#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৬,৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
৬
নাস্তার টেবিলে বসে থাকা নাফিসের মন খাবারের দিকে নেই । টেবিলে ভরপুর খাবারে । তিন বছর আগে যেই খাবার যোগার করার অজুহাতে একটা মেয়ের বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা সব কিছুকে পায়ে ঠেলে মেয়েটাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল সে । আজ সেই খাবারের অভাব নেই তার ঘরে । শুধু অভাব তার সেই কাদম্বরীর । যাকে সেও চেয়েছিল এক সময়ে একান্ত আপন ভাবে । কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সব কিছুকে মাটি চাপা দিতে হয়েছিল তাকে । সামনে খাবার রাখা আছে কিন্তু আজ কেন জানি সেই খাবার গুলোও । কিছু কথা আপন মনে অন্তর বলে উঠে ,
– একদিন দায়িত্বের অজুহাত দেখিয়ে জুঁইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম । আর আজ সেই সব দায়িত্ব অনেকটাই সফল হয়ে গেছে শুধু সাথে নেই আমার ভালোবাসার সেই মানুষটা ।
এমন সময় একজন ভদ্রমহিলার ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় ,
– নাফিস ,,,,,,?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই নাফিস ,,,,,,,,,,?
– হুউউউ ,
– কি ব্যাপার , খাচ্ছিস না যে ?
– খাচ্ছি না কোথায় ? খাচ্ছি তো
– কোথায় খাচ্ছিস তুই ?
ভদ্রমহিলা হলেন রেহানা পারভিন সম্পর্কে তিনি নাফিসের মা । তার কথায় নাফিস বিরক্তবোধ করে তবুও দাত মুখ খিটে রয় । এমন সময় একজন ভদ্রলোকও তার পাশে এসে বসে যায় ।
– কিরে বাবা , কি হয়েছে ?
– কোথায় কি হয়েছে ?
– মন খারাপ নাকি ?
– বাবা , আমার মন ভালো নাকি খারাপ সেটার খবর তো আগে কেউ নাও নি আজ কেন ?
ভদ্রলোক আনিস বেপারি সম্পর্কে নাফিসের বাবা তিনি । ছেলের কথায় অভিমানের ছাপ এটা তিনক বেশ বুঝে গেছেন । কিন্তু তিনিও আবদ্ধ তার স্ত্রী রেহানার কাছে । বলতে গেলে ভদ্রমহিলা সবার জীবনটাকে নষ্ট করে রেখে দিয়েছেন । এমন সময় রেহানা পারভিন বলে উঠেন ,
– কি হয়েছে তোর ? এমন করস কেন ?
– কিছুই হয় নি ।
– কিছু না হলেই ভালো । যাই হোক আজকে সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি আসিস । এক জায়গায় যাবো আমরা ।
মায়ের কথায় নাফিস বুঝে যায় যে কোথায় যাওয়ার কথা বলছে তার মা । তাই নাফিসও কড়া স্বরে জবাব দেয় ।
– নেক্সট টাইম এইসব কথা আমার সামনে বলবে না তুমি । এখন আর এইসবের টাইম নেই আমার কাছে ।
– নাফিস ,,,,,,,,?
– চিৎকার করো না , আজকে তোমার জন্যে আমার এই অবস্থা মা । নিজেরা ভালো থাকার জন্যে আমার ভালো থাকাটা কেড়ে নিয়েছো । এখন তো ভালো আছো তাহলে আমাকে আমার অবস্থাতে থাকতে দাও ।
এই বলে নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যায় নাফিস । ভদ্রমহিলা রেহানা পারভিন আনিস বেপারিকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলে ওঠে ,
– ও কি সেইখানেই এখনও আটকে আছে ? যা হবার তা তো হয়েই গেছে । এখন ও-কে বিয়ে করতে হবে ।
– সবটাই তো শেষ করে দিছো , এখন আর বিয়ে বিয়ে করছো কেন ? তখন তো বিয়ের নামেও তোমার আর তোমার মেয়েদের জ্বালা ধরে যেতো ।
– তুমি কথা কম বলো ,
– আমি তো কথা কম-ই বলি । তোমাদের সব অন্যায় দেখেও চুপ করেই আছি ।
আনিস বেপারির কথায় চুপ হয়ে যায় রেহানা পারভিন । মুখ বাকিয়ে উঠে চলে যান তিনি ।
অফিসে বসে এক মনে কাজ করে যাচ্ছে জুঁই । পাশে ইফসি বসা , সে খেলছে । এমন সময় তার টেবিলের ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে । ফোন রিসিভ করতেই ভদ্রলোক মাহবুব হোসেন বলে উঠলেন ,
– নাদিরা একটু রুমে আসুন তো ,,,
– জ্বি স্যার আসছি ,,
মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ছোট্ট ইফসি মাকে ডেকে দেয় ,
– আম্মুন ,,,,,,,,
জুঁইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে ইফসি ইশারায় তার মাকে বুঝাচ্ছে তাকে কোলে তুলে নিতে । ছোট্ট ইফসির এই একটাই আবদার তার মায়ের কাছে । সে শুধু একটু কোলে উঠতে চায় । আর কিছুই আবদার করার নেই তার । জুঁই মেয়ের দিকে হাটু গেড়ে বসে মেয়ের গালে হাত রাখে ,
– আম্মুন , আমি একটু আসছি । যাবো আর আসবো । তুমি একটু থাকো আম্মুন
মায়ের কথায় চুপসে যায় ছোট্ট ইফসি । সে বুঝে যায় তার মায়ের কথা । তাই সে চুপ করে পুতুল গুলো দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে । ইফসিকে বসিয়ে রেখে জুঁই তার বসের রুমে যায় ।
– স্যার আসবো ?
– হ্যাঁ আসুন ,
– জ্বি স্যার বলুন ।
– বসুন ,
মাহবুব হোসেন এর কথায় সামনে থাকা চেয়ারে বসে যায় জুঁই । ভাবছে হঠাৎ এইভাবে ডেকে পাঠালো তাকে ,
– নাদিরা , কিছু কথা বলার আছে ?
– জ্বি স্যার বলুন ,
– নাদিরা গতকাল আমরা একজন নতুন employee নিয়েছি । তিনি এতদিন শাখা অফিসে ছিলেন , গতকালই মেইন অফিসে জয়েন হলেন । গতকাল আপনাকে আর বলা হয় নি তাই আজ বলে দিলাম । এখন থেকে মেইন ফাইল গুলো আগে আপনার কাছে যাবে তারপর তার কাছে সে ফাইল সাইন করে দিলেই তা আমার কাছে আসার এপ্রুভাল পাবে । আমি আশা রাখবো আপনি বুঝতে পেরেছেন ?
– জ্বি স্যার বুঝতে পেরেছি ।
– সো তিনিও আপনার সিনিয়র হিসেবে জয়েন দিয়েছেন এই অফিসে । আপনার কেবিনের ঠিক আগের কেবিনটাই তার । চাইলে দেখা করে আসতে পারেন আপনি ।
– জ্বি স্যার ।
– এইবার আপনি আসতে পারেন ।
– জ্বি স্যার ।
জুঁই কেবিন থেকে বের হয়ে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ায় । মনে মনে ভয় ঢুকে গেছে । সিনিয়র হিসেবে জয়েন করা ভদ্রলোক কেমন হবে কে জানে । তার উপর ফাইলে ত্রুটি ধরতে পারলেই বড় সড় ঝামেলা হয়ে যাবে । সব মিলিয়ে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো এলোপাথাড়ি ছুটাছুটি করছে তার ।
নিজ কেবিনে এসে আরও অবাক হয়ে যায় জুঁই । যেই চেয়ারে সে তার ছোট্ট ইফসিকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সেই চেয়ারটা ফাঁকা । ফাঁকা চেয়ার দেখে জুঁইয়ের কলিজায় পাহাড় নেমে আসে । জুঁইয়ের চোখ থেকে অনায়াসেই পানি গুলো গড়িয়ে পড়ে যায় । সব দিকে শক্ত থাকলেও জুঁই তার ছোট্ট ইফসির জন্যে বড় বেশিই অসহায় । মেয়ের কিছু হলে সে পাগল হয়ে যায় । এইটুকুন একটা মেয়ে ভরা অফিস থেকে কোথায় উধাও হবে ? মুখে হাত দিয়ে চাপা স্বরে কেঁদে দেয় জুঁই । ওয়াসরুম সহ সবটা চেক করে সে এইখানে ইফসি কোথাও নেই । পাগল পাগল লাগছিল জুঁইয়ের নিজেকে । কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না জুঁই । কেবিনের বাহিরে গিয়ে মেইন কোরিডোরে মেয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকে সে । অফিসের বাকি স্টাফরাও জুঁইয়ের এমন ডাকাডাকিতে ইফসিকে খুজতে থাকে । কিন্তু ইফসি কোথাও নেই । দারোয়ানের কথা অনুযায়ী ইফসি অফিসের বাহিরেও যায় নি । তাহলে ইফসি কোথায় যাবে । জুঁই আর নিজেকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে পারে নি । সবার সামনেই মেঝেতে বসে যায় ।
– আম্মুন কোথায় তুমি ? আম্মুন খুজছি তোমায় , চলে আসো আম্মুনের কাছে । ইফসি , আম্মুনের কাছে আসো ।
সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে যায় জুঁই । কয়েকজন ফিমেইল স্টাফ জুঁইকে রিলেক্স করায় । কিন্তু জুঁইকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না । তার মেয়েকে তার এক্ষুনি চাই । পাগল হয়ে মেয়েকে ডাকতে থাকে সে ।
– ইফসি , ইফসি , ইফসি আম্মুন কোথায় তুমি , ইফসি ।
.
.
চলবে…………………
#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর ইফসি আম্মুন বলে ডাক দেয় । ইফসির মুখে আম্মুন ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় জুঁই । ইফসিকে দেখে কলিজায় পানি আসে জুঁইয়ের । মনের মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে যায় তার । জুঁই ইফসিকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ আদর করে ।
– আম্মুন কোথায় চলে গেছিলে ?
– আমি তো তেলি(খেলি)
– কোথায় খেলেছো আম্মুন তুমি ? আম্মুন খুজেছি তো তোমাকে ।
– আমি তেলি(খেলি) আন্তেলের (আংকেলের) সাতে(সাথে)
– কোন আংকেল আম্মুন । তোমাকে না বলেছি অপরিচিত কারো সাথে কোথাও যাবে না । কেন তুমি আম্মুনকে কষ্ট দাও ।
এমন সময় ইফসির পিছনে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ায় । ইফসিকে জড়িয়ে ধরে ভদ্রলোকের দিকে তাকায় জুঁই । ভদ্রলোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে জুঁইয়ের পায়ের নিচ থেকে আরও একবার মাটি সরে যায় । ভদ্রলোকটি আর কেউ নয় , তার জীবন থেকে গত তিন বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই পুরুষটি । নাফিসকে দেখে জুঁই আরও একবার ভড়কে যায় । এই অফিসে এইভাবে নাফিসকে সে আশা করে নি । অফিসের অন্যান্যরা স্টাফরা নাফিসকে দেখে স্যার বলে সম্বোধন করে । তাদের এই সম্বোধন করা দেখে জুঁইয়েরও আর বুঝতে বাকি নেই যে নতুন employee তাহলে নাফিস । এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে । নাফিস এক দৃষ্টিতে তার সেই আগের কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । নাফিসের দৃষ্টি বরাবরই শান্ত আর তীক্ষ্ণ । জুঁইয়ের চোখ নাফিসের দৃষ্টির সীমানায় ঘুর ঘুর করছে । এই মুহুর্তে তার নাফিসের দৃষ্টি থেকে সরে যেতে হবে । বলতে গেলে এক রকম পালিয়ে যেতে হবে তাকে এখন । তাই ইফসিকে কোলে নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে দ্রুত হেটে চলে যায় জুঁই । নাফিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে জুঁইয়ের চলে যাওয়া দেখতে থাকে । আর ছোট্ট ইফসি তার মায়ের কোলে থেকে মায়ের কাঁধের আড়ালে এসে নাফিসের দিকে দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় আর এক হাত দিয়ে টা টা দিয়ে দেয় । বাচ্চাটাকে দেখে নাফিসের মনের কোথাও একটা জমাট বাঁধা পাহাড়টা পানি হয়ে বয়ে যায় অচিরেই ।
কেবিনে ঢুকে মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মাথা হাত দিয়ে বসে পড়ে জুঁই । তার কাছে খুব অবাক লাগছে চারপাশের জিনিস গুলো । যেই অতীতকে সে আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে দাফন করেছিল এখন সেই অতীত কেন বর্তমান হয়ে তার সামনেই প্রকট হচ্ছে । ইফসির নাফিসের কাছে যাওয়াটা , নাফিসের এই অফিসে ট্রান্সফার হয়ে আসাটা কি ইংগিত করছে তাকে সে এইটাই বুঝতে পারছে না । হঠাৎ তার নজর পড়ে তার মেয়ের দিকে । ইফসি খেলছে আর চকলেট খাচ্ছে । দেড় বছরের বাচ্চাকে কিই বা জিজ্ঞেস করবে সে । জুঁই তবুও মেয়ের দিকে এগিয়ে যায় ,
– আম্মুন , একটা কথা বলবা ?
মায়ের কথায় চোখ গুলো বড় বড় করে তাকায় ইফসি ।
– আম্মুন , এই চকলেট টা কে দিয়েছে ? আম্মুনকে বলবা
– আন্তেল দিয়েতে(আংকেল দিয়েছে)
জুঁই বুঝে যায় সবটা । এই মুহুর্তে মাথা কাজ করছে না তার । সে চাচ্ছেই না যে নাফিসের সাথে পরবর্তীতে তার আর যোগাযোগ কিংবা দেখা হোক । কিন্তু সব দিক বন্ধ দেখছে সে । হুটহাট চাকরি ছাড়াটা হবে ওর জীবনের সব থেকে বড় বোকামি । একমাত্র এই চাকরির জোরেই ও একা একজন নারী নিজের বাচ্চাকে নিয়ে সার্ভাইভ করছে । চাকরিটা ছাড়া এই মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব না । এমন অবস্থায় কি করা উচিত তার সেইটাও তার মাথায় আসছে না ।
এইসবের মাঝেই পিওন এসে হাজির হয় ।
– ম্যাডাম আসবো ?
– জ্বি আসুন ,
– ম্যাডাম এস এস কোম্পানির ফাইল নিয়ে নাফিস স্যার ওনার রুমে আপনাকে যেতে বলছে ।
আরও বড় ধাক্কা খায় জুঁই পিওনের কথা শুনে । এই পর্যন্ত চোখাচোখি ছিল এখন তো কথাতেও যেতে হবে দেখা যাচ্ছে । পিওনের সামনে নিজেকে কোন রকম শান্ত রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে পিওনকে জবাব দেয় জুঁই ,
– জ্বি আচ্ছা , আমি যাচ্ছি ।
– জ্বি ম্যাডাম
ফাইল হাতে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জুঁই । ভেতরে যাবে কি যাবে না ভাবছে সে । পরবর্তীতে নিজের মাঝে এক উদ্যোম নিয়ে আসে সে ।
– যখন সবটা শেষ করে দিয়েছে তখন এখানে আর কিছুই থাকে না । যা হবে শুধুই প্রফেশনাল কাজের জন্য হবে । এর বাহিরে না আমি তাকে চিনি না তাকে আমায় চিনার সেই সুযোগ দিবো ।
এইসব ভেবে নিজেকে সব দিক থেকে এক পাশে এনে মনকে শক্ত করে নাফিসের কেবিনে পা রাখে জুঁই ।
– স্যার আসবো ??
নাফিস তখন সেই মুহুর্তে ল্যাপটপে কাজ করছে । চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর তার কানে যাওয়ার সাথে সাথে মাথা তুলে তাকায় দরজার সামনে । তারসামনে এক নারী চরিত্র দাঁড়ানো । পরনে সাদা শাড়ি , খোঁপা করা চুল , হাতে এক জোড়া চিকন সিটি গোল্ডের চুড়ি । চোখে যেন হাজারো মেঘ জমা তাহার । মনে হচ্ছে কোন এক কাঙ্খিত মুহুর্তের অপেক্ষায় আছে যেই মুহূর্তের জন্যে এই মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাবে তার চোখ থেকে ।
ভাবনার রাজ্য থেকে ফিরতে বাধ্য হয় নাফিসকে কারণ সেই মুহুর্তে জুঁই আরও একবার স্যার বলে সম্বোধন করে তাকে । নাফিসের এপ্রুভালে জুঁই ভেতরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায় । ফাইলটা এগিয়ে দেয় নাফিসের সামনে । চোখ জোরা তার টেবিলের কাচের উপর । কারণ সেই কাচের মাঝেই নাফিসকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে । নাফিস নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে । আগের নাফিস আর এখনকার নাফিসের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ । আগের প্রেমিক পুরুষটি আজ সময়ের সাথে সাথে দায়িত্বশীল পুরুষ মানুষ হয়ে গেছে ।
নাফিস তখন ফাইলের বাহানায় সেই কাচের মাঝে তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । কেমন যেন চুপসে গেছে মেয়েটা । ক্যাম্পাসের সেই হাসি-খুশি মেয়েটা আজ লেপ্টে আছে এই সাদা শাড়ির মাঝে । নাফিসের খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কি ঘটে গেছে তার কাদম্বরীর জীবনে । কেন এই সাদা শাড়ি ? হঠাৎ নিজেই উপলব্ধি করতে থাকে ,
– ও কি বিধবা ? নাকি স্বামীর সাথে ডির্ভোস হয়ে গেছে ? জুঁই তো এতটা শক্ত ছিল না ? তবুও এতটা বদলে গেছে কিভাবে ? নরম স্বভাবের মেয়েটা আজ সময়ের কাছে হেরে গিয়ে আমার কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে এখন হয়তো পাথর হয়ে গেছে । যেন তার চোখ বলে দিচ্ছে তার ভেতরে কতটা চিৎকার হচ্ছে ।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না নাফিস । অন্যদিকে লজ্জাও লাগছে জুঁইয়ের সাথে কথা বলতে । তবুও কেন জানি তার মুখ থেকে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বেরিয়ে যায় ,
– প্রাণবন্ত আমার কাদম্বরী
আজ এই সাদামাটা নারী
রঙের মাঝে রাঙিয়ে থাকা
নারী কেন আজ পুরো ফাঁকা
নাফিসের মুখ থেকে চার লাইন কবিতা শুনে অবাক হয়ে যায় জুঁই । বুকের মাঝের চিন চিন ব্যাথাটা আরও বেড়ে যায় । খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার , খুব কষ্ট হচ্ছিলো । নাফিসের কাছ থেকে তখন যা আশা করেছিল তার ছিটেফোটাটাও পায় নি সে । আর যেখানে আশা গুলো ফিকে হয়ে গেছে তখন আবার নাফিস কেন তার কাছেই এগুচ্ছে । জুঁই আর এক সেকেন্ডের জন্যেও এখানে থাকতে চাচ্ছে না তাই সে চলে যেতে পিছনে পা বাড়ায় । ওমনি নাফিস তাকে আটকে দেয় ,
– দাড়াও জুঁই ,,,,,,,,,
জুঁই কেন জানি শুনেও শুনে নি নাফিসের ডাক । আরেক কদম দিতেই আরেকবার ডাকে জুঁইয়ের পা জোড়া সেখানেই থামতে বাধ্য হয় ।
– পালিয়ে যাচ্ছো ?
নাফিসের এই কথার উত্তরটা অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় । কিন্তু সেই মুহুর্তে জুঁই তা করবে না । তবুও একবার ইচ্ছে করছিলো পেছন ফিরে নাফিসকে দেখতে । মন জিনিসটা বড্ড বেশি বেহায়া , কেন যেন অতীতকে আঁকড়ে ধরতে চায় বারে বারে । পিছন ফিরে তিন বছর পর প্রথম নাফিসের চোখের দিকে তাকায় জুঁই । কেন যেন চাইতেও গলা দিয়ে স্বর বেরিয়ে আসছে না তার । কিছু বলতে চাচ্ছে সে তবুও কথা বের হচ্ছে না ।
অন্যদিকে নাফিস তার কাদম্বরীর সবটুকুই বুঝতে পারে অনায়াসে । সে বুঝেও যায় তার কাদম্বরীর মাঝে ঝড় শুরু হয়ে গেছে । তাই নিজেই আরও একবার মুখ খুলে ,
– কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমায় ? আমার কাদম্বরী তো এমন ছিল না । নিজের মনের সবটুকু খুলে রেখে দিত সে আমার সামনে । তবে আজ কেন কাদম্বরীর মুখে কথা আসছে না ? তবে আজ কেন কাদম্বরী তার অভিমান গুলো আমার সামনে উপস্থাপন করছে না ?
নাফিসের কথা শুনে বুকের মাঝে তোলপাড় করে উঠছে জুঁইয়ের । তবুও অনেক কষ্টে মুখ থেকে বের করে ,
– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার , আমি কাদম্বরী নই । আমি নাদিরা ইয়াসমিন জুঁই , আমার এক সন্তান আছে । ভুল করছেন স্যার । আমি শুধুই এই অফিসের একজন কর্মচারী ।
জুঁই খুব সহজেই এই কথা গুলো বলে দেয় নাফিসকে । নাফিস কিন্তু খুব অবাক হয় নি । ওর জায়গায় অন্য কোন নারী হলে এতক্ষণে নাফিসকে ছুলে রেখে দিতো । কিন্তু এই নারী যে তার মনের রানী তার কাদম্বরী । যার মাঝে কিনা আছে অন্যরকম সব অনুভূতি ।
– জুঁই , আমি আমার কৃতকর্মের জন্য সত্যিই খুব লজ্জিত । সেইদিন উপায় ছিল না , বড্ড বেশি অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম । দুটো দিকের মাঝে একটি দিক বেছে নিতে হতো আমায় । কোনদিকে যাবো , ভালোবাসা নাকি দায়িত্ববোধ । পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি । বাধ্য হয়েছিলাম তোমাকে ছেড়ে যেতে । কথা দিয়েও ফিরতে পারি নি আমি ।
নাফিসের কথা গুলো শুনে কেন জানি চোখের পানি গুলো আর আটকে রাখতে পারেনি জুঁই । এক দৃষ্টিতে নাফিসের দিকে চেয়ে আছে জুঁই ।
জুঁইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হৃদয়ে ঝড় বয়ে চলছে নাফিসের । জুঁইয়ের চোখের পানি গুলো বলে দিচ্ছে তার ভেতরের চাপা হাহাকার । পাগল মন যেন বার বার পাগলামি করতে চাইছে আজ ।
এরই মাঝে জুঁই কিছু বলে ওঠে , কারণ তারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব ,
– আমাদের মাঝে ভালোবাসার কমতি ছিল না
শুধু তোমার মাঝে দায়িত্বের মিথ্যে বোঝা ছিল
তুমি ছেড়ে তো গিয়েছো
আঁধার রাতে একা করে দিয়েছো
সেই রাতের মাঝেই আমি আমার সবটা তোমায় মুক্ত করে দিয়েছিলাম
এখন এলে যখন তখন দেখে যাও এ বুকে কত হাহাকার জমাট বেঁছে আছে
জুঁইয়ের কথা গুলো শুনে টপ টপ করে চোখের পানি পড়ে যায় নাফিসের চোখ থেকে । সেই চোখের পানি দেখে জুঁই আবারও বলে ,
– কান্না তোমায় মানায় না
কান্না তো সব আমার জন্যে
সেইবার কেঁদেছিলাম তোমার পা ধরে
তারপর প্রতিনিয়ত কাঁদতে হচ্ছে
নিয়তির হাতে পুতুল হয়ে
দয়া করে অফিসে সবার সামনে আমায় ছোট করে দিও না । এক বাচ্চার মা আমি সেই সাথে বিধবা নারী । নোংরা উক্তি তুলতে কারো মুখে বাধবে না । ভুলে যখন গিয়েছিলে এখন আর মনে করো না । রাস্তা দুটো আগেই আলাদা করে দিয়েছো এখন আর এই রাস্তায় আসার ভুলটা করো না । অকারণে বার বার কেবিনে ডাকতে যেও না । আসছি ,
জুঁই আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় নি সেখানে । হন হন করে চলে যায় । বিধবা শব্দটা শুনে নাফিসের কলিজাটাও কেঁপে ওঠে ।
– এত কষ্টও কি আল্লাহ পাক কোন নারীকে দিতে পারে । অন্যায় তো করেছিলাম আমি ওর সাথে । তবে কেন আল্লাহ পাক আমায় সাফল্যের দিকে ধাবিত করে ও-কে কষ্টের মাঝে ডুবিয়ে দিলেন । এটাই কি তাহলে ভাগ্য ? নাকি এটাকেই বলে ভবিতব্য ?
কথা গুলো বলে নাফিস চেয়ারে বসে পড়ে । আর অন্যদিকে নুজ কেবিনের চেয়ারে বসে ঢুকরে কেঁদে দেয় জুঁই । ইফসি তখন পুতুল কোলে মায়ের দিকে এক নজরে তাকিয়ে রয় ।
.
.
চলবে…………