#কুয়াশার_মতো
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
বিষয়টা তুমিও খেয়াল রাখতে পারতে। তাছাড়া এখানে তেমন কিছুই হয়নি। ”
” আচ্ছা দুঃখিত। ”
সোহাগ নিজের মতো রান্না করতে লাগলো, মুখ দেখে মনে হচ্ছে রান্না করতে এসে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে। অতিভক্তি চো’রের লক্ষণ! সোহাগের ব্যবহার স্বাভাবিক নয়, যেন দু’দিকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। সোহিনী আসা পর্যন্ত দু’জনের ভিতর তেমন কথা হলো না। নিজে থেকে বাড়তি কিছু বলতে যাইনি৷ সোহিনী আসতে আসতে বেলা তিনটে, সবে গোসল সেরে ফ্যানের নিচে বসেছি। কোমর সমান চুল শুকাতে বেশ সময় লাগে। সোহাগ দরজা খুলে দিয়েছে, সোহিনী দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে গলায় বললো, ” কি খবর রূপবতী? কেমন আছো?”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো? ”
” আছি ভালোই, তবে ক্ষুধা লেগেছে। হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। ”
সোহিনী আমার পাশে বসে নিজের মতো খাবার খাচ্ছে। কয়েক মিনিট পর পর রান্নার প্রশংসায় দুই-চারটে শব্দ বলছে। সোহাগ আমাদের মুখোমুখি বসে নিজের মতো খাবার খাচ্ছে।
” সোহিনী মা-বাবা কেমন আছে? জানিয়ে এসেছিস?”
” আছে ভালোই। হ্যাঁ বলে এসেছি। দাদি শুনে বললো ওই বাসায় কেন যাবি!”
” তুই কি বলেছিস?”
” বলেছি ভাবীর হাতের চিংড়ি মাছ রান্না খেতে যাব। ”
” তারপর?”
” উফফ! ভাইয়া একটু শান্তিতে খেতে দাও। পরে তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। ”
সোহাগ কপাল কুঁচকে সোহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সোহিনীর অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই।
।
দুপুরের খাওয়া শেষে ননদ-ভাবী গল্প করতে বসেছি। সোহাগ বাইরে কোথাও গেছে।
” এই যে রূপবতী কন্যা, কতদিন পর এলাম কিন্তু তুমি তো কথাই বলছো না।”
” একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। ”
” তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে চিন্তায় আছো, কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?”
” আসলে..”
” কি?”
” আসলে তোমাকে বিয়ে দিতে হবে, ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। ”
সোহিনী জোরে জোরে হাসতে লাগলো। আপাতত কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে না, সবুরে মেওয়াও ফলে।
” ননদী তুমি একটু বসো, আমি একটা কাজ সেরে আসছি। ”
” তাড়াতাড়ি আসবে, ততক্ষণে তোমার গল্পের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। ”
মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, ছাঁদে যাব। সোহাগ কোথায় জানতে হবে। এক পা দুপা করে ছাঁদের দিকে এগোতে লাগলাম। একটাই প্রার্থনা আমার চিন্তা যেন ভুল হয়।
ছাঁদের দরজা খুলে দেখলাম সোহাগ চৈতীর সাথে গল্প করছে।
মুচকি হেসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে, এখন থেকে কোন দ্বিধা দন্দ রইলো না। ওঁদের ভিতর কোন না কোন সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে।
।
।
সকাল আটটা। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। সোহিনী মেয়েটা বড্ড অস্থির প্রকৃতির, কাল রাতেই বাড়ি ফিরে গেছে। বালিশের পাশে হাত দিয়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলাম, রাতে তো এখানেই রেখেছিলাম। বিছানা ছেড়ে উঠবো এমন সময় সোহাগ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
” স’র্ব’না’শ হয়ে গেছে পিয়াসী। ”
” কি হয়েছে? ”
” চৈতীকে কেউ বাজেভাবে খু’ন করেছে। সারা ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে। ”
” চৈতী মা”রা গেছে এতে তোমার স’র্ব’না’শ হবে কেন? প্রেমিকাকে হারিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছো বুঝি?’
‘ এসব কি বলছো? চৈতী আমার প্রেমিকা হতে যাবে কেন?’
‘ কারণে অকারণে এতো গল্প করো তাই ভাবলাম। যাইহোক ফ্রেশ হতে হবে। তুমি কিছুক্ষণ হাহুতাশ করে নাও। শত হলেও তোমার জীবনে একজন বিশেষ ব্যক্তি ছিলো ।”
সোহাগ হতভম্ব হয়ে আমাী দিকে তাকিয়ে রইলো, ওর দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। গতকাল সন্ধ্যের দিকে সোহাগ বাড়ি ছিল না, সোহিনীকে এগিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ডে গেছে। মেয়েটার কখন কেমন ইচ্ছে হয় বোঝা মুশকিল, সারা বিকেল থাকবো থাকবো বলে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার বায়না। একা একা টিভি দেখছি, কিছু ভালো লাগছে না। দরজার কড়া নড়ছে, মনে হয় কেউ এসেছে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুলে দেখলাম চৈতী দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মাঝামাঝি সাইজের গামলা।
” কিছু বলবেন?”
” না, তেমন কিছু না। শুনলাম আপনার নন এসেছে তাই উনাকে দেখতে এলাম। ”
” আচ্ছা ভেতরে আসেন। ননদ এসেছিল কিন্তু কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। ”
” ওহ্! তাহলে আর কি হলো। উনার জন্য চিংড়ি মাছ রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম। আপনারাই রেখে দেন। ”
” আমাদের নিয়ে আপনার এতো চিন্তা? বাবা গো বাবা! ”
” এভাবে কথা বলছেন কেন?”
” বরের প্রেমিকার সাথে কিভাবে কথা বলবো আপনি শিখিয়ে দেন তাহলে। ”
” পিয়াসী তুমি ভুল বুচ্ছো, আমাদের ভিতর কোন সম্পর্ক নেই। ”
“আমি চোখ থাকতেও অন্ধ ব্যক্তি নই, যে আপনি যা বলবেন বিশ্বাস করে নিবো। ”
” বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার, সত্যিটা বললাম। ”
” কি সত্যি? ”
“সোহাগের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে নেই, আমাদের ভিতর শুধুমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ”
” আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না। ”
” আপাত দৃষ্টিতে দেখা সবকিছু সত্যি হয় না। ”
” আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ”
চৈতী কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওঁদের কাউকেই বিশ্বাস করতে চাই না। তবে চৈতীর মৃ”ত্যু কাম্য ছিল না। ফ্রেশ হয়ে খু’নের জায়গায় চলে গেলাম। লোকের ভিড়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। সকলে চৈতীর লা’শ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিষণ বাজেভাবে মেয়েটাকে খু’ন করা হয়েছে, হাত-পায়ে নখের দাগ স্পষ্ট। মৃ’ত্যুর আগে খুনির সাথে ঘস্তাঘস্তি হয়েছিল বোধ-হয়। পুলিশ আসতে ঢের দেরি, চারদিকে নানান আলোচনা সমালোচনা চলছে। লোকের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ঘরে চলে এলাম। সোহাগ আমার পিছন পিছন এলো।
” পিয়াসী কি হয়েছে তোমার? ”
” সবকিছু কেমন খাপছাড়া লাগছে!”
” আচ্ছা, একটু শান্ত হয়ে বসো। র”ক্ত দেখতে না পারলে ওখানে যাওয়ার কি দরকার ছিল?”
” জানি না। ”
ছোটবেলা থেকে র’ক্ত দেখতে পারি না। হাঁস-মুরগি জ’বা’ই করতে গেলেও কেমন অদ্ভুত লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে, হাত-পা কাঁপতে থাকে। ভিষণ বাজে একটা রোগ। এই রোগের কারণে বাবা ডাক্তারি পড়াতে সাহস করেনি। আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে পড়ার খরচ দিতে পারলেও আমার পক্ষে মেডিকেল পড়া সম্ভব ছিল না।
সোহাগ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। শান্ত ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ” তুমি একটু বিশ্রাম করো। ”
” তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না বলো?”
” আরে পা’গ’লী, কেউ মা’রা গেলে খারাপ লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস করো চৈতীর সাথে আমার কোনপ্রকার বাজে সম্পর্ক ছিল না। চৈতীর স্বামী আমার ছোট বেলার বন্ধু। ”
” আগে তো কখনো শুনিনি। ”
” আমি নিজেও জানতাম না, কয়েকদিন আগে শুনেছি। ”
” ওহ্!”
সকাল দশটা। রাস্তা পর্যন্ত মানুষের ভিড় লেগে আছে। পু’লি’শ এসেছে লা’শ নিয়ে যাওয়ার জন্য। চৈতীর বাড়ির লোকদের খবর দেওয়া হয়েছে, বাড়ি দূরে বিধায় উনারা এখনও পৌঁছায়নি। সোহাগ চৈতীর স্বামীকে সবকিছু জানিয়েছে। উনিও নাকি দেশে ফিরছেন।
” সোহাগ ভাই দারোগা সাহেব কথা বলবেন, বিল্ডিংয়ের সবাইকে ডাকছে। ”
গেটের দারোয়ান হারুন ভাই এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। ওসি সাহেব সবাইকে জিজ্ঞেসাবাদ করছে, চৈতীর বাড়ির লোকদের খুঁজছে।
” আপনিই মিস্টার সোহাগ? ”
” হ্যাঁ, আমি। ”
” আপনার সাথে উনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
” বন্ধুত্বপূর্ণ, চৈতীর স্বামী আমার ছোটবেলার বন্ধু। ”
” শুনলাম আপনারা পরকীয়ায় জড়িয়ে ছিলেন। কথাটা কি সত্যি? ”
” না সত্যি না। ”
” কিছু মনে করবেন না সোহাগ সাহেব, তদন্তের খাতিরে অনেকেই এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করতে হয়। তাছাড়া সকলের মতো উনার সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝেমধ্যে আপনাদের একসাথে দেখা যেত। ”
” সমস্যা নেই, আপনি তদন্ত করতে পারেন। আমি নির্দোষ হলে নিশ্চয়ই সমস্যায় পড়বো না। ”
” আইনের উপর বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে। যেহেতু আপনি উনার পূর্বপরিচিত, উনার স্বামীকেও চেনেন। ”
” আচ্ছা। ”
পু’লি’শ চৈতীর লা’শ নিয়ে চলে গেল। সোহাগসহ বিল্ডিংয়ের দু’জন লোককে সাথে নিয়ে গেছে, কহসব জিজ্ঞেসাবাদ করবে। চৈতীর বাড়ির লোক আসলে থা’নায় যোগাযোগ করতে করতে বলেছে। পো’স্ট’ম’র্টে’মের পর লা’শ দা’ফ’ন করতে পারবে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছি। চৈতী মা’রা যাওয়ার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এ বাড়িতে চৈতী একা থাকতো। যতদূর শুনেছি ওর স্বামী বিদেশে থাকে, বছরের মাথায় বেড়াতে আসে। কিন্তু আমরা এখানে আসার পর একবারও ওর স্বামীকে আসতে দেখিনি। পরিবারের লোকজনেরও তেমন যাতায়াত নেই। সকলে নাকি অনেক দূরে দূরে থাকে। চৈতী অবশ্য মাসখানেকের মাথায় বাপের বাড়ি বেড়াতে যেত। গ্রাম থেকে নানান শাকসবজি ফলমূল নিয়ে আসতো। বিল্ডিংয়ের অনেকেই সেগুলোর কিছু অংশ হাদিয়া দিত।
মেয়েটার সাথে বিল্ডিংয়ের কারো অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা নেই। শুধুমাত্র আমাদের বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। কিছুদিন ধরে সোহাগের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি নিজেই ওর বড় শ’ত্রু। তবে আমার পক্ষে মানুষ হ”ত্যার মতো এতো জ’ঘ’ন্য কাজ করা সম্ভব নয়। তবে কি সোহাগ খু’ন করেছে? এমনও তো হতে পারে সোহাগ চৈতীকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে চৈতী ওর স্বামীকে ঠকাতে চায়নি। সে-ই রাগ থেকে চৈতীর খু’ন।
নানান চিন্তার মাথা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে। পু*লিশ যদি সোহাগকে সন্দেহ করে অথবা আমাকে? তখন কি হবে! চৌদ্দশিকের আড়ালে জীবন কাটতে হবে না তো? এসব ভাবতে পারছি না, সোহাগ ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কোথাও অনেক বড় রহস্য লুকিয়ে আছে।
চলবে