ছেঁড়া বাঁধন পর্ব- ১১,১২

ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ১১,১২
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে নওরিনকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার জন্য বলতে চেয়েও বললো না নোমান। ফাইজা যখন যাচ্ছে, তো যাক। সেখানে গেলে সাবিহার সাথে দেখা হতে পারে। সে চাইছে না সাবিহার সাথে আর দেখা হোক। তাই বললো না এই ব্যাপারে কিছু। নাস্তা করে চলে গেলো অফিসে। তারা মা মেয়ে চলে গেলো স্কুলে। আজও অসুস্থ বোধ করছিলো ফাইজা, তবে গতকাল তার জন্য যাওয়া হয়নি তাই আজ মিস দিলো না স্কুল। সময় মতো দিয়ে এসেছে আবার নিতে গিয়েছে। কিন্তু ছুটি হতেই মেয়েকে মলিন মুখে বের হতে দেখা গেলো। নিকটে আসতেই ফাইজা জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে, মা? মন খারাপ কেন?”
নওরিন জবাব দিলো না তার জিজ্ঞাসায়। গাল ফুলিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইজা থুতনি ধরে মাথা উপর দিকে তুলে বললো,
“ঝগড়া করেছো কারো সাথে?”
নওরিন দুদিকে মাথা নাড়লে ফাইজা বললো,
“তবে? কি হয়েছে?”
“সাবিহা মিস আমাকে মেরেছে।”
“মেরেছে! কেন? দুষ্টুমি করেছো?”
“উহু। কি যেন একটা পড়া জিজ্ঞেস করেছে, আমি বলতে পারিনি।”
“পড়া পারোনি! কি পড়া জিজ্ঞেস করেছিলো?”
“কি যেন একটা বলেছে। আমার মনে নেই। তুমি কখনো আমাকে সেটা পড়াওনি। টিচারও পড়ায়নি। তবে আমি পারবো কোত্থেকে!”
“আমি পড়াইনি, টিচারও পড়ায়নি! টিচার না পড়ালে জিজ্ঞেস করবে কেন! কাল পড়িয়েছে হয়তো। তুমি তো কাল আসোনি।”
“এজন্যই চাইনা আমি স্কুল বন্ধ করতে। তুমিই আমাকে কাল স্কুলে নিয়ে আসোনি। আর আজ মার খেতে হলো।”
“তুমি বললে না মিসকে, আমার আম্মু ছুটি নিয়েছে।”
“বলেছি তো। তবুও পড়া দিতে হবে!”
ফাইজা একটু চিন্তিত হয়ে তার মাথায় হাত বুলালো। মেয়ের ব্যাথায় একটু ব্যাথা লাগলেও বললো,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। টিচার মারলে কিছু হয় না। আবার কখনো এমন হলে, টিচারকে বলবে লিখে দিতে। শিখিয়ে দিবো। ওকে?”
নওরিন ঘাড় হালকা কাত করলো। ফাইজা তার মন ভালো করতে বললো,
“আচ্ছা, নওরিন আজ কি খাবে বলো তো! আইস্ক্রিম? ঝালমুড়ি? নাকি কিটক্যাট?”
“ওই বড় বড় গোলাপি হাওয়াই মিঠাই কিনে দিবে কি?”
“অবশ্যই! আমার নওরিন হাওয়াই মিঠাই খাবে আর আমি কিনে দিবো না!”
ফাইজা এগিয়ে গেলো হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে। তাকে জিজ্ঞেস করলো গোলাপিটা নিবে নাকি সাদাটা। সে মতলব জারি করে হেসে উঠলো যে, দুইটাই নিবে। তার দুষ্টুমিতে হেসে ফাইজা তাকে দুইটাই কিনে দিলো। তারপর রিকশা নিয়ে ফিরে এলো বাড়িতে। আর মন খারাপ হয়নি নওরিনের।
সন্ধ্যায় একই সময়ে বাড়ি ফিরেছে নোমান। যদিও ফাইজা আগের অভ্যাস মতে যথাসময়ে খাবারের প্লেট রেডি করেছে। কিন্তু নোমান ফ্রেশ হয়ে খেতে না বসে চলে গেছে নামাজ পড়তে। পেছনে ফাইজাকে দেখেনি, তাই বের হওয়ার সময় নওরিনের রুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
“নওরিন, দরজা লাগিয়ে যাও।”
নওরিন রুমে থেকেই চেচালো,
“কোথায় যাও, বাবাই?”
“নামাজে যাবো বাবাই। এসো, দরজা লাগিয়ে যাও।”
“আসছি।”
চেয়ার ছেড়ে নেমে এসেছে নওরিন। তবে দরজা লাগাতে ফাইজাই এগিয়ে এসেছে। নামাজ পড়ে আজ আবারও চমচম এবং পাউরুটি নিয়ে ফিরেছে। কলিং বেল বাজালে নওরিনই দরজা খুলতে গেছে। ফাইজা তখন নামাজ পড়ছিলো। নোমান তার হাতে চমচমের প্যাকেট ধরিয়ে দিলে নওরিন বললো,
“এটা কি, বাবাই?”
“চমচম।”
“এমন কেন প্যাকেট?”
“এটা অন্য দোকান থেকে এনেছি, তাই আলাদা প্যাকেট।”
“আমি ভেবেছি চকলেট কেক নিয়ে এসেছো বুঝি!”
“তুমি চকলেট কেক খাবে?”
“চকলেট কেক খেতে তো মজাই লাগে।”
“আচ্ছা, আজ চমচম খাও। কাল অফিস থেকে আসার সময় ভালো দেখে একটা চকলেট কেক নিয়ে আসবো।”
“ওকে। তুমি জানো, আজ আমি দুইটা বড় বড় হাওয়াই মিঠাই খেয়েছি। আম্মু কিনে দিয়েছে স্কুল থেকে আসার সময়।”
“আমাকে রেখেই খেয়ে ফেলেছো এতো বড় বড় হাওয়াই মিঠাই!”
বাবার আস্কারায় নওরিন মাথা হেলিয়ে হেসে বললো,
“তুমি আসতে আসতে তো হাওয়াই মিঠাই হাওয়া হয়ে যেতো। কিভাবে রাখবো তোমার জন্য!”
নোমান মুচকি হেসে বললো,
“চলো একসাথে বসে ডিনার করবো। আম্মুকে খাবার দিতে বলো।”
“আম্মু তো নামাজ পড়ে।”
“এসো, আমরাই নিয়ে নিয়ে সব খেয়ে ফেলি।”
চমচমের প্যাকেট হাতে নওরিন টেবিলের দিকে চলে গেলো বাবার সাথে। এদিকে মোনাজাতে কেঁদে উঠেছে ফাইজা। নামাজ তার শেষই হয়ে গিয়েছিলো। নোমান যখন এসেছে, তখন সে তসবিহ হাতে জিকির করছিলো। দরজা খোলা থেকে শুরু করে বাবা-মেয়ের সব কথাই শুনছিলো। কি সুন্দর মায়াবী তাদের কথপোকথন! অথচ ওই লোকটা এই মায়া ছেড়ে চলে গেছে পরনারীর তরে। এলোমেলো করে দিয়েছে তার মায়ার সংসারটাকে। এই মমতা জড়ানো কথাবার্তা কি তার ভালো লাগে না শুনতে? তবে কিভাবে গেলো এই মায়ার বাঁধন ছেড়ে! এসব ভেবেও কেঁদে চলেছে মোনাজাতে। তার হেদায়েত হোক, এখনো সেই দোয়া করে। কিন্তু মন মানে না মনে পড়লে, সে চলে গিয়েছিলো পরনারীর ঘরে!
মোনাজাত শেষ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে এলো জায়নামাজ ছেড়ে। টেবিলে দেখলো নওরিন বই খাতা খুলে রেখেই চলে গেছে। তা গোছাতে যেতেই কানে এলো নওরিনের গলা,
“আম্মু খাবে কি! আম্মু খাবে কি!”
নোমান প্রত্যুত্তর করছে,
“আম্মুর খেতে হবে না আজ। আম্মু না খেয়েই বাঁচতে পারে।”
রুম থেকে বের হতেই দেখলো মুগ্ধকর দৃশ্য! বাবা মেয়ে পাশাপাশি খেতে বসে গেছে। ফাইজা তাকে গতকাল ডেকে নিয়ে রুমে বসে খায়িয়েছে, তাই আজ নোমান চালাকিটা করেই বসলো। ফাইজা তো খাবে না, মেয়ে পাশে বসুক। এইযে, মেয়ের আম্মুর জন্য খাবার রাখবে না, রাখবে না বলে মেয়েকে রাগাচ্ছে। এতেও ভালো লাগছে নোমানের। সাথে ভালো লাগছে এপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফাইজার। সে নোমানের জন্য প্লেটে ভাত দিয়েই এসেছিলো। নোমান এখন নওরিনকে প্লেটে ভাত দিয়ে খেতে দিয়েছে। সে বলছে সব খেয়ে নিবে, যেটা ধরছে তাতেই মেয়ে বলছে,
“এইটা একটুখানি আম্মুর জন্য রাখো। ওইটা একটুখানি আম্মুর জন্য রাখো। সব খাবে না বলে দিচ্ছি। আম্মু কষ্ট করে রান্না করেছে না!”
“আমিও তো কষ্ট করে সব এনে দিয়েছি।”
বাবার প্রত্যুত্তরে মেয়ে ভ্রু কুচকে জবাব দিলো,
“তাইতো তুমিও একটু একটু খাবে। রান্না তো আর তুমি করোনি। তাই আম্মুর জন্য রাখো। নয়তো কাল সকালে কিন্তু আম্মু আর রান্না করবে না।”
“ওকে বাবা, রেখেছি আম্মুর জন্য। খাও তুমি।”
ফাইজা আবার ফিরে এসেছে রুমের ভেতর। তারা আনন্দের সাথে খাচ্ছে, সে যাবে না তাদের আনন্দ নষ্ট করতে। খাওয়া শেষে নওরিন ফিরে এলে বললো,
“তোমার আব্বুর খাওয়া হয়েছে?”
“হ্যাঁ। তোমাকে রেখেই সব খেয়ে নিতে চেয়েছিলো বাবাই। আমি নিষেধ করেছি।”
“বাবাই সব খেতে পারবে না। দুষ্টুমি করেছে। তুমি লেখা শেষ করোনি। এটা শেষ করো।”
“আর ভালো লাগছে না। হোমওয়ার্ক তো সব শেষ করেছি। এতো পড়তে হবে!”
“আচ্ছা, এটা শেষ করে রেখে দাও। আর পড়তে হবে না।”
“ওকে, আবার বলবে না কিন্তু আরেকটা পড়তে।”
“ঠিক আছে৷ বলবো না আরেকটা পড়তে।”
আজ খাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমাতে যায়নি নোমান। ফ্রিজে চমচমের প্যাকেট রাখতে গিয়ে আগের প্যাকেটটা এখনো অবশিষ্ট পেয়ে সেটা হাতে নিয়ে চলে এলো নওরিনের রুমে। ফাইজাও বের হতে যাচ্ছিলো, তাকে দরজার সামনে দেখে থেমে গেছে। নোমান হাতের তালুতে প্যাকেট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
“আগেরগুলো শেষ হয়নি দেখি এখনো।”
ফাইজা কিছু বলেনি, সে-ও অপেক্ষায় বসে থাকেনি তার প্রত্যুত্তরের। নওরিনের সামনে প্যাকেট ধরে বললো,
“বাবাই, নাও।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও! আমি এটা লিখে নেই আগে।”
“ওকে, লিখো।”
নোমান অন্য হাতে রিমোর্ট নিয়ে বিছানায় বসলো। টিভি অন করতে করতে চমচম তুললো মুখে। ফাইজা গেছে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে। বাবা মেয়ে আগের প্যাকেটের অবশিষ্ট চার চমচম শেষ করে ফেলেছে বসে বসে। নওরিন অবশ্য একটার বেশি একসাথে খেতে পারে না। তিনটা নোমানের পেটেই গিয়েছে। একটু বেশিই পছন্দের তার।
ফাইজা খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে চেয়ারেই বসে ছিলো। ভাবছে কত রকমের কথাই। নোমান সেখানে থাকায় যাচ্ছেও না ঘুমাতে। একটু পর নোমান বেরিয়ে এসে নিজ রুমে যেতে যেতে তাকে বললো,
“এই রুমে ঘুমাতে এসো।”
কিন্তু ফাইজা চলে গেলো তার বিপরীতে। নওরিনকে হয়তো ডেকে এসেছিলো, তাই নওরিন এদিকেই আসছিলো। ফাইজা হাত ধরে নিয়ে চলে গেলো সাথে। লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো মা মেয়ে। এদিকে নোমানের অপেক্ষার অবসান ঘটলো না। না মেয়ে এসেছে, আর না মেয়ের মা!
সকালে ঘুম থেকে উঠে এক মুহূর্তের জন্য ফাইজাই চমকে গেলো! তারা তো যায়নি ঠিক, কিন্তু নোমানই চলে এসেছে তাদের কাছে। ওইতো, নওরিনের ওপাশে শুয়ে আছে! বিপরীত মুখী হয়ে ঘুমাচ্ছে। নওরিন বাবার মাথার উপর হাত ফেলে পিঠের সাথে লেগে শুয়ে আছে। বাবা-মেয়ের কারোই হুশ নেই। নওরিনটা এমনই। ঘুমের মধ্যে বেশ ছটফট করে। কখনো ফাইজার চুল পেচিয়ে যায় তার হাতে। আগে তো মুখের উপর পা-ও তুলে দিতো। এখন অবশ্য একশো আশি ডিগ্রিতে ঘুরে না। তবে ত্রিশ-ষাট ডিগ্রি ঘুরে যায় মাঝে মাঝে। ওইতো, তার মাথা চলে গেছে বালিশের উপর দিয়ে, হাতের কনুই চলে গেছে বাপের মাথায়! হাটু ঠেস দিয়ে আছে বাপের পিঠে! যেন আরেকটু ধাক্কা লাগলেই তার বাবা চলে যাবে মেঝেতে! খাটে এখন তিনটা বালিশ। নোমান বালিশ নিয়ে এসেছে সাথে। অথচ কখন এসেছে খেয়াল করতে পারেনি ফাইজা। সে নওরিনকে একটু টানলো এদিকে৷ নয়তো ধাক্কা খেয়ে ঠিকই পড়ে যেতে পারে তার বাবা। আগে তাকে বালিশের মাঝামাঝিতে আনলো, তারপর চেষ্টা করলো বালিশসহ টেনে আনার। যথাসম্ভব এনেছে তবে শক্তিতে কুলাতে পারছে না আর। পেটে ব্যাথা অনুভব হয়। তাই ঝুঁকি নিতে গেলো না আর। ওদিকে মাথা থেকে হাত সরে আসায় নোমানও ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে পাশ ফিরে নওরিনকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। এখন আর পড়ে যাওয়ার আশংকা নেই।

“ছেঁড়া বাঁধন”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
তাদের কাণ্ড দেখে ফাইজা চলে গেলো নামাজ আদায় করতে। তারপর রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। শরীরটা আজ আরও বেশি খারাপ লাগছে। রান্না করতেও ভালো লাগছে না। বেশ ক্লান্তিতে ভুগছে। ইচ্ছে হচ্ছে শরীরের ভার ছেড়ে দিতে মেঝেতে। কিন্তু ভার ছেড়ে দিলে তো চলবে না। মেয়ে স্কুলে যাবে, তার বাবা অফিস যাবে। ঘুম থেকে উঠলেই তাদের নাস্তা দিতে হবে। ভাত বসিয়ে সবজি কাটার সময় যেন চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে! ফাইজা ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসলো। হেলান দিয়ে মাথার ভারটাও ছেড়ে দিলো পেছনে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে! হাত বাড়িয়ে জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে মাথার তালুতে দিলো পরপর দুইবার। তারপর চোখ বুজে বসে রইলো কিছুক্ষণ। ভাতের মার পড়ার শব্দ পেয়ে চোখ খুলে উঠে এলো। তা-ও আগের চেয়ে ভালো লাগছে কিছুটা। সবজির দিকে তাকিয়ে আর ইচ্ছে হচ্ছে না কাটতে। সে শুধু মাছ ভেজে নিলো। ওদিকে ভাত হয়ে এসেছে। সাবধানে মার গালতে দিলো। তরকারি কিছুই রান্না হলো না আর। ডিম সিদ্ধ বসিয়ে গিয়ে শুয়ে রইলো পাশের রুমে। ওদিকে তারা বাবা মেয়ে ঘুমায় ওই রুমে। বেশ কিছুক্ষণ পর নওরিন জেগেছে। কিচেনে গিয়ে মাকে না পেয়ে সেখানে থেকেই ডাকলে ফাইজা সাড়া দিলো। এর আগে ফাইজা চুলা অফ করে রেখে এসেছিলো। নওরিন এগিয়ে এলে বললো,
“তোমার আব্বু উঠেছে?”
“না। তুমি এখানে ঘুমাচ্ছো কেন?”
“ঘুমাচ্ছি না। এমনি শুয়ে আছি৷ তোমার আব্বুকে ডাকো, অফিস যাবে।”
নওরিন ডাকতে গেলে ফাইজা ডিমের খোসা ছাড়িয়ে প্লেটে ডিম, পাউরুটি ও চমচম দিলো নাস্তা হিসেবে। সাথে ভাত ও ভাজা মাছও রাখলো টেবিলে। যে যেটা খায়! গতরাতের একটু তরকারি অবশিষ্ট ছিলো, সেটাও জ্বাল করে রেখেছে সামনে। নওরিনকে পাউরুটি আর ডিম সিদ্ধ খেতে দিয়ে তারপর ঘরে পড়তে বসতে বললো। আজও স্কুলে নিয়ে যাবে না ফাইজা। তার খুবই খারাপ লাগছে। এদিকে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নোমান খাবারের আইটেম দেখে ভালোমন্দ কিছুই বললো না। সে ভাজা মাছ আর সিদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছে। সকাল সকাল পাউরুটি চমচম খেতে ইচ্ছে করছে না। গতরাতে এমনিতেই এক বসায় তিনটা চমচম খেয়েছে। ভাতেই শান্তি অনুভব করলো এখন। নওরিনকে রেডি হতে না দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আজ স্কুলে যাবে না?”
“না। আম্মু অসুস্থ। কে নিয়ে যাবে আমাকে!”
“কি হয়েছে আম্মুর?”
“সকাল থেকে মাথায় পানি দিয়ে শুয়ে আছে, দেখছো না! আম্মুর মাথা ব্যাথা করছে।”
“রেডি হও, আমি দিয়ে যাবো স্কুলে।”
নওরিন দ্রুত মায়ের কাছে চলে গেলো।
“আম্মু, বাবাই বলেছে আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে। তাই ঝটপট রেডি হতে।”
ফাইজা নিষেধ করলো না। শোয়া থেকে উঠে তাকে রেডি করে দিতে লাগলো। নোমান নাস্তা করে এসে বললো,
“নাস্তা করেছো?”
ফাইজার মুখে জবাব ফুটেনি তার জিজ্ঞাসায়। সে আবার বললো,
“শরীর বেশি অসুস্থ? ডাক্তারের কাছে যাবে?”
ফাইজা এবারও কোনো জবাব দিলো না। নোমান রেগে ধমকের সুরে বললো,
“মুখে তালা দিয়েছো? একটা কথারও জবাব নেই! অসুখ বাঁধিয়ে চুপ থেকে বসে বসে মরো গিয়ে।”
তার রেগে যাওয়াতে বিরক্তি ফুটে উঠলো ফাইজার চেহারায়। নোমান হনহনিয়ে চলে গেছে পাশের রুমে। ফাইজা জুটি গেঁথে দিচ্ছে মেয়ের মাথায়। বাবার মেজাজ দেখে মায়ের মুখে একবার তাকালো নওরিন। ফাইজা জুটি গাঁথা শেষ করে কাঁধে ব্যাগ দিয়ে বললো,
“যাও, বাবার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
নওরিন চুপচাপ পাশের রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালেই নোমান বেরিয়ে এলো। যাওয়ার সময় ফাইজাকে নরম গলায় বলে গেলো,
“দুপুরে যেতে পারলে আনতে যেয়ো। অসুস্থ থাকলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাকে কল করো। আমিই যাবো।”
তারা চলে যাওয়ার পর লবণ মাখিয়ে একটা ডিম সিদ্ধ খেয়ে আবার বিশ্রাম নিয়েছে ফাইজা। তারপর অনেকটা ভালো অনুভব করায় ধীরে ধীরে বাকি রান্না সেড়েছে। দুপুরে ততটা খারাপ লাগছে না তাই সে-ই আনতে গেছে। নওরিনকে নিয়ে মাত্র রিকশায় উঠেছে, এমনি নোমানের কল এলো। ফাইজা নওরিনের কাছে ফোন দিয়ে বললো,
“বাবার সাথে কথা বলো।”
নওরিন রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই নোমান জিজ্ঞেস করলো,
“বাসায় এসে গেছো? আম্মু নিয়ে এসেছে?”
“না, আমরা রিকশায়। বাসায় যাচ্ছি আম্মুর সাথে।”
“ওকে।”
ফাইজা নওরিনকে নিতে গিয়েছে জেনে ফোন রেখে দিয়েছে নোমান। পরদিন নওরিনকে স্কুলে দিয়ে এলেও অফিস যায়নি সে। ফাইজার শরীর অনেকটাই খারাপ লক্ষ্য করছে। ডেলিভারি ডেটও নিকটে চলে এসেছে, ডাক্তার দেখানো হয় না অনেক দিন যাবত। তাই সকালে নওরিনকে স্কুলে দিয়ে ফিরে এসেই বললো,
“রেডি হও, ডাক্তারের কাছে যাই।”
ফাইজা কোনো প্রতিক্রিয়াই জানায়নি তার কথায়। নওরিনের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নোমান যেতে দেখেই বলেছে,
“এদিকে কোথায় যাও? রেডি হতে বলেছি।”
তবুও যখন ফিরলো না রেগে গেলো খুব! সে রুমে এসে রাগে চেচালো,
“কানে যায়নি কথা? থাপ্পড় মেরে কান তব্দা লাগিয়ে দিবো। একটায় কম পড়ে গেছে বুঝি! এখানে বসেছো কেন? উঠো!”
ফাইজা তার উপর বিরক্তিকর চোখে তাকালে সে চোখ মটকে বললে,
“এক মিনিটের মধ্যে রেডি হবে। যাও বলছি!”
ফাইজারও রাগ হচ্ছে। রাগের তাড়নায়ই উঠে চলে গেলো রেডি হতে। অসহ্য লাগছে তার চেচামেচি। মুখে তালা লাগিয়ে চুপচাপ গেলো সে নোমানের সাথে। ডাক্তার তাকে দেখে বিস্ময়ের সাথে বললো,
“এ কি অবস্থা! এমন শুকালে কিভাবে? খাওয়াদাওয়া করো না ঠিক মতো? কি মানুষ, কি হয়ে এসেছে! এমন হলে তো রক্তশূন্যতা দেখা দিবে। আমিষ খাও না ঠিকমতো?”
“খেতে পারি না। গন্ধ সহ্য হয় না।”
“সহ্য না হলেও খেতে হবে। এভাবে বাঁচা যাবে!”
খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারে নোমান কিছুই বলতে পারলো না। কারণ সে জানে না ফাইজা কি খাচ্ছে আর কি খাচ্ছে না। তবে তাকে খেতে দেখা যায় না, তাই এটুকু বলতে পারলো, ঠিকমতো খায় না। ডাক্তার তাকে দোষারোপ করলো, না খেলে সে আছে কিজন্য! ঠিকমতো খাওয়াতে পারে না! এই ডাক্তারটা অনেক ভালো কেয়ার করে রোগীদের। নওরিনের সময়ও তার কাছেই আসতো ফাইজা, এখনো তার কাছেই আসে। তিনি অপারেশনের জন্য আগামী সপ্তাহে যেতে বলে দিলেন। এই কদিনে খাওয়ার প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে বললেন। আগামী সপ্তাহ বলতে নির্ধারিত সময়ের আর পাঁচ দিন বাকি। বাড়ি ফেরার পথে কিছু ফলমূল কিনে নিলো নোমান। তাকে বাড়িতে রেখে নওরিনকে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে। বাকিটুকু সময় বাড়িতেই কেটেছে। একটু পরপর কানের কাছে বলে যাচ্ছে, “একটু পরপর ফলটল খেয়ো।”
“আজ মাংস রান্না করো।”
“ভাতে বেশি বেশি মাছ মাংস খেয়ো।”
অথচ আমিষ হিসেবে ফাইজা বেছে নিয়েছে ডাল! মাছ মাংসের চেয়ে ডাল দিয়ে ভাত বেশি খাওয়া হয় তার। তবে একেবারেই ইগনোর করেনি, চেষ্টা করছে অল্প হলেও মাছমাংস খাওয়ার। বিকেলে নোমান বাজারে গিয়েছিলো, কিছু সবজি কিনেছে ও মাছ কিনে কেটে নিয়ে এসেছে। এতোদিনে যেন তার হুশ ফিরেছে এবং হুশিয়ারির সাথে যত্ন নিতে লেগে পড়েছে। অবশ্য এর পেছনে কারণও আছে। আজ সে একটু বেশিই আনন্দ অনুভব করছে। ডাক্তার যমজ বাচ্চার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এতেই যেন মনের অজান্তেই আনন্দ বিরাজ করছে তার মাঝে। ওদিকে ফাইজা যেন পড়ে গেছে আরও বিপাকীয় চিন্তায়! সন্ধ্যায় চোখ বুজে শুয়ে শুয়েও চিন্তাই করছিলো, তার শরীর তো ভালো না। বাচ্চাদের কন্ডিশন ভালো হবে তো!
ওদিকে মেয়েকে পড়াচ্ছে তার বাবা। তাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে বলে নোমান স্বেচ্ছায়ই গেছে পড়াতে। বাসায়ই তো আছে, পড়াতে সমস্যা নেই তার। একটু পর ফাইজার কাছে নওরিন এলে চোখ খুলে তাকালো ফাইজা।
“আম্মু, তুমি ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছো?”
“না, ঘুমাচ্ছি না। এমনি শুয়ে আছি। পড়া শেষ তোমার?”
“উহুম, বাবাই তোমাকে এটা পড়তে বলেছে। তুমি পড়তে পারো কি না জানতে চায়।”
ফাইজা ভ্রু সামান্য কুচকে নওরিনের এগিয়ে দেওয়া খাতায় তাকিয়ে দেখলো পুরো পেজে বড় করে নোমানের হাতের লেখা, “স্যরি ম্যাম”
ফাইজা সামান্য বিরক্ত হলো। মেয়েকে বললো,
“পড়ার নাম করে বসে বসে খাতা নষ্ট করছো!”
“আমি লিখিনি তো। বাবাই লিখেছে। বলেছে তুমি নাকি পড়তে পারবে না। এটা তো আমিই পড়তে পারি। স, য-ফলা স্য, র ই-কার রি। স্যরি। ম, য-ফলা আ-কার ম্যা, ম। ম্যাম। স্যরি ম্যাম! ঠিক বলেছি কি?”
“হুম, ঠিক বলছো। যাও এবার, এসব দুষ্টুমি বাদ দিয়ে পড়াশোনা করো।”
“বাবাই বলেছে, এটা আবার বাবাইয়ের কাছে তোমাকে পড়া দিতে। তুমি তো এটা পারোই, তাই না আম্মু?”
“না, পারি না। তোমার বাবাই আমার থেকে বেশি শিক্ষিত। তাই তোমার বাবাইয়ের এসব শেখা আছে। আমার নেই।”
“আমিও তো পারি। তবে আমিও বাবাইয়ের মতো তোমার থেকে বেশি শিক্ষিত?”
ফাইজার হাসি পেয়ে গেলো। মৃদু হেসে বললো,
“না, তুমি এখনো বানান করে পড়ো। তাই বাবাইয়ের মতো বেশি শিক্ষিত এখনো হতে পারোনি। তোমার বাবাই বানান করে পড়ে না। বাবাইয়ের মতো বেশি শিক্ষিত হতে হলে তোমাকে আরও বেশি পড়তে হবে। যাও, পড়ো।”
“ওকে।”
নওরিন বাবার কাছে ফিরে এসে বললো,
“বাবাই, তুমি কি করে দেখে দেখে বানান ছাড়াই পড়ে নিতে পারো? আমি তো পারি না।”
“ওটা পড়তে পড়তে হয়ে যাবে। আমিও তোমার মতো ছোট থাকতে বানান করেই পড়েছি।”
“তবে কি আমি তোমার মতো বড় হলে বেশি শিক্ষিত হতে পারবো?”
“বেশি শিক্ষিত!”
নোমান বুঝতে না পেরে বিস্মিত সুর টানলো কথায়। নওরিন তাকে বললো,
“হুম, আম্মু বললো তো তুমি আম্মুর চেয়ে বেশি শিক্ষিত। তাই এটা লিখেছো।”
“ও আচ্ছা, আর কি বললো আম্মু?”
“আর বলেছে আম্মু এটা পারে না।”
“আর কিছু বলেনি?”
“বলেছে খাতা নষ্ট করছি কেন এসব লিখে!”
নোমান মৃদু হাসলো। নওরিন জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মু তোমার থেকে কম শিক্ষিত কেন বাবাই?”
“তোমার সাথে সাথে পড়বে বলে আম্মু কম শিক্ষিত রয়ে গেছে।”
“তবে আম্মুকে স্কুলে ভর্তি করে দাও আমার সাথে।”
হাসিমুখে নওরিন বলে উঠতেই শরীর কাপিয়ে হাসলো নোমান। তারপর মেয়ের জবাবে বললো,
“তোমার আম্মুকে আমিই পড়াতে পারি। স্কুলে ভর্তি করতে হবে না।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here