কাগজের তুমি আমি,৫ম_পর্ব,৬ পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৫ম_পর্ব
– এভাবে কাঁদলে যা একটু ভালো হয়েছিলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু!
পেছন থেকে নারী কন্ঠটি শুনে অনলের ভেতরে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যায়। অবাক নয়নে পেছন ফিরতেই দেখলো তার সামনে কালো শাড়ি পরিহিতা এক নারী। যার ঢেউ খেলানো মাজা অবধি চুলগুলো বেনুনী করে কাধের এক পাশে ফেলে রেখেছে। হরিণ টানা চোখ গুলো চশমার আড়ালে তার। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় পাতলা ঠোঁটগুলি যে কোনো পুরুষকেই আকর্ষণ করবে। সামনে দাঁড়ানো নারীটি সেই নারী যার কিশোরী মনটাকে একদিন নিজ হাতে গলাটিপে মেরে ফেলেছিলো অনল। যে উনিশ বছরের কিশোরীর চোখে তার জন্য একসাগর ভালোবাসা দেখতে পেতো; আজ সে নারীর চোখে এক অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে যা অনলকে তলিয়ে দিতে সক্ষম। তার সামনে উনিশ বছরের ধারা নয়; প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে যার মাঝে এক অজানা রহস্য রয়েছে, এক অজানা গভীরতা। অনলের চোখের পলক পড়ছে না, এক দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ধারাকে দেখে সুভাসিনী বেগম গদগদ গলায় বলে উঠেন,
– দেখেছিস বলেছিলাম না আমার ছেলে ঠিক চলে আসবে, তুই তো বিশ্বাস করিস নি।
– হুম হুম বুঝলাম, ঘাট হয়েছে আমার। এবার তো ছেলে এসে পড়েছে এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হও তো বাপু। আর মেন্টাল স্ট্রেস নিতে পারছি না আমি। তুমি সুস্থ হলে আমি একটু ঝাড়া হাত হয়ে ট্যুর দিবো।
– কোথায় যাবি তুই?
– বলবো না, সিক্রেট। তোমার রিপোর্ট ভালো এসেছে, তবে অনন্যা আপু বলেছে আরো খাওয়া দাওয়া করতে হবে। অনল ভাই, এবার কিন্তু তুমি ফুপিকে সামলাবে। আমার কোনো কথা শুনে না সে।
অনল সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধারাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে, মেয়েটা এতো স্বাভাবিক কিভাবে! তার কি কিছুই যায় আসছে না এতো বছর পর অনল ফিরে এসেছে এই ব্যপারটাতে! আর ধারার মুখে ভাই শব্দটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করছে। মার সামনে কিছুই বলতে পারছিলো না; তবে ধারার সাথে কথা বলাটা খুবই দরকার। সে কি সত্যি সব কিছু ভুলে গেছে!!
রাত ৯টা,
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে বাসার দিকে রওনা দেয় অনল এবং ধারা। সেলিম সাহেব আগেই চলে গিয়েছেন। এই হাসপাতালে রোগীর সাথে কারোর থাকার পারমিশন নেই। তাই ধারা অনলের সাথেই বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অনল ও খুব টায়ার্ড, এয়ারপোর্ট থেকে নেমেই হাসপাতালে গিয়েছিলো। একই ট্যাক্সিতে বাসার দিকে যাচ্ছে তারা; গাড়ি নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ধারার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। এখনো অবধি একবার ও সে অনলের সাথে কথা বলে নি, একবারও জিজ্ঞেস করে নি কেমন আছে অনল। খুব অস্বস্তি লাগছে অনলের। কেনো জানে চাইলেও কথা শুরু করতে পারছে না সে। সত্যি ধারা অনেক বড় হয়ে গেছে। পাশাপাশি বসে রয়েছে দুজন কিন্তু তাদের মনের দূরুত্বটুকু এতো বেশি যে চাইলেও তা কমানো সম্ভব নয়। সারা রাস্তা নিঃশব্দেই তারা বসে থাকে ট্যাক্সিতে, যেনো দুজন অপরিচিত মানুষ।
বাসায় এসে অনলের রুমের দরজাটা খুলে দেয় ধারা। এতোদিন তালাবব্ধ ছিলো রুমটি, সুভাসিনী বেগম অবশ্য প্রতি দু দিন অন্তর অন্তর রুমটি পরিষ্কার করে রাখতেন। এখন তিনি অসুস্থ হওয়ায় ধারাই সে কাজটি করে। ধারা যখন চলে যাচ্ছিলো তখন অনল প্রশ্ন করে বসে,
– ভালো আছিস ধারা?
অনলের প্রশ্নটি খুব কঠিন কোনো প্রশ্ন নয় তবুও কেনো জানে পা আটকে গেলো ধারার। চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিলো, তখন অনল আবার ও বলে উঠে,
– বেশ বড় হয়ে গেছিস, এখন আর তোকে পুচকে মেয়ে লাগে না। কি অদ্ভুত না? পাঁচ বছর আগে কতো ছোট না ছিলি তুই?
– পাঁচ বছর নয়, পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন। আজ পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন পর তুমি আমাকে দেখছো। বড় তো হতে হতো। তোমার কিছু লাগলে আমাকে জানিয়ো।
– এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে?
– না, এড়িয়ে যাবো কেনো?
– তাহলে বললি না যে ভালো আছিস তুই?
– খারাপ তো থাকার কথা নয় আমার। তুমি তো আমাকে ভালো রাখার জন্যই চলে গিয়েছিলে অনল ভাই, আমাকে ফেলে।
শক্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে ধারা। আজ অনলের সামনে এ যেনো অন্য ধারা দাঁড়ানো, যার চোখে শুধুই ক্ষোভের অগ্নি জ্বলজ্বল করছে। ধীর গলায় অনল বলে উঠে,
– আগে তো কখনো ভাই বলতি না।
– আগে সম্পর্কটা অন্য রকম ছিলো, তাই ভাই বলার প্রশ্নই উঠতো না। কিন্তু এখন সম্পর্কটা অন্যরকম, আর তুমি আমার থেকে যথেষ্ট বড় তাই নাম ধরে সম্বোধন করার প্রশ্ন আসছে না। অনেক জার্নি করে এসেছো, আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে ফুপিকে ডিসচার্জ দিবে। সকাল সকাল উঠতে হবে।
– তুই কি ডিভোর্স লেটারটা
– হ্যা, সাবমিট করা হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের কাগজের সম্পর্কটা আর নেই অনল ভাই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
স্মিত হাসির সাথে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ধারা। ধারার প্রতিটি কথা অনলের বুকে ছুরির মতো লেগেছে। সত্যি তো এখন আর সে অনলের কাগজের স্ত্রী নেই। তাদের মধ্য এখন আর স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই। আর ধারার চোখে তার প্রতি কোনো ভালোবাসার ছিটাফোটাও নেই। এটাই তো চেয়েছিলো অনল। তবে আজ এতোটা কষ্ট লাগছে কেনো। বুকটা এতো ফাঁকা ফাঁকা কেনো লাগছে ঠিক যেমন মাহি চলে যাবার সময় লেগেছিলো। তবে কি সেই উনিশ বছরের কিশোরী মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছে সে! হয়তো অনেক আগেই পড়েছিলো, শুধু অনুভব করতে পারে নি। আজ যখন সেই কিশোরী মেয়েটি তার কিশোরী খোলশটি বদলে চব্বিশ বছরের নারী রুপে তার সামনে হাজির হয়েছে তখন সেই সুপ্ত ভালোবাসার প্রতিটি কণা অনল উপলব্ধি করতে পারছে। বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যথাটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এবার সে তার ভালোবাসাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দিবে না। পাঁচ বছর আগের সব কয়টি ভুল সে শুধরে নিবে। যত কাঠখোর পুরানো লাগুক সে আবার ধারার মনে নিজের জন্য ভালোবাসার সূচনা করবে, করতে যে হবেই______
রাত ২টা,
নিজ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ধারা। আঁচলটা নিচে গড়াচ্ছে তার, চুলগুলো বেহায়া বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। আকাশে আজ আবার মেঘ করেছে, তার মনেও আজ পাঁচ বছর পর আজ মেঘ করেছে। লোকটা তার জীবনে আবার ফিরে এসেছে। একটা সময় লোকটাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো সে। কিন্তু সেই ভালোবাসা তাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছে। না জানে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। ফুপুর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। দম বন্ধ লাগতো ধারার, মনে হতো এই বুঝি মরে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হতো সে তো ভালোই আছে ধারাকে ছাড়া। তাহলে ধারার এতো কষ্ট পাবার কি মানে! আজ যখন পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন পর সেই মানুষটাকে আবার চোখের সামনে দেখেছিলো, পা যেন আগাতে চাইছিলো না ধারার; কোথাও পালিয়ে যেতে পারলে হয়তো এই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতো। মানুষটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে, সেই চোখ, সেই চেহারা। শুধু আর এখন সে আঠাশ বছরের যুবক নেই, তেত্রিশ বছরের একজন পুরুষ। বয়সটা তার চেহারাতে যে খুব বুঝা যাচ্ছে তা নয়। তবে সময়টা সত্যি অনেক বেশী কেটে গেছে। এখন আর তার প্রতি ভালোবাসাগুলো মুক্ত নয়। মনের বদ্ধ কুঠিরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে ধারা, আর সেই তালার চাবিটা না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে; যেমন তার কিশোরী মনটা হারিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে রওনা হয় সে।
সকাল ৯টা,
সূর্যের প্রখরতা চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো অনলের, চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়লো সে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে আসতেই চোখ আটকে গেলো তার। ডাইনিং টেবিল থেকে রান্নাঘরের ভেতরটা স্পষ্ট। রান্নাঘরে তখন শাড়ি কোমড়ে গুজে ধারা নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। চুল খোপা করে ঘাড়ের উপরে তোলা, ঘাড় বেয়ে ঘাম ঝড়ছে, অবাদ্ধ চুল গুলো বারংবার তার কপালে পড়ছে এবং সে তা বারংবার কানের নিচে গুজার চেষ্টায় আছে। ধারাকে বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছে অনলের কাছে। এক অজানা আকর্ষণে মনের অজান্তেই ধারার পেছনে এসে দাঁড়ায় অনল। ধারার খেয়াল ই নেই কেউ তাকে এতোটা কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছে। তার ঘাড়ের ঠিক নিচে গাঢ় কালো তিলটি যেন অনলকে পাগলের মতো কাছে টানছে; খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছে অনলের। মনের অজান্তেই যখন তার হাত ধারার ঘাড় স্পর্শ করবে ঠিক তখন……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
কাগজের_তুমি_আমি
৬ষ্ঠ_পর্ব
এক অজানা আকর্ষণে মনের অজান্তেই ধারার পেছনে এসে দাঁড়ায় অনল। ধারার খেয়াল ই নেই কেউ তাকে এতোটা কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছে। তার ঘাড়ের ঠিক নিচে গাঢ় কালো তিলটি যেন অনলকে পাগলের মতো কাছে টানছে; খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছে অনলের। মনের অজান্তেই যখন তার হাত ধারার ঘাড় স্পর্শ করবে ঠিক তখন পেছন থেকে সেলিম সাহেব অনলকে ডেকে উঠেন,
– অনল, আপাকে কখন নিতে যাবা?
সেলিম সাহেবের হঠাৎ ডেকে উঠার কারণে অনল অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হাত সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়,
– এইতো মামা, তোমার মেয়ে খেতে দিলেই একটু পর বের হবো।
অনলের কথা শুনতে পেরে ধারা পেছন ফিরে দেখে, তার ঠিক পেছনে অনল দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে খানিকটা চমকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে অনলকে জিজ্ঞেস করে,
– কিছু লাগবে তোমার?
– উম………পানি, পানি নিতে এসেছিলাম
– পানি টেবিলে রাখা আছে, এখানে তো সরাসরি কলস থেকে খেতে হবে।
– না মানে, জগটা খেয়াল করি নি।
– ঠিক মাঝ বরাবরই তো রাখা ( উকি দিয়ে জগটা খেয়াল করে)
– তোর ইন্টারোগেশন শেষ হলে খেতে দে, ক্ষুধা লেগেছে।
বলেই কোনো রকমে সেখান থেকে কেটে পরে অনল। ধারা আর কথা বাড়ায় নি, কথায় কথা বাড়বে। সেলিম সাহেবের সামনে শুধু শুধু সকালবেলা সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। খাওয়া দাওয়া শেষে তারা বেরিয়ে পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ধারা একেবারে রেডি হয়ে এসেছে, হাসপাতাল থেকে সরাসরি স্কুলে চলে যাবে সে। ধারা এখন একটি স্কুলে ইংলিশ টিচার হিসেবে কার্যরত রয়েছে। বাচ্চাদের পড়াতে বেশ লাগে তার। গ্রাডুয়েশনের পর পর এই চাকুরিটা শুরু করে সে। সুভাসিনী বেগম অসুস্থ থাকায় এতোদিন যেতে পেরে নি, আজ যেহেতু উনি বাসায় চলে আসছেন তাই আবার জয়েন করছে কাজে ধারা।
সকাল ১১টা,
হাসপাতালের কেবিনে গোছগাছ করে নিচ্ছে ধারা, একটু পর সুভাসিনি বেগমকে নিয়ে চলে যাবে বাসায়। আজ সুভাসিনী বেগমের মন খুবই ভালো; এতোদিন পর বাসায় ফিরবেন তিনি। হসপিটালের খাবার, নিয়ম-নীতির মধ্যে বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অনল নার্সের কাছে থেকে আপডেট নিচ্ছিলো তখন ধারার সুভাসিনী বেগমকে বলা কথাটি তার কানে আসে,
– ফুপু, আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছি। বাবা ফরমালিটি গুলো মিটিয়ে আসলে তোমরা বাড়ি চলে যাও। আমি তাহলে আসছি।
– কোথায় যাচ্ছিস তুই?
নার্সের সাথে কথা বলার ফাকেই ধারার কাছে প্রশ্নটি ছুড়ে দেয় অনল। যে মানুষটার বিগত বছর গুলোতে ধারা কি করেছে তাতে মাথা ব্যথা ছিলো না, আজ হুট করেই তার প্রতি এতো কেয়ার দেখে বেশ অবাক হয় ধারা। নিজের কৌতুহল নিজের মধ্যে রেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয়,
– কোথায় আবার, স্কুলে যাবো।
– স্কুলে কি করতে?
– কি অদ্ভুত, পড়তে নিশ্চয়ই যাবো না। আমি কাজ করি সেখানে।
– হ্যা, অনল তোকে বলা হয় নি, আমাদের ধারা একটা ভালো স্কুলে শিক্ষকতা করে। খুব ভালো পড়ায় ও। (সুভাসিনী বেগম)
– ওহ, তাহলে ওয়েট কর আমি মাকে বাসায় রেখে তোকে ড্রপ করে আসবোনে।
– তার কোনো দরকার নেই, আমি একা একা যাওয়া আসা করতে পারি। ডোন্ট ওয়ারি
– আসবি কখন?
– ছুটি হলে, সাধারণত ৬টা বেজে যায়।
– এড্রেস ম্যাজেস করে দিস, আমি নিতে যাবো নে।
– আরে আজিব তো, আমি একা একা যাতায়াত করতে পারি। বাচ্চা মেয়ে না আমি। এতোদিন একা একা ই আসা যাওয়া করেছি।
– এতো বেশি বকিস কেনো? যা বলছি তাই করবে। আমি যাবো ব্যাস যাবো। ছুটি হলে ম্যাজেস করে দিবি।
রাগে কটমট করতে করতে কথা গুলো অনল বললো। আসার পর থেকে সবকিছুতে মেয়েটা এতো বাড়াবাড়ি করছে যা তার ভালো লাগছে না। এক রত্তি মেয়ের এত তেজ দেখে খুব রাগ লাগছে অনলের। এদিকে অনলের অভারকেয়ারিং ন্যাচার যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ধারার। বিয়ের পর থকে অনলের এক রকম গা ছাড়া স্বভাব ছিলো ধারার প্রতি কিন্তু হুট করেই ধারার প্রতি কেয়ার গুলো যেনো একেবারেই নিতে পারছে না ধারা। ফুপুর সামনে কথা না বাড়ানো শ্রেয় মনে হয়েছে তার। হুম বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে সেখান থেকে। ধারা যাওয়ার পর সুভাসিনি বেগম অনলের হাত টেনে ধরে, বসার ইশারা করে তার পাশে। অনল বসলে কোমল স্বরে বলে,
– মেয়েটা অনেক বদলে গেছে রে। সেই ছোট ধারা আর নেই। জেদ বেড়ে গেছে চার-পাঁচ গুন। গতবার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তোদের জীবনের এতোগুলো বছর আমি নষ্ট করে দিয়েছি। ক্ষমা করতে পেরেছিস তো বাবা।
– কি বলছো মা, দোষ তো তোমার ছিলো না। আমার ছিলো। মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে বাস্তব জ্ঞানটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে এবার আর সেই ভুল করছি না মা। তাতে যদি আমার কাটখড় পুড়াতে হয় আমি রাজী। এবার আর তোমার বউ মাকে কোনো কষ্ট পেতে দিব না আমি।
– সব কি আমাদের ইচ্ছেমত হয় অনল? একতা সময় ধারা তোকে পাওয়ার জন্য পাগল ছিলো, সর্বস্ব দিয়ে তোকে ভালোবাসতো কিন্তু এখন! এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে বাবা। আর সবথেকে বড় কথা তোদের ডিভোর্স লেটারটা কোর্টে সাবমিট হয়ে গেছে। হ্যা, তুই দেশে না থাকার কারণে জাজমেন্ট এখনো পেন্ডিং আছে। তাতে কি খুব কিছু যায় আসবে?
– জাজ জাজমেন্ট দেয় নি?
অবাক নয়নে প্রশ্নটি করে অনল। তখন সুভাসিনী বেগম উত্তর দেন,
– না তুই তো জার্মানি ছিলি। কোর্টের হাজিরা না দিলে তো এটার আইনত কোনো ফলাফল কোর্ট দিতে পারবে না। এক প্রকার জেদের বসেই আমি ডিভোর্স লেটারটা সাবমিট করেছিলাম। তারপর কেনো যেনো খুব খারাপ লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো এটা ভুল। তোরা স্বামী স্ত্রী, সম্পর্ক গড়তে বছর লেগে যায়। কিন্তু একটা কালির খোঁচায় মূহুর্তে সেটা ভেঙ্গে যেতে পারে। এজন্য এই পাঁচ বছরে ৭ বার তোদের হাজিরার ডেট পড়েছিলো। আমি তোকে জানাই নি। এটা ভেবে যে ভেঙ্গে ফেললে তো ভেঙেই যাবে। তখন লাখ চাইলেও জোড়া লাগানো যাবে না। আর তোরা অলরেডি আলাদা ছিলি। তাতেই মেয়েটা এতোটা কষ্ট ভোগ করছিলো। আর যদি একবার ডিভোর্সটা হয়ে যায় তাহলে সেটার মাশুল ওই মেয়েটা সারাজীবন দিবে। আমি চাইছিলাম তুই ওর গুরুত্বটা বুঝিস। তাই তোর থেকে ওকে আলাদা করেছি। আমার ইচ্ছে কোনোদিন তোদের সারাজীবনের জন্য আলাদা করার ছিলো না, তাই তো নানা ইস্যু দেখিয়ে ডিভোর্সটা পিছাচ্ছিলাম। কিন্তু তুই ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়ে চলে গেলি। তাই জেদের বসে আমিও সাবমিট করে দিয়েছিলাম।
– তাহলে আর কোনো ইস্যুই নেই মা।
– উহু, সবচেয়ে বড় ইস্যু ধারা। ওর মধ্যে আমি যে পরিবর্তনটা দেখেছি সেটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু। তোর প্রতি ওর অভিমানগুলো কিন্তু অনেক গভীর, ওর ঘাগুলো কিন্তু অনেক তাজা। তোর অন্যায়গুলো ও কি আদৌ ক্ষমা করতে পারবে? এতো বছরের জমানো কষ্টগুলো যেগুলো না জানে কত রাতের সমষ্টি সেগুলোর ভার কি তুই নিতে পারবি? পারবি ওর মনে নিজের জায়গা করে নিতে? কারণ সেটা না হলে কিন্তু ও চাইলেই আবার এপ্লিকেশন করে কোর্টে তোদের ফাইলটা তুলতে পারে। তখন তুই হাজিরা দিতে বাধ্য হবি। আর তখন কিন্তু আমাদের হাতে কিচ্ছু থাকবে না।
– মা, আমার যে পারতেই হবে। তোমার ছেলেটা যে আবার ভালোবাসতে শিখেছে। তার তালাবদ্ধ অনুভূতিগুলো যে ডানা মিলতে চাচ্ছে। আমার মনের বদ্ধ কুঠিরে ধীর পায়ে এসে মেয়েটা এতো জোরে আলোরণ সৃষ্টি করেছে যে এখন আমি আমার মনের বদ্ধ কুঠির খুলতে বাদ্ধ হয়েছি। এবার যদি ওকে হারিয়ে ফেলি বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলবো।
অনলের গলা ধরে এসেছে। সুভাসিনী বেগম কাঁদছেন, এটা যে খুশির কান্না। অবশেষে তার পাগল ছেলেটার একটা গতি হয়েছে। এবার হয়তো ধারার এতো বছরের কষ্টের অবসান হবে।
বিকাল ৫.৩০টা,
ধারার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনল। উদ্দেশ্য ধারাকে আজ একাকিত্ব সময় কাটাবে সে। বিয়ের পর থেকে কোনোদিন ধারাকে নিয়ে এক মূহুর্তের জন্য ও ঘুরতে যাওয়া হয় নি তার। আজ সেই সবগুলো কাজ করবে যা আগে কখনোই করে নি সে। কিন্তু যার জন্য এতো প্লান তার ই খবর নেই। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনল। হঠাৎ খেয়াল করলো মেইন গেট থেকে ধারা বের হচ্ছে। কিন্তু পর মূহুর্তে এমন কিছু দেখলো যা দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না অনল। ধারা ……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি