#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৯,১০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
জুঁইকে নিজের করে নেয়ার পূর্ণ বাসনা চেপেছে নাফিসের মনে । জুঁইকে দেয়া সব কষ্টের অবসান ঘটাতে এক পা এগিয়ে দিয়ে জীবনকে আবার আরেকটা সুযোগ দিতে চায় নাফিস । ইফসির মাথার উপর থেকে এতিম নামক শব্দটা ঘুচিয়ে দিতে চায় সে । এই কচি বয়সের জুঁইয়ের অঙ্গের সাথে লেপ্টে থাকা সাদা শাড়িকে রঙিন শাড়িতে বদলে দিয়ে জুঁইয়ের পাশে দাড়াতে চায় নাফিস ।
এইসব ভাবতে ভাবতে সিগারেট শেষ করেছে প্রায় ১০ টার মত । এমন সময় শান্তা নাফিসের রুমে প্রবেশ করে । রুমে এসেই সিগারেটের ধোঁয়া আর গন্ধে বুঝে গেছে সিগারেটের সাথে তার ভাইয়ের অন্তর পুড়ছে । কাছে গিয়ে বসে শান্তা । ভাইয়ের খুব কাছের সে । দুজনের সব টুকু সুখ দুঃখ শেয়ার করে দুজনে মিলে ।
– মনের কষ্টকে সিগারেটের ধোঁয়ায় বিলীন করছিস ভাইয়া ?
বোনের কথায় ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকায় নাফিস । শান্তা পাশে দাঁড়িয়ে আছে । ভাইয়ের হাতটা ধরে বিছানায় ইশারা করে শান্তা ।
– আয় বিছানায় বস ,
– হু
– কি হয়েছে বল তো ? আজকে কয়েকদিন যাবত একদম চুপ হয়ে গেছিস যে ?
– আমি কি আগেও কথা বলতাম , চুপ তো আমি সেদিনই হয়ে গেছিলাম যেদিন কাদম্বরীকে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছিলাম ।
– গত তিনটা বছরে তোকে হাসতে দেখি নি আমি ।
– সে চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার হাসি টাও নিয়ে গেছে রে ।
– অনেক কেঁদেছিল সেদিন সে ।
– আমার পা জোড়া ধরে রেখেছিল , খুব ভালোবাসতো আমায় ।
– হু
– মজার কথা কি জানিস ? এখন আমায় ঘেন্না করে খুব ঘেন্না করে । কারণ আমি যে কথা দিয়েও ফিরি নি ।
– মানে ?
তারপর শান্তাকে সব খুলে বলে নাফিস । জুঁইয়ের সাথে দেখা হওয়া , জুঁইয়ের সাথে এক অফিসে জব করা , জুঁইয়ের মেয়ের কথা , জুঁইয়ের বিধবা হয়ে যাওয়া সব কিছুই খুলে বলে সে । সব শুনে শান্তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । এত ভালো একজন মানুষের সাথে এত অঘটন কিভাবে ঘটে যেতে পারে । তাই ভাবছে শান্তা । আপনা আপনি চোখের পানি গুলো বেয়ে পড়ছে তার চোখ থেকে ।
– কাঁদিস না রে , আর কাঁদিস না । দেখিস না আমার কাঁদি না ।
– ভাইয়া ,,,,,,?
শান্তা তার ভাইয়ের চোখে লেগে থাকা চিকচিক পানি গুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । কোন পুরুষ কাঁদতে পারে , তার জানা ছিল না । সে তার ভাইকে আগেও কাঁদতে দেখেছে তবে তা গোপনে । আর আজ তার ভাই তার সামনেই চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে । পুরুষ মানুষ তখনই কাঁদে যখন সে সব থেকে অসহায় হয়ে যায় । আর তার ভাইয়ের অসহায়ত্ব হচ্ছে কাদম্বরী । কলিযুগের কাদম্বরী যাকে তার ভাই ভালোবেসেও বলতে পারে নি । যাকে তার ভাই রাখতে চেয়েও রাখতে পারে নি । কাদম্বরীর সাথে সাথে তার ভাইও হারিয়ে গেছে ।
– কাঁদতে চাস ভাইয়া ? কান্না কর ভাইয়া , কান্না কর । আমার সামনে কেঁদে নে ।
নাফিস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি । দুইহাত মুখে নিয়ে কেঁদে দেয় সে । শান্তার বুক ছিড়ে যাচ্ছে ভাইয়ের এমন দুঃখে । বোন হয়েও তার হাত পা বাঁধা ।
– আমাকে আমার কাদম্বরী এনে দিবি ? এনে দে না প্লিজ , আমার কাদম্বরীকে লাগবে ।
নাফিসের এমন কথায় এইবার মনে হয় রুহটা বেরিয়ে যাবে শান্তার । তবুও অনেক কষ্টে ভাইকে শান্ত করে সে । জুঁইয়ের বাসার ঠিকানা নেয় শান্তা । এক ফাঁক করে একদিন দেখা করে আসবে সে । হয়তো কোন এক নতুন কিছু সূচনার পথে পা বাড়াবে সে নিজেও ।
অন্যান্য দিনের মত আজকেও জুঁইকে অফিস করতে হচ্ছে । ক্লান্ত শরীর আর ব্যর্থ মন নিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে নিজের সাথে , লড়াই করতে হচ্ছে পরিস্থিতির সাথে । তার আর এই জীবনে সুখের মুখ দেখা হবে বলে তার মনে হচ্ছে না ।
ইফসি পাশে বসে খেলা করছে । কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার করে মেয়েকেও দেখা লাগে তার । সব দিকেই নজর রাখতে হয় জুঁইকে ।
অফিস টাইমে পিওন এসে দরজায় নক করে ,
– ম্যাডাম আসবো ?
– জ্বি আসুন ,
– ম্যাডাম বিকেল ৪ টায় মিটিং আছে ?
– আজ বিকেলে ?
– জ্বি , স্যার বললেন জানাতে আপনাদের ,
– আচ্ছা ।
– জ্বি ,
– রহমান ভাই ,,,,,,,?
– জ্বি ম্যাডাম ,
– ইফসিকে নিয়ে একটু বাহিরে যেতে পারবেন ? মানে কেবিনের বাহিরে আর কি । তখন থেকে যেতে চাচ্ছিলো ।
– এইটা আবার বলতে , আসো ইফসি আম্মু ,,,
পিওন রহমান এর কথায় ফিক করে হেসে দেয় ইফসি । ঝুটি নাড়িয়ে মায়ের দিকে বলে ,
– আমি তাই(যাই) আমি তাই (যাই)
– আচ্ছা আম্মুন যাও । কাউকে জ্বালিও না , কেমন ?
পিওন রহমান রুমের মধ্যে এসে ইফসিকে কোলে করে রুমের বাহিরে নিয়ে যায় । আর এই ফাঁকে জুঁই বাকি ফাইল গুলোর কাজ করা শুরু করে দেয় ।
অন্যদিকে , নাফিস তার রুমে কিছু ফাইল নিয়ে ব্যস্ত । বস মাহবুব সাহেব নাফিসের উপরে কিছু দায়িত্ব দিয়েছে যার পুরো দায়িত্বটাই তাকে যথার্থভাবে পালন করতে হবে । তা নিয়ে খুব ব্যস্ত সে । নাফিসের একটা দিন প্রশংসা করার মত । সে তার ব্যাক্তিগত দিক আর প্রফেশনাল দিক সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা করে রাখে । ব্যাক্তিগত জীবনে যা কিছুই হয়ে যাক না কেন প্রফেশনাল সময়ে সে সব সময় স্ট্রং থাকতে পারে ।
এদিকে ইফসি পুরো অফিস জুড়ে খেলছে দৌড়াচ্ছে । এর ডেস্কে যায় তো তার ডেস্কে যায় । অফিসের সবাই ইফসিকে খুব আদর করে । রীতিমত এখানে সবার নয়নের মনি সে । এর কলম ধরে তো তার পি সি তে প্রেস করে । কেউ বিরক্ত হয় না বরং আনন্দিত হয় । তাদের মধ্যে একজন আছে মোহি নামের এক ভদ্রমহিলা । তিনি ইফসিকে ডাক দেয় ,
– ইফসি ,,,,,, মাম্মাম এইদিকে আসো তো ?
ইফসি দৌড়ে তার কাছে চলে যায় । সবাই তাকিয়ে থাকে ইফসির দিকে । মোহি ইফসিকে কোলে তুলে নিয়ে বসায় ।
– মাম্মাম এই ড্রেসটা কে দিয়েছে ?
– আম্মুন আম্মুন ,
– তাই ?
– হু ,
– ইফসি সোনা একটু নাচো তো । আমরা সবাই তোমার নাচ দেখি ।
ইফসি নাচতে পারে না । এইটুকুন বাচ্চা আর কিই বা নাচবে৷। তবে গান তার খুব পছন্দের । কারণ জুঁই সব সময় রবীন্দ্রসংগীত শুনে । আর ইফসিও মায়ের সাথে শুনতে শুনতে সেই সব গান পছন্দ করে ফেলেছে । গান শুনলে সে হাত পা নাচায় এটাই সবার কাছে নাচ হয়ে গেছে । ইফসি এমন এক বাচ্চা যাকে দেখলে শয়তানেরও মায়া লেগে যাবে । আর এখানে তো সবাই মানুষ । তারপর মোহি তার মোবাইলে আমারও পরাণ যাহা চায়া গানটা চালিয়ে দেয় আর ইফসি তার হাত পা গুলো নাচাতে থাকে আর খিল খিল করে হাসতে থাকে । ইফসির সাথে অফিসের বাকি স্টাফরাও হাসছে । এমন সময় মাহবুব সাহেব আর নাফিস তাদের কেবিন থেকে বেরিয়ে তাকিয়ে ইফসিকে দেখছে । তারাও হাসছে ইফসির সাথে । নাফিস মুগ্ধ নয়নে দেখছে ইফসিকে । যেন ছোট কাদম্বরীকে দেখছে সে । এরই মধ্যে ইফসি নাফিসকে দেখে ফেলে । তারপর দৌড়ে নাফিসের কোলে উঠে যায় । আর নাফিসও কোলে তুলে নিয়ে গালে চোখে কপালে চুমু দিতে থাকে । আর ইফসিও নাফিসের গলা জড়িয়ে ধরে হাসে । অফিসের সবার চোখে এই জিনিসটা সহজেই লেগে যায় । নাফিসের অবশ্য ওইদিকে নজর নেই । এরই মাঝে মোহি বলে উঠে ,
– মনে হচ্ছে যেন , এরা বাবা আর মেয়ে । আমাদের ইফসি মাম্মাম কিভাবে নাফিস স্যারের আদর খাচ্ছে ।
এই কথা শুনে কয়েক মিনিটের জন্যে স্তব্ধ হয়ে যায় নাফিস । মোহি হয়তো ঘুরিয়ে বললেও কথাটা মন্দ বলে নি । নাফিস মন থেকে ইফসিকে কেন জানি নিজের সন্তান ভেবে নিয়েছে । খুব আদর করতে মন চায় তার ইফসিকে । ইফসিকে নিজের কোলে নিলে কেমন একটা অনুভূতি জাগে নাফিসের মনে । এ যেন এক পিতৃস্নেহের অনুভূতি ।
বিকেল ৪ টা ,
মিটিং রুমে সবাই বসে আছে । মাহবুব সাহেব এসে সবার সামনে বসে যায় ।
– আপনাদের সবার সাথে আমার কিছু কথা আছে ।
তখন নাফিস বলে ওঠে ,
– জ্বি স্যার বলুন ,
– দেখুন কোম্পানি আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলছে এখন । তা আপনাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে । এর জন্যে আমি সত্যিই আপনাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ ।
তখন আরেক স্টাফ বলে ওঠে ,
– স্যার অফিসে আসার পর আপনার এই অমায়িক ব্যবহার পেয়ে আমরাও সন্তুষ্ট । অফিস না মনে হয় নিজের বাড়িতেই আছি আমরা ।
– ধন্যবাদ । স্টিল প্রজেক্টটা সাইন হয়ে গেছে ।
শুনেছেন তো সবাই ।
– জ্বি স্যার ,
– সেই উপলক্ষে ছোট খাটো পার্টি রাখা হয়েছে
– তাই নাকি স্যার ,
– জ্বি , আপনারা সকলেই সেখানে আমন্ত্রিত ।
মাহবুব সাহেব দেখলেন যে নাফিস আর জুঁই চুপচাপ বসে আছে । তখন তিনি নিজে থেকেই বললেন ,
– নাদিরা , আপনি কিছু বলুন ?
স্যারের কথা শুনে একটু নড়ে বসে জুঁই ।
– স্যার যেভাবে ভালো হয় ।
– আচ্ছা আর নাফিস সাহেব আপনারও কি একই মত ।
– জ্বি স্যার ।
নাফিসের কথা শুনে জুঁই মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে ফ্লোরের দিকে । নাফিসও চুপচাপ । তখন মাহবুব সাহেব বললেন ,
– বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টায় পার্টি । আমি সবার উপস্থিতি আশা করছি ।
তখন সবাই মিলে বলে ওঠে ,
– ওকে স্যার ।
মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে জুঁই নিজ কেবিনের দিকে পা বাড়ায় । আর তখনই নাফিস তাকে আটকে ধরে ।
– দাড়াও জুঁই ,
– জ্বি স্যার কিছু বলবেন ?
– এতটা ইগনোর করছো আমাকে যে স্যার বলা শুরু করে দিয়েছো ?
– নাফিস এটা অফিস ,
– জানি অফিস , তাই তো নরমাল আছি ।
– আমি বড্ড বেশি অগছালো হয়ে গেছি নাফিস , গুছাতে এসো না । না হয় তুমিও অগছালো হয়ে যাবে । পিছু ডেকো না ।
এই বলে জুঁই চলে যায় । আর নাফিস সেখানে দাঁড়িয়ে রয় । দূর থেকে মোহি সবটাই লক্ষ্য করে । তার মনে এখন অন্য ভাবনার উদয় ঘটেছে ।
.
.
চলবে…………
#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সময় তার সঠিক গতিতে বেয়ে যাচ্ছে । কথায় আছে বয়স এবং কাহারো জন্যে বসে থাকে না । এমনকি কার হায়াত কতটুকু তাও কেউ বলতে পারে না । জীবনটা খুব বেশি বড় নয় । এই অল্প সময়ে জীবনকে উপভোগ করাই উত্তম । কিন্তু কিছু কিছু সময়ে কিছু কিছু জীবন এমন ভাবে শেষ হয়ে যায় যেখানে সব কিছু ঠিক করতেও বহু সময় লেগে যায় । এখানেও ঠিক তেমন । নাফিস এবং জুঁইয়ের সম্পর্কে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি । জীবন যখন নতুন করে জুঁইয়ের দুয়ারে কড়া নাড়তে থাকে তখন জুঁই নিজ হাতে সেই দুয়ারে খিল দিয়ে দিয়েছে কারণ জীবন তাকে ততদিনে বিষিয়ে তুলেছে । সব কিছু এক এক করে হারাতে হারাতে সে জীবনের কাছে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে । এখন আর জীবনকে উপভোগ করতে ইচ্ছে করে না তার । এখন আর ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না তার । তার ধারণা তার ভালোবাসার মাঝে ঘাটতি এতটাই ছিল যে সে তার ভালোবাসাকে পায় নি আর যাকে পরিস্থিতি ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল তাকে সে এই পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারলো না । ভালোবাসা নামক ছোট শব্দটার উপর থেকে বিশ্বাস , ভরসা , চাওয়া-পাওয়া সব শেষ হয়ে গেছে । এখন আর জীবন থেকে কিছুই নেয়ার মত নেই তার ।
অন্যদিকে নাফিস জীবনকে আরও একবার সুযোগ দিয়ে জুঁইকে আপন করে কাছে টেনে নিতে চায় । ইফসিকে আপন করে নিতে চায় । ভালোবাসার ভিক্ষা করতে বার বার উপস্থিত হয় জুঁইয়ের দুয়ারে । আর প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়ে শূন্য এবং ব্যাথিত মনে ফিরে আসতে হয় তাকে । সে জানে এইসব জুঁইয়ের অভিমান । হাজারো অভিযোগ জমা জুঁইয়ের মনে । জুঁইও এখন আর আগের মত নেই , শোক সন্তাপে কষ্ট দুঃখ প্রত্যায়িত হয়ে নিজেই নিজেকে পাথর বানিয়ে ফেলেছে আর এমন ভাবেই পাথর বানিয়েছে যে সেই পাথরে নাফিসের মনের আকুলতার চোখের পানি পড়েও পাথর গলে নাই । প্রতি রাত জুঁইয়ের কেমন কাটে তা নাফিসের জানা নেই তবে প্রতি রাতে নাফিসের কলিজা ফালা ফালা হয় মনের ছুরিতে ।
রাত বাড়ার সাথে সাথে যন্ত্রণা তখন জুঁইয়ের বুকে দ্বিগুণ ভাবে জায়গা করে নেয় । কেন যেন মন বার বার দুর্বল হয়ে যাচ্ছে । কেন জানি নাফিসকে পাওয়ার পূর্ণ বাসনা নিজের মনেও চেপে বসে এক এক বার । শরীরটা যেন একটু হলেও কারো স্পর্শ পেতে চায় । কিন্তু ভাবনার মাঝে মনে পড়ে যায় সেই সব দিনের কথা যে সব দিনে আস্তে আস্তে নাফিস তাকে তার জীবন থেকে দূরে সরে দিয়েছে । অনেক কেঁদেও কূল করতে পারে নি সেদিন জুঁই । অসহায় অবস্থায় দিক বিক না ভেবে ছেলে মানুষের মত নাফিসের দুই পা জড়িয়ে বসে পড়েছিল সে । এইসব ভাবতে গিয়ে বুকের ব্যাথা গাঢ় হয়ে যায় তার । মেয়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায় জুঁই । ভাবতে থাকে পার্কের সেই রুদ্ধশ্বাস করা এক ঘন্টার কথা । প্রায় ৫০+ বার ফোন দেয়ার পর নাফিস সেদিন ফোন রিসিভ করে ।
– আসসালামু আলাইকুম ,
– এত ফোন কেন দেও ?
– একবার দেখা করো না প্লিজ ।
– কেন ?
– কেন কি নাফিস । এমন করতেছো কেন আমার সাথে । আমার অপরাধ কোথায় নাফিস ।
– আমার ভালো লাগে না ।
– কি ভালো লাগে না ?
– রাখছি , আর ফোন দিও না ।
– বাসা থেকে বিয়ের জন্যে প্রেশার দিচ্ছে নাফিস ।
– বিয়ে করে নেও ,
– মানে কি নাফিস ?
– কিছুই না ।
– নাফিস প্লিজ একবার শুধু একবার দেখা করো ।
– নাহ ,
– আল্লাহর দোহাই লাগে নাফিস । শুধু একবার দেখা করো , প্লিজ নাফিস ।
– ঠিকাছে ৪ টায় আসো ।
– ধন্যবাদ নাফিস অনেজ অনেক ধন্যবাদ ।
নাফিস বিরক্ত হয়ে লাইনটা কেটে দেয় । অন্যদিকে চারদিক থেকে চাপ আসতে থাকা অসহায় মেয়েটা (জুঁই) কিছুটা সময়ের জন্যে একটু শান্তি পেয়েছিল । নাফিসের প্রিয় রঙ হলুদ রঙের শাড়ি পরে সেদিন পার্কে গিয়েছিল
জুঁই । শুধু একটু ভরসা আর বিশ্বাস নিয়ে যে তাকে তার ভালোবাসা কখনও ধোকা দিবে না । সেদিন বিকেলে প্রায় আধা ঘণ্টা পর নাফিস আছে । একদম ভাঙাচোরা অবস্থা তার ।
সেদিন খুব অসহায় ছিল নাফিস অসহায় ছিল
জুঁই । অসহায় ছিল তাদের সময় । ভয়াবহ এক পরিস্থিতি চলছে তখন তাদের মাঝে । এক দৃষ্টিতে প্রায় অনেক্ষন নাফিসে দিকে চেয়ে আছে জুঁই । নাফিসকে কেন জানি অপরাধী মনে হচ্ছিলো সেদিন । সাধারণত নাফিস কখনো মাথা নিচু করে না কিন্তু সেদিন তার মাথা নিচু ছিল । সেদিন তার চোখ জুঁইয়ের দিকে ছিল না ছিল মাটির দিকে ।
– নাফিস এইদিকে দেখো ?
– বলো ,
– আমার দিকে তাকাও ?
– বলো শুনছি , কি বলবে ?
– নাফিস দেখো আজকে হলুদ শাড়ি পরেছি ।
– ভালো করেছো ।
– নাফিস চলো না বিয়ে করে ফেলি ?
– সম্ভব না ।
– কেন সম্ভব না ?
– আমার পরিবার আছে , মা বাবা দুইটা অবিবাহিতা বোন আছে ।
– নাফিস আমি তো বলি নি তাদের ছাড়তে হবে । আমায় সাথে নিয়ে কি চলা যাবে না ?
– নাহ ?
– এমন টাই যদি করবে তাহলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলে কেন ?
– জড়ালেই বিয়ে করতে হয় না ।
– তাই ?
– হয়তো ।
নাফিসের কথা গুলো তীরের মত বিধছে জুঁইয়ের বুকে । পার্কের এই দিকটা নির্জন , জুঁই এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল সেদিন। হুট করেই নাফিসের সামনে এসে বসে পড়ে মাটিতে । দুই হাত দিয়ে নাফিসের গাল গুলো ধরে ।
– নাফিস , এই নাফিস তোমার কাদম্বরীর খুব কষ্ট হচ্ছে ।
– কষ্টকে কাবু করতে শিখো ।
– নাফিস আই লাভ ইউ ,
– ভুলে যাও আমায় জুঁই ।
– আমি তোমাকে চাই নাফিস ,
– আমি তোমার হতে পারবো না এখন ।
– বাসায় বিয়ের জন্যে প্রেশার দিচ্ছে নাফিস ,
– বিয়ে করে নেও ।
– এটা কিভাবে বলো তুমি নাফিস ?
-………………………….
নাফিস উঠে চলে যেতে নিলে জুঁই তখন নাফিসের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে । আর বেহায়ার মত কেঁদে দেয় ।
– এই নাফিস প্লিজ যেও না । প্লিজ নাফিস আমি বাঁচবো না , যেও না প্লিজ ।
– জুঁই পা ছাড়ো । কি করছো এখানে তুমি ?
– নাফিস আমি না খেয়ে থাকবো , প্রয়োজন হলে আমি মেঝেতে থেকেও যাবো শুধু বিয়ে করে নেও আমায় । প্লিজ নাফিস ।
– আমি তোমাকে কিভাবে বিয়ে করবো ? হ্যাঁ , কিভাবে বিয়ে করবো । আমি তোমাকে ভালোবাসি তা ঠিক কিন্তু আমার দায়িত্ব থেকে কিভাবে সরে যাবো ?
– বিয়ে করলে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া হয় বুঝি ?
– হ্যাঁ হয় ।
– নাফিস কেন এমন করতেছো ?
– জুঁই বাসায় যাও , ওকে ?
– নাফিস দাড়াও , তাহলে আমার সাথে একদিন থাকো ।
সেদিন ভালোবাসার মোহে এতটাই পাগল ছিল
জুঁই যে নিজেকে বিকিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিল সে । সেদিন পাগল এবং অবুঝের মত কিছু চেয়ে বসেছিল সে নাফিসের কাছে ।
– এই নাফিস , একটা রাত আমায় দিবে ? আমি তোমার সাথে থাকতে চাই ।
– মাথা ঠিকাছে তোমার ?
– হ্যাঁ ঠিকাছে আমার মাথা ।
– নাহ ঠিক নেই , কি সব বলছো ।
– আমি চাই আমায় যদি কেউ ছোয় তাহলে প্রথম তুমিই ছুবে । নাফিস আমায় একটা রাত দেবে ।
– স্যাট আপ , যাও বাসায় যাও ।
– নাফিস,,,,,,,,,,,,,,,,?
– হ্যাঁ , নাফিস । আমি নাফিস বলছি তোমাকে , যাও বাসায় । আর কখনো আসবে না আমার সামনে । বিয়ে করে নেও পরিবারের সবার পছন্দে । আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না । আমার অনেক দায়িত্ব ।
এই বলে সেদিন পার্কে জুঁইকে একা ফেলে চলে যায় নাফিস । আর জুঁই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ।
– এত কিছুর পরেও নাফিস তুমি চলে গেলে আমায় ছেড়ে । এর জন্যউ কি এত ভালোবেসে ছিলাম তোমাকে । দায়িত্বের অজুহাতে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারলে তুমি ?
সেদিন পার্কে শুধু জুঁইয়ের বুকটা ফালা ফালা হয় নি তার সাথে নাফিসিও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল । পার্কের গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দুচোখ ভর্তি পানি নিয়ে বের হয় নাফিস ।
ফোনের আওয়াজে তিন বছর আগের এক ভয়াবহ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে
জুঁই । ঘড়িতে চেয়ে দেখে রাত ৩ টা । এত রাতে কে ফোন দিচ্ছে । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে একটা অচেনা নাম্বার । সম্পূর্ণ অপরিচিত নাম্বার । অপরিচিত এয়ারটেল নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থেকে মোবাইলের রিসিভ অপশন টা ক্লিক করে জুঁই ।
– আসসালামু আলাইকুম , কে বলছেন ?
ওপাশ থেকে শুধুই নিরবতা ভেসে আসছে । তার কিছুক্ষণ পর জুঁই আবারও বলে উঠে ,
– হ্যালো , কে বলছেন আপনি ?
তখন জবাবের পরিবর্তে শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে ফোনের ওপাশ থেকে । দীর্ঘশ্বাসটা এতটাই পরিচিত ছিল যে ওপাশের মানুষটা কে তা আর বুঝতে বাকি ছিলো না জুঁইয়ের ।
– নাফিস,,,,,? এত রাতে ফোন দিয়েছো যে ?
নাম্বার পেলে কোথায় ?
জুঁই যে এইভাবে তাকে চিনে ফেলবে নাফিস বুঝতে পারে নি । একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে সেই মানুষের একটা দীর্ঘশ্বাসে চিনে ফেলতে পারে । ভালোবাসার পরীক্ষায় জুঁই জিপিএ প্রাপ্ত প্রেমিকা আর সেই একই পরীক্ষায় অউত্তীর্ণ প্রেমিক । নিরবতা ভেঙে তখন নাফিসও উদগ্রীব হয়ে যায় ।
– কেমন আছো তুমি ?
– ভালো থাকার জন্যে যাকে দূরে ঠেলে দেয়া হয় সে কি করে খারাপ থাকে । আমি ভালোই আছি ।
– ওহ ,,
– কেন ফোন দিলে ?
– ইফসি কেমন আছে ?
– ভালোই আছে ।
– কাল আসবে তো ?
– এটা বলার জন্যে রাত ৩ টায় ফোন দিলে ?
-…………………………..
– যে রাস্তা নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছিলে সেই রাস্তায় আজ আবার ফিরতে চাচ্ছো কেন নাফিস ? আর ফিরতে চাচ্ছো কোন সময়ে যেই সময়ে আমি বিধবা , আমার একটা দেড় বছরের মেয়ে আছে ।
– কাদম্বরী ,,,,,,,,?
– আমি তোমার কাদম্বরী নই নাফিস । আমি ইফসির মা । এটাই এখন আমার পরিচয় ।
– অভিমান যদি থেকে থাকে তাহলে বলো ?
– না আছে অভিমান , না আছে রাগ কিংবা অনুযোগ । আমার রাজ্যে আমি একাই বর্বর ।
– আমি কি সারাজীবনের জন্যে তোমার কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম জুঁই ?
– সেদিন আমি কি অপরাধ করেছিলাম ? কোন অপরাধের শাস্তি দিয়েছো আমায় । সব কিছুকে এক সাইডে রেখে সেদিন আমিও গিয়েছিলাম তোমার কাছে । ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমায় ।
– সেদিন সত্যিই হাত পা বাঁধা ছিল আমার । চাকরিও ছিল না যে তোমার দায়িত্ব নিতাম ।
– যাক ভালোই হয়েছে , আমিও সরে গেছি চাকরিও হয়ে গেলো । এখন তুমি সাবলীল এবং সুন্দর জীবন কাটাও । আমার শহরে আর পা দিও না , রাখছি । আল্লাহ হাফেজ ।
নাফিসকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে মোবাইলের এয়ারপ্লেন মুড টা অন করে দেয় জুঁই । কারণ জুঁই খুব ভালো মতই জানে নাফিস আবারও ফোন দিবে তাকে । আসলেই নাফিস পরবর্তীতে আবারও ফোন দেয় জুঁইকে । কিন্তু তখন নাম্বার অফ পায় জুঁইয়ের । সিগারেটের আগুনের সাথে নাফিসের মন তখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ১৫ মিনিট হয়ে গেছে । অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু জুঁইয়ের আসার খবর নেই । এদিকে অনুষ্ঠানে সবাই বলাবলি করছিল জুঁই কেন আসে নি সেদিন তো বলেছিল আসবে তাহলে আসে নি কেন । অন্যদিকে নাফিসও অধির আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে জুঁইয়ের জন্যে । প্রায় ১৫ মিনিট পর প্রায় ৭ টা ৩০ মিনিটে জুঁই এসে অনুষ্ঠানে পৌঁছায় ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই তাদের মা মেয়েকে দেখে তাকিয়ে আছে । ইফসিকে একদম পুতুলের মত লাগছিল । হাল্কা পিংক কালারের একটা ফ্লাফি ফ্রক পরা , মাথায় দুটো ঝুটি করা তাও পিংক কালারের রিবোন দিয়ে । ইফসির চোখ গুলো একদম জুঁইয়ের চোখের মত । ইফসির চোখগুলো বড় বড় আর ল্যাশ গুলোও টানা টানা । চোখ গুলো তার মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর । পায়ে পিংক কালারের সু জুতা । একদম পিংক পরীর মত লাগছিল তাকে । মায়ের পাশে মিষ্টি হাসি দিয়ে দুই হাত এক করে দাঁড়িয়ে আছে পাকনি বুড়ি ইফসি রানী । আর জুঁইয়ের তো জবাব নেই । সে জানে সে বিধবা তাই রঙ চং তার পছন্দের নয় । তাই সাদা আর পিংক কালারের হাল্কা কম্বিনেশনে একটা হাফ সিল্প শাড়ি পরেছে সে আর তার ফুল হাতা ব্লাউজ । হাতে এক জোড়া সিটি গোল্ডের চুড়ি । ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক । সব মিলিয়ে সাধারণের মাঝেও নাফিসের কাদম্বরী বরাবরই অসাধারণ ।
অনুষ্ঠানে মাহমুদ সাহেবের স্ত্রী এবং তার দুজন সন্তানও উপস্থিত ছিলেন । সবাই জুঁই এবং ইফসির সাথে আলাপ করে । ইফসি তো ফাঁক পেয়ে দৌড়ে নাফিসের কোলে উঠে যায় । নাফিস যেন ইফসির পরিবর্তে এক পরীকে দেখছে । এত কিউট কোন বাচ্চা হতে পারে । নাফিসের দেখা সব থেকে আদরের বাচ্চা সে ।
– কি হয়েছে বুড়ি ? এত সাজুগুজু কে করিয়ে দিয়েছে ?
নাফিসের কথায় ইফসি চোখ গুলো আরও বড় বড় করে খিল খিল করে হেসে দেয় আর বলে ,
– আম্মুন আম্মুন
ইফসির কথায় খুব শান্ত নজরে নাফিস জুঁইয়ের দিকে তাকায় । আর কথার ছলে জুঁইয়ের নজরও নাফিসের দিকে যায় । নাফিসকে অনেক সুন্দর লাগছিল আজ । একটা ফরমাল পরেছে আজ সে তাও আবার ধূসর কালারের । সব মিলিয়ে অফিসের অবিবাহিতা ফিমেইল স্টাফরা তাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে গেছে । অথচ নাফিসের নজর সবার থেকে একদম আলাদা ভাবে তার কাদম্বরীকেই গ্রাস করছে । যা বুঝতে তার কাদম্বরীরও বেশি সময় লাগে নি ।
.
.
চলবে………..