ছেঁড়া বাঁধন পর্ব- ৯,১০

ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৯,১০
(নূর নাফিসা)

.
ফেরার পথে স্টেশনারি দোকান থেকে ঘুরে এলো। মেয়ের পেন্সিল শেষ বলেছিলো, তাই এক বক্স পেন্সিল নিলো। সাথে রাবারও বলেছিলো মনে আছে। কিন্তু কি ফ্লেভারের কথা যেন বলেছিলো সেদিন, তা ভুলে গেছে। তাই দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো ফ্লেভার জাতীয় কোনো রাবার আছে কি না। দোকানদার ম্যাংগো, অরেঞ্জ আর স্ট্রবেরি ফ্লেভারের বারার বের করলে ঠিক কোনটার কথা বলেছে তা মনে করতে না পারায় ফাইজাকে কল করেছিলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এবং আরও কিছু লাগবে কি না তা জানার জন্য। কিন্তু ফাইজার ফোন রিসিভই হলো না। তাই তিনটা ফ্লেভার থেকে তিনটা রাবার নিলো। সাথে নিলো একটা পেন্সিল কাটার, আরেকটা খাতা। বাড়ি ফিরে আজ আবারও লক্ষ্য করলো ফাইজাকে। মনযোগ দিয়েই দেখলো কিন্তু কথা বললো না। ইশ! চেহারার কি হাল! কেমন দেখাচ্ছে তাকে! রোগাটে কাঠ! শরীরে যেন ওই পেটটাই ভেসে আছে শুধু। অথচ গড়নে কি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলো ফাইজা! আজ অনুধাবন করতে পারছে, এসবের জন্যও দায়ী নোমান নিজেই। নওরিন আসার সময় কি যত্নশীল ছিলো সে, আজ কেন অবহেলা করছে! কাজটা তো মোটেও ঠিক হচ্ছে না! ধীর নিশ্বাস ফেলে সে রুমে গেলো। কানে ভেসে এলো ইশার আজানের শব্দ। একসময় নামাজ পড়তোই না। তারপর আবার নিয়মিত পড়তে শুরু করেছিলো ফাইজা এবং সে, উভয়ই। সময়টা ছিলো নওরিন জন্মের কিছুদিন পর। তারপর বহুদিনের অভ্যাস আবার বদলে গেলো কয়েক মাস যাবত। মাঝে মাঝে পড়ে, আবার পড়ে না। আজ হঠাৎ আজানের শব্দ লক্ষ্য করে পড়ার ইচ্ছে জাগলো। মনটা যেন হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছে। তাই পোশাক পাল্টে ওযু করে মসজিদে চলে গেলো। যাওয়ার সময় নওরিনের রুমের দিকে তাকিয়ে বলে গেলো,
“দরজা লাগিয়ে যাও।”
সে চলে গেলে ফাইজা দরজা লাগিয়ে দিয়ে এলো। মেয়ের পড়া ধরে লিখতে দিয়ে আবার কিচেনে গেলো। আজ দুপুরে রান্না সেরেছিলো তাই খাবার গরম করতে হবে এখন। একটু পর নওরিন লেখা শেষ করে মায়ের কাছেই যাচ্ছিলো, মাঝপথে যেতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ফাইজা নওরিনকে দেখে বললো,
“দরজা খুলে দাও।”
নওরিন দরজা না খুলে চলে গেলো কিচেনে,
“তুমিই খুলে দাও।”
মেয়ে সাহস পাচ্ছে না তাই বাধ্য হয়ে ফাইজাই গেলো। দরজা খুলে সে কিচেনে গেলো, দরজা লাগিয়ে নোমান গেলো নওরিনের রুমে নওরিনের খোঁজে। কিন্তু নওরিনকে পেলো না তাই কিচেনেই যেতে লাগলো। সিড়ি দিয়ে উঠার সময়ই ভেবে এসেছে মেয়ের ভয় ভাঙাবে। তার শপিং তার হাতে তুলে দিবে। তাই এখন কিচেনে এসেই মেয়েকে নিতে এলো। ফাইজা তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে পেছনে তাকাতেই নওরিন হুট করে তাকে ঝাপটে ধরলো। নোমানও থেমে গেছে মেয়ের অবস্থা দেখে! এতো ভয় পায় তার মেয়ে! সেদিনের গলা জড়িয়ে কোলে বসে থাকা তার নওরিন কোথায়? সে হাত বাড়িয়ে বললো,
“এসো বাবাই।”
নওরিন আরও চেপে গেলো মায়ের সাথে। নোমান তার একটা হাত ধরে বললো,
“তোমার জন্য কি এনেছে বাবাই, দেখে যাও।”
নওরিন হাত টেনে নিতে চাইলে নোমান তাকে টেনে কোলেই তুলে নিলো। নওরিন কাঁদোকাঁদো চেহারায় মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে উচ্চারণ করে বললো,
“আম্মু”
চোখ থেকে পানি পড়তেও শুরু করেছে। ফাইজা কি করবে আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নোমান কি করতে চাইছে। মেয়ে যে ভয় পাচ্ছে, তার কতটুকু কদর সে করছে। তা-ই দেখছে। আজ গলা এতো নরম কেন? আদর উতলে পড়ছে নাকি মেয়ের জন্য? মূলত তার উদ্দেশ্য দেখার জন্যই চুপ হয়ে আছে ফাইজা। এদিকে নওরিন কেঁদেই দিয়েছে। নোমান তাকে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলতে লাগলো,
“বাবাই, বাবাই, এই যে আদর দিচ্ছি। আর কখনো বকা দিবো না তোমাকে, প্রমিজ।”
নওরিন নেমে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। নোমান রুমের উদ্দেশ্যে পা চালিয়ে বলতে লাগলো,
“তোমার জন্য কতকিছু এনেছি, তুমি জানো? এত্তগুলো পেন্সিল, কাটার, খাতা। আবার ম্যাংগো, অরেঞ্জ, স্ট্রবেরি সব ফ্লেভারের রাবার। আরও কি এনেছি জানো? বাবাই শপিং করেও এনেছি তোমার জন্য। এগুলো সবার আগে কে দেখবে?”
নওরিন ওভাবে জোরে কান্না করেনি তবে বাবার আদুরে গলার কারণে ভয় কমে অভিমানের কান্নাই এখন জুড়েছে বেশি। তাকে বিছানায় বসালে সে নেমে চলে আসতে চাইলো। নোমান তাকে থামিয়ে হাটু ভেঙে বসে পড়লো মেঝেতে। দুহাতে মাথা ধরে কপালে চুমু দিয়ে আবার এক হাতে নিজের কান ধরলো,
“এই যে বাবাই, স্যরি বলছি। আর কখনো বাবাই তোমাকে বকা দিবে না। আমি যে এতোকিছু নিয়ে এলাম, তুমি কান্না করলে আমি কাকে দিবো এসব? এই দেখো, কি এনেছি…”
নোমান উঠে দ্রুত খাতা পেন্সিলের ব্যাগটা এনে ঢেলে দিলো বিছানায়। নওরিন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাকিয়ে দেখলো সেসব। রাবারগুলো হাতে তুলে নোমান বললো,
“তুমি কি এই বাবারের কথা বলেছো?”
নওরিন ফোঁপানোর মাঝেই অভিমান নিয়ে বললো,
“ম্যাংগো ফ্লেভার রাবার আম্মু কিনে দিয়েছে আমাকে। পেন্সিলও কিনে দিয়েছে দুইটা।”
“আম্মু কিনে দিয়েছে? আমিও তো এনেছি তোমার জন্য। এক বক্স পেন্সিল নিয়ে এসেছি। এইযে, ম্যাংগো, অরেঞ্জ, স্ট্রবেরি সব ফ্লেভারের রাবার এনেছি। আরও কি এনেছি দেখবে? ওয়ান মিনিট…”
নোমান তার কাপড়ের ব্যাগটা এনে এবার বিছানায় তুলে নওরিনের মুখোমুখি বসলো। তার কাপড়চোপড়ও নামায়নি এখনো ব্যাগ থেকে। তবে সামনেই রাখা আছে শপিং করা পোশাক গুলো। নওরিনের দুইটা পোশাক বের করে দেখালো। একটা গোলাপি, আরেকটা কালো জামা। যেকোনো অনুষ্ঠানে পরার উপযোগী দুইটাই। গোলাপিটা লং জামা, কালোটা হাটু অব্দি শর্ট জামা। নোমান তাকে একটা পরিয়ে দেখতে চাইলো সাইজে ঠিক আছে কি না। কালো জামাটা হাতে তুলে বললো,
“ড্রেস গুলো পছন্দ হয়েছে তোমার?”
নওরিন কান্না থামিয়ে দিয়েছে ব্যাগ খোলার সময়ই। এখন গাল ফুলানো রেখে দুইটা ড্রেসের দিকেই তাকিয়ে দেখছে। নোমান তার ফোলানো গালে আঙুল দিয়ে খোঁচা দিলো। নওরিন হাসলো না। আবারও দিলো, তবুও হাসলো না। পেটের দুপাশে খোঁচা দিলে নড়েচড়ে উঠলো এবং গাল ফুলানো ভাবটা চলে গেলো। তবে হাসেনি। এবার পেটে কুতুকুতু দিতেই হাত-পা ছুড়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো নওরিন৷ মেয়েকে হাসাতে পেরে নোমানও হেসে দুহাতে মেয়ের চোখ মুছে দিলো। বিছানা থেকে নামিয়ে কালো জামাটা পরিয়ে দেখলো সাইজ ঠিকই আছে। অবশ্য কেনাকাটায় ভুল হয় না নোমানের। ছোট থেকেই নওরিনের পোশাক সে কিনে বিধায় সাইজের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নওরিনের দুগাল চেপে সে বললো,
“এই যে, কি সুন্দর লাগছে আমার বাবাইকে।”
তারপর আরও একটা প্যাকেট বের করে বললো,
এটা তোমার আম্মুকে দিবে। যাও, তোমারটাও দেখিয়ে এসো আম্মুকে।”
“এটা আম্মুর?”
“হুম, আম্মুর শাড়ি।”
ব্যাগে আরও দুইটা প্যাকেট দেখেছে নওরিন। একটা টেনে বললো,
“এটা কার?”
নোমানের মুখটা আগের তুলনায় কিছুটা মলিন হয়ে উঠলো, যেটা বাচ্চাদের বুঝার ক্ষমতা নেই। ওই দুইটা প্যাকেটেই থ্রিপিস আছে। এনেছিলো সাবিহার জন্য। কিন্তু সে এখন সাবিহাকে দিবে না। এ পর্যন্ত সাবিহাকে উপহার হিসেবে কিছুই দেওয়া হয়নি ভেবেই কিনেছিলো। তবে আর দেওয়ার প্রয়োজনও নেই। সাবিহা বলতে কেউ নেই। তাই আবারও মুখে হাসি ফুটিয়ে নির্দ্বিধায় প্যাকেট দুটো বের করে নওরিনের হাতে তিনটা একত্রে তুলে দিয়ে বললো,
“সবগুলোই তোমার আম্মুর।”
“আম্মুর এতো শাড়ি!”
“উহুম, একটা শাড়ি৷ এগুলো আম্মুর জামা। যাও, দিয়ে এসো। নিয়ে যেতে পারবে?”
নওরিন তিনটা প্যাকেটই বুকে চেপে রেখে হাটতে শুরু করলো। তার গোলাপি জামাটা শুধু এখানে রয়ে গেছে। কিচেনে এসে খুশিতে বললো,
“আম্মু, দেখো আমি কি পরেছি। বাবাই আমার জন্য দুইটা ড্রেস এনেছে। সুন্দর না?”
ফাইজা পিছু ফিরে কয়েক সেকেন্ড দেখলো তাকে। জামা সুন্দর, মেয়ের মুখটাও সুন্দর। খুব হাসিখুশি। বাবা খুশি করতে পেরেছে তাকে। এইতো, একটু আদর করলেই বাচ্চারা খুব খুশি হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষণিকের এই খুশিটা বুকে ধারণ করতে পারলো না ফাইজা। মেয়ের খুশিতে সামিল হতে মুখে এক টুকরো খুশি ধারণ করে মৃদু হেসে বললো,
“হুম, খুব সুন্দর।”
প্যাকেটগুলো এগিয়ে নওরিন বললো,
“এইযে, দেখো। তোমার জন্যও বাবাই এতোগুলো জামা নিয়ে এসেছে। খুলে দেখো।”
ফাইজা প্যাকেটে তাকিয়ে আবার মেয়ের মুখে তাকালো। হাসি বজায় নেই তার মুখে। সে কাজে মনযোগ দিয়ে বললো,
“বাবাইকে দিয়ে এসো এগুলো। বলো, আম্মুর প্রয়োজন নেই এসবের।”
“দেখো না একটু।”
“নওরিন, যেটা বলেছি সেটা করো।”
নওরিন ফিরে গেলো। নোমান তার কাপড়চোপড় আলমারিতে তুলে রাখছিলো। প্যাকেটগুলো খাটে রেখে সে বাবাইকে বললো,
“বাবাই…”
“হুম?”
“আম্মুর এসবের প্রয়োজন নেই বলেছে।”
নোমান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। মেয়ের মুখে তাকানোর পরপর মলিন মুখে প্যাকেটের দিকেও তাকিয়েছে। আবার নওরিনকে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু দেখেছে এগুলো?”
নওরিন মাথা নেড়েছে দুদিকে৷ নোমান ধীর নিশ্বাস ফেলে কাপড়চোপড় গুছাতে লাগলো। নওরিন তার কাছে এসেছে জামার চেইন খুলে দিতে। আলমারি লক করে হাটু ভেঙে মেঝেতে বসে নওরিনের জামা খুলে দিলো। তারপর বেরিয়ে এলো ফাইজার উদ্দেশ্যে। কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ড্রেস পছন্দ হয়নি?”

“ছেঁড়া বাঁধন”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
“ড্রেস পছন্দ হয়নি?”
ফাইজা তার দিকে তাকায়নি, কোনো প্রত্যুত্তরও করেনি। প্লেট ও বাটিতে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো। জবাব না পেয়ে নোমান বললো,
“কি বললাম?”
এবারও কোনো জবাব নেই। নোমান ভেতরে এগিয়ে এসছিলো। তার চলাচল থামিয়ে এক হাতের বাহু ধরে বললো,
“মুখে তালা দিয়েছো? প্যাকেট খুলে দেখোনি?”
ফাইজা তবুও তার দিকে তাকায়নি। হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতেই নওরিন এসে গেছে তার গোলাপি জামা হাতে নিয়ে। তাই আর চেষ্টা করতেও হয়নি, নোমান এমনিতেই ছেড়ে দিয়েছে। নওরিন দুহাতে জামা তুলে রেখে বললো,
“আম্মু, দেখো। আর এটা এনেছে আমার জন্য।”
ফাইজা ওভাবে না দেখেই বাটি হাতে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
“হুম, সুন্দর। এগুলো রাখো এখন। ভাত খাবে।”
নোমান তার কাণ্ড দেখেও কিছু বললো না। চুপচাপ হাত ধুয়ে নিলো খেতে বসার জন্য। চেয়ারে বসে প্লেট এগিয়ে নিয়েছে। তরকারি নিজেই নিয়ে নিচ্ছে। বহুদিন হয়, সবাই মিলে একসাথে খেতে বসে না। ফাইজা অন্য প্লেটে ভাত নিচ্ছে। নোমান বুঝতে পেরেছে নওরিনের জন্য নিচ্ছে, তাই তাকে বললো,
“বসো, একসাথে খাই।”
ফাইজা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে প্লেটে খাবার নিয়ে মেয়েকে বললো,
“নওরিন, তাড়াতাড়ি এসো। আম্মু খায়িয়ে দিবো।”
“আসছি আম্মু। আমার পেন্সিলগুলো নিয়ে নেই।”
ফাইজা প্লেট হাতে চলে গেলো নওরিনের রুমে। নওরিন খাতা, রাবার, পেন্সিল সব নিয়ে বেরিয়ে মায়ের পিছু পিছুই গেছে তার রুমে রাখতে। ফাইজার উপেক্ষণীয় আচরণে ঘাড় বাঁকা করে শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো নোমান। আজ তারও গায়ে লেগেছে। রাগও হচ্ছিলো এভাবে প্রত্যেকটা মুহুর্তে চুপ থাকায়। রাগের উপর আবার অপরাধও বোধ করছিলো এই সবটার জন্য সে নিজেই দায়ী বলে। তাই রাগ হজম করে খাবারের দিকে মনযোগ ফেরালো। মেয়ে আর মা, পুরোই এক কাতারে দাঁড়িয়ে। যেমন অভিমানী, তেমনই মুখভঙ্গি। মেয়ের অভিমান তো ফুরালো, এবার মায়েরটা ফুরায় কতক্ষণে দেখা যাক।
ফাইজা মেয়ের প্লেটেই বেশি খাবার নিয়েছে নিজের জন্য। মা মেয়ের এক প্লেটেই খাওয়া হয়ে গেছে। ততক্ষণ পর্যন্ত নওরিন বারবারই পেন্সিল গুনেছে, রাবার এক কাতারে রেখে সাজিয়েছে, নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে। নতুন পুরাতন গুলো সব একত্রিত করছে আবার আলাদাভাবে সাজয়ে রাখছে একটা একটা ব্যবহার করবে বলে। ফাইজা ভাবতে গেলেই বারবার তাচ্ছিল্যের নিশ্বাস পড়ে নোমানের উপর। কি ভুত চেপেছে হঠাৎ? চলে গিয়েও ফিরে এলো, বকে গিয়েও আদর উতলে দিলো! সেদিন বারবার বলে আনাতে পারেনি, আজ না বলতেই এতোসব নিয়ে এসেছে। মতলবটা কি তার! কোন মতলবে আবার গলার স্বর পরিবর্তন করেছে দূরে ঠেলে দেওয়া বউ বাচ্চার প্রতি?
খাওয়া শেষ করে প্লেট রাখতে এসে দেখলো নোমানের খাওয়া শেষ হয়েছে। তাই সবকিছু গুছাতে ব্যস্ত হলো ফাইজা। নোমান তখন বিছানা থেকে জামাকাপড়গুলো তুলে আলমারিতে রাখছে নিজেই। অভিমান শেষ না হলে এসব দেখবেও না ফাইজা। অযথা তাকে দেখানোর প্রত্যাশায় বাইরে রেখে লাভ নেই। যখন কিচেন থেকে শব্দ এলো, বুঝতে পারলো ফাইজা আছে সেখানে। তাই এগিয়ে গেলো। বেসিনে প্লেট ধুয়ে নিচ্ছে সে। নোমান নিঃশব্দে এগিয়ে এসে পেটে হাত রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো এবং কানের কাছে নাক ঘেঁষে বিড়বিড় করে বললো,
“কতক্ষণ লাগবে তোমার অভিমান ঝরতে? ড্রেসগুলো শখ করে নিয়ে এলাম, দেখলে না কেন…”
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই হকচকিয়ে পিছু ফিরে তাকে এমনভাবে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো এবং পিছিয়ে গেলো যে, যেন কোনো অপরিচিত পরপুরুষ এসে তাকে স্পর্শ করেছে। হ্যাঁ, ঠিক ততোটাই অসহ্যকর লেগেছে এই মুহূর্তে নোমানের স্পর্শকে। নোমান বিস্মিত হয়ে গেলো তার আচরণে! ফাইজা নিজে সরেই চুলার কাছ ঘেঁষে দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। ঘৃণায় চোখে পানি এনে দিয়েছে। নোমানের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
“একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। দুদিন থেকে এসেছো, তৃপ্তি মেটেনি? না মিটলে আবার যাও। ডেকেছে নাকি কেউ ফিরে আসার জন্য?”
তার কথার মর্মার্থ বুঝতে যেন একটুও অসুবিধা হলো না নোমানের। সে চোখে মুখে বিস্ময় এনে সন্দেহের অবকাশ দূর করতে বললো,
“আমি বান্দরবানে ছিলাম! অফিস থেকে ট্যুরে…”
“আমি কোনো কৈফিয়ত চাইনি। আমার কোনো কৈফিয়তের প্রয়োজন নেই। দূরে থাকো আমার থেকে। যেখানে প্রয়োজন, যেখানে ইচ্ছে, সেখানেই যাও। আমার বলা না বলায় কিছু আসে যায় না।”
“তুমি ভুল ভাবছো। ফাইজা আমি…”
নোমান এক কদম এগিয়ে যেতেই সে খপ করে চুলার সামনে থেকে দিয়াশলাই হাতে তুলে নিয়েছে। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে কম্পিত হাতে দ্রুত দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“একদম কাছে আসবে না। আমাকে স্পর্শ করবে না। এ শরীর জ্বালিয়ে দিবো আমি।”
“পাগল হয়ে গেছো তুমি!”
“হ্যাঁ, হয়ে গেছি পাগল। একদম কাছে আসবে না। এক্ষুনি আগুন লাগিয়ে দিবো শরীরে। নিজে তো মরবোই, পেটেরটা সাথে নিয়ে মরবো।”
নোমান একদমই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অবিশ্বাস তো বটেই, ফাইজার এমন উদ্ভট কথাবার্তা ও আচরণ দেখে তার মাথা হ্যাং হয়ে গেছে! হাতে আগুন তুলে নেওয়ায় রাগে কষ্টে যেন চোখ ছলছল করে উঠছে। চোখের রঙও পরিবর্তন হয়ে গেছে মুহুর্তেই। প্রথমবারের মতো আজ সে এতোটা অসহায়ত্বের সাথে রাগলো যে, কোনো শব্দই আর উচ্চারণ করলো না। হাতের কাঠি জ্বলে শেষ হতেই তৎক্ষনাৎ আরেকটা কাঠি জ্বালিয়ে নিয়েছে ফাইজা। নোমান এগিয়ে গেলেই সে তার নিজের কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দিবে! অসহায়ত্বের রাগ নিয়ে মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার স্পর্ধাটুকুই নিষ্পলক দেখলো এবং বেরিয়ে গেলো নোমান। একটা থাপ্পড় তাকে এতোটাই পরিবর্তন করেছে যে সে অবিশ্বাস নিয়ে এখন আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত!
একা ঘরে মাথা ঠিক করতে পায়চারি করে সময় কাটালো নোমান। ফাইজাকে পাশের রুমে যেতে দেখেছে সে। তারপরই ঘুমানোর জন্য বিছানায় পড়েই ছটফট করতে লাগলো। এ কেমন হুমকি দিলো ফাইজা! এমনটা কিভাবে করলো! নাহয় একটু আঘাত করেছেই সে, তাই বলে বাচ্চাসহ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা করবে সে! মাথা যেন কোনোভাবেই ঠিক করতে পারছে না নোমান। অসহায়ত্বের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার জন্য।
ওদিকে সে বের হলেই ফাইজার নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দুহাতে চোখ মুছে নিয়েছে। এক কোণে বসে বসে কান্না করার মানসিকতার জন্ম সে একদমই দেয়নি। হাতের গতি বাড়িয়ে দ্রুত বাকিটুকু কাজ শেষ করে চলে গেছে ঘুমাতে। অথচ এই চোখে ঘুম নামতে কত কষ্ট পোহাতে হয়, তার অনুভূতি একমাত্র সে-ই অনুভব করতে পারে। বন্ধ চোখের পাতার নিচে ঘুরাফেরা করছে পিঞ্জরে বাঁধা কষ্টরা। “বিয়ে” নামক বাঁধনটা হচ্ছে একটা ছেঁড়া বাঁধন। শুধুমাত্র সাক্ষ্যপ্রমাণে গড়ে উঠে এই অদৃশ্যমান বাঁধনটি। বিচ্ছেদ ব্যাতিত, চাইলেই এ বাঁধন ছেড়ে চলে যাওয়া যায়। আবার মন চাইলো তো ফিরেও আসা যায়। এইতো, এসেছে। কিন্তু মন থেকে সম্পর্কটা বিষাদে রূপান্তরিত হয়ে গেছে একরাশ ঘৃণার ছোবলে। তবুও চলে যাওয়া হলো না ফাইজার। হ্যাঁ, চাইলেই পারতো ছেড়ে যেতে। কিন্তু প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ায় মন সায় দিলো না। সে কারো প্রিয় না হোক, মানুষটাকে তো প্রিয় করে নিয়েছিলো সে। মনের সেই দায়ে তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারলো না। কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? সে ছাড়া এই ধরণীতে নিকটতম হয়ে আছেই বা আর কে? সব তো হারিয়ে বসেছে সেই কবেই। আবারও হারিয়ে নিঃস্ব হতে চায় না। সে চলে গেলে তার বাচ্চাদেরই বা কি হবে? এই অবস্থায় তাদের নিয়ে আশ্রিত হবে কোথায়? সে তো শারীরিক দিক থেকেও এখন অক্ষম। রাগ করে, জেদ ধরে বাচ্চা নিয়ে ঘর ছাড়ার মতো মানসিকতার জন্ম দিতে পারবে সে, কিন্তু সন্তানদের নিয়ে পথে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না তখন। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি তার কর্মক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছে। কাজ না করতে পারলে আশ্রয় পাবে কোথায়, আর বাচ্চাদের আহারের ব্যবস্থাই হবে কি করে? শারীরিকভাবে একদমই অসহায় সে। একূল ওকূল সবটা ভেবে ভেবেই আর হলো না যাওয়া। কে চায় তার সুন্দর সাজানো সংসারটা ফেলে চলে যেতে? প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়াবে? কার বিরুদ্ধে? যাকে সে নিঃশর্তে ভালোবেসে নিয়েছে? ভুল তো তারই। তারই বুঝা উচিত ছিলো, যে তার জন্য পরিবার ছেড়ে দিতে পারে, সে একদিন তাকেও ছাড়তে পারে। সেই ভুল যখন বুঝতে পারেনি সেদিন, আজ তার প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই হবে। গলায় দম আটকে গেলেও প্রিয় সংসার ত্যাগ করতে পারবে না। হয়তো বেঁধে রাখেনি কেউ, তবুও ছাড়লো না নিয়তি। আবার পারছেও না নোমানের আদিক্ষেতাকে প্রশ্রয় দিতে। বরং তাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই ঘৃণা হচ্ছে। হবে না-ই বা কেন? তার মনে তো অন্য নারীকে ঠাঁই দিয়েছে নোমান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here