টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০১,০২

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩),০১,০২
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০১

০২-রা জুন, ২০২২।
সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রিহান জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে। রিমঝিম বৃষ্টি। সামনের সড়ক দিয়ে যানবাহনগুলো ছুটে চলেছে। পথচারীরা হাঁটছে ছাতা মাথায় দিয়ে। কেউ কেউ দাড়িয়ে দোকান থেকে এটা-সেটা কিনছে। রাস্তার ওপাশে একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে কয়েকজন বাচ্চা ফুটবল খেলছে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। এদের খেলার মতো পর্যাপ্ত খোলা মাঠ নেই, তাই বাড়ির ছাদটাকেই মাঠ বানিয়ে নিয়েছে। ওদের খেলা দেখতে দেখতে রিহান সুফিয়ার কথা ভাবলো। সুফিয়া যেদিন মারা যায়, ৯ই জুলাই, ২০১৮। সুফিয়া সেদিন ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিল আজকের দিনটার ব্যাপারে। সে বলেছিল- আজকের এই দিনে রিহান আবার অতীতে যাবে। তাই সকাল থেকেই সে আজ খুব উত্তেজিত। অবশ্য কয়েকদিন ধরেই তার ভেতরে এই উত্তেজনাটুকু কাজ করছে। কিন্তু, আজ একটু বেশি। আচ্ছা, কী করে সে অতীতে যাবে? আগেরবার তো একটা সেকেলে বাসে ওঠেছিল সে, বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর ঘুম ভাঙতেই দেখে অতীত। কিন্তু এইবার সে কী করে যাবে অতীতে? বৃষ্টির জন্য তো বেরোতেই পারছে না সে। এই জানালার পাশে বসা অবস্থাতেই কি সে অতীতে চলে যাবে?

রিহানের দাদি সাহারা বানু এসে দাঁড়ালেন পেছনে। কয়েকদিন আগে তাদের বাড়িতে এসেছেন তিনি বেড়াতে। ছোটো ছেলের সাথেই তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন মূলত। মাঝেমধ্যে বাকি ছেলেমেয়েদের বাসায় বেড়াতে যান। এখন এসেছে রিহানদের বাড়িতে।

‘দাদি, তুমি? আসো, বসো এখানে।’ দাদির উপস্থিতি বুঝতে পেরে বললো রিহান।

‘একা একা এখানে বসে আছিস কেন দাদুভাই? কী হয়ছে? মন খারাপ?’

‘না দাদি, বৃষ্টি দেখছি। ভালো লাগছে।’

‘এভাবে একা একা বৃষ্টি দেখলে ভালো লাগবে, বল? বৃষ্টি দেখতে হয় সঙ্গী নিয়ে।’ রিহানের পাশে বসতে বসতে বললেন সাহারা বানু।

‘এই তো তুমি আসছো, সঙ্গী।’

‘বুদ্ধু! আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি। আমার সাথে দেখেও মজা নেই। বিয়ে করছিস না কেন? তোর বিয়েটা কি দেখে যেতে দিবি না?’

‘আহ্ দাদি, ইমোশনাল হইয়ো না-তো। এখন বলো তো, দাদার সাথে বসে কখনও বৃষ্টি দেখেছ?’

‘কত বৃষ্টি দেখেছি তোর দাদার সাথে! বৃষ্টিতে ভিজেছি, মজা করেছি। আহ্, কত স্মৃতি তোর দাদার সাথে! একবার কী হয়েছিল জানিস?’

‘কী হয়েছিল?’

‘খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আমাদের বাড়িতে তো সে সময় টিনের ছাউনি ছিল। টিন বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়লে আমরা কলসিতে ভরে নিতাম৷ সেদিন তোর দাদাকে বললাম বৃষ্টির পানি ভরতে। তো কলসিটা নিয়ে যখন উনি পানি ভরতে গেলেন, আমি পেছন থেকে ধাক্কা দিলাম। কলসিসহ উনি উঠোনে পড়ে গেলেন। আমি হাসতে লাগলাম। উনি তখন উঠে এসে আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলেন উঠোনে৷ আমি ছাড়তে বললেও ছাড়েনি। পরে দুজন ভিজলাম অনেক৷ হঠাৎ কিছুটা দূরে খেয়াল হতেই দেখলাম একটা ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আমি তোর দাদাকে তখন ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে যাই৷ সেই ধাক্কাতে পড়ে গিয়ে তোর দাদার পা মচকে গিয়েছিল। কয়েকদিন হাঁটতে পারেনি ঠিকমতো।’

‘আহ্, বেচারা দাদার এমন অঘটনটা কেমনে করলা তুমি? আচ্ছা, এটা কখনকার সময়ের ঘটনা ছিল?’

‘সালটা মনে নাই ঠিক। ওই সময় আমার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিল।’

‘তোমার বিয়ের সালটা মনে রাখতে পারোনি?’

‘আরে তখন কি আর এই সময়ের মতো অত রংঢং ছিল?’

‘সে যাহোক, তোমার নামটা কে রেখেছে বলো তো?’

‘আমার বাবা রেখেছে।’

‘তোমার বাবা আমার কাছ থেকে শুনেই তো তোমার নামটা রেখেছিল সেই সময়।’

‘হা হা হা। হ্যাঁ, তোর কাছ থেকে শুনেই তো আমার নামটা রেখেছিল।’ সাহারা বানু কথাটা মজা হিসেবেই নিলেন৷ কিন্তু, রিহানের কথাটা মোটেও মজার ছিল না। সে সময় তার দাদির বাবা খিজির তার কাছেই শুনে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সাহারা বানু। ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুত! রিহান নামটা শুনেছে তার দাদির মুখ থেকে। আবার সে অতীতে গিয়ে নামটা বলেছে দাদির বাবাকে। পরে দাদির নাম রাখা হয় ওটা৷ ব্যাপারটা ভাবতেই হাসলো রিহান। কথার ফাঁকে রিহান তার দাদির সাথে আরও গল্প চালিয়ে যেতে লাগলো অতীতের৷

বিকেলের দিকে বৃষ্টি থেমে গেছে। রিহান বের হলো বাইরে। সাথে একটা ব্যাগ নিয়েছে সে পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে। কোনোভাবে যদি সুফিয়ার কথাটা সত্যি হয়ে, সে অতীতে চলে যায়, তবে কাপড়-চোপড় নিয়ে সমস্যা হতে পারে৷ তাই প্রয়োজনীয় সবকিছু ব্যাগে নিয়েছে সে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো সে। বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘ এখনও কাটেনি। তাই সন্ধ্যার হওয়ার আগেই যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিন্তু, আর কতক্ষণ সে অপেক্ষা করবে? এখনও কিছুই ঘটলো না অতীতে যাওয়ার ব্যাপারে? সুফিয়া কি তবে মিথ্যা বলেছিল? না, না, মিথ্যে বলেনি সে৷ মিথ্যে হলে রিহানের ছোটো ছেলে ইকবালের জন্মই হতো না৷ দুই ছেলের কথা মনে পড়লো রিহানের। ইকবাল কারাগারে আছে। শহিদকে খুনের ব্যাপারে সে ওই সময় স্বীকারোক্তি দিয়েছিল আদালতে। এরপর থেকে কারাগারেই তার দিনগুলো কাটছে। ইকবালের সাথে রিহানের খুব বেশি মেশা হয়নি, তাই তার জন্য রিহানের মনে খুব একটা দাগ কাটেনি। কিন্তু, ইউসুফ সাহেবের কথা মনে পড়তেই রিহানের চোখটা ভিজে ওঠলো। গতবছর মারা গেছেন তিনি হার্ট-অ্যাটাকে। বর্তমানে ইকবাল ছাড়া রিহানের অতীতে যাওয়ার আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। ইকবালও যদি মারা যায়, তবে রিহানের অতীতে যাওয়ার শেষ চিহ্নটাও মুছে যাবে পৃথিবী থেকে।

রাস্তার পাশে একটা টং দোকানে দাঁড়িয়ে রিহান এক কাপ চা চাইলো৷ দোকানি এক কাপ চা এগিয়ে দিলে সে ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিতে লাগলো৷ হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দে রিহান তাকালো। তখন সে দেখতে পেল অদ্ভুত সেই বাসটাকে৷ বাসটা গতি কমিয়ে থেমেছে তার পাশে। হেলপার আগেরজন নেই। নতুন হেলপার দেখা যাচ্ছে। হাক ছেড়ে সে যাত্রী ডাকছে। কিন্তু কোনো যাত্রী না পেয়ে চলে যেতে চাইলো। তখন রিহান, একটা একশো টাকার নোট টং দোকানিকে দিয়ে বললো, ‘গাড়ি চলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চায়ের দামটা নিন।’

‘ভাংতি তো নাই৷ খুচরা দ্যান ভাই।’ দোকানি নোটটা ফিরিয়ে দিলো।

‘আহ্৷ খুচরা তো নেই। গাড়িটাও চলে যাচ্ছে।’

‘কী কন ভাই? ওখানে তো কোনো গাড়ি-ই নেই?’

‘গাড়ি নেই মানে? ওই যে অদ্ভুত গাড়িটাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?’

‘গাড়ি কই পাইলেন ভাই আপনে? রাস্তা তো খালি?’

‘গাড়ি নেই!’ চমকে একবার দোকানির দিকে তাকালো সে, আরেকবার রাস্তায়৷ গাড়িটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল। রিহান দোকানির উদ্দেশ্যে বললো, ‘টাকাটা পরে দিচ্ছি আপনাকে।’ বলেই দৌড় দিলো সে গাড়িটাকে ধরতে৷ বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ে সে গাড়িতে উঠে পড়লো। দেখলো, গাড়িতে একটা মাত্র সিট খালি। ওই আগের সিটটা, যেটাতে সে আগেরবারও বসেছিল। সিটটাতে বসে সে কিছুক্ষণ হাঁপাতে লাগলো। বাইরে আবার গুটিগুটি বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আচমকা জোরে একটা বজ্রপাতের শব্দ হলো। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো রিহান সাথে সাথে। তারপর গাড়িটা তাকে কোথায় নিয়ে চললো কিছুই জানে না সে৷

পরে জ্ঞান ফিরলো তার গাড়ির হেলপারের ডাকে৷ রিহান চোখ খুলে তাকালো হেলপারের দিকে। কিন্তু, হেলপারটাকে সে চিনতে পারলো না। মনে হচ্ছে সেকেলে পোশাক পরে কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে আর কোনো যাত্রীও নেই, সবাই নেমে গেছে। রিহানকে চোখ খুলতে দেখে হেলপার কিছুটা বিরক্তিভাব নিয়ে বললো, ‘কী মশাই, গাড়িতে উঠলেই কি সিটটারে নিজের বেডরুম ভাবা শুরু কইরা দ্যান? কহন থেইক্কা ডাকতাছি আপনেরে, উঠতাছেন না।’

‘ওহ্, দুঃখিত ভাই। ভাড়া কত হয়ছে আমার?’

‘দশ আনা দ্যান।’

‘ভাই, আমার কাছে তো ভাড়া নেই।’

‘গাড়িতে উইঠা মরার মতো ঘুমান, আবার কন ভাড়া নাই?’

‘ভাড়া আছে। তবে আপনার টাকার সাথে আমার টাকার মিল নেই। আপনি এক কাজ করুন, আমার হাতের ঘড়িটা রেখে দিন।’ বলেই রিহান হাতঘড়িটা খুলে হেলপারের হাতে দিলো। হেলাপারের চোখেমুখে এবার খুশির ঝিলিক দেখা গেল। রিহান গাড়ি থেকে নামতে নামতে হেলপারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ কত তারিখ ভাই?’

‘দুই জুন।’ ঘড়িটা নিজহাতে পরতে পরতে জবাব দিলো হেলপার।

‘০২-রা জুন। আচ্ছা এটা কি ১৯৬৪ সাল?’ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো রিহান। হেলপারটা মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বললো, ‘মজা লন ভাই? সালডাও কি জিজ্ঞেস করা লাগে? হ, এইডা ১৯৬৪ সাল। এইবার নাইমা যান তো মিয়া গাড়ি থেইকা।’ রিহানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো হেলপার। তার ভয়- ঘড়িটা আবার যদি ফিরিয়ে নেয়।

রিহান গাড়ি থেকে নামলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। চারপাশটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কিছুটা দূরে কিছু দোকান দেখা গেল। ল্যাম্প জ্বলছে ওখানে। রিহান ওদিকে এগিয়ে গেল। ওদিকে কিছুটা আলো জ্বলছে। কাছে এসে সে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করলো। চিনতে পারলো সে। এটা সুফিয়াদের এলাকা ছিল। সামনে একটা মসজিদ আছে। আর কিছুটা দূরে গেলে জাফর মাস্টারের বাড়িটা পাওয়া যাবে। সেই ১৯৪২ সালে বাড়িটা থেকে সুফিয়াকে ব্রিটিশরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এখন ১৯৬৪ সাল। বাড়িটার এখন কী অবস্থা কে জানে। কারা থাকে? না-কি এখনও খালি পড়ে আছে? রিহান এগিয়ে গেল সুফিয়াদের বাড়িটার দিকে।

[[চলবে… ]]

টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০৩)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০২

সুফিয়ার বাড়িটাতে একটা পুরনো তালা ঝুলছে। কিছুক্ষণ তালাটা নেড়েচেড়ে দেখলো রিহান। পুরনো তালা, জং ধরেছে। অনেকদিন হয়তো খোলা হয় না। তারমানে বাড়িটাতে কেউ এখন আর থাকে না। রিহান তালাটা ধরে টান মেরে খুলতে চাইলো, কিন্তু খুললো না। শব্দ শুনে কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে বের হলো পাশের একটা বাড়ি থেকে, হাতে একটা কুপি। কুপিটা যাতে নিভে না যায় তাই সে বাঁহাতের তালুটা প্রশস্ত করে ধরেছে শিখার একপাশে। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আকাশের চাঁদটা মেঘে ঢেকে গেছে। ঠান্ডা বাতাস আর ভেজা মাটিতে বোঝা গেল এখানেও কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। কুপি হাতে মেয়েটা কাছে এলো। বয়স ষোলো-সতেরো। রিহানের কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপ্নে?’

রিহান মুহূর্তেই জবাব দিতে পারলো না। মেয়েটা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপ্নে? কথা বলতাছেন না ক্যান?’

এবার রিহান আমতা আমতা করে জবাব দিলো, ‘আমার নাম রিহান। এই বাড়িটা… এই বাড়িটাতে কেউ থাকে না?’ বাড়িটার দিকে ইশারা করলো রিহান।

‘না, অনেকবছর ধইরা এইভাবে পইড়া আছে বাড়িডা।’

‘সুফিয়াদের বাড়ি না এইটা? জাফর মাস্টারের বাড়ি…’

এবার মেয়েটা যে ঘর থেকে বের হলো, ওই ঘরের ভেতর থেকে একটা মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে রে শিউলি ওইহানে? কারে চায়?’

‘সুফিয়া খালারে চায়।’ শিউলি গলার আওয়াজ উঁচু করে জবাব দিলো। মহিলাটা এবার ক্ষীণ আলোতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কুপির আলোতে এলে রিহান তার চেহারায় একটা পরিচিত আদল দেখতে পেল। হয়তো আগেও দেখেছে সে এই মহিলাকে। মহিলাটাও কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কে বাবু আপ্নে? আপ্নেরে চেনা চেনা লাগে।’

‘আমার নাম রিহান। অনেক বছর আগে এই বাড়িতে আমি থাকতাম। জাফর মাস্টার আমাকে খুব দেখতে পারতো।’

মহিলাটা শিউলির হাত থেকে কুপিটা নিয়ে রিহানের সামনে ধরলো, খুঁটিয়ে রিহানের চেহারায় কী যেন পর্যবেক্ষণ করে বললো, ‘আপ্নে সেই রিহান না? যার লগে সুফিয়ারে লইয়া কানাঘুষা চলছিল? সুফিয়ার বিয়া ভাইঙ্গা গিয়াছিল?’

‘হ্যাঁ, আমি সেই রিহান।’

‘কিন্তু আপ্নে তো এহনও ওইরহমই আছেন। বয়স তো বাড়েনাই আপ্নের। এও কি সম্ভব?’ বলতে বলতে মহিলাটা শিউলির হাত ধরলো, কাঁপছে সে কী যেন ভয়ে। তারপর শিউলিকে টেনে দৌড় দিতে দিতে বললো, ‘শিউলি পালা, এইডা মানুষ না।’

দৌড় দিলো ওরা। বাতাসের ঝাপটায় কুপিটা নিভে গেল। একজনের উপর আরেকজন পড়লো ওরা। তারপর উঠে কার আগে কে ঘরে ঢুকতে পারে তার প্রতিযোগিতা চললো। খট করে একটা শব্দ হলো জোরে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। ওরা কী কারণে ভয় পেয়েছে রিহান তা বুঝলো। ওদের দরজায় গিয়ে সে কয়েকবার টোকা দিতে দিতে বললো, ‘শুনুন, আমি ভূত না। দরজা খুলুন।’

শিউলির কণ্ঠ শোনা গেল, ‘মা, উনি ভূত না কইছে।’

‘চুপ, গলার আওয়াজ বাড়াইস না। হাত ঢুকাইয়া টেনে লইয়া যাইবো। কোনো ভূত কি স্বীকার করবো হে ভূত?’ শিউলির মা চাপা কণ্ঠে মেয়েকে বোঝাতে লাগলো।

‘দাঁড়াও মা, আমি কুপিডা জ্বালাইয়া দেইখা আসি হে আসলে ভূত না-কি মানুষ। ভূত হইলে মাডিতে তার পা ছুঁইবো না। মাডি থেইকা কিছুডা উপরে থাকবো তার পা।’

‘খবরদার! এ কাম করবি না। তুই ওরে দেখতে যাবি আর আমারেও ভূতের হাত মারবি।’

ওদের মা মেয়ের কথা শুনে হাসলো রিহান। পুরনো এই যুগটাতে কতটা যে ভূতের বিশ্বাস ছিল তা বুঝতে পারলো সে। ওদের বাড়ির জানালাটা খোলা ছিল। জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলো আসছিল। ওদিকে এগিয়ে গেল রিহান। ভেতর থেকে একজন দৌড়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলো। হয়তো শিউলির মায়ের কাজ এটা। রিহান পুনরায় বললো, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি ভূত না।’

‘মা, লোকডা সত্যি কইতাছে হয়তো। ভূতেরা তো আগুন ভয় পায়। হে কিন্তু জ্বলন্ত কুপি দেইখা ভয় পাইনাই।’

‘হ, ভূতডার বইয়া গেছে যে হে তোর সামনে ভয় পাইছে যে হেইডা দেখাইবো। ইস্মার্ট ভূত চিনোস? এইডা হইলো ইস্মার্ট ভূত। হে রে আমি বাইশ বছর আগেও দ্যাখছি, এইরহম। আমার থেইকা বয়সে অনেক বড়ো ছিল হে। এহন দ্যাখ, খুঁজলে আমার মাথায় দুয়েকডা পাকা চুল পাবি, তয় হে এহনও আগের লাহান থাহে কী করে ক?’

‘সত্যি লোকডা বাইশ বছর আগেও এরহম ছিল?’

‘হ, এইরহমই ছিল। চুপ থাক, এত জোরে কথা কস ক্যান?’

‘ঠিক আছে, মা। তুমিও চুপ থাহো।’ মায়ের গা ঘেঁষে ফিসফিস করলো শিউলি।

রিহান আর ওদের বিরক্ত করলো না। সকালে ওদের ভুলটা ভাঙানো যাবে। এখন আপাতত রাতটা কাটানো যাক সুফিয়াদের বাড়িটাতে। পেট চু-চু করে ওঠলো খিদায়, কিন্তু পাত্তা দিলো না। এখন খিদে লাগলেও কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না। উপোস কাটাতে হবে রাতটা৷

একটা ভাঙা ইট খুঁজে নিয়ে রিহান দরজায় লাগানো তালাটা ভাঙলো। তারপর ঠেলা দিতেই ক্যাচক্যাচ করে খুলে গেল দরজা। অনেকদিন আলো-বাতাস ঢুকেনি ভেতরে। একটা ভ্যাপসা গন্ধ লাগলো নাকে৷ ফোনের আলোতে রিহান ভেতরটা হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলো৷ সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু মাকড়সার জাল বেড়ে গেছে ঘরের চারপাশে, আর এখানে সেখানে ঘুণ জমেছে৷ সামনের কক্ষে যে বিছানাটাতে জাফর মাস্টার ঘুমাতো, ওটা ঝেড়ে পরিষ্কার করলো রিহান। বিছানার পাশে একটা ছোটো আকারের সেগুন কাঠের টেবিল আছে। ওখানেও ঘুণ জমেছে। টেবিলের উপর শতশত পুরনো পত্রিকা ভাজ করা আছে। সুফিয়া নিশ্চয়ই নিজ হাতে গুছিয়ে রেখেছিল এসব। বড্ড গুছালো মেয়ে ছিল সে। উপরের পত্রিকাটা হাতে নিলো রিহান। আগস্টের শেষ তারিখের পত্রিকা, নবযুগ। পত্রিকার উপরে বড়ো বড়ো করে শিরোনাম দেয়া, ‘নজরুলের অবস্থার আরও অবনতি’, শিরোনামটা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রিহান। নজরুল এবং রস গ্রেগরি এই দুইটা লোককে বেশি পছন্দ করতো সুফিয়া। পত্রিকার এই শিরোনামটা হয়তো বড্ড কষ্ট দিয়েছিল সে সময় তাকে। ব্যাগটা বিছানায় রেখে সুফিয়ার কক্ষের দিকে গেল রিহান। দরজাটা ভেজানো ছিল, হালকা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সে। ভ্যাপসা গন্ধটা আর নাকে লাগছে তার। বাতাসে যেন এখন সুফিয়ার গায়ের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে। জোর শ্বাস টেন বুক ভরে বাতাস নিলো রিহান। কক্ষের চারপাশে চোখ বুলালো৷ হাত দিয়ে মাকড়সার জাল সরিয়ে বাঁপাশের দেয়ালের পাশে দাঁড়ালো সে। দেয়ালে এখনও নজরুল আর রস গ্রেগরির পেপার-কাট ছবিগুলো বিদ্ধ হয়ে আছে। ছবিগুলোর উপর হাত বুলালো রিহান। এগুলোতে সুফিয়ার স্পর্শ লেগে আছে এখনও। চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শটুকু অনুভব করলো রিহান। পাশের দেয়ালের নিচে একটা সিন্দুক দেখা গেল। জং ধরেছে সিন্দুকে, তবে কোনো তালা নেই। সিন্দুকটা খুললো রিহান। ভেতরে সুফিয়ার কিছু জামাকাপড় আছে। তবে একদম উপরে দুইটা গাঁদা ফুলের মালা শুকিয়ে পড়ে আছে। চিনতে পারলো রিহান মালা দুইটা। জাফর মাস্টারের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে সে মালা দুইটা কিনেছিল সুফিয়ার জন্য। সুফিয়াকে দেয়া তার প্রথম উপহার এগুলো। হাত দিয়ে মালা দুইটা নিতে গিয়ে কী যেন ভেবে থেমে গেল। এভাবে হাতে নেয়া যাবে না মালা দুইটা, ঝরে পড়তে পারে। তখন মনে হবে সুফিয়ার বুকেই সে ছোরা দিয়ে আঘাত করেছে। এমনটা সে করতে পারে না। মুখটা নিচু করে সে মালা দুইটার গন্ধ নিলো। মিষ্টি ঘ্রাণ, তবে গাঁদা ফুলের না, সুফিয়ার চুলের গন্ধ পাচ্ছে সে। কয়েকমুহূর্ত সে চেয়ে রইলো শুকনো মালা দুটোর দিকে। তারপর চোখ বেয়ে তার টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মালা দুটোর উপর।

সুফিয়া যে জায়গাটাতে সারাক্ষণ বিচরণ করতো রিহান আজ সেখানে, কিন্তু সুফিয়া নেই। একপাশে সুফিয়ার বিছানা পড়ে আছে। বিছানাটা ঝাড়লো রিহান। বালিশের পাশে একটা লম্বা চুল খুঁজে পেল সে। চুলটা পেয়েই যেন সে গুপ্তধন খুঁজে পেল। পরম যত্নে চুলটা তুলে নিয়ে বুকের সাথে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরলো সে। সুফিয়া নেই, তবে তার অঙ্গের যে একটা চুল পেয়েছে, এটাও কম কীসে? বালিশের নিচে আরেকটা জিনিস দেখে রিহানের চোখ আটকে গেল। একটা রুমাল। রুমালের উপর রিহান আর সুফিয়ার নামের অক্ষর লেখা। সুফিয়া নিজ হাতে এই কারুকাজটা করেছিল, যখন ওরা জমিদার বাড়িতে থাকতো। সে সময় সুফিয়া প্রেগন্যান্ট ছিল, ভারি কোনো কাজ করতো না তেমন। তাই বসে বসে সময় কাটাতে সে এরকম নকশা করতো। শেষবার এই রুমালটা রিহান সুফিয়ার হাতে দেখেছিল, যখন ব্রিটিশরা তাঁকে জমিদার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন। জাপানিরা যখন জঙ্গলে একটা বাসগাড়িতে তাকে বেঁধে রেখেছিল, সুফিয়া তার গলায় ছুরি চালিয়ে পালিয়ে যায়, সে সময়ও সুফিয়ার হাতে রুমালটা ছিল। হ্যাঁ, রিহানের স্পষ্ট মনে আছে, ডানহাতে তার ছোরা ছিল, বাঁহাতে ছিল রুমালটা। কিন্তু রুমালটা এখানে এলো কী করে? তারমানে সুফিয়া এখানে এসেছিল আবার। নিশ্চয়ই ওই সময় সে পালিয়ে পুনরায় এখানে এসেছিল। এখানে রাত কাটিয়েছে। হয়তো কয়েকদিন এখানে থেকেছেও সে ব্রিটিশ আর জাপানিদের কাছ থেকে গা ঢাকা দিতে। তারপর হয়তো ভুলে রেখে গেছে সে রুমালটা, অথবা হয়তো তার মনটা বুঝে গিয়েছিল রুমালটা একদিন এভাবে রিহানের হাতে এসে পড়বে। মুখে উপর বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরলো রিহান রুমালটা। রুমালের উলটোপৃষ্টে সুফিয়ার কাঁপা হাতের একটা লেখা দেখতে পেল সে। সুফিয়া লিখেছে, ‘যুগের অবসানে যদি আর মিলিত না হই, যদি সময় মোদের আর মিলাতে না চায়, তবে বন্ধু গো আমার থেকো না অপেক্ষায়, হে প্রিয়তম, বিদায়।’

লেখাটা পড়ে চোখ ভিজে উঠলো রিহানের। এটা লিখতে হয়তো সে সময় সুফিয়ার বুকটা ফেটে গিয়েছিল কষ্টে। হয়তো চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু পড়েছিল লেখাটার উপর। এখন নতুন করে আরও কয়েক ফোঁটা অশ্রু যোগ হলো রিহানের। খুঁজে পাওয়া চুলটা রুমালে গুঁজে নিয়ে ভাজ করে রুমালটা নিজের কাছে রাখলো রিহান। তারপর মনে মনে বললো, ‘সুফিয়া, আর কিছুটা সময় অপেক্ষা করো, আমি তোমাকে খুঁজে নেবো যেখানে তুমি থাকো।’

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here