কাগজের_তুমি_আমি ৯ম_পর্ব

কাগজের_তুমি_আমি
৯ম_পর্ব

হঠাৎ কারোর গগণবিদারী চিৎকার শুনতে পারলে এক লাফে উঠে পড়ে সে। চোখ খুলতেই দেখলো অনল রীতিমতো এক হাত কামড়ে আরেকহাত দিয়ে বুক ঢলে যাচ্ছে। অবাক চোখে তার দিকে তাকালে ঝাঁঝালো কন্ঠে অনল বলে উঠে,
– কি দেখছিস এভাবে?
– তুমি এখানে কি করছো?
– আপাতত তোর খামছি খাচ্ছিলাম। আচ্ছা পার্ট টাইমে কি নখ দিয়ে মাটি খুড়িস? উফফফ জ্বলে গেছে আমার বুকটা। দানবী কোথাকার।
– কে বলেছে আমার কাছে আসতে। আবার আমার কাছে আসলে এভাবে খামছি দিবো। সরো এখান থেকে।

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ধারা বলে উঠে। প্রতি উত্তরে অনল ও
বলে উঠে,
– একে সারারাত আমার বুকের উপরে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাইছিস, সকাল হতে না হতেই আমার পশম তুলে দেবার মতো সাংঘাতিক কাজ করেছিস, আমাকে খামছি অবধি দিয়েছিস এখন আমার উপরই রাগ দেখাচ্ছিস।
– হয়ে গেছে? তোমার ফালতু কথা শোনার ইচ্ছে বা সময় আমার নেই।

বলেই উঠে চলে যেতে নিলে ধারার হাত টেনে ধরে অনল। আকুল আকুতির স্বরে বলে উঠে,
– আমাকে শেষ সুযোগটা দিবি না ধারা?

আবারো সেই প্রশ্ন ধারার ভেতরটাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। নিজের আত্নসম্মান আর ভালোবাসার যুদ্ধে আজ অসহায় সে। অনলকে কি উত্তর দিবে তার জানা নেই। মস্তিষ্ক এবং মনের এই যুদ্ধ প্রতিনিয়ত ধারা পুড়িয়ে যাচ্ছে। না অনলকে ক্ষমা করতে পারছে না অনলকে শাস্তি দিতে পারছে। আচ্ছা একটা শেষ সুযোগ দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে! ধারা চুপ থাকতে দেখে অনল শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
– বেশ এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি শুধু এক মাস সময় নিবো। এক মাসের পর ও যদি তোর মনে হয় আমাকে মেনে নিতে তোর কষ্ট হচ্ছে আমি তোর জীবনে বাধা হয়ে আর ধারাবো না। তুই যা চাবি তখন তাই হবে। একটা মাস আমাকে শুধু সময়টা দে।
– এক মাস দিলে কি হবে বলো? আমার জীবনের চলে যাওয়া দিন গুলো তুমি চাইলেও ফেরাতে পারবে না।
– না হয়তো পারবো না। কিন্তু এতটুকু কথা দিতে পারি এই পাঁচ বছর দশ মাস সতেরো দিনের যেই কষ্টের পাহাড় আছে তা ভেঙে গুড়িয়ে সুখের আস্তানা সাজাবো, তোর মনে আবার নিজের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।

অনলের কথা শুনে টিটকারির সুরে ধারা বলে উঠে,
– আমার কষ্টের পাহাড় এতোটাই বেশি যে চাইলেও সেটা কমাতে পারবে না। আমিও দেখতে চাই এই এক মাসে তুমি কি এমন এভারেস্ট জয় করতে পারো। আমি আমার রুমে যাচ্ছি, ফ্রেশ হয়ে ফুপুর কাছে যাও।

কথাটা বলে এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করে ধারা। অনল এক দৃষ্টিতে ধারার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে। এই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো সে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয়গুলো উঁকিঝুকি দিচ্ছে। সত্যি কি মেয়েটাকে সেই সুখগুলো ফেরত দিতে পারবে! আগে একটা চকলেট দিলেই মেয়েটা তার মুক্তোর মতো হাসি দিয়ে সেটা গ্রহণ করতো, এতো আগলে রাখতো মনে হতো কতো না দামী সেই চকলেটটা। তবে এখনের ধারা পুরোই আলাদা। এতোদিনের কষ্টগুলো তাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। এই পাথরে হৃদয়ে পুনরায় ভালোবাসার বীজ বুনা কি সহজ হবে! তার মনের বদ্ধ কুঠিরের তালাটা কি এতো সহজে খোলা যাবে!

সকাল ১১টা,
সুভাসিনী বেগমের রুমে সবাই একজোট হয়েছে। সুভাসিনী বেগম রীতিমতো জিদ ধরে বসে আসেন তাকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। ধারা তাকে বুঝাতে পারছে না এখন গ্রামে ট্রাভেল করাটা তার জন্য ঠিক হবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। সে গ্রামে যাবে মানে যাবে। বাধ্য হয়ে অনল সিদ্ধান্ত নেয় কাল তারা কুমিল্লা যাবে। সুভাসিনী বেগমের বাবার বাড়ি কুমিল্লার প্রত্যন্ত সিধলাই গ্রামে। প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টার পথ। দুই-তিন দিন ঘুরে আসলে খুব একটা খারাপ হবে না। আর কি এখন আবার ধারার ছুটি নিতে হবে। সুভাসিনী বেগমের রুম থেকে বেরিয়েই দিগন্তকে ফোন করলো ধারা। ফোন রিসিভ হলেই অনুরোধের স্বরে বলে ধারা,
– হ্যালো, দিগন্ত ভাই। একটা ফেবার চাচ্ছিলাম। করতে পারবেন?
– হ্যা, হ্যা বলো। তোমাকে ফেবার করতে আমার কি কখনো আপত্তি ছিলো। বলো
– আমাকে চারদিনের একটা ছুটি ম্যানেজ করে দিতে হবে, পারবেন?
– হঠাৎ? আন্টি কি আবার অসুস্থ?
– না, এবার গ্রামে যাবার বায়না করেছে। তাই একটু ঘুরে আসতে চাচ্ছিলাম
– আচ্ছা সমস্যা নেই; একটা কথা ছিলো ধারা
– জ্বী বলেন
– না থাক তুমি ঘুরে আসো তারপর বলবো
– ঠিক আছে, তাহলে রাখি দিগন্ত ভাই।

দিগন্তের সাথে কথা বলার মাঝেই ফোনটা কেড়ে নেয় অনল। অনলের এমন কাজে প্রচন্ড ক্ষেপে যায় ধারা। অনেকটা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– এটা কি হলো? কথা বলছিলাম তো নাকি?

ফোনটা কেটে দিয়ে নির্বিকারভাবে বলতে লাগলো অনল,
– কি হবে? এই চেংড়া ছেলের সাথে এতো কিসের কথা তোর? যা যেয়ে ব্যাগ গুছা। ৩টার সময় খেয়ে দেয় রওনা দিবো
– আজিব তো, আমি আবার ছুটি নিচ্ছি, দিগন্ত ভাইকে জানানোর জন্য ই ফোনটা দিয়েছি নাকি?
– অদ্ভুত তুই তোর ছুটি নিবি ওকে জানানোর কি আছে? ওর পি.এ নাকি ও?
– তোমার সাথে কথা বলা আর উলোবনে মুক্ত ছড়ানো অনেকটা এক।
– বুঝেছিস যখন কথা না বলে ব্যাগ গুছা যেয়ে।
– অসহ্য লোক একটা।

বলেই গটগট করে রুমে চলে গেলো ধারা। জানে লোকটার সাথে কথা বললে মেজাজটাই মাঝখান থেকে শুধু খারাপ হবে। দিগন্তকে দেখলেই কিংবা ওর কথা তুললেই অনল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এটা বুঝতে বাকি নেই ধারার। অবশ্য এটা যে সে উপভোগ করছে না তাও নয়। বেশ মজা লাগছে অনলকে এভাবে রাগিয়ে তুলতে। এই খুনসুটির ভেতরে অন্যরকম শান্তি লুকিয়ে রয়েছে।

সন্ধ্যা ৭টা,
বাড়ির গেটের সামনে এসে পৌছালো অনলরা। সারা রাস্তা ড্রাইভ করে এসে খুব ক্লান্ত লাগছে অনলের। তিন বছর বাদে আজ ধারা তার বাড়ি ফিরেছে। অনলের জার্মানি যাবার পর একবার এসেছিলো শুধু মাকে দেখতে। নিজের বাড়ি নিজের বাড়ি ই হয়। আজ এতদিন বাদে এসেও কি শান্তি না লাগছে। বিয়ের পর এই প্রথম অনল এখানে পা রেখেছে। গতবার যখন এসেছিলো তখন তাকে জোরপূর্বক ধারার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আজ হিসেবটা উলটো, আজ সে এই ধারাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে। বাড়ির গেট খুলতে না খুলতেই ধারার মা অর্থাৎ সুরাইয়া বেগম দৌড়ে জামাইকে বরণ করতে চলে আসেন। বিয়ের পর নিজের হাতে এক বেলাও মেইয়ের জামাইকে মনের তৃপ্তি অনুযায়ী খাওয়াতে পারেন নি তিনি। অনলকে ন্যে যেয়ে বসাতে না বসাতেই আপ্পায়নের ধুম পড়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে নিজের মামীর কান্ড দেখে যাচ্ছে অনল। এই সরবত দিচ্ছে, এই মিষ্টি; উনার যতটুকু সাধ্য সবটুকু নিয়ে অনলের খাতিরদারীর ব্যবস্থা করছেন তিনি। গ্রামের মানুষদের মনের মধ্যে পেঁচটুকু থাকে না। এইজন্য হয়তো তাদের সরল হৃদয়ে ভালোবাসার কমতি থাকে না। কোথাও যেনো অনলের নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছিলো। এই মানুষটা তাকে এতো যত্ন করছে অথচ তার মেয়েকে কতই না কষ্ট পেতে হয়েছে বিয়ের পর থেকে। এসব ভেবে পানিটুকু ও গলায় আটকে যাচ্ছিলো। হুট করেই সুরাইয়া বেগম ধারাকে বলে উঠে,
– মা, আমি তোর রুম গুছায়ে রাখছি। অনল বাবারে তোর রুমে নিয়ে যা।
– আমার রুমে মানে?
– কি কথা কস তুই? তোর রুম ছাড়া আর রুমে থাকবে সে?

সুরাইয়া বেগমের কথায় এটা বুঝতে বাকি নেই ধারার এই মানুষটার সাথে এক রুমে এই কয়দিন থাকতে হবে। গা জ্বলছে ধারার কিন্তু কিছুই করার নেই। এদিকে অনলের খুশি যেনো ধরছে না। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা। হঠাৎ অনলের মোবাইলটা বেজে উঠে, মোবাইলের নাম্বারটা চোখে ভাসতেই চোখ মুখের রঙ বদলে গেলো অনলের। তখনই ধারা জিজ্ঞেস করে উঠে……………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here