#চন্দ্রকিরণ
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১৩
রাত ততটা গভীর হয়নি। জাহান ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে। বেনামে ওর একাউন্টে কেউ ইমেইল পাঠিয়েছে সঙ্গে কিছু ভিডিও আর ছবি। জাহান মিষ্টি করে হাসলো। যেই এই কাজটা করেছে লোকটা বড্ড চালাক। জাহান হ্যাক করে আইডির পুরো ডাটা কালেক্ট করতে পারে ভেবে তথ্য ছাড়া একাউন্ট অপেন করা। জাহান বেশ মজা পেলো। কথায় বলে শেয়ালে শেয়ালে কোলাকুলি। বিষয়টা বেশ জমবে। আগামীকাল ওর ফিরে যাওয়ার দিন। রাত আটটার সময় ফ্লাইট তার আগেই সবটা গুছিয়ে নিয়ে হবে। আরিয়ানের সঙ্গে কথা বলা জরুরী। বিষয়টা ভেবে ও কল দিলো। চতুর্থ বারের সময় ফোন রিসিভ হলো। জাহান সালাম দিয়ে বলল,
> আপনার সঙ্গে দেখা করা জরুরী। দেখা করতে পারবেন নাকি ভয় পাচ্ছেন? পুরুষ মানুষের এতোটা ভয় সাজেনা।
জাহান উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের মতো কথাগুলো বলে থামলো। ওপাশ থেকে চুপচাপ কোনো আওয়াজ আসছে না। মিনিট পেরিয়ে যাবার পর মেয়েলী কণ্ঠে উত্তর আসলো,
> কে বলছেন? উনিতো ঘুমাচ্ছেন। প্লিজ সকালে ফোন দিবেন। সারাদিন কাজকর্ম করে ক্লান্ত একটু বিশ্রাম নিবে তাও আপনাদের জন্য হচ্ছে না। কে বলুন তো আপনি? কাজ আমার সতীন হয়ে উঠেছে।
মেয়েটা এক নাগাড়ে বকবক করছে। জাহানের মাথাটা ঘুরে উঠলো। আরেকবার ফোন চেক করে দেখে নিলো নাম্বারটা ঠিক আছে কিনা। সব ঠিকঠিক তাহলে এই মেয়েটা কে? আরিয়ান আবারও বিয়ে করেছে? কিন্তু কিভাবে সম্ভব? সবটা কেমন এলোমেলো লাগছে। কেউ যেনো ওর গলা টিপে ধরেছে। আওয়াজ হচ্ছে না। রিপ্লাই করতে হবে ভেবে ঢোক গিলে বলল,
> আপনি কে?
ওপাশ থেকে ঝাঝালো কণ্ঠে আওয়াজ হলো,
> আমি কে মানে? আমি ফোনের মালিকের স্ত্রী। আজব মেয়েতো আপনি। বিবাহিত পুরুষ মানুষের কাছে রাতের বেলা ফোন করেছেন আবার বলছেন কে আমি। শুনুন আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না। দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম তারপর বিয়ে করেছি । যদিও বিয়েটা আমরা লুকিয়ে করেছি। আরিয়ানের ফুপিমা জানেনা। তাতে কি এবার সবাই জানবে। আমাদের বেবি আসছে। আমি মা হতে চলেছি বুঝেছেন?
> আপনি জানেন আমি কে? আমি আরিয়ান শাহরিয়ারের স্ত্রী। উম্মে দিলরুবা জাহান খান। আপনি যে মিথ্যা বলছেন না তার কি প্রমাণ আছে? হবু ব্যারিষ্টার আমি। চালাকি করে পার পাবেন না। ফোনটা চুরি করেছেন তাইনা?ব্যাপার না আমি খোঁজ ঠিক নিয়ে নিবো।
জাহান হুমকি দিলো। যদি সত্যিটা বের হয় কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। বরং ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ আসলো সঙ্গে উত্তর,
> ও আপনি? আরিয়ানের হয়ে সত্যি আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আসলে ফুপি মায়ের কথা শুনতে ও বাধ্য হয়েছিল। আপনি বড়লোকের মেয়ে। এসব বিয়ে ডিভোর্স কোনো ব্যাপার না। প্লিজ আপা আমাদের বাচ্চাটার কথা ভেবে হলেও উনাকে ছেড়ে দিন। আমাদের সংসারটাকে নষ্ট করবেন না। আপনি নিজে থেকেই বলুন আরিয়ান কখনও আপনাকে স্পর্শ করেছে? ও জেনে বুঝে আপনার জীবন নষ্ট করতে চাইনি। যথেষ্ট দুরুত্ব রেখেছে আপনার থেকে। তাছাড়া বারবার চেয়েছে যোগাযোগ না করতে কিন্তু আপনি তো শুনছেন না। ক্ষমা করুন প্লিজ। আমাদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ হয়ে আসবেন না। আমাদের নিজেদের মতো বাঁচতে দিন। আমার বাচ্চার কথাটা ভাবুন একবার।
মেয়েটা যেনো অতিরিক্ত কথা বলতে পছন্দ করে। জাহান থমকে গেলো। আরিয়ান ওকে ঠকিয়েছে কিভাবে পারলো এরকম করতে? নাকি কোনো রহস্য আছে? জাহান ভাবতে পারছে না। বুক কাঁপছে। যদি এমনটা হয় কিভাবে সহ্য করবে? ম*রেই যাবে। কতগুলো দিন এই লোকটার কথা ভেবে ওর পার হয়েছে। বিদেশের মাটিতে কতশত বন্ধু আছে। নিত্য দিন কত জন প্রপোজ করেছে শুধু একটা মানুষকে ভালোবেসে সবাইকে এড়িয়ে চলেছে। বুকের মধ্যে লুকানো পাহাড় সমান ভালোবাসার কিছুই যে প্রকাশ করা হলোনা। জাহান ফোনটা রেখে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। চোখের কোনা দিয়ে পানি গড়িয়ে ল্যাপটপের উপরে এসে পড়ছে। কি যন্ত্রণা নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে তোড়পাড় করছে। ভালোবাসলে এতোটা যন্ত্রণা পেতে হবে জানলে কখনও এই জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাপ দেবার মতো পাপ ও করতো না। জাহান ভেঙে পড়ার মানুষ না। তাড়াতাড়ি ফোন করলো উকিলের কাছে। নোটিশ আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চৌধুরী বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আজকের পর থেকে হয়তো ঘুমের পরি ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। গতকাল বিলুর স্বীকারউক্তি সঙ্গে অচেনা নাম্বার থেকে আসার ভিডিও সবটাই অকার্যকর হয়ে গেলো। হাসপাতালে থাকা ভদ্রলোক সুস্থ অবস্থায় নেই। সবচেয়ে বড় সাক্ষী উনি। জাহান ছয় আস উনাকে রিহাবে পাঠিয়ে দিলো। উপযুক্ত প্রমাণ রেডি আছে শুধু সময়ের অপেক্ষা।
*************
চৌধুরী বাড়িতে আজকাল শান্তি নামক বস্তুটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। লাবিব হাসপাতালে ভর্তি ফিরোজ নিজের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরছে। মিটিং মিছিল করে সময় থাকলে এই বাড়িতে আসে না থাকলে শশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। এই ছেলের লাজ লজ্জা খুব কম। জাবির চৌধুরী কমোলিনির দিকে চেয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন,
> ফিরোজকে বলে দাও এই বাড়িতে ওকে আর কষ্ট করে ফিরতে হবে না। বেহা*য়া লজ্জাহীন ছেলের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। সারাদিন কাজকর্ম ছেড়ে মিছিল মিটিং করে মাথা ফা*টিয়ে একাকার অবস্থা। মান সম্মান যা ছিল সব শেষ।
কমোলিনি মূদু কণ্ঠে উত্তর দিলো,
> চাচাজান ওই ছেলের সঙ্গে আমার কথা বলতেই ইচ্ছে করেনা। ককর্শ কণ্ঠ সঙ্গে গা জ্বালানো কথাবার্তা। আপনি বলুন যদি কাজ হয়।
জাবির চৌধুরী চুপ করলেন। ফিরোজের সঙ্গে কথা বলতে উনারও বিরক্ত লাগে। সম্মানতো দিবেই না বরং বরং নেবার জন্য মুখিয়ে থাকে। উনি কিছুটা দম নিয়ে বললেন,
> আরিয়ানকে ডাকো আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
> চাচাজান ওতো বাড়িতে নেই। রাইস মিলের কাজকর্ম নতুনভাবে চালু করতে হচ্ছে। অনেক ঝামেলা। ও ফিরলে আপনাকে বলবো।
> আচ্ছা যাও আমার জন্য কফি পাঠাও।
কমোলেনি মাথা নাড়িয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো। হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে ফুলিকে বলল,
> ফুলি আজ দুপুরে বিরানি রান্না হবে। রাতে দুই রকমের মাংস,চালের রুটি,পোলাও ইলিশ মাছ ভাজি আর রুই মাছের কালিয়া তৈরী করতে হবে। দুপুরের পর থেকেই রান্না শুরু করবি। রাতের খাবারে গড়মিল হচ্ছে।
ফুলি পানি চুলাই বসিয়ে দিয়ে বলল,
> খালাম্মা হঠাৎ আপনার পছন্দের খাবার রান্না হচ্ছে? আজকে কি আপনার জন্মবার? নাকি ওই যে কি বলে জানি কুলখানি নাকি বিয়ের দিন কি বলে ওইটা?
ফুলির কথা শুনে কমোলিনির মেজাজ বিগড়ে গেলো। কুলখানির মানে কি? ম*রে গেছে নাকি যে কুলখানি হবে? অশিক্ষিত কাজের বুয়া নিয়ে জীবন শেষ। উনি ধমক দিয়ে উত্তর দিলেন,
> তোর কাজ রান্না করা আপাতত সেটাই কর? একদম আজেবাজে কথাবার্তা বলে আমাকে বিরক্ত করবি না। যা এখান থেকে। ফাজি*ল মেয়ে।
ফুলি গাল ফুলিয়ে প্রস্থান করলো। ভাবলো ভুল কি বলেছি কে জানে। এই মহিলা হুদাই রাগারাগি করে। পড়ন্ত বিকেলে বাড়িতে ফিরলো আরিয়ান। ক্লান্ত শরীর। বুকের মধ্যে কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে উঠে বসলো। তাড়াতাড়ি করে ল্যাপটপ অন করতেই সামনে একটা অচেনা মুখ ভেসে উঠলো। লোকটার গায়ের রং ফর্সা।মধ্য বয়সি ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে ওর যেনো হুবহু না হলেও কিছুটা মিল আছে। আরিয়ান ভড়কে গেলো। নিচে ছোট্ট টেক্সট,
>সত্যিটা খুব তাড়াতাড়ি সামনে আসবে। নিজেকে প্রস্তর করুন। আমার থেকে দূরে থাকার জন্য এতো আয়োজন না করলেও পারতেন। আমি ফিরে যাচ্ছি। ছয় মাস সময় দিন আপনার কষ্টের দিন ইনশাআল্লাহ শেষ হবে।
জাহানের আইডি থেকে টেক্সট এসেছে। আরিয়ান রিপ্লাই করলো,
> আপনার জন্য শুভকামনা রইল। ভালো থাকবেন। পারলে এই অধমকে ভুলে যাবেন।
> নিশ্চয়ই। আমি কোনো বেইমা*নকে মনে রাখিনা। তবে দায়িত্ব পালনে আমি অবহেলা করবো না। যেটুকু প্রয়োজন ইনশাআল্লাহ করবো।ভালো থাকবেন। সব বোকামি আমি করেছি আপনি না। দায়বদ্ধতা আমার আপনি মুক্ত।
আরিয়ান কি বলবে কথা খুজেঁ পেলোনা। প্রতিটা লাইন বারবার করে পড়লো। রাগে দুঃখে হাতের ফোনটা আছাড় দিয়ে কপালের চুলগুলো টেনে ধরলো। এখন যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতো তবে শান্তি মিলতো। নিজের জীবনটা কিভাবে সুন্দর করে নিজ হাতে এলোমেলো করে ফেলল। শান্তির দেখা এজীবনে আর মিলবে না।
*****************
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে জাহান। ইব্রাহিম খান মেয়ের হাতটা ধরে অনুরোধ করলেন,
> আম্মা ওখানে গিয়ে কিন্তু মাথা গরম করলে চলবে না। বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। আমার কিন্তু চিন্তা হয়। ছয় মাস পরে আমি সাত দিনের সফরে যাব ততদিন নিজের খেয়াল রাখবে। আজিয়া আন্টির কথা শুনবে। রাজনীতির ভুত মাথা থেকে নামিয়ে ফেলো। আমার একটা মাত্র মেয়ে। তোমাকে আমি স্বাধীনতা দিয়েছি। যখন যা প্রয়োজন সবটা দিয়েছি। আব্বাজানের উপরে রাগ করতে পারবে না।
জাহান হুটকরে ইব্রাহিম খানকে জড়িয়ে ধরলো। চোখের পানি লুকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
> তোমার উপরে আমার রাগ আসে না তবে কিভাবে রাগ করবো আব্বাজান? আমি তোমার সব কথায় শুনবো প্রমিজ। তবে তুমিও কিন্তু আমার কথা শুনবে। আরিয়ান শাহরিয়ার কে আমার নাম্বার বা ঠিকানা কিছুতেই দিবা না। লোকটা আমাকে দুঃখ দিয়েছে আব্বা। আমি কিছুতেই ভুলবো না। আমার একরাশ ভালোবাসার সাদা শুভ্র কোমল পদতলে পৃষ্ট করেছে। আমি অপমানিত হয়েছিল। কতটা দুঃখ নিয়ে দেশ ছাড়ছি সে শুধু আমি আর আমার আল্লাহ জানেন। মানুষ এতো বোকা কিভাবে হয় আব্বা? লোকটা ভীতু আমার সঙ্গে যায়না। আমিতো ভেবেছিলাম লোকটা আমার জীবনে হিরো হয়ে এসেছে। সব মিথ্যা আব্বা। আমি সব ভুলে যেতে চাই। তুমি কাউকে বলোনা আমার কথা। আমার লজ্জা, আমার কষ্ট সবটা আমার থাক।
জাহান নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েছিল কিন্তু পারলোনা। ফুপিয়ে উঠলো। ইব্রাহিম খান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন। মনে মনে খেপে আছেন। আরিয়ানকে পেলে থা*প্পর লাগিয়ে উনি উচিৎ শিক্ষা দিবেন। মেয়েটার চোখের পানি উনি সহ্য করতে পারেন না। আজকের পর থেকে আরিয়ান শাহরিয়ারের ছায়া উনি মেয়ের উপরে পড়তে দিবেন না।
কয়েক মূহুর্ত এভাবেই পার হলো। আটটার সময় জাহানের ফ্লাইট। বাবার থেকে বিদায় নিয়ে এক বুক শূন্যতা নিয়ে পাড়ি দিলো নিজের গন্তব্যের দিকে।
চলবে