ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ৭,৮
(নূর নাফিসা)
৭
.
হৃদয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে উড়ে। কিন্তু কষ্ট কভু যায় না সরে। রাগ, কষ্ট, ঘৃণায় নিকৃষ্টতরভাবে নোমানকে স্মরণ করছে ফাইজা। বাবা বাড়ি ফিরে না কেন, বাবা বাড়ি ফিরেছে কি না, সেসব নিয়ে কোনো প্রশ্নও ফুটে না নওরিনের মুখে। বাবা তাকে বকেছে, সে তা ভুলেনি। তাই বাবার রুমের সামনেও যায় না সে এখন। সেদিন ফিরলো না, পরদিনও ফিরলো না। তারপরদিন দুপুরে কলিং বেল ঠিক বেজে উঠলো। নওরিন তখন স্কুলে। এইতো, একটু পরেই স্কুল থেকে আনতে যাবে ফাইজা। দুদিনে তার মুখের অবস্থা এতোটাই করুণ হয়েছে যে, না চাইতেও যেন নোমানের চোখ পড়ে গেছে দরজা খোলার পর। তবে ওই মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালোও না ফাইজা। দরজা খুলে পায়ের দিকে লক্ষ্য করেই বুঝে গেছে নোমান, তাই উপরে চোখ তুলে আর কষ্ট করে দেখতে হয়নি তাকে। সে দ্রুতই সেখান থেকে সরে রুমে ঠাঁই নিয়েছে। আর সরে আসতে আসতেই যতটুকু সম্ভব, তার মুখ দেখতে পেয়েছে নোমান। অথচ অন্যসময় মুখে তাকিয়ে ঘরে প্রবেশ করেনি সে। আজ করুণ অবস্থা চোখে পড়লেও তার কোনো পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়া ফুটে আসেনি প্রকাশ্যভাবে। যে ব্যাগ হাতে বেরিয়েছিলো, আজ দুদিন পর সেই ব্যাগ হাতেই ফিরে এসেছে। এদিকে ঘৃণায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে ফাইজা। ইচ্ছে করছিলো না তাকে ঘরে প্রবেশের সুযোগ দিতে৷ কোথাও একটা বাঁধা থাকায় পারলো না মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিতে। অসহায়ের মতো ঘৃণার পাত্রকেও প্রিয় ঘরে ঠাঁই দিতে হলো নিরবে। সে ঠাঁই দেওয়া বা না দেওয়ারই কে? ঘরতো ঘৃণ্যতম পাত্রেরই!
বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে নোমান কিচেনে ঘুরে এসেছে। হাড়ির ঢাকনা খুলে খুলে খাবার দেখে নিজেই প্লেট ধুয়ে ভাত নিলো, তরকারি নিলো। প্লেট হাতে চলে গেলো রুমে। খেয়েদেয়ে আবার প্লেট কিচেনে রেখে এসে ঢাল হয়ে পড়লো বিছানাতে৷ ফাইজা মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওদিকটায় গিয়ে দেখলো হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাতে দেখা যাচ্ছে নোমানকে। তাই সে বাইরে থেকে দরজা লক করে বের হলো। বাড়ি ফিরে মেয়েকে গোসল করিয়ে যখন খাবার দিতে গেলো, এঁটো প্লেট দেখে বুঝতে পারলো নিজে নিয়েই খেয়েছে নোমান। মেয়েকে খাওয়ালো ঠিক, কিন্তু নিজের মুখে আর খাবার তুলতে পারলো না। এতোদিন কষ্ট পেতো, কিন্তু দুদিন যাবত কষ্টের চেয়ে ঘৃণা হয় বেশি। ঘৃণা হয় ওই মানুষটার প্রতি, ঘৃণা হয় নিজের ভালোবাসার প্রতি! ইচ্ছে করছে এখনই তার বাড়ি ছাড়তে। অথচ একদমই নিরুপায় পথের পথিক সে। চোখের জল আজ দুই ফোঁটার বেশি গড়ায়নি তার চোখে। যেখানে ভালোবাসা বিশুদ্ধ নয়, সেখানে চোখের জল ফেলার কোনো মানেই না হয়।
দুপুরের পর মা মেয়ের সময়ও কেটেছে ঘুমে ঘুমেই। যখন ফাইজার ঘুম ভাঙলো, লক্ষ্য করলো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। তার তো আসরের নামাজও পড়া হয়নি! সে উঠে আগে নামাজটা আদায় করে নিলো। তারপর কিচেনের দিকে যাওয়ার সময় নওরিনকে ডেকে গেলো। নওরিন ঘুমঘুম চোখে হেলতে দুলতে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে এসেছে। মগে পানি নিয়ে ছোট ছোট হাতে কখনো হাত, কখনো মুখ, কখনো পা ঘঁষে ঘঁষে ধুয়ে নিচ্ছে। পানির কাছে এলেই চলে বাচ্চাদের খেলাধুলা। সে আরেকটু পরিষ্কারগিরি দেখাতে সাবান হাতে নিলো। দুহাত কচলে ফেনা তুললো। ফুঁ দিয়ে কয়েকবার উড়িয়ে তারপর সেই ফেনা মুখমন্ডলে ঘঁষে দিলো। পানি দিয়ে আবার মুখ ধুতে গিয়েই এক চোখে সাবান পানি লেগে গেছে। আরও এক মগ পানি নিয়ে মুখ ধুতেই আছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। সে “আম্মু” ডেকে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে কিচেনের উদ্দেশ্যে ছুটতে গেলেই ধাক্কা খেলো নোমানের সাথে। উপরে তাকিয়ে বাবাকে দেখতেই ভয় পেয়ে চুপসে গেলো আবার! এবার ভয়ের তাড়নায়ই দৌড় দিলো মায়ের কাছে৷ সে তো জানতোই না ঘরে বাবা আছে৷ তাহলে ওভাবে উঁচু গলায় আম্মুকেও ডাকতো না, ছুটেও আসতো না। ভয় পেয়েছে, বাবাই না আবার ধমক মেরে বসে ধাক্কা খাওয়াতে! নোমান মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। মেয়ে ধাক্কা খাওয়াতে সে পথ চলা থামিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু বলেনি কিছুই। নওরিন ছুটে চলে গেলেই সে আবার স্বাভাবিকভাবে চলতে চলতে বেরিয়ে গেছে। এদিকে নওরিন এসে মায়ের পা জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে। ফাইজা এক হাতে চুলা অন করতে করতে আরেক হাত তার মাথায় রেখে বললো,
“কি হয়েছে? ডেকেছো কেন?”
“আমার চোখে সাবান লেগেছে। জ্বলছে খুব। আমি তাকাতে পারছি না আম্মু।”
ফাইজা হালকা উপুড় হয়ে চোখের পাতা উঁচিয়ে বললো,
“দেখি! সাবান ধরতে গেলে কেন আবার!”
“সাবান দিয়েই তো মুখ ধুয়েছি।”
“ইশ! পাকামো না করলে চলে না! আবার সাবান দিয়ে মুখ ধুতে হবে। কি ময়লাটাই না লেগে আছে মুখে! দেখি চোখ খোলো।”
ফাইজা তার চোখ ফুঁ দিলো কয়েকবার। তারপর সান্ত্বনা দিলো,
“বারবার বড় চোখ করে তাকাও। ঠিক হয়ে যাবে। হাত দিবে না চোখে।”
ফাইজা ফ্রিজ থেকে সবজি নিয়ে কাটতে লাগলে নওরিন মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু, বাবাই কখন ফিরেছে বাসায়?”
ফাইজা কাজ থামিয়ে নিশ্চুপ তাকালো মেয়ের দিকে। মেয়ে দেখে এসেছে হয়তো বাবাইকে, বুঝতে পেরেছে সে। আবার কাজে মনযোগ দিয়ে জবাব দিলো,
“দুপুরে, তুমি স্কুল থেকে ফেরার আগে।”
“তখন থেকে বাবাই ঘরে ছিলো!”
মেয়ে যেন চমকে উঠেছে! তার চমকে উঠার কারণ সে তো গোসলের সময়ও মাকে চেচিয়ে ডেকেছে! ভাগ্যিস, বাবাই বকা দেয়নি! এদিকে তার প্রতিক্রিয়া দেখে ফাইজা জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
“কিছু না।”
“যাও পড়তে বসো। স্কুলের হোমওয়ার্ক রেডি করো গিয়ে। যেটা লেখা দিয়েছে খাতায়, সব শেষ করো। আম্মু এসে পড়াবো।”
“ওকে।”
দরজার কাছে গিয়ে নওরিন পিছু ফিরে বললো,
“আম্মু?”
“হুম?”
“বাবাই তো বেরিয়ে গেছে। দরজা তো খোলা। লাগিয়ে দিবো? নাকি বাবাই ফিরে আসবে আবার এখনই?”
“বেরিয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, গেলো তো।”
“তুমি যাও, আমি আসছি।”
মাগরিবের আজান পড়েছে। নামাজ পড়তে ফাইজাই কাজ থামিয়ে উঠে গেলো। ভাত হতে হতে তার নামাজ শেষ হয়ে যাবে। তাই পরে বাকি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলো। দরজা লাগিয়ে সে চলে গেলো নামাজ পড়তে। মেয়েকে পড়াতে যেতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো রান্নার কারণে। প্রতিদিনই ভাবে সন্ধ্যার আগে রান্না শেষ করবে, কিন্তু এই সেই কারণে বেশিরভাগ সময়ই হয়ে উঠছে না পরিকল্পনা মোতাবেক। শরীর ও মনের উপর আর কত জোর দেওয়া যায়?
সারা সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে নোমান ফিরেছে রাতে। মা মেয়ে তখন ঘুমাতে যাচ্ছে। কলিং বেল বাজলে ফাইজা দরজা খুলে দিয়ে চলে গেছে। খাওয়ার জন্য আজ বলতেও পাঠায়নি মেয়েকে। বললেও মেয়ে যাবে না তার সামনে। কারণ মেয়ে ভয় পায় এখন তার বাবাকে। কারও ডাকার অপেক্ষায় বসে না থেকে নোমান নিজ দায়িত্বেই খেয়ে নিয়েছে। প্লেটে খাবার রেডি করেই রেখে গেছে ফাইজা।
সকালেও একই কাণ্ড। বেলা এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে, তবুও কেউ ডাকেনি তাকে৷ নিত্য দিনের মতো আজও রান্নাবান্না শেষ করে খাবার রেডি করে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে। অন্যসময় তো ঘুম থেকে উঠেছে কি না, মেয়েকে দেখতে পাঠাতো। উঠলে নাস্তা করার জন্য ডাকতে পাঠাতো। আজ তা-ও করলো না। নাস্তার জন্যও কেউ ডাকতে এলো না নোমানকে। দুপুর এবং রাতেও সময়মতো খাবার প্লেটে দিয়ে রেখেছে। দুপুরে তো বাড়ি ছিলো না, রাতে ফিরে বাড়িতে খেয়েছে। খাওয়া শেষে মেয়েকে বাথরুম থেকে বের হতে দেখে স্বাভাবিক গলায় নোমান ডাকলো,
“নওরিন, শুনে যাও।”
নওরিন থেমে তার দিকে তাকালো ঠিক কিন্তু এগিয়ে গেলো না। চেহারাটা যেন থমকে আছে ভয়ের উপস্থিতিতে। নোমান আবার বললো,
“এসো?”
এবার নওরিন হাটতে শুরু করলো তার নিজের রুমের দিকে। সাথে সাথেই নোমান সামান্য বিরক্ত বোধ করে বললো,
“এই, তোমাকে ডেকেছি না!”
উপেক্ষা করে দৌড়েই চলে গেলো। সে ভয়ে দৌড় দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হলো না নোমানের। তাই আর দ্বিতীয়বার ডাকলো না। ঘুমানোর জন্য রুমে চলে এসেছে নোমান।
“ছেঁড়া বাঁধন”
পর্ব- ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
মেয়েকে ডেকে ঘুমাতে তো চলে এলো, কিন্তু ঘুম এলো না চোখে। আবছা আলোতেই ব্যাগের দিকে তাকালো। বান্দরবান থেকে ফিরেছে আজ নিয়ে দুদিন। ব্যাগটা যেভাবে যেখানে রেখেছিলো, সেভাবে সেখানেই আছে এখনো। নিজেও ধরেনি, ধরার মতো কেউ আসেওনি এখানে। গতকাল ক্লান্তিকর অবস্থার কারণে নিজেরই মনে ছিলো না। আজ মনে থাকলেও ডেকেও আনা গেলো না। মেয়ের জন্য শপিং করে এসেছিলো, তা দেওয়ার জন্যই ডাকলো মেয়েকে৷ মেয়ে উল্টো ভয় পেয়ে চলে গেলো। তৎক্ষনাৎই মনে পড়েছে নোমানের, সেদিন বকেছিলো মেয়েকে। তাই মেয়ে সামনে আসে না এখন। অন্ধকার রুমে শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করলো ঘরে বেশ নির্জনতা কাজ করছে দুদিন যাবত। কারো সাথে কারো কোনো কথা নেই, কোনোদিকে কারো সাড়াশব্দ নেই। একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ। স্ত্রীর সাথে তো কথা হয় না মোটামুটি অনেক দিন, দুদিন যাবত মেয়েরও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। খেতে যাওয়ার জন্যও ডাকতে আসে না। গতকাল ধাক্কা খাওয়াতেই কেমন আৎকে উঠেছিলো, আজ স্বাভাবিকতার সাথে ডাকার পরও কেমন ভয় পেয়ে চলে গেলো! এতো অস্বাভাবিকতা কেন বিরাজ করছে ঘরে? মেয়ে তো কি আহ্লাদের সাথে কথা বলতে আসতো আগে, এখন দেখলেই পালিয়ে যায়! কাজটা কি ঠিক করেছে সেদিন? কীজন্য যেন রেগে গিয়েছিলো? পেন্সিল! হ্যাঁ, পেন্সিলের কথাই তো বলতে এসেছিলো বোধহয়। সামান্য পেন্সিলের জন্য সে রেগে গেলো কি করে! পেন্সিলের কথা তো আরও একদিন বলেছিলো, সে এনে দিলেই পারতো। মেয়ের পেন্সিল লাগবে, তো এনে দিবে না! অবশ্যই দিবে।
ভ্রমণ করে এসে যেন ব্রেনও ওয়াশ হয়েছে, তাই জ্বলে উঠা রাগ এখন অযথা হয়ে ধরা দিচ্ছে নিজের কাছেই। বিছানাটা কেমন খালি খালি, যেটা গতরাতে এবং আজ রাতেই অনুভব করতে পারছে। অথচ ভ্রমণে যাওয়ার আগে একবারও এমনটা মনে হয়নি কোনো কিছুর অভাব আছে তার পাশে। সে এপাশে, মেয়ে মাঝখানে, ফাইজা ওপাশে থাকতো। মেয়ে কখনো তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো, আবার ঘুমের মধ্যেই গড়াগড়ি খেয়ে তার উপর চলে আসতো। কখনো কোনোরকম প্রতিক্রিয়া সে করতো না, কখনো বা রেগে সরিয়ে দিতো। অথচ আজ এখানে কেউ গড়াগড়ি খাচ্ছে না। কারো গা ঘেঁষে ঘুমাতে হচ্ছে না। পুরো বিছানাটাই ফাঁকা! যখন তখন মেয়ে এসে কোনো প্রয়োজনের কথাও তুলে ধরছে না। আর ফাইজা? তার মুখের একটা শব্দও শোনেনি থাপ্পড় দেওয়ার পর থেকে। খুব কষ্ট পেয়েছিলো সে, যেটা এখন অনুভব করতে পারছে নোমান। তাইতো দরজা খুলে দেওয়ার সময়ও মুখ তুলে তাকায় না একবার। ইশ, কি বিশ্রী দেখাচ্ছিলো তার গতকালের মুখটা! এমন এলোমেলো হয়ে গেলো কেন সব? এর জন্য কি সে-ই দায়ী? সত্যিই কি কাজটা ঠিক করছে সে! না অন্যায়? তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে তো আগে বেশ ভালোই ছিলো। হৈ-হুল্লোড়, দুষ্টুমি, খুনসুটিতে বেশ ভালো কেটে যেতো সময়। অথচ এখন ঘরে থাকলে সময় যেন কাটতেই চায় না। বাড়ি ফিরলেও ঘরে কেউ আছে কি না বুঝা যায় না। ঘরে হাসি নেই, কাশি নেই, দুষ্টুমি নেই, রাগারাগি নেই, ভালোবাসাও নেই! থাকার মধ্যে আছে শুধুই অভাব। বেশ মনে পড়ছে, আগে অফিস থেকে ফিরলেই “বাবাই” বলে চিৎকার করে দৌড়ে এসে কোলে উঠে যেতো নওরিন। আজ সেই ছোট্ট নওরিন কি বড় হয়ে গেছে? কোলে উঠে না যে! এ বছরে কোলে তুলেছিলো কি না মেয়েকে, মনে পড়ে না তার। সত্যিই কি তবে বড় হয়ে গেলো? নাকি ফাইজার কথাই ঠিক? ভালোবাসা একদমই কমে গেছে তার! অকারণে অবহেলায় সরিয়ে দিয়েছে দূরে। তাইতো মেয়ে কাছে আসে না। ফাইজাকেও কেমন অসহ্য লাগে। ঘরে এলেও শান্তি পায় না। ঘরের শান্তিকে হত্যা করেছে সে নিজেই। নিজের কাজটা মোটেও ঠিক বলে মনে হচ্ছে না নোমানের। ওই একটা কারণেই তার শান্তি চলে গেছে, যা বেশ অনুধাবন করতে পারছে সে। আগের জীবন এবং বর্তমান জীবনের পার্থক্যটা নিয়ে বেশ ভাবলো নোমান। অর্ধেকটা রাত কেটে গেলো সবটা ভাবতে ভাবতেই। ফাইজা কি চাইছিলো? ভালোবাসা। এছাড়া তো আর কিছু নয়। আর সেই ভালোবাসা তো দিলোই না, উল্টো আঘাত করে তার জবানই যেন বন্ধ করে দিলো। যার ফলে কতদিন তার কণ্ঠ শুনে না। সেদিন একবার না ভাবলেও আজ বারবার মনে হচ্ছে তার অন্যায়গুলোকে। এই অবস্থায় থাপ্পড় কিভাবে মারলো তাকে! ফাইজা তো কোনো অন্যায় করেনি। বরং সে ওই মেয়েটার পাল্লায় পড়ে পরিবারের ধারাবাহিকতাকে উলটপালট করে দিলো। কে সে? সাবিহা কে? যার জন্য সে নিজের স্ত্রী সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করলো! সাবিহা তো কেউ না তার। তার প্রতি মুগ্ধতা দেখিয়ে কি লাভ? ভালোবেসে তো বরণ করেছিলো ফাইজাকে। এইতো, বছর কয়েক আগে বাবামায়ের অবাধ্য হয়ে ফাইজাকে নিয়ে পালিয়ে এলো। বাঁধলো নতুন বন্ধন, বাঁধলো সংসার, কোলে এলো নওরিন ফুল, এক ঝাক সুখেরা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। অথচ আজ চারিদিকে কেমন শূণ্যতা ছড়িয়ে! দুদিন পর নতুন সদস্যও আসতে চলেছে। ঘরে আরেকটা আমেজ পড়বে, বাচ্চারা ছোটাছুটি আর দুষ্টুমিতে মাতামাতি করে ঘরটাকে আগলে রাখবে। আর সে কি না বাইরের একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সব আমেজ বন্ধ করে দিচ্ছে! নাহ! এসব একদমই ঠিক হচ্ছে না! অভাবকে চিরবিদায় জানানো দরকার। নিদ্রায় যাওয়ার আগে ভেবে রাখলো সকালে মেয়েকে আদর করে ডেকে তার শপিং তুলে দিবে। কিন্তু তা হলো না। সকালে অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেলেও ঘুম থেকে ডেকে তুলেনি কেউ। তবে খাবারটা ঠিকঠাক ভাবে রেডি পায়। বেশ তো, সে নিজেই উঠে, ঝটপট রেডি হয়ে, ঝটপট অর্ধেক খাবার তুলে রেখে বাকিটা শেষ করে বেরিয়ে গেছে। শপিং তুলে দেওয়ার সময় নেই। বরং অফিসের সময়ে আরও দেরি হয়ে গেছে।
রুমে বসে থেকে ফাইজার দৃষ্টি দরজার দিকে ছিলো, কখন সে বের হবে। কারণ বের হওয়ার পর দরজা লাগাতে হবে। আজ তাদের স্কুলে যাওয়া নিয়ে মোটেও তাড়া নেই। স্কুলের জন্য রেডি করাচ্ছে না তাই নওরিন জানতে চাইলো,
“আম্মু, স্কুলে যাবো না?”
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফাইজা জবাব দিলো,
“না, মা। আম্মু অসুস্থ। আজ নিয়ে যেতে পারবো না।”
“মিস যদি বকা দেয়, তখন কি হবে?”
“দিবে না বকা। আমি মিসের কাছে কল করে বলে দিবো।”
“তবে কি কাল যাবো?”
“হুম। যাবো ইনশাআল্লাহ।”
দরজা লাগিয়ে দিয়ে সে এসে আবার শুয়ে রইলো। মাথাটা ব্যাথা করছে খুব। নওরিন টিভি অন করে বসেছে। বাইরে যেন কোথাও না যায়, সেদিকে সতর্ক করে ফাইজা চোখ বন্ধ করলো। পরে আবার নওরিনের হাত তার মাথায় রেখে বললো,
“চুলগুলো ধীরে ধীরে টেনে দাও তো, মা।”
নওরিন মায়ের দিকে ঘুরে বসে দুহাতে চুল টেনে মাথা টিপে দিতে লাগলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মাথায় তেল দিয়ে দিবো, আম্মু?”
“বা রে! আমার নওরিন দেখি বড় হয়ে গেছে! তুমি তেল দিতে পারবে আম্মুর মাথায়?”
“দেখবে তুমি? দাঁড়াও।”
মায়ের বলার আর অপেক্ষায় রইলো না। সে জানে বাবা বেরিয়ে গেছে। তাই দৌড়ে ওই রুমে গেলো এবং তেলের বোতল নিয়ে এসে মায়ের পাশে বসলো৷ দু-এক ফোঁটা তেল নিয়ে ছোট হাত মায়ের মাথায় ঘঁষে দিচ্ছে। মন্দ লাগছে না ফাইজার। তেল নষ্ট করবে, তেল ফেলে জামা নষ্ট করবে সেসব ভেবে বাঁধা দিলো না মেয়ের কাজে। মেয়ের মন চেয়েছে, করুক সে। খেলাধুলা তো মায়ের সাথেই করবে। আর কে আছে তার খেলার সাথী হয়ে এখানে?
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে নোমান। দুদিন যাবত সাবিহার সাথেও কথা হয়নি ফোনে। যেন প্রায় ভুলেই বসেছিলো তাকে। আজ বাড়ি ফেরার সময় সাবিহা কল করলে নোমান ক্ষমা চাইলো তার কাছে।
“আ’ম স্যরি, সাবিহা। আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, আমার পরিবার ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না। আমি পারবো না জীবন থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দিতে। তাদের ছাড়া আমার চলবে না। তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে, অবশ্যই খুব ভালো একজনকে ডিজার্ভ করো তুমি। আশাকরি শীঘ্রই কেউ আসবে তোমার জীবনে। তোমার কাছে রিকোয়েস্ট থাকবে আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ না করার। আমার বউ বাচ্চা ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারছি না।”
“এসব কি বলছেন আপনি! পাগল হয়ে গেছেন?”
“যা শুনেছো, তা-ই বলছি। সম্ভব না আমার পক্ষে। ভুলে যাও আমাকে। স্যরি সবকিছুর জন্য।”
কল কেটে নম্বর ব্লক করে দিয়েছে নোমান। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, নিয়ে ফেলেছে সে। ওপথে আর এগিয়ে যাচ্ছে না। পুরনো সুখটাই তাকে খুঁজে নিয়ে বাঁচতে হবে। একদমই অসুখে কাটছে তার বর্তমান দিনকাল। একবার বাবা মা হারালো, আবার স্ত্রী সন্তান হারিয়ে এভাবে ভাসমান জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় তার দ্বারা। ভাসমান জীবনে কোনো আনন্দ নেই। স্থায়ী জীবনে বেশ আনন্দ আছে। তার সেটুকুই চাই।