ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রণয়ের শুরুটা হয়েছে স্কুল জীবনের শেষ দিকে। তারপর কলেজ জীবনে যেন তা বেশ জমে উঠেছে। নোমান তখন ভার্সিটির ছাত্র। নিয়মিত দেখা, সাক্ষাৎ, যাতায়াত পথে একত্রে সময় কাটানো, বিভিন্ন মুখো রোচক খাবারের সমারোহে বেশ ভালোই চলতো সব। কলেজ জীবনের মাঝামাঝিতে ফাইজার বাড়িতে পাত্রপক্ষের আনাগোনা চলতে লাগলেই ভয়টা জন্মে যায় দুজনেরই। একে তো লুকোচুরি প্রেম, তারউপর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস অন্যরকম। তাই বলার সাহস খুঁজে পায়নি ফাইজা। এদিকে নোমানও পারছিলো না বিয়ের ব্যাপার ম্যানেজ করতে। কেননা পরিবারে তৃতীয় অর্থাৎ ছোট ছেলে সে। সবেমাত্র বড় ভাই বিয়ে করেছে, মেজো ভাই বাকি। তাকে রেখে ছোটকে বিয়ে করাবে না তার বাবা মা। তবুও সে জেদ করলে তার পছন্দের পাত্রীকে দেখতে চাই তারা। পছন্দ হলো না ফাইজাকে। ফাইজা দেখতে অপছন্দের মতো নয়, কিন্তু ফ্যামিলি স্ট্যাটাসে তাদের সাথে যায় না। মূলত ফাইজার পরিবার তাদের তুলনায় কিছুটা উঁচু বংশের, যেখানে সম্পর্ক সৃষ্টি হলে দেখা যাবে ছেলের বাবাকে মাথা নত করে চলতে হতে পারে। যার কারণে মোটেও রাজি হয়নি নোমানের বাবা মা। আর ফাইজা সাহস পায়নি পায়নি করেও শেষ বেলা মুখে উচ্চারণ করেছিলো মায়ের কাছে। তাতেই উত্তম ঝাড়ি এবং হুমকি খেতে হলো তাকে। যেন আরও জোর দেওয়া শুরু করলেন মেয়ে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার। আর তাই নোমান বললো পালিয়ে আসতে, সে-ও সাড়া দিয়ে চলে এলো তার কাছে। সেদিন নোমানের প্রতি এতোটাই দুর্বল ছিলো যে দ্বিতীয়বার ভাবেওনি বেড়ে উঠা নিজ পরিবার ছাড়তে। সব ছেড়ে ধরে রাখলো শুধু নোমানেরই হাত। প্রথমবার পরিবার থেকে অমত পোষণ করায় দ্বিতীয়বার নোমান বিয়ে করা বউ নিয়েই হাজির হয়েছিলো বাবামায়ের সামনে। বাবা মা তাকে তো তাড়ায়নি, তবে ফাইজাকেও ঠাঁই দেয়নি পালিয়ে যাওয়ার কারণে। পরিষ্কার বলে দিয়েছে পরিবারহীন মেয়ে ওবাড়ির বউ হতে পারবে না। তিন ছেলের মধ্যে নোমানটা বেশিই ঘাড় বাঁকা ছেলে ছিলো। মনমতো না হলেই তার ঘাড় বাঁকামো স্বভাব প্রকাশ পায়। ফাইজা যদি বউ হয়ে না থাকতে পারে, সে-ও ওবাড়িতে ছেলে হয়ে থাকবে না। কিছু সঞ্চয় ছিলো হাতে, তাতেই বউ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। টাকা হলে এই শহরে থাকার জায়গার অভাব হবে না। হয়নিও অভাব। বাড়ি ভাড়া নিলো। দলবলের সহযোগিতায় চাকরির সন্ধান করলো, ব্যবস্থা হতেও সময় লাগেনি তেমন। হাতে লোক থাকতে আর এতো টেনশন করার কি দরকার! বেশ তো, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার আয় বাড়তে লাগলো। সংসার সাজাতে লাগলো তাদের মনের মতোন। তার পড়াশোনাও শেষ হলো, তবে ফাইজার পড়াশোনা আর হলো না। ইচ্ছেও ছিলো না তাতে কারোই। বছর গড়িয়ে নওরিন কোলে এলো। কি আনন্দের সংসার তাদের! ভালোবাসার অভাব বিন্দুমাত্র অনুভব হয়নি তখন। যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই ভালোবাসা বেড়েছে। একটা সময় সেই ভালোবাসা চূড়ায় উঠে যেন আবার সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই নামতে শুরু করেছে। এইতো, বেশি না। বছরখানেক ধরেই যেন নোমানের বদলে যাওয়া শুরু হয়েছে। তার প্রমোশন হয়েছে, কাজের চাপ বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। ভালোবাসা এবং আহ্লাদের সময়টুকু কমে এসেছে কাজের চাপে। যখন তখন মেজাজ প্রকাশ পাচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে, অবহেলায় ঠেলে দিচ্ছে ভালোবাসার বন্ধনকে। আর এখন?
নওরিনকে এবছরই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে ক্লাস নার্সারিতে। শুরুতে ফাইজাই পড়াতো, পরে ভাবলো টিচারের কাছে দিলে তার মেয়ে আরও ভালো হবে পড়াশোনায়। কেননা, মেধা ভালো আছে তার মেয়ের। উচ্চশিক্ষিতের কাছে পড়তে দিলে ভালো শিক্ষা আয়ত্তে নিতে পারবে৷ সেই ভেবে তিনমাস আগে নওরিনের স্কুলের টিচার সাবিহাকে পড়ানোর জন্য বলে। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে সাবিহা। দেখতেও সুন্দরী। সুন্দরী তার প্রয়োজন ছিলো না, শিক্ষাটাই যথেষ্ট। অথচ অপ্রয়োজনীয় এই সুন্দরী শব্দটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ শুধু সুন্দরী না, উচ্চশিক্ষাটাও জড়িত আছে সাথে। দুমাস যাবত নোমানকে লক্ষ্য করছে ফাইজা। অল্প অল্প থেকে যেন পুরোপুরিই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে নোমানের দৃষ্টি সাবিহার তরে পতন হয়েছে। সাবিহা মেয়েটা মিষ্টি কথায় মিষ্টি হাসিতে তার মিষ্টি সংসারে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা লুকোচুরি হলেও ইদানীং যেন খোলামেলা হয়ে গেছে। একমাস যাবত নোমান এখন জলদি বাড়ি ফিরে যেন সাবিহার সাথে দেখা করতে পারে। কষ্ট করে সন্দেহের চোখ পাকাতে হয় না ফাইজাকে। তার সামনেও নোমান ভালোমন্দের খবর জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত বোধ করে না, বউয়ের সাথে বাজে আচরণ করে ওই সাবিহার সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে না মোটেও। যেন ফাইজা কিছু মনে করলেও তাতে তার যায় আসে না। গত শুক্রবার সাবিহার সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছে, সেই খবরও এসেছে ফাইজার কানে। পরিবার তো ফেলে এসেছে, কিন্তু ছোট বোনটার সাথে দুইবছর যাবত যোগাযোগ হয় মাঝে মাঝে। বাইরে দেখা হয়েছিলো, ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আলাপ সালাপ হয় এখন। গত শুক্রবার সে-ই অন্য মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে বোনের জামাইকে দেখে বাড়ি ফিরে ফাইজাকে কল করে জিজ্ঞেস করে। ফাইজার কণ্ঠ মজবুত থাকলেও ভেতরের কষ্ট পাথরটা কেঁদে উঠেছিলো। স্বভাবতই সে কান্না চেপে রাখার মানুষ। সময়ে অসময়ে হাউমাউ কাঁদতে জানে না। বয়স বেড়েছে, বয়সের সাথে ম্যাচুরিটি বেড়েছে। ধৈর্য্যশীল হয়েছে, বুদ্ধিশুদ্ধির ক্ষমতা বেড়েছে, ভালোবাসার পরিধিও বেড়েছে। পৃথিবীর কেউই প্রিয়জনের অধিকার অন্যকে দিতে পারে না, একান্তই নিজের করে রাখতে চায়। ফাইজাও চাইছে। কিন্তু বদলে গেছে নোমান। তৃতীয় ব্যক্তির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে সে। স্ত্রীর সাথে সময়ে অসময়ে খুনসুটি এখন চলে না তার, মেয়ের আদুরে কথায়ও আদুরে তাল মেলায় না। ঘরে এলেই যেন তার বিরক্তি আর বিরক্তি! স্বেচ্ছায় বাজার করতে ভুলে যায়, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কথা জোর দিয়ে বলে দিলে এনে দেয়। অথচ ত্রিশ তারিখে সাবিহার বেতন দিতে হবে, সেটা ভুলে যেতে দেখা যায় না। ত্রিশ তারিখের আগেই দিয়ে রাখে ফাইজার কাছে, যেন সময় মতো সাবিহাকে দিতে পারে। অথচ স্কুলের বেতন ফি-র খবরাখবর রাখে না। ডায়রিতে নোটিশ এলে ফাইজাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে হবে। আহা! স্ত্রী সন্তানের প্রতি সম্প্রতি তার চমৎকার দায়িত্ব!
মেয়ের মাথা বুকে নিয়ে নিশ্চুপ চোখ ঝরাচ্ছে ফাইজা। সময় নিয়ে ভারি নিশ্বাসও ফেলছে। অথচ পাশেই লোকটা ভারি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঘুমে কি সুখ তার! অথচ চোখে এই এক টুকরো সুখ ডেকে আনতে সারারাত ছটফট করতে হয় ফাইজাকে। এপাশ এপাশ নড়তেও ভীষণ কষ্ট হয়। তারউপর মেয়ের হাত পা আবার কখন ছুটে আসে পেটের দিকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। মেয়েটা মা কিংবা বাবাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারে না। হঠাৎ জেগে কান্না করে উঠে। তাই সমস্যা হলেও উপায়ান্তর নেই তার। মনে পড়ে, নওরিন পেটে থাকতে কত নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছিলো নোমান। শুধুমাত্র ফাইজার ঘুম হচ্ছে না বলে। আজ সে কদিন যাবত ঘুমাচ্ছে না, তার হিসেব তো দূর! ওই নির্ঘুম চোখে নজরও পড়ছে না এই লোকটার।
ভোর হতেই উঠে নামাজ আদায়। তারপর রান্নাবান্নার আয়োজন। মেয়েটা স্কুলে যাবে, মেয়ের বাবা অফিস যাবে। খাবারটা ঝটপট রেডি করে দিতে হবে। ঘুম থেকে উঠেই তাড়া শুরু করবে, তা বেশ ভালো জানা আছে ফাইজার। তবে রান্না তার তাড়াতাড়িই শেষ হলো। রুটি বানিয়েছে, মাংস রান্না করা আছে। আর একটু সবজি করেছে৷ এতেই হবে সকালের নাস্তা। পরে ধীরেসুস্থে আবার দুপুর ও রাতের রান্না একত্রে বসিয়ে দিবে। ফাইজা কিচেনের কাজ সেড়ে নওরিনকে ডেকে তুললো। নোমানও জেগে গেছে তার ডাকে। হাত পা মেলে আড়মোড়া ভেঙে বিছানাতেই লেগে আছে। নওরিনকে তুলে ব্রাশ করিয়ে নাস্তা শেষ করালো৷ তারপর স্কুলের জন্য রেডি করালো। নোমান ততক্ষণে নাস্তা শেষ করে এসেছে। অফিসের জন্য রেডি হতেই ফাইজা বললো,
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। তুমি নওরিনকে স্কুলে দিয়ে এসো একটু।”
“আমি পারবো না এখন ওদিকে যেতে। অফিস যাবো।”
“কতক্ষণ আর লাগবে।”
“সময় নেই আমার।”
চলে গেলো নোমান। ফাইজা মেয়ের কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিলো৷ পাঠাবে না স্কুলে। শরীর তার সত্যিই খারাপ লাগছে৷ আবার ভাবলো একটু অসুস্থতার জন্য মেয়ের পড়াটা মিস যাবে। রেডি হয়ে বসেছে যখন, একটু কষ্ট না হয় করুক। রিকশা দিয়ে যাবে, আবার নামিয়ে দিয়ে ওই রিকশাতেই ফিরে আসবে। তা-ই করলো ফাইজা। কিন্তু সিড়ি বেয়ে নামতে উঠতেও হাঁপাতে হয় তাকে। এইটুকুতে পানি পিপাসা লেগে যায়৷ প্রথম সন্তানের বেলায় এতোটা কষ্ট পোহাতে হয়নি তাকে। শুধু একটু ভয় ছিলো প্রসবকালের কথা ভেবে। এবার তার সেই ভয় নেই, কিন্তু কষ্টের প্রকোপটা বড্ড বেশি। শারীরিক কষ্ট, মানসিক কষ্ট দুয়ে মিলে পোড়াচ্ছে তাকে। ঘরে ফিরে কোনোমতে বোরকাটা পাল্টে ফ্যানের নিচে নিস্তেজ দেহ এলিয়ে দিলো বিছানায়। ঘুম নামতেও যেন সময় নেয়নি। অথচ কতদিন ধরে ঘুমাতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। আর কত? নির্ঘুম চোখও শান্তি চায় এবার।