গল্পের নাম: হ-য-ব-র-ল,পর্ব_০১
লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
১.
চলন্ত ট্রেনে লিরার লেবার পেইন উঠলো।অথচ তার বাচ্চা প্রসবের ডেইটের এখনো সতেরো দিন বাকি।সে ব্যথায় কুঁকড়ে রোদ্দুর হিমের হাঁটু চেপে বলল,
‘হিম!যতদ্রুত সম্ভব ডাক্তার নিয়ে আসো।আমি মরে যাচ্ছি!’
লিরার এক হাত তার শ্বাশুড়ি মা ধরে আছে।খসে পড়া আরেক হাত তার শ্বশুর মশাই ধরলো।রোদ্দুর তাদের ফ্রন্ট সিটে বসে ছিল।সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো।চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘চলন্ত ট্রেনে ডক্টর পাব কোথায় ভাবী?আবার গাইনী বিশেষজ্ঞ লাগবে।তুমি তো বিপদে ফেলে দিলে ভাবী।শুধু বিপদ না!যাকে বলে মহাবিপদ!মহাসাগর,মহাবিশ্ব, মহাসচিব যেমন, তেমনি মহাবিপদ!’
রোদ্দুরের একমাত্র জননী হাজেরা বেগম মুখ থমথমে করে বললেন,
‘অযথা ক্যাঁচাল পারবি না হিম।ডাক্তার ধরে নিয়ে আয় তো!’
‘কত করে বললাম, আমাকে প্রাইভেট মেডিকেলে ডাক্তারি পড়াও।শুনলে না তো?এখন এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে দেখিয়ে দিতাম রোদ্দুর হিমের খেল!’
রোদ্দুরের বাবা উসমান আলী অনবরত দোয়া দরুদ পড়ে লিরার মাথায় ফু দিচ্ছেন।কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না।লিরার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে।উসমান আলী তৃতীয় বারের মতো লিরার মাথায় আল্লাহর কালাম পড়া ফু দিয়ে সামান্য থুথু ছিটালেন।তারপর রোদ্দুরের দিকে ভয়ানক চোখ করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘বেকু্ব!আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ!তোর মুখ দেখতে চাই না।’
‘তোমাদের এই মহাবিপদে রেখে আমি কোথায় যাব বাবা?আমার যে মহাহৃদয়!তুমি বরং আমার মুখ দেখতে না চাইলে আমার মুখের দিকে তাকিও না।সিম্পল!’
উসমান আলী বাজখাঁই গলায় বললেন,
‘আর দুই মিনিট যদি সামনে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকিস,তাহলে তোকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিব!ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে না পারলে আমি বাকি জীবনটা ছাগলের মতো ম্যাঁ ম্যাঁ করে কাটানোর শপথ করলাম!আমি হলাম ওয়ান ওয়ার্ড ম্যান!”
অবস্থা বেগতিক দেখে হাজেরা বেগমের কপাল কুঁচকে গেল।তিনি কঠোর গলায় বললেন,
‘হিম!তুই এক্ষুণি কেবিনের বাইরে যা।সারা ট্রেনে খোঁজ নে। দেখ,কোনো ডাক্তার পাস কি না!’
লিরা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে বার বার।অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা বলছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে।রোদ্দুর দুঃখীত মনে তিনবার বলল,
‘আহারে!আহারে!আহারে!’
তারপর সান্ত্বনার সুরে বলল,
‘সন্তান জন্ম দেয়া কি কষ্টকর কাজ ভাবী!ভাগ্যিস মেয়ে হয়ে জন্ম হয়নি।তুমি টেনশন করো না।আমি ফু দিয়ে ডাক্তার সাথে নিয়ে আসছি।একটু কষ্ট করো আমার লক্ষী ভাবী!’
সে ঝড়ের বেগে কেবিনের বাইরে এলো।বাইরে থেকে কেবিনের দরজা টেনে দিল।পাশাপাশি টু সিটার প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং বার্থ টিকেট সংগ্রহ করা ছিল।কথা ছিল একটাতে হাজেরা বেগম আর লিরা যাবে।আরেক টাতে রোদ্দুর আর উসমান আলী যাবে।কিন্তু ট্রেন মাঝপথে আসার পর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে লিরার লেবার পেইন উঠে গেছে।
রোদ্দুর পাশের কেবিনটাতে ঢুকল।ফোনটা পকেট থেকে বের করে তার বড় ভাইকে ফোন করতে নিয়ে শেষমুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টাল।এ অবস্থায় ভাই তো কিছু করতে পারবে না।একটা জিনিস বাদে।সেটা হলো টেনশন!সে ফোনটা ব্যাগের চিপায় রেখে কেবিন থেকে বের হলো।চলন্ত ট্রেনে প্রচুর ফোন চুরি হয়।আগে থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো।
ট্রেনের এক হাত করিডোর ধরে উঠানামার দরজার কাছে এলো রোদ্দুর।এসি করা বগি হওয়ায় বেশি মানুষ নেই।বন্ধ দরজার কাছে চারজন পুরুষ আর দুইজন বয়স্কা মহিলা উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে ।রোদ্দুরকে দেখে তারা একটু ঘাবড়ে গেল।তাদের ভয়মিশ্রিত চোখের দিকে চেয়ে রোদ্দুর প্রশ্রয়ের হাসি হাসল।কিন্তু কারো মুখোভঙ্গির কোনোরূপ বিক্রিয়া ঘটলো না।ফলে পরিবর্তন সাধিতও হলো না।
এদের ভাব ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে কেউ পেশাদার ডাক্তার নয়।তবুও রোদ্দুর একবার জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার আছে?আমার কাছের একজনের লেবার পেইন উঠেছে।’
লোকগুলো উত্তর দিল না।তবে ক্রমেই তাদের চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠছে।হয়তো এরা লেবার পেইন কি সেটাই জানে না!
রোদ্দুর আর সময় ব্যয় করলো না।সামনে এগিয়ে গিয়ে পরবর্তী বগিতে জিগ্যেস করল।কিন্তু কোনো ডাক্তার খুঁজে পেল না।তার পরের বগিতে ভীড়ের জন্য ঢুকতে পারলো না।সে উল্টো ঘুরে তাদের বগিতে এলো।এনাউন্সমেন্ট রুমটা খুঁজে বের করতে হবে।সেখানে মাইক্রোস্পিকারে ঝরঝরে কন্ঠে বলতে হবে,
‘সম্মানিত যাত্রীবিন্দু!খুবই দুঃখের সহিত জানানো যাচ্ছে যে আমাদের এই চলমান ট্রেনে একটা নারীর লেবার পেইন উঠেছে।তিনি প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছেন।কোনো ডাক্তার যদি থেকে থাকেন তাহলে অতিসত্বর এসি বগির ১৩ নাম্বার কেবিনে যোগাযোগ করুন।জানেনই তো!জান বাঁচানো ফরয।তাই দ্রুত যোগাযোগ করুন।’
এ ছাড়া আর উপায় নেই!কিন্তু সাদা পোশাকের কোনো এটেনডেন্ট চোখে পড়ছে না।তারা সাহায্য করতে পারতো।রোদ্দুর চিন্তিত মুখে কেবিনের দিকে এগোল।দরজা টেনে খোলার আগেই লিরা ভাবীর চিৎকার ভেসে এলো।হাজেরা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলছেন,
‘বউ মা!আর একটু সহ্য করো।আর দুইটা স্টেশন পর ট্রেন থামবে।তখন ব্যবস্থা নিব।’
তার বাবা উসমান আলী থমথমে গলায় বললেন,
‘হাজু এক কাজ করি।ইমার্জেন্সি চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দেই!কি বলো?’
রোদ্দুরের বাবা তার মাকে আদর করে হাজু বলে ডাকে।হাজেরা থেকে হাজু।ক্লাস সেভেনে থাকতে সে একবার মাকে হাজু বলেছিল, তার মা তেরো ঘন্টা ভাত দেইনি।কত বৈষম্য!মেনে নেয়া যায়?আলবাত মেনে নেয়া যায় না।কিন্তু সে ভালো ছেলে বলে মেনে নিয়েছে!
বাবার চেইন টেনে ট্রেন থামানোর আইডিয়াটা রোদ্দুরের পছন্দ হয়েছে।পুরো হুলস্থুল একটা কান্ড হবে।সবাই জানবে নবজাতক একজন পৃথিবীতে আসছে।নবজাতকটির সারাজীবন বলে বেরানোর মতো চমৎকার একটি গল্প হবে।বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনীদের পাশে বসিয়ে বলবে,”জানিস আমার জন্মের সময় কি হয়েছিল?ট্রেনের মধ্যে মাঝ জঙ্গলে মায়ের ব্যথা শুরু হলো।কোথাও ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছিল না।আমার কাকু কি করলো জানিস?ইমার্জেন্সি চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দিল।বুঝলি কাকু খুব সাহসী ছিলেন।কাকুর মতো মানুষ এক পিসই হয়।কাকু তো………”
সে কেবিনে ঢোকার আগে তার মা চেঁচিয়ে বাবাকে বললেন,
‘তোমার যতসব গাঁজাখুরি কথা।চেইন টেনে এই মাঝ জঙ্গলের ভেতর ট্রেন থামিয়ে কোন মহান কাজ করবে শুনি?তার চেয়ে এখানে বসে না থেকে ট্রেনে খোঁজ করো কোনো ডাক্তার পাও কি না!’
মায়ের কথা বাবা কখনো অগ্রাহ্য করে না।তার মানে বাবা এখন কেবিন থেকে বের হবে।তার আগেই রোদ্দুরকে সরে পড়তে হবে।
সে দ্রুত করিডোর ধরে সামনে এগোল।বুফে কারের দিকে গিয়ে দেখা যাক কাউকে পাওয়া যায় কি না।তাছাড়া তার টেনশনে প্রচন্ড চা পিপাসা পেয়েছে।পরপর তিন কাপ চা না খেলে মাথার জ্যাম ছাড়বে না!
‘হোয়াট ননসেন্স!’
মেয়েলি একটা রাগী কন্ঠ রোদ্দুরের কানে এসে বাজলো।সামনে তাকাতে তার চোখ ছানাবড়া।তার সামনে সাক্ষাৎ ডানা কাটা পরী দাঁড়িয়ে আছে।রাগী পরী।যার বিরক্তিতে কপালে দুটো ভাঁজের সৃষ্টি হয়েছে।সেই ভাঁজ দুটো যেন সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।পরীটা চোখ তুলে তাকাল।
সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুরের ভেতর স্লথ গতিতে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল।তার বুক ধড়ফড় করছে।গলা শুকিয়ে আসছে।শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে।হাত পা অসাড় হয়ে আসছে।হার্টের প্রতিটি বিটে যেন তুমুল বেগে শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে।সে বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
‘ও মাই গড!’
ততক্ষণে মেয়েটা জামা ঝেরে বিরক্তি ঝরা কন্ঠে বলে উঠলো,
‘পেছন থেকে পুলিশ ধাওয়া করেছে?চোরের মতো দৌঁড়াচ্ছেন কেন?টেন মিনিটস দাঁড়িয়ে থেকে চা কিনলাম আর আপনি?টু সেকেন্ডসে সেটা ঢেলে দিলেন?’
রোদ্দুরের টনক নড়লো।তার সামনের পরীটার বিরক্তির কারণ বুঝতে পারলো।অসাবধানতাবশত মেয়েটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে।যার কারণে তার হাতের ওয়ান টাইম চায়ের গ্লাস ছলকে সব চা ঢেলে গেছে।মেয়েটাকে রোদ্দুরের মনে ধরেছে।শুধু ধরেনি,সুপার গ্লুর মতো আটকে গেছে।
রোদ্দুর কন্ঠে মধু ঢেলে বলল,
‘মন প্রাণ ঢেলে স্যরি বলছি।আমি এক্ষুণি আপনাকে বিশ কাপ চা দিচ্ছি!’
‘লাগবে না।এই চোখ দুটো দেখে চলার জন্য দিয়েছে।নেক্সট টাইম থেকে তার যথাযথ ব্যবহার করবেন।’
রোদ্দুর মন্ত্র মুগ্ধের মতো মেয়েটার দিকে চেয়ে আছে।কন্ঠে ভালোবাসা নিবেদন করে বলল,
‘আমি তো তাই করছি।চোখের যথাযথ ব্যবহার করছি।’
মেয়েটার চোখের দৃষ্টি শকুনের মতো তীক্ষ্ণ হলো।এক পলক রোদ্দুরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে বিড়বিড় করে বলল,
‘সাইকো!’
মেয়েটা চলে যেতে উদ্যত হতেই রোদ্দুরের মনে পড়লো মেয়েটার নাম তো জানা হলো না?ম্যারিড কি না সেটাও জানতে হবে।সরাসরি জিগ্যেস করবে?নিশ্চিত বলবে না।সে হঠাৎ এক গাল হেসে বলল,
‘আরে ম্যাডাম আপনি!আপনাকে স্যার ডাকছে?’
রোদ্দুর স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটার ভ্রু যুগল কুঁচকে যাচ্ছে।সে কুঁচকানো চোখে মুখে বলল,
‘কোন স্যার?’
‘হে হে হে!আপনার হাজব্যান্ড!ওদিকে দাঁড়িয়ে দেখলাম।আমাকে বললো আপনাকে ডেকে দিতে।তাড়াহুড়ো করে আসতে ধাক্কা লেগে গেল।স্যরি ফর দ্যাট!’
‘আপনি আমার এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করছেন সেটা বেশ বুঝতে পারছি।তার জন্য এত মিথ্যে বলতে হবে?ফর ইউর কাউন্ড ইনফরমেশন, আমি আনম্যারিড!গুড বায়!’
মেয়েটা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই রোদ্দুর ঝটপট বলল,
‘কিন্তু আমি তো মিথ্যে বলছি না ম্যাডাম।আ’ম ড্যাম সিউর!একটা টাক মাথার মোটাসোটা লোক আপনাকেই ডাকছে।আপনার নাম বন্যা না?আপনার হাজব্যান্ড আদর করে ব্যাঙ বলে ডাকে।পানিতে যার বসবাস।’
‘বন্যা আমাদের বাসার কাজের মেয়েটির নাম।১৯৮৮ সালের বন্যায় তার জন্ম বলে বন্যা নাম রেখেছে তার মা!আমার বাবা শর্ট ফর্মে তাকে বন বলে ডাকে।আমি অহি!অজান্তা অহি!আই উইশ,আমাদের আর দেখা না হোক!’
রোদ্দুরকে পরম হেলাফেলা করে পাশ কাটিয়ে অহি নামক মেয়েটা এগিয়ে গেল।রোদ্দুর এক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রয়েছে।সে মুচকি হেসে মনে মনে বলল,
‘অজান্তা,আমার বোকা পরী!শুধু আই কেন?চোখ, নাক, কান, যকৃত,ফুসফুস, হার্ট সব উইশ করবে যে আমাদের আবার দেখা হবে।’
অহি রোবটের মতো মেপে মেপে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।কিছুদূর এগিয়ে যেতে রোদ্দুরের মস্তিষ্ক খোলাসা হলো।অহি নামক মেয়েটারর গায়ে তো সাদা এপ্রোন।তার মানে নিশ্চিত ডাক্তার।ধুর!ভাবীর কথা বেমালুম ভুলে গেছে।
সে এক দৌঁড়ে অহির কাছে গিয়ে সাদা এপ্রোনের নিচের অংশ টেনে ধরলো।হড়বড় করে বলল,
‘ডক্টর!মিস অজান্তা অহি!আমার লেবার পেইন উঠেছে।প্লিজ, বাঁচান ডক্টর!’
(চলবে……)