ছায়া,১ম পর্ব
Misk Al Maruf
শাশুড়ির রুম থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনে বেশ দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল সুমি। যদিও লায়লা বেগমের সাথে সুমির সম্পর্কটা কয়েকমাস যাবৎই ভালো যাচ্ছে না তবুও শাশুড়ি যত বড় শত্রুই হোক না কেন বিপদের মুহূর্তে যদি সে এগিয়ে না যায় তবে স্বাভাবিক ভাবে যে কেউই তার হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও দ্বিধা করবে না।
নিজের রুমের চৌকাঠ পেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সুমি খেয়াল করলো একটি আবছায়া ঠিক লায়লা বেগমের দরজার পাশ থেকে দৌড়ে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। এমন দৃশ্য দেখে সুমি কিছুটা ভয় পেলেও সে দমে না গিয়ে দ্রুত পায়ে লায়লা বেগমের ঘরে ঢুকতেই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে সুমি কিছুটা চমকে উঠে। কারণ লায়লা বেগম নিজের বিছানার উপর বসে অনবরত মৃগী রোগীর ন্যায় কাঁপছে এবং মুখ থেকে অস্বাভাবিক ভাবে সাদা ফেনার স্তুপ বেড়িয়ে আসছে। শাশুড়ীর এমন মুমূর্ষু অবস্থা দেখে এইমুহূর্তে সুমি কি করবে তা যেন ওর ভাবনাতেই আসছে না।
দৌড়ে গিয়ে লায়লা বেগমের মাথাটা নিজের হাতের উপরে রেখেই ভয়ার্ত স্বরে সুমি জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা আপনের কি হইছে? আপনে এমন করতেছেন কেন?”
সুমির কথার প্রতিউত্তরে লায়লা বেগম কিছু একটা বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। আস্তে আস্তে তার গোঙানির আওয়াজটা যেন নীরবতায় রূপ নিলো এবং মুহূর্তেই তার নিস্তেজ দেহটি সুমির কোলে ঢলে পরলো।
সুমি বেশ কয়েকবার নিজের শাশুড়িকে ধাক্কা দিলেও তিনি আর জেগে উঠলেন না।
ইতিমধ্যেই আশেপাশের বাড়িগুলোতে ফলাও ভাবে প্রচার হয়ে গেছে যে সিকদার বাড়ির বউ নিজের শাশুড়িকে বিঁষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। একজন দুজন করে আশেপাশের তিন চার গ্রামে এই খবর পৌঁছে গেল। এই সন্ধ্যার সময়েও মানুষ এমন খবর শোনার পর সকলেই সিকদার বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করেছে খুনি বউ এবং মৃত শাশুড়িকে একটুখানি দেখার জন্য।
হিমেলের কানে যখন পৌঁছালো যে তার বউ তার মা’কে বিঁষ খাইয়ে মেরেছে তখন সে একটুও নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারেনি। কারণ সে জানে তার স্ত্রীর সাথে তার মায়ের যতই মনমালিন্য থাকুক না কেন সুমি এধরণের কাজ জীবনেও করবে না। তবুও সে মায়ের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র আর একমুহূর্ত দেরী না করে শহর থেকে গ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো।
সুমি নিজের রুমের মেঝেতে বসে অনবরত কেঁদেই চলছে আর একটু পর পর এক একজন মহিলা এসে তাকে দেখে ঘৃণিত মুখে আবার চলে যাচ্ছে। কেউ আবার তাকে বলছে,
“শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক ভালো না বলে তাকে একদম মেরেই ফেললি। একটুও কি মায়াদয়া নেই তোর মনে?”
সুমি উত্তরে কিছু বলতে পারে না বরং শুধু কাঁদে। কারণ গ্রামের এসব অজ্ঞ মানুষকে হাজার বার বুঝিয়েও লাভ নেই।
তবে লায়লা বেগমকে বিঁষ খাওয়ানোর ব্যাপারে সুমিকে সন্দেহ করারও একটি বড় কারণ রয়েছে। ঘটনাটা পনেরো দিন আগের, সুমি তখন সবে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে এসেছে। কিন্ত দশদিনের উপর বাপের বাড়িতে অবস্থান করায় লায়লা বেগম তখনই সুমিকে ঝাড়তে থাকে। কারণ তিনি আগেই বলে দিয়েছিলেন দুই দিনের বেশি সে যেন বাপের বাড়িতে না থাকে। এই নিয়ে লায়লা বেগমের একের পর এক জ্বালাময়ী কথা শুনে সুমিও লায়লা বেগমকে অনেক কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়। একপর্যায়ে ছেলের বউয়ের এমন কঠিন কথা শুনে লায়লা বেগম সুমিকে মারতে উদ্যত হন, এমনকি একটি চড়ও বসিয়ে দেন সুমির গালে। শাশুড়ির এমন দুর্ব্যবহার দেখে সেও আর স্থির থাকতে পারেনি বরং পাশে থাকা একটি স্টিলের মগ লায়লা বেগমের মাথা বরবার ছুড়ে মারে। যদিও সেটি লায়লা বেগমের শরীরে লাগেনি তবুও তিনি এই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে একাকার করে ফেলেন। একে একে সকল প্রতিবেশীর নিকট তিনি ছেলের বউয়ের দোষ ত্রুটি বলতে থাকেন। যার কারণে সবার মনেই সুমির প্রতি একটি খারাপ ধারণার জন্ম নেয়। কিন্তু সেদিন সুমির কাছে এসবের থেকেও খারাপ লেগেছিল হিমেলের নিশ্চুপ থাকা দেখে। কারণ সে সব দৃশ্য দেখেও তার মা’কে কিছুই বলেনি। মূলত হিমেল নিজের পছন্দে সুমিকে বিয়ে করার কারণেই লায়লা বেগমের নিকট সুমি ছিল চোখে বিঁধে যাওয়া কাঁটার অনুরূপ।
হিমেলের বোন বাড়িতে উপস্থিত হওয়া মাত্রই আর্তনাদ স্বরে নিজের মায়ের মৃত্যু শোকে কষ্ট লোপণ করতে লাগলো, একই সাথে সে মায়ের মৃত্যুর জন্য সুমিকেই দায়ী করছে। কে যেন আবার পুলিশকে খবর দিয়েছিল তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে পুলিশ এসে উপস্থিত হয়। হিমেলের বড় বোন পুলিশের নিকট একের পর এক সুমির ব্যাপারে তার মায়ের সাথে করা অবিচারের কথা বলতে থাকে। এমনকি এও বলে যে এর আগেও নাকি সুমি তার মা’কে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। তার মুখে এমন কথা শুনে থানার কর্মকর্তা লায়লা বেগমের লাশ চেক করে অনেকটা বিশ্বাসই করে ফেলেন যে সুমিই ওনাকে বিঁষ খাইয়ে মেরেছে। তাই তিনি সাথে সাথেই তার সঙ্গে থাকা মহিলা কনস্টেবলকে নির্দেশ দেন সুমিকে এ্যারেষ্ট করার জন্য। এদিকে সুমিকে যখন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সে চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্য বলছিল,
“বিশ্বাস করেন আমি আমার শাশুড়িকে বিঁষ খাওয়াই নাই। বিশ্বাস করেন! আমার স্বামী আসুক তারপর আপনারা আমারে জেলে নিয়েন। উনি জানে আমি খুন করিনাই।”
কিন্তু পুলিশ তার কথা যেন একদমই শুনছিল না উল্টো তাকে অনেকটা জোরপূর্বকই ভ্যানে তোলা হয়। এদিকে হিমেল বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বোনের মুখ থেকে সকল ঘটনার বিস্তারিত শুনে সুমির প্রতি তার বিশ্বাসটা যেন অনেকাংশে লোপ পায়। হিমেলের বোন বিথী হিমেলকে জড়িয়ে ধরে কান্না মাখা স্বরে বলে ওঠে,
“ভাই, তুই যদি ঐসময়ে মায়ের পছন্দমতো বিয়াটা করতি তাইলে আইজ আমগো মায়ের মরাটা দেখা লাগতো না। এখনও কি তুই তোর বউরে বিশ্বাস করোছ? আমি তোর বিয়ার পরই বুঝছিলাম এই মাইয়া মায়রে সম্মান দিবেনা আর আইজকা দেখ আমার মায়রে পুরা মাইরাই ফালাইলো।”
এই বলেই হু হু করে কেঁদে দিলেন তিনি। বোনের এমন কথা শুনে হিমেলের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না। তার একদিকে যেমন মনে হচ্ছে এমন কাজ আদৌ সুমির দ্বারা করা সম্ভব না আবার অপরদিকে মনে হচ্ছে তার বোনের কথাই সঠিক। কারণ বাড়িতে সুমি আর মা ব্যতীত আর কেউই তো ছিল না। তাহলে?
কারাগারের দেয়াল ঘেঁসে সুমি নিজের হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে সেদিকে যেন খেয়াল নেই। হঠাৎই সেই চিরচেনা কন্ঠস্বরে ‘সুমি’ ডাক শুনে মুহূর্তেই সে চমকে উঠলো। মুখখানা উপরে উঠাতেই খেয়াল করে এ আর কেউ না বরং তারই প্রাণপ্রিয় স্বামী হিমেল। যদি তাকে জেলের এই অন্ধকার রুম থেকে কেউ বের করতে পারে তবে হিমেল ব্যতীত আর কেউই পারবে না। সুমি বসা থেকে অনেকটা দৌড়ে গিয়ে লোহার শিকের এপাশ থেকে হিমেলের হাতদুটো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“বিশ্বাস করো আম্মাকে আমি বিঁষ দেইনি। তুমিই বলো সামান্য ঝগড়ার কারণে আমি কেনইবা আম্মাকে মারতে যাবো?”
অতঃপর এক এক করে সমস্ত ঘটনা সে হিমেলের নিকট খুলে বললো। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো হিমেল সুমিকে কোনোরূপ সান্ত্বনা না দিয়ে কিছুটা কঠিন স্বরে বললো,
“তুমি সত্য বলছো না মিথ্যা বলছো সেটা আমি জানিনা কিন্তু তুমি যদি মা’কে বিঁষ না দাও তাহলে কে দিবে? বাড়িতে তো মা আর তুমি ব্যাতীত আর কেউ ছিলে না তাই নাহ?”
স্বামীর মুখে এমন কঠিন কথা শুনে মুহূর্তেই সুমির হৃদয়টা দুর্বল হয়ে যায়। কারণ তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য শেষ ভরসার মানুষটাও আজ তাকে ভুল বুঝছে। হিমেলের কথার প্রতিউত্তরে সুমি কিছু বলতে পারেনা বরং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সে ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে তাকে বাঁচানোর মতো আর কেউই অবশিষ্ট নেই। সুমি আস্তে করে হিমেলের হাতটা ছেড়ে দিয়ে পূর্বের জায়গাতে বসে পরে। অন্যদিকে হিমেল উপরে উপরে সুমিকে কঠোর কথা শুনালেও তার মনটাও ভালোবাসার মানুষের এমন কষ্ট দেখে চূড়মার হয়ে যায়। কিন্তু এখনি সে সুমির পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলবেনা বলে মনঃস্থির করে নেয়। বিদায় বেলায় হিমেল সুমিকে কিছু একটা বলতে যেয়েও বলতে পারে না বরং আস্তে করে লোহার শিক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকে। আস্তে আস্তে দূরে সরে যাওয়ার সাথে সাথে তার মনে হয় হৃদয় থেকে কিছু একটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সে জানে না আদৌ সে সুমিকে নির্দোষ প্রমান করে ঐ বদ্ধ ঘর থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারবে কিনা?
লায়লা বেগমের জানাজার নামাজ শেষে তাকে দাফন করা পর্যন্ত হিমেল একটা বিষয় খেয়াল করে যে ওর দুই চাচাতো ভাই কেমন যেন খাপছাড়া স্বভাবের মধ্য দিয়ে সবকিছু পাশ কাঁটিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লায়লা বেগমের মৃত্যুতে তারা কষ্ট পাওয়ার চেয়ে উল্টো বেশ খুশিই হয়েছে। কেননা জায়গা জমি নিয়ে বহু আগে থেকেই হিমেলের সাথে তাদের একটা খারাপ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তাই বলে এই মৃত্যু কালেও তাদের এমন ব্যবহার সে কখনোই আশা করেনি।
দাফন কাজ শেষ করে যখন হিমেল এবং ওর দুই ভগ্নিপতি বাড়িতে ফিরবে তখনই সে খেয়াল করে বেশ কিছুটা দূরেই ওর চাচাতো ভাই কামাল ও জামাল কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে আর হাসাহাসি করছে। হঠাৎই কামাল দূর থেকে হিমেলের দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময়ী হাসি দেয়। হাসিটা হিমেলের বুকে কাঁটার মতো আঘাত হানে। মুহূর্তেই মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে ওদের প্রতি সন্দেহটা বাড়তে থাকে। আর তাছাড়া সুমি তাকে বলেছিল সে যখন লায়লা বেগমের চিৎকার শুনে দৌড়ে যায় তখন সে একটি ছায়াকে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখেছিল। তাহলে কি এসবের সাথে ওদের কোন সংশ্লিষ্টতা আছে? প্রশ্নটা থেকেই যায়…
[To be continued]