কনে বদল পার্ট – ৩

কনে বদল
পার্ট – ৩
Taslima Munni

গভীর রাতে গোঙানির শব্দে মাহিরের ঘুম ভাঙে।প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি কিসের শব্দ। ঘুম একটু কাটতেই বুঝতে পারলো শব্দটা নিচে থেকে আসছে।
মাহির উঠে বসলো।
লাইট অন করার পর দেখলো শিখা কাঁপছে।
গায়ে কাঁপুনি দেয়ার মতো শীত নেই, তবুও মেয়েটা কাঁপছে!
মাহির ভাবলো হয়তো জ্বর এসেছে। কাছে গিয়ে দেখবে কি দেখবে না….
অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত গিয়ে কপালে হাত রেখে দেখে অনেক জ্বর মেয়েটার গায়ে। এ অবস্থায় নিচে শুয়ে থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু…
এইযে শুনছো?…. এই মেয়ে..
আস্তে করে ধাক্কা দিলো।কিন্তু শিখা কোনো সাড়া দিলো না।

মাহির শিখাকে মেনে নিতে পারেনি ঠিক। কিন্তু এভাবে জ্বরের মধ্যে একটা মানুষকে নিচে ফেলার রাখার মতো অমানুষ নয়।।
শিখাকে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো।

পরদিন সকালে মাহির ইভাকে গিয়ে বললো
– ভাবি,শিখার অনেক জ্বর। তুমি ওকে খায়িয়ে দিও।
– ওর গায়ে তো জ্বর ছিলোই।এখন মনে হয় আরও বেড়ে গেছে।
– হুম।
মাহির চলে গেলো।

মাহির ঔষধের প্যাকেটটা এনে শিখার সামনে দিয়ে বললো
– এখানে ঔষধ আছে। খেয়ে নিও।
মাহিরের এই সামান্য কথায় শিখা অনেক খুশি হলো। এতটুকু চিন্তা করেছে ওর জন্য এটাই তো অনেক!!
কিছু দিনের মধ্যে শিখা সুস্থ হয়ে উঠলো।

সারোয়ার সাহেব বলার পরেও শিখা ওর মাকে ফোন করেনি।হঠাৎ কি মনে করে ওর মাকে ফোন করলো।
– হ্যালো… মা।
– শিখা!! তুই কেমন আছিস? এতো দিন হয়ে গেছে একটা ফোন করিসনি! তুই ভালো আছিস তো মা?
– এতো কিছু জেনে কি করবে?
তোমার কাঁধের বোঝা নেমে গেছে! এটাতেই খুশি থাকো না।
– এভাবে বলছিস কেন? তুই তো জানিস..
– জানি বলেই তো বললাম। তোমার ঘরে বয়স্ক একটা মেয়ে ছিলো, তার বিয়ে দিতে পারছিলেনা। ঠকিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামিয়েছ।আপদ বিদায় হয়েছে। আর তো চিন্তার কিছু নেই!!
– মা রে… তুই আমার দুঃখ টা বুঝলি না?
কাঁদতে কাঁদতে শিখার মা বললো।
– রোজ রোজ তোর এত অপমান আমি আর কত সহ্য করতাম??
– আর তো সহ্য করতে হবে না
শুনো মা, আমাকে আর ফোন দিও না। এখানে সবাই খুব ভালো মানুষ। এতো কিছুর পরেও তোমার মেয়েকে বাড়িতে যায়গা দিয়েছে। কিন্তু তোমাদের উনারা সহ্য করতে পারেন না। তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখি সেটা উনাদের পছন্দ না।
– ঠিক আছে। তুই যদি ভালো থাকিস তাহলে যোগাযোগ করবো না। তবুও আমার মেয়েটা একটু সুখ পাক।
– শশীকে বলে দিও আমি ভালো আছি।
– কথা বলবি শশীর সাথে? নে কথা বল।
– না বলবো না। যোগাযোগ যেন না করো সেটা জানাতে ফোন করেছি।আর আমার শ্বশুরকেও ফোন দিবে না।
রাখলাম।
বলেই ফোন রেখে দিলো শিখা।
মাকে এতো কড়া ভাষায় কথা বলে, এতো খারাপ ব্যবহার করেও শিখার ভাবলেশহীন। যেন কিছুই হয়নি!!

শিখা বয়সে মাহিরের থেকে দুই-তিন বছরের বড়। তার উপর মাহিরের পাশে বড্ড বেমানান। শিখার সেই রূপ নেই যা দিয়ে স্বামীর মন ভুলাবে! সাধারণের থেকে সাধারণ চেহারার মাঝে যেন বয়সের ছাপটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
মাহির কোনো ভাবেই এটা মেনে নিতে পারছেনা।
শিখার ব্যবহারে মন নরম হলেও শিখার মুখের দিকে তাকালে যেন মাহিরের মন বিষিয়ে যায়।
শিখা মাহিরের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। সেই কাঁটা না গিলতে পারছে না বের করতে পারছে।
ওর জীবন বিষিয়ে গেছে। শিখাকে নিজের স্ত্রী বলে কারো সামনে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে।

মাহিরের বিয়ের পরে যখন ওর বোনদের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে শুনলো,মাহির রীতিমতো পালিয়ে থাকলো। কারণ ওর পক্ষে শিখাকে বউ বলে পরিচয় দেয়া সম্ভব না।
দুনিয়া সুন্দরের পূজারী। সুন্দর চেহারার আড়ালে কুৎসিত, বিকৃত মন থাকলেও সুন্দরের দোহাই দিয়ে পাড় পেয়ে যায়!
আর কুৎসিত একটা চেহারার আড়ালে সুন্দর একটা মন থাকলেও সেটা অযত্নে, অবহেলায়, অপমানে রোজ রোজ নরকের যন্ত্রণা সহ্য করে।

মাহির আর শিখার বিয়ে হয়েছে অনেক দিন হয়ে গেছে। মাহিরের বাবা জোর করে শিখাকে এই বাড়িতে রাখলেও মাহির যে মেনে নিতে পারেনি সেটা উনি জানেন।
তিনি একদিন ইভাকে বললেন
– মাহির বোধহয় বিয়েটা এখনো মেনে নিতে পারেনি।।
– আসলে বাবা… মাহিরের পক্ষে কি এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া সম্ভব? ওর যায়গা থেকে চিন্তা করে দেখুন।আমরা তো মেনে নিয়েছি। মাহিরও ঠিক মেনে নিবে।আরও কিছু দিন সময় দিন।
আপনি চিন্তা করবেনা না।
– হুমম।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাহিরের বাবা।

মাহিরের অফিসের একটা ট্রেনিং এর জন্য ৩ মাস ঢাকায় থাকতে হবে। এটা জেনে মাহির অনেক খুশি হলো। কিছু দিন সে এই বাড়ির বাইরে থেকে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
এই খবর বাড়িতে জানার পরেও সারোয়ার সাহেব মনে মনে বুদ্ধি করলেন, এই সুযোগ। মাহির আর শিখা নিজেদের মতো কিছু দিন থাকুক এই বাড়ির বাইরে। এতে হয়তো মাহিরের মন গলবে। তিনি মাহিরকে বললেন
– যাচ্ছো যে থাকবে কোথায়? অফিসের কোনো ব্যবস্থা আছে?
– হা বাবা।উনারা সব ব্যবস্থা করে দিবেন।
– হুম। ওখানেই থাকতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি?
– না,তা নেই।অনেকেই বাইরে থাকবে। যার ইচ্ছে সেখানে থাকবে।
– তাহলে তো ভালো ই হয়েছে। তুমি তিন মাসের জন্য একটা বাসা ভাড়া করে নাও।
– বাসা ভাড়া করে কি করবো? আমি তো সেখানেই থাকতে পারবো।
– না পারবে না। কারণ শিখাও যাবে তোমার সাথে।
-বাবা.. আমি তো বেড়াতে যাচ্ছি না।
– সেটা জানি। কিন্তু বাসা থেকে গিয়ে ট্রেনিং করতে পারবে না এমন তো কোনো কথা নেই।
খোঁজ নিয়ে আগে বাসার ব্যবস্থা করো।
তাছাড়া কি খাবে না খাবে তার ঠিক নেই।শিখা তোমার সাথেই যাবে।
– আচ্ছা, ঠিক আছে।

মাহির মুখকালো করে বেরিয়ে ওর মার কাছে গিয়ে বলে
– মা….
বাবা কি শুরু করেছেন এসব? সব কিছু কি জোর করে চাপিয়ে দিতে চান আমার উপর?
সারোয়ার সাহেব মাহিরের পিছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছেন সেটা মাহির বুঝতে পারেনি।
– তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছিনা। যাতে তুমি মানিয়ে নিতে পারো সেই চেষ্টা করছি।।

মাহির পিছনে ফিরে ওর বাবাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো।
– বসো মাহির। আজ তোমাকে একটা গল্প বলি।

একটা ছেলে ছিলো। সে পড়াশোনায় খুব ভালো। অনেক আগ্রহ ছিলো পড়ার। স্কুলের স্যার মেডাম বলতেন, ” ছেলে টা অনেক মেধাবী,জীবনে অনেক বড় হবে। ”
কিন্তু ছেলে টা এতো গরীব ছিলো যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার তৌফিক ছিলো না।
অনেক কষ্টে দশম শ্রেণি অবধি পড়ার পরে ছেলেটার পড়া বন্ধ হয়ে যাবে প্রায়,এমন অবস্থা। কারণ সামনে মেট্রিক পরীক্ষা।কিন্তু ফরম পূরণ করার জন্য অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন। ছেলেটার বাবা দিন মজুরের কাজ করতো।
এতো গুলো টাকা জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। অনেক যায়গায় হাত পাতলো । কিন্তু খুব সামান্য কিছু টাকা ধার পেলো। কারণ দিন মুজুরকে কেউ সহজে ধার দেয় না, দিলেও খুব সামান্য।
ফরম পূরণ করার শেষ দিন ছেলেটা বসে বসে কাঁদছে। কারণ তার পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। কষ্টে তার বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো।

তখন ছেলেটার এলাকার এক বড় ভাই আসলো। সে শহরের কলেজে পড়তো। অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো তার সাথে। বয়সে দুই-তিন বছরের বড় হলেও বন্ধুর মতো। সেই ছেলেটা ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলো। তাদের আবার অবস্থা অনেক ভালো ছিলো।
সে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? ছেলেটা সব বলার পরে বললো
– আয় আমার সাথে।
তারপর নিজে ঘর থেকে টাকা নিয়ে স্কুলে গিয়ে ছেলেটা সব টাকা পরিশোধ করে দিলো। ছেলে টা পরীক্ষা দিলো। সবাই যেমন ভালো ভেবেছিলো, তারচেয়েও অনেক ভালো রেজাল্ট করলো । পত্রিকায় ছবি ছাঁপালো।

তারপর শহরের কলেজে সেই ভাই তাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি।নিজের পড়াশোনার খরচ ছেলেটা নিজেই টিউশনি করে জোগাড় করে।।
পড়াশোনা শেষ করে অনেক বড় একটা চাকরি করে।

কিন্তু সেই যে দুই হাজার টাকা ছেলেটার প্রয়োজন ছিলো, সেটা না পেলে ছেলেটা হয়তো দিন মুজুরের কাজই করতো।

সেই দুই হাজার টাকা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই জন্যই আজ এই বাড়ি! এতো আরাম আয়েশ! তোমাদের সব চাহিদা অনুযায়ী পেয়েছো। লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করছো।সম্মানের জীবন কাটাচ্ছো।

সেই দুই হাজার টাকা যদি না থাকতো তবে আজ তোমরা সারোয়ার সাহেবের ছেলের পরিচয় না, কামলা সারোয়ারের পুত পরিচয়ে বাঁচতা!!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here