কাগজের তুমি আমি,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব

কাগজের তুমি আমি,৭ম_পর্ব,৮ম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৭ম_পর্ব

কিন্তু পরমূহুর্তে এমন কিছু দেখলো যা দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না অনল। ধারা তখন একটি ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলো। ছেলেটি ধারার সমবয়সী হবে, পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। শ্যাম বর্ণের ছেলেটি ধারার সাথে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলছে। ধারা এতো হাসছে মনে হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে বড় কমিডিয়ান তার সামনে দাঁড়ানো। মেজাজটা মূহুর্তে চটে গেলো অনলের। কি কেমন কথা বলছে যে অনলকেই দেখতে পাচ্ছে না। অপরদিকে ধারা ক্লাস শেষে বের হতেই দিগন্তের সাথে দেখা। দিগন্ত ছেলেটা ধারার ভার্সিটির সিনিয়র। একই সাথে স্কুলে চাকরি করে তারা। যেমন দেখতে সুন্দর তেমন মার্জিত ব্যবহার। আর ছেলেটার সব থেকে ভালো যে স্বভাবটা ধারার কাছে মনে হয় তা হলো তার মন ভালো করার পদ্ধতি। লেম লেম জোক মেরে সবসময় ধারাকে হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। আর ধারার মন তখন ভালো হতে বাধ্য। দিগন্ত তার সিনিয়র, কলিগের সাথে সাথে একজন খুব ভালো বন্ধু; যে কিনা বিগত চার বছর ধরে তার সাথে আছে। দিগন্তের সাথে দেখা হতেই অটোমেটিক মুখে হাসি ফুটে উঠলো ধারার ঠোঁটে।
– কি ম্যাডাম, লম্বা ছুটি কেমন কাটলো?
– হসপিটাল-বাসা করতে করতে কেটেছে। আপনি কেমন আছেন বলেন?
– আমি তো ভালোই ছিলাম কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে মনের হালকা অসুস্থ ছিলো। যাক আমার মনের ঔষধ চলে এসেছে।
– এতো ফ্লার্ট করেন কিভাবে? টায়ার্ড হন না?
– এই শোনো এখন টায়ার্ড হয়ে গেলে আর বউ পাওয়া লাগবে না আমার।
– বিবাহিত মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করলে বউ পেয়ে যাবেন?
– আজিব, দেখো আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করি, তুমি ইরিটেট হও। আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার একটাই উপায় আমাকে বউ খুজে দেয়া। সো তুমি ইরিটেট হলেও আমাকে বাধ্য হয়ে মেয়ে খুজে দিবে যাতে আমি আর তোমার সাথে ফ্লার্ট না করি।
– কি বুদ্ধি! আই এম শকড।

ধারা যখন দিগন্তের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ায় অনল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধারাকে জিজ্ঞেস করে,
– আজ কি এখানে থাকার প্লান করে রেখেছিস?

হঠাৎ অনলের কন্ঠস্বর শুনে বেশ খানিকটা চমকে উঠে ধারা। পেছনে ফিরে অনলকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখে অবাক ও হয় সে। একে অনল ঠিক সময়মত এসে হাজির হয়েছে, উপরে রাগী দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে আসে যেনো মহাপাপ কিছু একটা ধারা করে ফেলেছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ধারা বললো,
– দিগন্ত ভাই, আমি আসি আজকে।
– সে ঠিক আছে কিন্তু উনি?
– আমার ফুপাতো ভাই, উনার নাম অনল। অনল ভাই ইনি আমার কলিগ দিগন্ত ভাই।
– হ্যালো।

দিগন্ত হাত বাড়িয়ে দিলে নিজের রাগ কোনোমতে কন্ট্রোল করে হ্যান্ডশেক করে অনল। রাগে গা রি রি করছে। কিন্তু ধারাকে এখন কিছু বলতে পারছে না। ধারার রাগ ভাঙাতে চায় সে, রাগ দেখালে হিতে বিপরীত হবে। তাই কিছু বললো না অনল। হ্যান্ডশেক করেই ধারাকে বললো,
– পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে আয়। মা ওয়েট করছে কখন থেকে
– আচ্ছা, চল। আসি দিগন্ত ভাই।

দিগন্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো ধারা। গাড়িতে উঠতে না উঠতেই অনল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি রে?
– মানে?
– মানে আবার কি! কালকে থেকে দেখছি ভাই ভাই করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস। আরেকবার যদি ভাই বলিস ত দেখিস
– অনল ভাই, একটা কথা মাথায় ঢুকায়ে রাখো, আমাদের মধ্যে এখন শুধু ফুপাতো-মামাতো ভাই-বোনের সম্পর্কটাই আছে। এছাড়া আর কিছু এক্সপেক্ট করতে যেও না। যেহেতু চলে এসেছো। আমি চাই আমাদের ডিভোর্সটা এবার পাকাপুক্তভাবে হয়ে যাক।
– মানে?
– মানে টা স্পষ্ট। সেবার তুমি আমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলে, এবার আমি মুক্তি চাচ্ছি।

ধারার কথা শুনে অনলের মুখ শক্ত হয়ে এসেছে। হাত মুঠো বদ্ধ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যাথাটা আবার তিব্রতর হয়ে আসছে। কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট করলো অনল। প্রচুর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বাড়ির গেটে এসে গাড়িটা থামালো। গাড়ি থামলে ধারা কোনো কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। সারা রাস্তা তারা কোনো কথাই বলে নি। অনলের আজ সব প্লান নষ্ট হয়ে গিয়েছে ধারার এক কথায়। বাড়ি এসে সোজাসোজি নিজের রুমে চলে যায় ধারা। অনল ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্লাবের দিকে। খুব দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। ধারা তাকে নিজের কথা বলার কোনো সুযোগ ই দিচ্ছে না। কিভাবে ধারার সাথে তার কাগজের সম্পর্কটাকে নরমাল সম্পর্কে পরিণতি করবে তা জানা নেই অনলের।

রাত ৮টা,
একের পর এক সিগারেট জ্বালাচ্ছে অনল। নিজের ভেতরের আগুনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। কষ্টগুলো ছুঁচের মত ফুটেই চলেছে।
– লিভার যা একটু ঠিক ছিলো সেটাও কি নষ্ট করে ফেলার ধান্দায় আছিস নাকি?

অনন্যার কথায় পেছনে না ফিরেই বলে উঠে অনল,
– এটা স্মোকিং যোন, তুই এখানেও কেনো ঢুকে পড়েছিস?
– স্মোকিং যোনে নিশ্চয়ই নাচতে আসি নাই। একটি বেনসন দে।
– তুই কবে থেকে স্মোক করিস?
– সে মেলা ইতিহাস। শর্ট কথা ব্রেকাপের পর থেকে।
– ভালো, এক দেবদাসে ভাত পাচ্ছে না। আরেকজন জুটেছে। নে।

বলে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো অনন্যার দিকে। অনন্যা সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বললো,
– আজ কি ছ্যাকার পরিমাণটা বেশি?
– ধারা আমাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে।
– তো? এটাই তো তুই চেয়েছিলি না? ইভেন তুই নিজে পেপারস এ সাইন করে গেছিস। এখন আবার মন চেঞ্জ?
– ভাই ভুল করেছিলাম, না অন্যায় করেছিলাম। বাট আমার ওকে ছাড়া চলবে না দোস্ত। আমি পারবো না ওকে ছাড়া আবার থাকতে। অনেক থাইকে দেখছি। আর না।
– ওয়াও। হ্যাটস অফ। তুই যখন চেয়েছিস ওকে ছেড়ে চলে গেলি। এখন তুই চাচ্ছিস এক সাথে থাকতে সো ধারার থাকতে হবে। এটা কি ফাজলামি। আর ইউ ফা**** কিডিং মি?
– তো কি করবো আমি? জানি অন্যায় করেছিলাম। কিন্তু এবার সেটাকে শুধরাতে চাইছি। ওকে সেই সব খুশী দিতে চাইছ যা ও ডিসার্ভ করে। একটা সুযোগ কি আমার প্রাপ্য নয়? একটা লাস্ট সুযোগ?
– সেটা ধারা ভালো বলতে পারবে।
– ও কি বলবে, এখন ওর কাছে তো চয়েজ আছে।
– হ্যা?
– আরে একটা চেংড়া ছেলে, ওর কলিগ। মে বি ওকে লাইক করে ডোন্ট নো। খুব ক্লোজ ওরা। আমাকে ছেলেটার সামনে ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। ক্যান ইউ ইমাজিন?
– হাহাহাহা, তুই কি এক্সপেক্ট করিস যে ও তোর মত বুইড়াকে হাসবেন্ড হিসেবে পরিচয় দিবে। শালা তোরে আংকেল বলে নাই তোর ভাগ্য ভালো। কলপ দিয়ে পাকা চুল ঢেকে রাখছোস আবার কথা।
– তুই আমার বন্ধু? আমার মাঝে মাঝে প্রশ্ন উঠে মনে।
– হাহাহা
– হাসবি না, আমি বুইড়া হলে তুই ও বুড়ি। তাও তো আমার বিয়ে হয়েছে, তুই আইবুড়োই থেকে যাবি।
– এই বিয়েশাদী যে আমার জন্য না এটা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কে বিয়ে করবে বলো এমন স্মোকার, বিনা চালচলনের মেয়েকে?
– সরি রে, আচ্ছা রবিনের সাথে তো তোর বিয়ে ঠিকঠাক ছিলো তাহলে কি হলো?
– শোন, আমার মতো বেহাল্লা মেয়েগুলো গার্লফ্রেন্ড ট্যাগ পাওয়ার ক্যাপাবিলিটি রাখে, স্ত্রী ট্যাগটা আমাদের জন্য না। আমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস তো তোর জানা। বাবা-মা ডিভোর্সড, সারাজীবন উড়ণচন্ডী ছিলাম। এসব কিছুই একেকটা ইস্যু ছিলো। তবে রবিন ছেলেটা অনেক চেষ্টা করেছে, প্রথমে ওর বাবা-মার চিন্তাধারা বদলাতে, তারপর আমাকে বদলাতে, না পেরে নিজেকে বদলাতে। ছেলেটা আমার সাথে সম্পর্কে পিসছিলো। ওর কষ্টগুলো আর নিতে পারছিলাম না। শেষমেশ বাড়ি ছাড়ার কথাও বলে। অনেক ভাবলাম জানিস, এতো গুলো সম্পর্ক ভাঙার থেকে আই গেস এই একটা সম্পর্ক ভাঙা ইজি। তাই আমি ব্রেকাপটা করেছি।
– তুই হ্যাপি তো?
– সিগারেটের সাথে ইয়েস। তবে কি লাইফ কারোর জন্য বসে থাকে না। এই দেখ না ওর সামনের মাসে বিয়ে। তাহলে আমার ডিসিশনটা তো ঠিক ছিলো বল।

অনন্যা কাঁদছে, মেয়েটাকে এই প্রথম কাঁদতে দেখছে অনল। জীবন তাকে ভাঙন বাদে কিছুই দিতে পারে নি। আজও তাই। অনল ও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলাচ্ছে। এরই নাম হয়তো বেঁচে থাকা।

রাত ১১টা,
কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো ধারার। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখলো………………

চলবে

কাগজের_তুমি_আমি
৮ম_পর্ব

রাত ১১টা,
কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো ধারার। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখলো অনন্যার কাধে ভর দিয়ে অনল দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে গরগর করে বলতে লাগলো,
– আমার কোনো দোষ নেই ধারা, আজ তোমার বরের দেবদাসগিরির মাত্রাটা একটু বেশি ছিলো তো। একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। আন্টি কই?
– ফুপু, বাবা সবাই ঘুম।
– এটাকে কই রাখবো?
– এখানে ফেলে রাখেন সকালে নেশা কাটলে নিজে হেটে হেটে যাবে রুমে।

বিরক্তির স্বরে ধারা বলে উঠে। ধারার হাবভাব শুনে অনন্যা বলে,
– এভাবে বলো না বেচারার আজ মনটা ভালো নেই। তুমি একটু সাপোর্ট দিলে রুমে ফেলে আসতে পারি।
– ঠিক আছে আপু।

দাঁতে দাঁত চেপে অনন্যার কথায় রাজী হয় ধারা। কোনোমতে বেড অবধি এনেই অনলকে শুইয়ে দিলো তারা। মোটামোটি খবর হয়ে গিয়েছিলো অনন্যা এবং ধারার, একটা ছয় ফুটের সুঠামদেহী পুরুষ বলে কথা। অনন্যা আর দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। অনন্যা যাবার পর কি মনে করে আবার অনলের রুমে আসলো ধারা। এসেই দেখে সে চুপচাপ বসে রয়েছে। অনলকে বসে থাকতে দেখে খানিকটা চটে গিয়ে ধারা বলে,
– যদি সোবার ই থাকেন তবে অহেতুক ঢং করার কি প্রয়োজন?
– ……………
– কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না যে?
– একটা শেষ সুযোগ কি আমার প্রাপ্য নয় ধারা?

অনলের নির্বিকার প্রশ্ন শুনে ধারা খানিকটা থমকে যায়। অনল তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনলের চোখ চিকচিক করছে। এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয় ধারা। এই চোখ জোড়া বড্ড ভয়ানক। সাড়ে পাঁচ বছর আগে এই চোখের মায়ার সাগরে নিজেকে তলিয়ে ফেলেছিলো সে। আজ আবার সেই চোখের মায়া তাকে নিজের জালে ধারাকে তলাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ফিরে কাঁপা কন্ঠে বললো,
– রাত হয়েছে, রেস্ট করুন। এসব কথা বলার কোনো মানে হয় না।

কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরে অনল। হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আলতো হাতে ধারার মুখটা দু হাতে ধরে উচু করে সে। কোমল কন্ঠে বলে,
– আমাকে একটাবার নিজের কথা বলার সুযোগটুকু ও দিবি না? ফাঁসির আসামীকেও নিজের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। কাল থেকে তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। তুই একটা সুযোগ ও দিচ্ছিস না?
– কি বলবে তুমি? কি বলার আছে? পাঁচ বছর আগে আমাকে সুযোগ দিয়েছিলে তুমি? আমিও তো একটা সুযোগ চেয়েছিলাম। দিয়েছিলে?
কাঁপা কাঁপা স্বরে ধারা বলে উঠে। নোনাজলের রাশি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। আজ ধারার কন্ঠে অভিমানের ছাপ। অভিমানের পাহাড় যা বিগত পাঁচ বছর ধরে জমে আছে। অনলের শার্টের কলার ধরে বলতে লাগলো,
– কি হলো চুপ করে আছো যে, খুব তো বলেছিলে কথা বলবে। বলো, কেনো চলে গিয়েছিলে? কেনো আমাকে একটা সুযোগ দাও নি। আমার কি দোষ ছিলো? কি দোষ ছিলো আমার? তোমাকে ভালোবাসা আমার দোষ ছিলো? কেনো একা ফেলে গেলে আমাকে। বিইয়ের পর থেকে আমার সাথে তুমি যা যা করেছো আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমাকে সময় দিতেও আমি রাজী ছিলাম। তাহলে কেনো চলে গিয়েছিলে?
– তুই তো ভালোভাবেই জানিস আমি কেনো গিয়েছিলাম, যাতে আমার দ্বারা তোর কোনো ক্ষতি না হয়। যাতে তুই কষ্ট না পাস। আমি না গেলে মা তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেত
– আমার হয়ে সব ডিসিশন তোমরাই নিয়ে ফেললে? একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আসলে আমি কি চাই? আমাকে কষ্ট না দিতে গিয়ে সবথেকে বড় কষ্ট দিয়ে ফেললে তার বেলায়?
– আই এম সরি। কিন্তু কি করতাম বল? আমার ঘা গুলো এতো তাজা ছিলো যে তোর ভালোবাসাটা মলম হলেও খুব যন্ত্রণা দিতো। প্রতি নিয়ত আমাকে যুদ্ধ করতে হতো। আমি যে পারছিলাম না, ভয় পেতাম। যদি তখন মিথ্যা আশায় তোকে রাখতাম সেটা কি খুব ভালো হতো। যেখানে আমি জানতাম তোকে ভালোবাসাটা আমার জন্য খুব সম্ভব হতো না। মাহির স্মৃতিগুলো কঁটার মতো আমাকে প্রতিনিয়ত ফুট ছিলো। সেখানে তকে জড়ানোটা কি খুব ভালো হতো? সেটা কি অন্যায় হতো না? তোর মাঝে আমি মাহিকে খুঁজতাম, তোকে মাহির জায়গায় ফিট করার চেষ্টা করতাম। সেটা অন্যায় হতো না? তোকে মিথ্যা ভালোবাসার মাঝে, মিথ্যা সম্পর্কের মাঝে কিভাবে রাখতাম বল? তাহলে আমার মাহির মাঝে পার্থক্য কি থাকতো। তখন তুই এই সম্পর্কটাকে টানতে টানতে টায়ার্ড হয়ে পরতি। খুব ভালো হতো সেটা। আমাদের সম্পর্কটা ভুল ছিলো না, সময়টা ভুল ছিলো।
– বেশ মানলাম, সম্পর্কের চাপ তুমি নিতে পারো নি, তাই পালিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু ডিভোর্স পেপারটা। সেটা কেনো সাইন করে গিয়েছিলে? উত্তর দাও

দৃঢ় কন্ঠে ধারা উত্তর চাচ্ছে অনলের কাছে। ধারা কাঁদছে, কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। বারবার ঢুকড়ে ঢুকড়ে কেঁদে উঠছে সে। অনল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। ধারার অশ্রুগুলো অনলকে বড্ড অসহায় করে নিচ্ছে, দূর্বল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা কেটে যদি তাকে দেখাতে পারতো হয়তো তাহলে নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হতো। ধারার চোখের পানিতে অনলের শার্টের খানিকটা ভিজে গেছে। ধারার চোখ দুহাতে মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
– আমি খুব দোটানায় ছিলাম ধারা। আমি কি করতাম তখন? তোর সাথে বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারবো কিনা! তোকে কোনোদিন স্ত্রীর মর্যাদাটা দিতে পারবো কিনা সেটাই আমার জানা ছিলো না। সেখানে তোকে একটা খোকলা সম্পর্কে বেধে রাখা আমার নীতির মধ্যে পড়ছিলো না। আমি তোর প্রতি অনুভূতিগুলো কোনো আকার দিতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার ভেতর ছিলাম না।
– তাহলে চলেই যখন গেছিলে, ফেরত কেনো এসেছো। কেনো আমার মনটাকে আবার স্বপ্ন দেখিয়ে আবার গুড়োগুড়ো করে ভেঙে দেবার জন্য? এখন কেনো আমাকে মুক্তি দিচ্ছো না।
– ভালোবাসি তোকে তাই। খুব ভালোবাসি, এই পাঁচটা বছর একটা দিন যায় নি আমি তোর কথা ভাবি নি। ভুল করেছিলাম, আমার এলোমেলো অনুভূতি গুলোকে প্রথমে বুঝতে দেরি করেছি, তারপর বুঝার পর সেটাকে মানতে দেরি করেছি। এই ভুলগুলো আমাদের জীবন থেকে পাঁচটা বছর কেঁড়ে নিয়েছে।
– পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন। জানো কতোগুলো দিন হয়, এক হাজার নয়শত আঠাশ দিন। প্রতিটা দিন আমি অপেক্ষা করতাম। এই ভেবে তুমি হয়তো ফিরবে, এই বুঝি আমার কাছে ফিরবে। কতোগুলো রাত নির্ঘু, কেঁটেছে আমার। ফিরিয়ে দিতে পারবে তুমি? আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত ফিরিয়ে দিতে পারবে? আমাদের বিয়ের আজ পাঁচ বছর দশ মাস সতেরো দিন। পারবে এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে। আমার জীবনের এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে? সেই কিশোরী মনের নিস্পাপ ভালোবাসাটাকে আবার জাগাতে পাঁরবে? পারবে না কিচ্ছু পারবে না। আমি থাকবো না তোমার সাথে। থাকবো না। আর কষ্ট নেওয়ার অবস্থায় আমি নেই।

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি ধারা। অনলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে হিচকি তুলে কাঁদছে সে। বিলাপের পরিমাণ বাড়তেই থাকলো। এতোদিনের অভিমানের পাহাড় আজ গলতে শুরু করেছে। কঠিন থাকতে থাকতে আজ ধারা ক্লান্ত। নিজের সকল অভিযোগ আজ সে অনলকে জানাবে। অনলও পরম যত্নে ধারাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই। তাদের কান্না আসে না, কিন্তু যখন কাঁদে সব উলট পালট করে দিতে সক্ষম। আজ অনল কাঁদছে। নিজের ভুলের মাশুল দিচ্ছে। কারণ ধারার প্রতিটা অশ্রুফোঁটা তাকে ভোঁতা ছুরির মতো আঘাত করছে। পারছে না ধারাকে নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে ওনলের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। ধারার কোনো আওয়াজ না পেলে ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে করে তাকে কোলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো তাকে অনল। ভেজা শার্টটা খুলে ধারার পাশেই মুখ করে শুয়ে পড়লো। নিপুন দৃষ্টিতে ধারাকে দেখে যাচ্ছে অনল। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে রয়েছে তার। চোখের নোনাজল এখনো শুকায় নি; চোখের নিচে লেগে রয়েছে। আস্তে করে ধারার মাথাটা নিজের বুকের উপর রেখে তাকে পরম যত্নে আগলে ধরলো অনল। মেয়েটাকে আর কোনোদিন কাঁদতে দিবে না সে। এটা তার কাছে স্পষ্ট মেয়েটা কাঁদলে বড্ড বেশি অসহায় লাগে, মনে হয় পুরো দুনিয়াটা উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে অনল ও ঘুমের অতল সাগরে তলিয়ে যায়।

সকাল ৭টা,
পাখির কিচিমিচি কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ধারা। মনে হচ্ছে খুব শক্ত কিছুর উপর উবু হয়ে আছে সে। মাথা ব্যথা করছে, চোখ খুলা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। কিসের উপর শুয়ে আছে বুঝার জন্য হাত দিয়ে হাতড়ে যাচ্ছে। চুলের মতো কিছু হাতে পড়লে সেটা টানার চেষ্টা করতে লাগলো সে। হঠাৎ কারোর গগণবিদারী চিৎকার শুনতে পারলে এক লাফে উঠে পড়ে সে। চোখ খুলতেই দেখলো………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here