন কেউ আছে,,,

আপনি চাইলে এখন গান শুনতে পারেন, আমার সমস্যা নেই।

একটা গান ডেডিকেট করি আপনাকে, প্লে করছি শুনুন। এর প্রতিটা লাইন অনুভব করবেন প্লিজ।

প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকে
রোজ দুইফোঁটা যেন আরও ভালো লাগে
গানে, অভিসারে, চাই শুধু বারেবারে
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে
বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে ধরবো তোমাকে।

পথ চেয়ে রই, দেরি করোনা যতই
আর ভোলা যাবেনা জীবনে কখনোই,
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি,
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে
বলো কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি?
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে
রং মিশে যায় রুক্ষ দুপুরে
সেই রং দিয়ে তোমাকেই আঁকি
আর কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি,,,,,,

আমি চোখ বন্ধ করে গানটা শুনলাম, এর প্রতিটা লাইন যেন আরাফেরই বলা। আরাফ বলল, কেমন লেগেছে? সুন্দর না?

শ্রেয়া ঘোষালের গান তাই না?

আপনি চিনলেন কিভাবে আপনি না গান শুনেন না?

শুনিনা,, তবে একসময় অনেক শুনতাম। ইনি আমার প্রিয় গায়িকা। আর আমার ভোক্যাল রিকগনাইজ পাওয়ার ভালো।

টেস্ট করতে ইচ্ছে করছে!

করতেই পারেন। তবে আমার অচেনা কেউ হলে সম্ভব না।

বুঝলাম। চলুন এসে পড়েছি।

পদ্মা নদীর কোল ঘেষে বাধাই করা পাড়। সবুজ ঘাসের গালিচা মাড়িয়ে আমরা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। সামনেই বিশাল তটিনী তার প্রবাহমান ধারায় বয়ে যাচ্ছে। পদ্মার কত গল্পই না শুনেছি আমি। তার রুদ্রানী রূপে কত মানুষ গৃহহারা হয়েছে। এই নদী নিয়ে আমার অনেক আগ্রহ ছিল। তাই এখানে বসে তাকে অবলোকন করাটা আমার কাছে স্বপ্নের চেয়ে কম নয়।

আরাফ বলল, এই জায়গাটা রিসেন্ট সংস্করণ করা হয়েছে। পদ্মা নদী নিয়ে আপনার অনেক ফ্যান্টাসি আছে আমি জানি, তাই এখানেই আসলাম। ভালো লাগছে?

জায়গাটা খুব মনোরম। আচ্ছা নৌকায় চড়ার ব্যবস্থা নেই?

আছে, তবে এখানে না। সেজন্য অন্য স্পটে যেতে হবে। আপনি চাইলে আমরা আরেকদিন ওখানে যাবো।

আচ্ছা।

আরাফ চারদিকে তাকিয়ে বলল, সবাই কেমন জোড়ায় জোড়ায় এসেছে এখানে, অথচ তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই দুজন‌ নাকি একজন।

আমি নড়েচড়ে বললাম, এসব তাদের বড্ড বাড়াবাড়ি। এমন পাবলিক প্লেসে ঘনিষ্ঠতা আমার বিরক্ত লাগে। আমি তো পারলে সব কটাকে ঢিল মেরে আলাদা করতাম।

আরাফ হাহাহা করে হাসতে লাগলো। তার হাসির শব্দে চারপাশ যেন‌ আলোড়িত হচ্ছে। আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম, হাসির কি আছে?

আরাফ হাসি থামিয়ে বললো, আপনার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। আপনাকে নিয়ে ঢাকার রমনা পার্কে কিংবা হাতির ঝিলে যাওয়া উচিত। ওখানের দৃশ্য দেখলে আপনি কি করবেন? এখানে তো জাস্ট একসঙ্গে বসে আছে,

আচ্ছা একটা কথা বলুন, কেউ তার ব্যক্তিগত সম্পদকে এমন জনসম্মুখে কিছু করবে? যারা ভ্রমর হয়ে মধু খেতে আসে তারাই ঝোপঝাড় খোঁজে, চারদিক পরোয়া না করে নোংরামি করে। প্রকৃত ভালোবাসা এখানে প্রকাশ পায় না।

আপনি যা বলেছেন তাতে আমার দ্বিমত নেই। তবে একসঙ্গে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে দোষ নেই কিন্তু।

আমি সংকোচ ভেঙে তার হাতে হাত রেখে বললাম, এভাবে?

সে আমার আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গলিয়ে শক্ত করে ধরে বলল, না এভাবে।

আমি উনার বাহুতে মাথা রেখে পড়ন্ত বিকেল উপভোগ করতে লাগলাম।

জীবনের শেষ সূর্যাস্তও যেন আমরা এভাবেই একসঙ্গে দেখতে পারি।

আপনার মনোঃকামনা পূরণ হোক!
হঠাৎ সে টিপ্পনী কেটে বলল, এখন কিন্তু আমরাও দুজন দেখাচ্ছি না!

আমি আরো শক্ত করে তার হাত জড়িয়ে বললাম, আমি আমার বরের হাত ধরেছি শুধু, অন্যকিছু তো করছিনা।

নিজের বেলা ষোলো আনা তাই না?

নাহ আপনার জন্য ষোলো আনা। আপনি যেহেতু সান লাভার, তাই আমার মনে হলো নিশ্চয়ই এভাবেই আপনি সূর্যাস্ত উপভোগ করতে চেয়েছেন, প্রিয়তমার হাতে হাত রেখে পাশাপাশি বসে,,,,

Woah! I’m impressed! আপনার বুদ্ধি খুলছে দেখছি, আমার সাথে থেকে থেকে রোমান্টিক হচ্ছেন। দারুণ!

তারপর আমরা ক্যাফেতে গিয়ে স্ন্যাক্স আর ফুচকা খেয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। ল্যাম্পোস্টের আলোয় রাতের শহরটা আরো বেশিই মায়াময় হয়ে উঠলো। আমি বহুবছর পর গুণগুণ করে গেয়ে উঠলাম,
চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম আর তুই কাকে ভালোবাসতি,,,,

আরাফ সাহেব আপনি কি তবে আগের রেবাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছেন? যে রেবা ভালোবাসতে জানতো, অপেক্ষা করতে জানতো। প্রিয় মানুষটিকে ঘিরে স্বপ্ন বুনতে জানতো। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে না জানলেও হয়তো এখন সে সেটাও পারবে। আপনি বোধহয় সত্যিই সফল, রেবার ভেতরের সবটায় আসিন হবার স্বপ্ন হয়তো শীঘ্রই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আপনাদের মিষ্টি ভালোবাসার সাক্ষী হতে। আপনার তরঙ্গিনীর আবেগঘন প্রবল উচ্ছাসে উচ্ছাসিত হতে,,,


বাসার সবার সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে আমি আরাফকে বললাম, আমার মনে হচ্ছে আপনার একবার ওখানে যাওয়া উচিত। জিহাদের বিষয়টা নিয়ে সবাই মোটামুটি টেনশনে আছে।

হুম কথা বলে তো তাই মনে হচ্ছে। সেজ চাচ্চু মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছেন।

হুম।

আমি বুঝতে পারছিনা জিহাদ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এরকম শেষ পর্যায়ে এসে গিভ আপ করার মতো ছেলে ও না। কিছু একটা তো হয়েছেই। আমাকেই হয়তো বিস্তারিত বলবে।

আপনি আর দেরী করবেন না, সময় বের করে চলুন গিয়ে দেখে আসি সবাইকে।

আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।

আরাফ ল্যাপটপে বিজি হয়ে গেল আর আমিও রাতের জন্য ভাত বসাতে চলে এলাম।
সত্যি বলতে সেজ চাচীর মুখ দেখার পর থেকে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। উনি সবসময় হাসিখুশী থাকেন, হঠাৎ এতো বিমর্ষ হয়ে গেছেন দেখে ভালো লাগছেনা। আর আমার মনে হচ্ছেনা কেবল ফাইনাল এক্সাম না দেওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই এমন মুষড়ে পড়বে। নিশ্চয়ই অন্য ঘটনা আছে যা আমরা দূরে আছি বলে কেউ জানাতে চাইছেনা।

এর দুইদিন পরই আমরা ঢাকায় আসি। পিহু আর রুহি এক মুহূর্তের জন্যও আমার পাশ ছাড়েনি। পুরোটা সময় আঠার মতো লেগে রইলো। সাথে তাদের কত শত গল্প। হঠাৎ রুহি বলল, জানো ভাবী সেদিন বড় ফুপ্পী বলছিল তোমরা কবে বাচ্চা নিবে। তোমরা এলেই যেন এ কথা কানে দেওয়া হয়।

পিহু বলল, উফফ তোর পেটেও কথা থাকেনা। ফুপ্পীর কথা ঠিকি মনে রেখেছিস অথচ মা যে নিষেধ করলো সেটা মনে নেই। ফাজিল একটা! ভাবী মা বলেছেন, এসব বলে তোমাদের বিব্রত না করতে। তোমরা নিজেদের চেনো বোঝো তারপর নাহয় ফ্যামিলি প্ল্যানিং করবে। তবে আশা করা যায় এটা শীঘ্রই হবে, ভাইয়া তো সবসময় বলে উনার বেবী অনেক পছন্দ। আগে কি বলতো জানো?
বৌ যদি রাজী থাকে আমি তো সাতটা বাচ্চা নিবো। আমার পরিবার হবে নয় সদস্যের নবরত্ন পরিবার হিহিহি।

রুহি— আমি নিশ্চিত এখন আর সেটা বলবেনা। ভাইয়া ভাবীকে যা ভালোবাসে মাশাআল্লাহ। একটাও নিতে বলে কি না সন্দেহ।

পিহু– হাহা সেটাও ঠিক। এখন বলবে লেবার পেইন সহ্য করে বাচ্চা নিতে হবেনা। আমার বৌ ভালো থাকলেই হলো।

রুহি আর পিহু হেসেই যাচ্ছে। আমি লজ্জায় লাল নীল হচ্ছি। তখন আরাফ এসে গম্ভীর স্বরে বলল, রেবা রুমে আসুন।

উনার চেহারা দেখে রুহি আর পিহু হাসি থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। আমাকে ইশারায় বলল, জলদি যাও।

আমি দ্রুত রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি বেলকনীতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার পেছনে দাঁড়াতেই উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, কি হয়েছে?

আপনার কেমন আক্কেল বলুন তো রেবা? আমরা এখানে এসেছি ১৪ঘন্টা হয়ে গেছে। আপনি একটাবার রুমে আসেননি। আমি যে আছি সেটাও ভুলে গেছেন? সবার মধ্যিমণি হয়ে বসে আছেন, না পারছি তাদের সামনে গিয়ে ডেকে আনতে না পারছি সহ্য করতে। এতো নির্দয় আপনি হুহ!

আমিতো ভেবেছি আপনি বাবার সঙ্গে অফিসে গেছেন, আপনি বাড়িতেই থাকবেন ভাবিনি তো! আর আমিই কি করবো এতোদিন পর সবাইকে দেখেছি, কত গল্প করছে সবাই। আমি উঠে আসবো কি করে?

আমি এতো কথা জানিনা, আপনি প্রতি ঘন্টায় একবার আমায় হাজিরা দিবেন। না একবার না তিনবার দিবেন।

আপনি পাগল হয়ে গেছেন। এমনিতেই ওরা যা বলে, আমি যদি এতোবার ঘরে আসি কি হবে ভাবতে পারছেন?

আমার বাড়ির সবাই পাগল হয়েছে আমি না। আগে তো এরা সারাদিন আড্ডা দিতো না। এখন এমন হয়েছে কেন? আর শুনুন কে কি বলল ও নিয়ে আমি ভাবি না। বিয়ে করেছি আমি, বৌও আমার। আমার বৌকে আমি দেখবো না তো কে দেখবে? আমিতো পারলে আপনাকে পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। সারাদিন আমার বুক পকেটে থাকবেন, আর আমি একটু পরপর পকেট ফাঁক করে দেখবো।

হাহাহাহা আরাফ আপনি পারেনও বটে। হাহাহা

উফফ একদম বুকে লাগছে। এতো সুন্দর করে হাসতে হয় আপনার,,,

ঢং ছাড়ুন তো। ওভার এক্টিং হচ্ছে এবার।

বেশি হয়ে গেল বুঝি?

আমি তার চুলগুলো এলোমেলো করে বললাম, আপনি আসলেই অনেক কিউট। একদম নিব্বা টাইপ!

একদম না। মনের কথা সম্পূর্ণ প্রকাশ করলেই আপনারা ভাবেন ফ্ল্যার্ট করছে, এটা কিন্তু ঠিক না। সবাই যদি লুকিয়ে রাখে প্রকাশ করবে কে? আমরা এক্সট্রোভার্টরা আছি বলেই মানবতা, প্রেমবতা এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। নয়তো সব অনুভূতি বাক্সবন্দী হয়েই রয়ে যেত, প্রজন্ম আর এগোতো না।

জ্বি জ্বি আপনারাই তো প্রেমবতা জিইয়ে রেখে সাত আটটা বাচ্চার প্ল্যান করেন, তাই তো প্রজন্ম টিকে আছে। আপনারা মহান! হলেন খুশী?

এই এই ওয়েট। সাতটা বাচ্চার প্ল্যান? আপনি এ কথা জানলেন কিভাবে? রুহি বলে দিছে না?

আপনার এই প্ল্যানিং তো বাসার সবাই জানে। দেখুন কি চিজ আপনি!

আরাফ চুপসে যাওয়া আমের মতো মুখ করে বলল, তো কি হয়েছে? বিয়ের আগে মানুষের কত ভাবনাই থাকে। আমি কি এখন আপনার জান রিস্কে ফেলে এতো বাচ্চা নিবো নাকি?
দুটো হলেই চলবে, একটা মেয়ে আরেকটা ছেলে।

আমি রেলিং এ হেলান দিয়ে বললাম, ওরা এটাও বলছিল।

হাহ! আমার কোনো লাভ লস নাই আমার জীবনটাই লস।

আমি হাসি আটকে বললাম, আহারে বেচারার জীবনটাই লস!!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here