গাঙচিল,পর্ব_১১ (বোনাস পার্ট)
লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
—“চাচাজি!চট করে একটা কাজী ধরে নিয়ে আসুন তো!আজই বিয়ে করবো!এক্ষুণি বিয়ে করবো।”
রোদ্দুরের কথায় জলিল মোল্লা ঘন ঘন মাথা দোলালেন।এই প্রস্তাবটা তার পছন্দ হয়েছে।দারুণ পছন্দ হয়েছে।হঠাৎ করে তার নজর পড়লো রোদ্দুরের মায়ের উপর।ছাই রঙের একটা শাড়ি পরিহিত মধ্য বয়স্কা নারী!রোদ্দুরের চেহারার সাথে কিঞ্চিৎ মিল।সাথে মাঝবয়সী আরেকটা মহিলা।তার হাতে কিছু ব্যাগ ধরা।জলিল দেখেই বুঝতে পারলো এটা কাজের লোক হবে হয়তো।সে ব্যস্ত হয়ে বলল,
—“আপনারা ভেতরে আসেন।বসেন!রেখা!কোথায় গেলে?এদিকে এসো তো!”
রোদ্দুরের মা থামিয়ে বলল,
—“এত ব্যস্ত হবেন না।আমরা ঠিক আছি।ফুলবানু কোথায়?”
জলিল আমতা আমতা করে মাথা চুলকে রোদ্দুরকে বলল,
—“ফুলবানু কে আবার?”
রোদ্দুর হেসে ফেলল।মাকে নিয়ে শফিকের রুমে বসে পড়লো।তার দু হাত ভর্তি বিয়ের বাজার।নাজমার হাতেও কিছু কিছু!রোদ্দুর দুহাতের সব শফিকের বিছানায় নামিয়ে রেখে বলল,
—“চাচাজি,মা অজান্তাকে ফুলবানু বলে ডাকে।”
—“অহ! খুবই ভালো।আমি দেখি অহিকে ডেকে দিই।”
জলিল চলে যেতে নিতে রোদ্দুর থামিয়ে দিয়ে বলল,
—“চাচাজি!শফিক কোথায়?অনেক কাজ করতে হবে।সাক্ষী লাগবে।আমি অবশ্য একজনকে আসতে বলেছি।আরো অনেক কাজও তো আছে।”
—“শফিক তো টিউশনিতে।এসে পড়বে বাবাজীবন!তুমি টেনশন কইরো না।বিয়ে হবে!সব হবে!আমি এতদিন চুপ করে ছিলাম এটা ভেবে যে তুমি কবে গর্জে উঠবে।কবে তুমি বঙ্গবন্ধুর সুরে সুর মিলিয়ে বলবে,আমার যা আছে আমি তাই নিয়ে প্রস্তুত।”
জলিলের মুখোভঙ্গিতে রোদ্দুর আবারো হেসে ফেলল।আজ তার খুশির দিন।তার সর্বোচ্চ হাসির দিন।তার মা সুস্থ হয়ে গেছে।আজ তার বিয়ে!তার অতি প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষটির সাথে।আজ সে হাসবে,যেখানে হাসা সমীচীন নয় সেখানেও হেসে গড়াগড়ি খাবে।
জলিল হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল বাজার করতে।রান্না করতে হবে তো।আসার পথে কাজী সাহেবকে সাথে নিয়ে ফিরবে।সে চলে যেতে রোদ্দুর মায়ের হাত ধরে বলল,
—“মা গো!ফুলবানু তোমার মায়ের নাম না?”
রোদ্দুরের মা রাহেলা মাথা দুলে বলল,
—“হ্যাঁ!তুই তোর নানির নাম জানিস না রোদ্দুর?কি কান্ড ছেলের!”
—“মা জানি জানি!নাম তো জানি!এখন কথা হচ্ছে তুমি তোমার মায়ের নাম মুখে নিবে তাতে নানি কষ্ট পাবে না? তোমার বৌমাকে ফুলবানু বলে ডাকবে সর্বক্ষণ এতে কেমন যেন হয়ে যায় ব্যাপারটা!”
নাজমা তড়িঘড়ি করে বলল,
—“হেইডাই তো আফা।আপনে মা-জননীর নাম মুখে লইবেন ক্যান?পাপ হবে তো!”
—“তাই তো!তওবা তওবা!সবসময় এভাবে তো মায়ের নাম মুখে আনা যাবে না।পাপ হবে!বৌমার নাম কি করে রোদ্দুর?”
—“মা, ওর নাম অজান্তা অহি।ডাকনাম অহি।”
—কি সুন্দর নাম রে!এখন বল,আমার বেয়াইন সাহেবা কই?অহি কোথায়?নাজমা আমার সাথে আয় তো।”
রাহেলা উঠে গেল।সাথে নাজমা খালাও!রোদ্দুর ভেতর থেকেই দেখলো তার মা হবু শ্বাশুড়ির রুমে ঢুকেছে।ভেতরে ঢোকার সময় দেখেছে তার হবু শ্বাশুড়ি নামায পড়ছে।এতক্ষণে শেষ হয়তো।
রোদ্দুর শফিকের বিছানায় রাখা বিয়ের শাড়ির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সে তার মনের মানুষের সাথে সারাজীবন থাকার সুযোগ পাবে।এক ছাদের নিচে থাকবে তারা।একদম কাছাকাছি, পাশাপাশি!রোদ্দুরের লজ্জায় এখুনি মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
সে লুকিয়ে শফিকের রুম থেকে বের হলো।অহির রুমের দরজা ভেড়ানো শুধু।রুমের দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে।তারপর চট করে ভেতরে ঢুকে গেল।ভেতরে ঢুকে দরজা আগের মতো সাবধানে ভিড়িয়ে দিল।এখন আর ভয় নেই।কিছুক্ষণ বাদেই অহির নামের সাথে, অস্তিত্বের সাথে রোদ্দুর হিম জুড়ে যাবে।
অহি গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।মাথার একরাশ চুল এলোমেলো ভাবে বালিশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মুখটা অনেক শুকিয়ে গেছে।অহির জ্বরের খবর রোদ্দুরের কানে গেছে সেদিনই।অহির অসুস্থতার খবর শুনে সে ছটফট করছিল।না কাছে আসতে পারছিল,না কিছু করতে পারছিল!কি করবে কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।
রোদ্দুর আস্তে করে অহির বিছানার এক পাশে মাথার কাছে বসলো।কাঁথার নিচ দিয়ে বের হওয়া অহির হাতটা নিজের কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো।
অহি সজাগ।রোদ্দুরের স্পর্শ পেতেই ডান হাতে বিছানার চাদর চেপে ধরলো।সে কিছুতেই চোখ খুলবে না।রোদ্দুরকে বিয়েও করবে না।তাকে ঘুমিয়ে পড়ার অভিনয় করতে হবে।
রোদ্দুর কিছুক্ষণ মুখটা হালকা নিচু করে অহির মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।অহির গলা শুকিয়ে আসছে।রোদ্দুরের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তার মুখে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে।যে ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সুদূরে।সে কি চোখ খুলবে?এই ভীতু বজ্জাত আবার মুখ এত কাছে এনে কি করতে চাইছে!
রোদ্দুর সাপের মতো ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মুখ সরালো।অহির হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল,
—“অজান্তা,আমি এতক্ষণ গভীর পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম তুমি জেগে আছো!তোমার চোখ পিটপিট করছে।ঘুমিয়ে পড়ার ভান ধরছো কেন?”
—“আমি অসুস্থ এসআই।চলে যান।আর আসবেন না আমাদের বাড়ি।”
অহি বন্ধ চোখেই বলল।রোদ্দুর ইতস্তত করে এদিক ওদিক কাঁপড় খুঁজলো।বিছানার এক পাশে অহির ওড়নাটা হাতে পেঁচিয়ে অহির কপাল স্পর্শ করলো।তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—“জ্বর তো নেই অজান্তা!”
অহি অবাক হয়ে চোখ খুলল।বিরক্ত কন্ঠে বলল,
—“হাতে কাপড় পেঁচিয়ে আপনি এসেছেন জ্বর মাপতে?আপনার বুদ্ধি দেখছি হাঁটুর নিচে।”
রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,
—“ইয়ে মানে আসলে তোমাকে ছুঁয়ে দিলে কেমন যেন হয়ে যাই।হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।কেমন জানি ইলেকট্রিক শক লাগে।তোমার হাতের একটু স্পর্শ পেলেই উথাল পাথাল হয়ে যাই।কপাল টপাল স্পর্শ করলে নিশ্চিত স্ট্রোক করবো।”
অহির হাসি পেল।কিন্তু বাইরে মুখ গম্ভীর করে রইল।এরকম একটা পাগলাটে মানুষকে সে কিভাবে ইগনোর করবে?তাকে ছেড়ে নিজে কিভাবে থাকবে!
—“অজান্তা মা এসেছে!নাজমা খালাও এসেছে।”
অহির বুক ফেটে গেল।রোদ্দুরের মায়ের কন্ঠ সে শুনেছে।কিন্তু মানুষটার সাথে দেখা করার সাহস পাচ্ছে না।দেখা হলে কি বলবে?এটা যে সে তার ছেলেকে বিয়ে করবে না?উপর মহল থেকে তাকে নিষেধ করেছে?ভয় দেখিয়েছে তাকে?এসব!
কিছু মনে পড়ায় রোদ্দুর হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।অস্থির পায়ে হাঁটা চলা করলো রুমে কিছুক্ষণ।তারপর এক জায়গা দাঁড়িয়ে বলল,
—“অজান্তা, তোমাকে কষে একটা চড় মারি?”
অহি অবাক হয়ে তাকালো।মানুষটার চোখ মুখ কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে।মারার আগে কেউ পারমিশন নেয়?অহি আলগোছে বলল,
—“আমাকে চড় মারবেন কেন?মারতে চাইলে সেদিনের মতো নিজের গালে মারুন!”
রোদ্দুর বাঁকা হয়ে অহির দিকে সামান্য ঝুঁকে বলল,
—“আমার নামমাত্র বাবার ভয়ে, তার থ্রেট শুনে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছো না সেটা আমাকে আগে কেন জানালে না?তোমাকে ওই লঞ্চ ঘাটে কতবার জিজ্ঞেস করেছি?কতবার বলেছি যে কেউ তোমায় বিয়েতে বাঁধা সৃষ্টি করলে আমায় বলো!আমি সামলে নিবো।বলো নি কেন?সেই তো আমি জেনেই গেলাম!সেই তো তোমাকে আমার বউ হয়েই বাঁচতে হবে!”
অহি চরম অবাক হয়েছে।তার দু ঠোঁট আলাদা হয়ে কিঞ্চিৎ হা হয়ে আছে।রোদ্দুরের বাবার ব্যাপারটা সে সম্পুর্ণ চেপে গেছে।কাউকে জানায়নি।তাহলে রোদ্দুরের কানে গেল কি করে?
তাছাড়া রোদ্দুরের বাবা তো ভুল কিছু করেনি।এতবড় বিজনেসম্যানের ছেলে রোদ্দুর।গভমেন্ট জব করে,দেখতে অতিশয় সুদর্শন!পড়াশোনা জানা মানুষ।আর অহি?থার্ডক্লাস তো দূরে থাক!পুরোপুরি ক্লাসলেস দরিদ্র একটা মেয়ে।রোদ্দুরের বাবা বহুদিন আগে তাকে ডেকে বিষয়টা সুন্দর মতো বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে রোদ্দুরের সাথে খাপ খায় না।অহিও ব্যাপারটা গভীর চিন্তা করে বুঝেছে।তার মতো মেয়ের সাথে রোদ্দুর জীবন যুক্ত করলে রোদ্দুর তার থেকে শুধু কষ্ট পাবে।সেজন্য সে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোদ্দুরের জীবন থেকে সরে যাবে এবং সেটাই করেছে।
রোদ্দুরের অহির দিকে ঝুঁকে তার চারপাশে ফোন খুঁজা শুরু করলো।চিন্তিত কন্ঠে বলল,
—“তোমার ফোন কই অজান্তা?আমি চেক করবো তুমি কতদিন বাবার সাথে কথা বলেছ!আমার তিনটে নাম্বার ব্লকলিস্টে রেখে আমার বাবার সাথে কথা বলার শিক্ষা তোমায় আমি দিবো।”
সটান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—“ফোন কোথায়?”
অহি পিঠের নিচ থেকে বাটন ফোনটা বের করে রোদ্দুরের হাতে দিল।হঠাৎ করেই তার ভালো লাগতে শুরু করেছে।এরকম একটা পাগলাটে মানুষকে পাশে না পেলে সে দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে।সে মনে মনে বলল,
—“প্লিজ!জোর করে আমায় বিয়ে করে নিন না!বিয়ে করে আমায় আপনার বুকের খাঁচায় আগলে রাখুন!আপনার বাবাও যেন আমার হদিস না পায়।এতটা লুকিয়ে রাখুন!”
রোদ্দুর ফোনে তার বাবার নাম্বারটা খুঁজতে খুঁজতে বলল,
—“দুদিন আগে তোমার সাথে দেখা করে বাড়িতে গিয়ে দেখি বাবাও বাড়িতে।বাবা বাড়িতে বেশি আসে না।মাকে নিয়ে আসার পর একদমই আসতো না।সেদিন কেন জানি লুকিয়ে এসেছে।মাও জানে না!এসেই নিজের রুমে ঢুকেছে।আমি ড্রয়িং রুমে যাওয়ার সময় ওনার মুখে অহি নাম শুনে থমকে যাই।মনের ভেতর ক্ষীণ সন্দেহ হয়।দরজার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তোমার সাথে বাবার কথোপকথন শুনেই সব বুঝতে পারি।বিশ্বাস করো!সেদিন বাড়িতে কিয়ামত ঘটিয়ে দিতাম।শুধু মা ছিল বলে,বাবার সাথে কোনো তর্কে যাইনি।কোনো কথা বলিনি।না হলে ওনাকে বুঝিয়ে দিতাম,এই রোদ্দুর হিমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস উনি পায় কি করে!”
অহি নরম গলায় বললো,
—“উনি আপনার বাবা তো!”
—“চুপ!কিছুক্ষণের মধ্যে কাজি এসে যাবে।উঠে পড়ো।তোমাকে আজই নিজের কারাগারে তুলবো।যাতে আর ফন্দি আঁটতে না পারো।”
রোদ্দুর চুপ হয়ে গেল।বাবার নাম্বারটা ব্লকলিস্টে ফেলে ফোনটা বিছানার অপর পাশে ছুঁড়ে মারলো।অহি অবাক হয়ে বলল,
—“ফোন ছোঁড়াছুড়ি করছেন কেন?যদি ভেঙে যায়?”
রোদ্দুর উত্তর দিল না।কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ফট করে অহির কাঁথার নিচে ঢুকে গেল।অহি চমকে সরে যেতে রোদ্দুর তার হাত চেপে ধরলো।দুজন পাশাপাশি হাত ধরে শুয়ে আছে।অহির লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।রোদ্দুর বড় বড় করে ছাদের টিন দেখছে।অহি নরম গলায় বললো,
—“আপনার হাত কাঁপছে এসআই।আমার হাত ছাড়ুন!”
—“কাঁপছে কাঁপুক।শুধু হাত কেন,সমস্ত পৃথিবী নিয়ে কাঁপবো।তোমার সমস্যা আছে?”
—“নাহ নেই!হাতটা ছাড়ুন!আপনি আমার হাতসহ কাঁপছেন।”
—“ছাড়বো না মানে ছাড়বো না।কি করবে?করো!”
অহি ভড়কে গেল।সত্যি তো!হাত না ছাড়লে কি করবে সে?কিছু করার আছে?অবশ্যই আছে।অনেক কিছু করার আছে।অহি সামান্য সরে রোদ্দুরের গা ঘেঁষে আসলো।দশ সেকেন্ডের মাথায় রোদ্দুর এক লাফে চৌকি থেকে ফ্লোরে ছিটকে বসে পড়লো।হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
—“ও মাই গড!অজান্তা,তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমানো জাস্ট ইম্পসিবল।আমি পারবো না।পারবো না!”
বারান্দা থেকে কারো কন্ঠ ভেসে আসলো।অতিরঞ্জিত হয়ে বলছে,
—“স্যার!আমি এসে গেছি।”
অহি মিটিমিটি হাসছে।রোদ্দুর এক পলক তার দিকে চেয়ে বলল,
—“বিদ্যুৎ এসেছে।বিয়ের সাক্ষী এসে গেছে।আমি বরং যাই!”
১৮.
অসুস্থ শরীর নিয়ে অহি বউ সেজে বসে আছে নিজের রুমে।সে একটু পর পর তার পরণের শাড়ির দিকে তাকাচ্ছে।নিজের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে।কতগুলো বছর পর আজ তার মা নিজ হাতে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে।পুরোটা সময় অহি ঘোরের মধ্যে ছিল যেন।
কিছুক্ষণ পর বয়স্ক কাজি তিনজন সাক্ষী সমেত এসে তাকে যখন কবুল বলতে বললো সে অসহায় মুখে মায়ের দিকে তাকালো।মায়ের আঁচল ছেড়ে সে অন্য কারো বউ হয়ে যাবে আজ।তবুও কি তার মা আজ আশীর্বাদ করবে না তাকে?তাকে ক্ষমা করবে না?টেনে বুকে নেবে না?
কাজি সাহেব তাড়া দিতেই রেখা এসে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তার গলা ধরে এসেছে।কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে।এক মেয়েকে ভেবে আরেক মেয়েকে এতটা অবহেলা সে কি করে করতে পারলো?অহির দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়ছে।মাকে জড়িয়ে ধরার তার সাহস নেই।সে কাঁদতে কাঁদতে জগতের সবচেয়ে ভারী ‘কবুল’ শব্দটি তিনবার বলে দিল।
তার পরবর্তী জীবন সুখের হবে।মায়ের আশীর্বাদের হাত মাথায় পড়েছে যে।সে হাত বাড়িয়ে তার নতুন মায়ের হাত চেপে ধরলো।আরেক হাতে তার মাথার উপর রাখা মায়ের হাত চেপে ধরলো।
১৯.
রোদ্দুরের পরণে মেরুন রঙের পাজামা পাঞ্জাবি।সে একগোছা চাবি থেকে একটা একটা করে তালা খোলার চেষ্টা করছে।হয়তো তালার চাবি কোনটা সেটা ভুলে গেছে।তার হাত কাঁপছে।প্রতিটা চাবি সে অধীর আগ্রহে, এক বুক আশা নিয়ে তালার ভেতর দিচ্ছে যে এটাতেই হয়তো খুলে যাবে।কিন্তু খুলছে না।
অহি পাশে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক পাশে নয়,কিছুটা পেছনে।তারা দুজন আপাতত গুলিস্তান আছে।রোদ্দুর এখানে নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে দুদিন হলো।তার একটাই কথা!অহিকে সে বাবার বাড়ি উঠাবে না।বিয়ে করে কোথায় রাখবে সেটা নিয়ে টেনশনে ছিল।পরে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দুদিনে মোটামুটি প্রয়োজনীয় সব ফার্নিচার কিনে ফেলেছে।এখন থেকে সে নাকি আর বাবার বাড়ি যাবে না।মাকে আর অহিকে নিয়ে এ ফ্ল্যাটে থাকবে।
অহির শাশুড়ি মা আসেনি।রাতের বেলা সে গাড়িতে চড়বে না।তাছাড়া ইতোমধ্যে রেখার সাথে, শফিকের সাথে তার বেশ ভাব জমে গেছে।সে কিছুদিন তাদের বাড়িতেই থাকবে।সাথে নাজমা খালা থাকবে।
সিঁড়ি ভেঙ্গে তিল তলা উঠেছে অহি।অসুস্থ শরীর নিয়ে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।রোদ্দুর এখনো তালা খুলতে পারেনি।সে একটানে রোদ্দুরের হাত থেকে চাবিটা নিয়ে সে নিজে তালা খোলার চেষ্টা করলো।তৃতীয় চাবির ছোঁড়াটা ঢুকাতে তালা খুলে গেল।সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
সুন্দর, ছিমছাম বাসা।অহির চোখ ভরে উঠার উপক্রম।এত সুন্দর একটা বাসায় সে আজ থেকে থাকবে?কেমন বিশ্বাস হতে চায় না।
অসুস্থ শরীর নিয়ে অহি ঘুরে ঘুরে দেখলো।দুটো বেড রুম।দুই রুমের মাঝখানে ড্রয়িং রুম।ড্রয়িং রুমের সাথে দক্ষিণ দিকে রান্নাঘর।রান্নাঘরের সাথে ছোট্ট আরেকটা গেস্ট রুম।অহি ক্লান্ত শরীরে ড্রয়িং রুমে রাখা সোফায় বসে বলল,
—“আমি কোন রুমে থাকবো?শুয়ে পড়তে হবে আমার।অসুস্থ লাগছে!”
রোদ্দুর রান্নাঘরে পানি খেতে নিয়েছিল।সবেমাত্র গ্লাসটা উঁচু করেছে। অহির কন্ঠ কানে যেতে ঠাস করে হাত থেকে গ্লাস পড়ে গেল।মুহূর্তে ভেঙ্গে খানখান।রোদ্দুর বুকে হাত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
—“ও মাই গড!অজান্তার সাথে এক বাসায় থাকবো কি করে?নাহ!আমি আজ মরে গেলেও রান্নাঘর থেকে বের হবো না।অজান্তার মুখোমুখি হবো না!মা গো!তোমার ছেলেকে উদ্ধার করো মা গো!”
(চলবে)