কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে #পর্ব_১১,১২

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১১,১২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
১১

অনুষ্ঠানে সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে । ইফসি খেলা করছে মাহবুব সাহেব এর বাচ্চাদের সাথে । সে আজ অনেক খুশি । এমন মানুষজন পূর্ণ এলাকা তার খুব ভালো লাগে । তার উপর নিজের সমবয়সী পাওয়াতে খুব খুশি সে । ইফসির খিল খিল হাসিটাই সবার পছন্দ হয় । সবার মন কেড়ে নেয় ।

জুঁই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে । সবার থেকে আলাদা হয়ে । মাঝে মাঝে দুজন স্টাফ রা আসে কথা বলে আবার অন্য পাশে যায় । নাফিস পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে । আজ কেন যেন তার কাদম্বরীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল । শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগছিল তাকে । এক সময়ের হাসিখুশী মানুষটা আজ চুপচাপ হয়ে গেছে । এটাই তার বুকে তীর হয়ে বিধছে ।

অনুষ্ঠানে সবাই নিজেদের মধ্যে নিজেরাই নাচ গান করছে । কেউ গান তো কেউ নাচ । নাফিস জানতো যে তার কাদম্বরী নাচ গান দুটোই পারে । জুঁইয়ের বেশিরভাগ সময় রবীন্দ্র সংগীত ভালো লাগতো । সে গাইতোও রবীন্দ্র সংগীত , আর নাচ টাও করতো সেই রকম । কিন্তু আজ তার সেই প্রাণচঞ্চলা নারীটি একেবারেই চুপ করে গেছে ।

কিছুক্ষণ পর মোহি এসে জুঁইয়ের পাশে দাঁড়ায় । তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– ম্যাম ,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– ম্যাম আপনিও কিছু একটা করুন ,
– কি করবো ?
– গান অথবা নাচ ।
– নাহ ,
– কেন ম্যাম ?
– বাদ দিন , আপনারা যান এঞ্জয় করুন ।
– আপনি এইভাবে একা থাকবেন আমরা এঞ্জয় কিভাবে করি ম্যাম ।
– সমস্যা নেই , যান আমি আছি তো এখানেই ।
– ম্যাম , একটা কথা বলি ?
– অবশ্যই , বলুন না ।
– ম্যাম আপনাকে না আজকে অনেক সুন্দর লাগছে । শাড়িটায় অনেক দারুণ মানিয়েছে আপনাকে ম্যাম ।
– ধন্যবাদ , আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে
– আমি ছেলে হলে আপনাকে তুলে নিতাম কিন্তু , এত শান্ত কিভাবে থাকেন ম্যাম । এত কিছু হওয়ার পরও কিভাবে নিজেকে এত স্ট্রং কিভাবে থাকেন ম্যাম ?
– আল্লাহ পাক এই ধৈর্য নামক জিনিসটা ভালো মতই দিয়েছে আমায় । আর কি করবো বলেন ।
– আমি দোয়া করি ম্যাম আপনি অনেক সুখী হবেন একদিন ।
– এখন আর সুখের চিন্তা করি না । আপনি যান এঞ্জয় করুন ।
– জ্বি আচ্ছা ।

মোহি গিয়ে আবারও সবার সাথে কথা বলায় মেতে ওঠে । আর জুঁই আবারও একা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে । এখন আর এইসব ভালো লাগে না তার ।

প্রায় অনেক্ষন পর মাহবুব সাহেব সবার সামনে জুঁইকে ডেকে মিডেলে নিয়ে যায় ।

– জ্বি স্যার বলুন ,
– একটা গান গেয়ে শুনান ।
– স্যার আমি তো গান পারি না ,
– এইসব বললে হবে না । গান শুনাতেই হবে ,
– স্যার সত্যিই বলছি গান পারি না ।
– আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না ।

তাদের কথার মাঝে মিসেস মাহবুবও অনেক রিকুয়েষ্ট করে জুঁইকে । যাই পারে না কেন একটা গান যাতে গায় । তখন জুঁই সবার অগোচরে নাফিসের দিকে তাকায় । আর নাফিসের দৃষ্টি তখন তার কাদম্বরীর দৃষ্টিতে । এ যেন এক তৃষ্ণা নিবারনের কৌশল তাদের । নাফিস বুঝে গেছে তার দিকে তাকানোর অর্থ কি ছিল । তার কাদম্বরী একমাত্র তার সামনেই গান গাইতো । এইবার সেটা একান্তেই হোক কিংবা সর্ব সম্মুখেই হোক নাফিসকে তার সামনে থাকতেই হতো । এটার ইংগিত দিচ্ছিলো তাকে তার কাদম্বরী । নাফিস লাষ্ট বার গান শুনেছিল তিন বছর আগে তাদের দূরত্বের প্রায় তিন মাস আগে । কলেজের একটা প্রোগ্রামে গেয়েছিল জুঁই । সেদিন নীল শাড়িতে , নীল চুড়িতে সেজেছিল নাফিসের কাদম্বরী । কাদম্বরীর নীলাভ আলোয় নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছিল নাফিস সেদিন । সেই স্মৃতিগুলো যেন নিমিষেই চোখের সামনে ভেসে উঠে গেলো । হয়তো আজও সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে তার কাদম্বরী ।

তখন সবার সামনে দিয়ে একটু এগিয়ে যায় জুঁই । জুঁইয়ের সব থেকে প্রিয় গানটাই গাওয়া শুরু করে জুঁই ,

যেতে যেতে একলা পথে

নিভেছে মোর বাতি

ঝড় এসেছে, ওরে, এবার

ঝড়কে পেলেম সাথি

জুঁইয়ের কন্ঠে এই গান শুনে কলিজা কেঁপে ওঠে নাফিসের । গানটার মিনিং ছিল অনেক । যা পুরোটা শুধুই নাফিসকে ইংগিত করছে । আর অন্যদিকে জুঁই গেয়ে যাচ্ছে ,

আকাশ-কোণে সর্বনেশে

ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে

প্রলয় আমার কেশে বেশে

করছে মাতামাতি

নাফিসের দৃষ্টি তার কাদম্বরীর দিকে । আর তার কাদম্বরীর দৃষ্টি তার দৃষ্টিতে । এরা যেন বহু বছরের অতৃপ্ত বাসনার তৃষ্ণা নিবারনের চেষ্টায় মগ্ন । যেন এদের চারপাশে কেউ নেই । যেন এক বাগানে এরা কেবলই একলা । জুঁই যেন গাইছিল না নিজের কলিজাকে কেটে নাফিসের সামনে পরিবেশন করছিল । সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক এবং মুগ্ধ ভাবে জুঁইয়ের গান শ্রবণ করছিল । নাফিসের তো ভাঙাচোড়া অবস্থা । এরই মাঝে জুঁইয়ের শেষ পারায় এসে সবার মন আরও নড়ে ওঠে ,

যে পথ দিয়ে যেতেছিলেম

ভুলিয়ে দিল তারে

আবার কোথা চলতে হবে

গভীর অন্ধকারে

বুঝি বা এই বজ্ররবে

নূতন পথের বার্তা কবে

কোন্‌ পুরীতে গিয়ে তবে

প্রভাত হবে রাতি

উফফফ , চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি রেখে গানটা গাইতে গাইতে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নেয় জুঁই । মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের ঘাড়ের কোণায় নিজের চোখের পানি লুকায় জুঁই । বাচ্চাটা কিছুই বুঝে নাই । শুধু কানে শুনেছে তার মা গাইছে । উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় জুঁইয়ের গান শুনে । মনে হচ্ছিল পরিবেশটা একদম থমথমে হয়ে গেছে । নাফিসের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরে পড়ছিল । কারণ শেষ পারার পুরোটাই জুঁই নাফিসের চোখের দিকে পলকবিহীন ভাবে তাকিয়ে গেয়েছে । আর এখানেই নাফিসের মন মস্তিষ্ক আরও একবার মার খেয়ে গেছে জুঁইয়ের কাছে ।

সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠে । সবার নজর জুঁইয়ের দিকে । যেহেতু জুঁই বাকি স্টাফদের থেকে সিনিয়র তাই তারা শুধু হাত তালি দিয়েই তাদের মনের আকুলতা উপস্থাপন করে দিলো । জুঁই যেন গান গায় নি , ৪ মিনিটের জন্যে নিজেকে নিজ হাতে উপস্থাপন করে রেখে দিয়েছে সবার সামনে সে । যার পুরোটাই নাফিস বুঝে যায় । তখন একজন স্টাফ বলে উঠেন ,

– কি গাইলেন ম্যাম এটা ? এত সুন্দর কিভাবে হলো ।
– আমি ভালো গাই না ভাই ,
– কি বলছেন ম্যাম , অসাধারণ হয়েছে ।

হঠাৎ মাহবুব সাহেব এবং তার স্ত্রী জুঁইকে বলেন ,

– অসাধারণ গাইলেন কিন্তু ।
– ধন্যবাদ স্যার , ধন্যবাদ ম্যাম ।

এইসবের মাঝে সবার দিক থেকে একদম আলাদা হয়ে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে নাফিসকে দেখে যাচ্ছে মোহি । নাফিসের চোখের পানি থেকে শুরু করে নাফিসের ঠোঁটের কোণে কষ্টের হাসি পর্যন্ত পুরোটাই দেখে মোহি । একদম এক নজরে তাকিয়ে থাকে সে নাফিসের দিকে । কোথাও একটা ক্লু খুঁজে চলছে এই মেয়েটা । মনে তার হাজারো প্রশ্ন , কিন্তু উত্তর জানার কোন রাস্তা নেই । কারণ নাফিস তার সিনিয়র । কি আছে নাফিস আর জুঁইয়ের মাঝে ।

– যতবার তারা এক হয়েছে ততবারই কিছু না কিছু আমার নজরেই পড়েছে । তাদের তাকানোর ভঙ্গি এমন কেন । তাদের মাঝে কিছু তো আছে ?

প্রশ্ন গুলো মোহি নিজের মনে সাজাতে পারলেও নাফিসের সামনে উপস্থাপন করতে পারে নি । করতে পারে নি বললে ভুল হবে , এতটা সাহস তার হবে না ।

– কিন্তু নাদিরা ম্যামের গানের সাথে নাফিস স্যারের চোখে পানি আসার কারণ কি ? উফফ সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন ?

এইদিকে মোহি হিসেব মেলাতে ব্যস্ত অন্যদিকে নাফিস তার কাদম্বরীকে পাওয়ার নেশায় মরিয়া আর তার কাদম্বরী নাফিসের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আবার মিলনের পথে কাটা দেয়ায় ব্যস্ত ।

রাত প্রায় ১১ টার উপর হয়ে গেছে । এখানের কার্যক্রমও মোটামুটি শেষ । খাওয়া দাওয়ার পর্বও চুকে গেছে । এদিকে ইফসিও ঘুমিয়ে গেছে । ইফসিকে কোলে নিয়ে জুঁই দাঁড়িয়ে আছে সি এন জি এর জন্যে । শাড়ি পরে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে । এমন সময় নাফিস জুঁইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায় ।

– ইফসিকে আমায় দেও ?

নাফিস কথাটা এমন ভাবে বললো যেন ইফসি তার সন্তান । আর জুঁই তার নিজের বউ । এমন ভাবে অধিকার ফলাচ্ছিল সে । তখন জুঁইও বলে দেয় ,

– লাগবে না আমি যেতে পারবো ।

নাফিসের এইবার অনেকটা রাগ উঠে যায় । প্রায় ধমকের সুরেই বলে ওঠে ,

– এমন করো কেন সব সময় ? আমি কি রাস্তার কুত্তা নাকি ? বার বার কাছে আসতে চাই দূরে ঠেলে দেও কেন ? অপরাধ না হয় করেছিলাম তাই বলে এত কিছু করবা ? ইফসিকে আমায় দাও , আর চুপচাপ বাইকে উঠো । তারপর আমি ইফসিকে তোমার কাছে দিবো ।
– আমি নিজে চলে যেতে পারবো ।
– এখানে আর একটা কথাও না । চুপচাপ বাইকে উঠো ।

রাত প্রায় ১১ টার উপর বেজে গেছে । তাই জুঁইও আর কথা বাড়ায় নি । নাফিসের বাইকে উঠে যায় । আর নাফিস ইফসিকে তার কোলে দিয়ে বাইক স্টার্ট করে দেয় ।

এইসব কিছুর আলামত দূর থেকে মোহির চোখেই পড়ে যায় । এইবার মোহির সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়ে যায় ।

প্রায় ১১ টা ৩০ ,

নাফিস বাইক থামায় জুঁইয়ের বাসার সামনে । বাইক থেকে নেমে নাফিস ইফসিকে কোলে নিয়ে নেয় । আর জুঁই তখন ইফসির জুতা হাতে নিয়ে উপরে উঠে যায় । নাফিসও চুপচাপ ইফসিকে কোলে নিয়ে উপরে চলে যায় । দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো খুব সুখী একটা পরিবার । আসলে ভেতরে কি আছে তা শুধু তারাই জানে ।
ঘরে এসে জুঁইয়ের ইশারায়া নাফিস ইফসিকে জুঁইয়ের রুমে শুইয়ে দেয় । ইফসিকে শুইয়ে দিয়ে তার কপালে একটা চুমা দিয়ে নাফিস রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেরিয়ে যাওয়ার আগে রুমটা ভালো মত দেখে নেয় । রুমের এক পাশে খাট , তার পাশে একটা ওয়ারড্রব আর একটা ড্রেসিং টেবিল রাখা । সামনের রুমে এক সেট বেতের সোফা আর একটা সিংগেল খাট রাখা । এ ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই ঘরে । জুঁইয়ের এই কষ্টের চলাফেরা নাফিসের ভেতরটাকে ভেঙে চুড়ে একাকার করে দেয় । যাওয়ার সময় নাফিস একবার জুঁইয়ের দিকে তাকায় । জুঁই তখন এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল । নাফিসের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিছু বলতে তাকে । পরবর্তীতে বলেই দেয় ,

– কাদম্বরীকে মাথা নিচুতে মানায় না ।

নাফিসের কথায় মাথা তুলে তাকায় সে নাফিসের দিকে । পরে নিজেও বলে ,

– কাদম্বরী তো কবেই নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে । এখন আর খুঁজে লাভ নেই তাকে । খুঁজলেও পাবে না তাকে , অতি সহজেই হারিয়েছো যাকে ।

জুঁইয়ের কথায় নাফিস আর কিছুই বলে নি । আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে আসে সে । আর জুঁই দরজায় খিল দিয়ে সেখানেই বসে পড়ে । না চাইতেও চিৎকার করে কাঁদতে চাচ্ছে সে । হাটু গেড়ে বসে কেঁদে দেয় জুঁই ।

– নাফিস আমি আর পারছি না । আর পারছি না , আর কত সহ্য করতে হবে আমাকে । আর কত ?

.
.

চলবে…………

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

অফিসের কাজের প্রেশার বেড়েই চলেছে দিন দিন । এই সময় নাফিসের মন তার কাদম্বরীর কাছে পড়ে আছে । আজকে দুপুর প্রায় ১২ টার উপর হয়ে গেছে । এখন অবদি নাফিস দেখে নি তার কাদম্বরীকে না দেখেছে ইফসিকে । ফাইলের বাহানায় পিওনকে ডেকে
জুঁইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই নতুন কিছু শুনতে পায় নাফিস ,

– রহমান ভাই , নাদিরা ইয়াসমিনকে ডেকে পাঠান তো ।
– স্যার ম্যাডাম তো আজ আসেন নাই ।
– আসেন নাই মানে , তিনি আজ অফিসে আসে নি ?
– নাহ স্যার ,
– কেন আসে নি , আপনি কি জানেন কিছু ?
– ম্যাডাম নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন , তাই কয়েকদিন ছুটি চেয়েছেন এম ডি স্যারের কাছে ।

পিওন রহমান সাহেবের কথা শুনেই বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে নাফিসের । নিজে নিজে কল্পনা করে যাচ্ছে ,

– কি হয়েছে হঠাৎ করে । পরশুদিন রাতেও তো ভালোই ছিল । মাঝে ছিল গতকালকের দিনটা
, কি হয়েছে ?

নাফিসকে চিন্তিত দেখে পিওন রহমান সাহেব বলে উঠেন ,

– স্যার , কোন সমস্যা হয়েছে কি ?

পিওনের কথায় ভাবনা থেকে বের হয় নাফিস ,

– নাহ ঠিক আছি আমি , আপনি এখন যান রহমান ভাই । প্রয়োজন হলে আমি আবার ডেকে নিবো , কেমন ?
– জ্বি স্যার ,

হাসি দিয়ে পিওন রহমান সাহেব বেরিয়ে যায় রুম থেকে । আর নাফিসও জুঁইকে ফোন করে দিয়ে বসে । কিন্তু সেই ফোন আর রিসিভ হয় নি । একবার নয় দুবার নয় তিনবার নয় লাগাতার ফোন দিয়ে যাচ্ছে নাফিস । কিন্তু রিসিভ হয় নি । টেনশন আরও বেড়ে যায় নাফিসের । বাড়াবাড়ি কিছু হয় নি তো তার কাদম্বরীর । তার উপর একা থাকে বাসাটায় । বাচ্চাটাও একদমই ছোট । নাফিস আর বসে থাকতে পারে নি । সোজা উঠে মাহবুব সাহেব এর রুমে যায় সে ।

– স্যার আসবো ??
– আরে নাফিস সাহেব যে , আসুন ।
– স্যার আমার এই মুহুর্তে ছুটি লাগবে ।
– মানে ?
– জ্বি স্যার , প্লিজ আমার ছুটি চাই এক্ষুনি ।
– এনিথিং রং মিষ্টার নাফিস ?
– স্যার কাউকে ছেড়ে দিয়েছিলাম বহু বছর আগে । এখন তাকে ধরে রাখতেও পারছি না কিন্তু চেষ্টা তো করতেই পারি , তাই না স্যার ?

নাফিসের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে নি মাহবুব সাহেব । নাফিস কি বলতে চায় , তাও বুঝতে পারেন নি । এরই মাঝে নাফিস আবারও বলে ,

– স্যার , প্লিজ আমায় ছুটি দিন ।
– আজকের জন্যে নাকি কয়েকদিনের জন্যে ?
– আপাতত আজকের জন্যে । ঝামেলা বেশি হলে আমি মেইল করবো ।
– আচ্ছা যান ।
– ধন্যবাদ স্যার ।

নাফিস আর এক মিনিটও দাঁড়ায় নি সেখানে । সোজা বেরিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে কোন রকম গুছিয়ে সে বেরিয়ে যায় । অফিসের বাকি স্টাফরা একটু অবাকই হয়েছেন বটে । মোহি খুব মন দিয়ে সবটা ভেবে দেখে , তার ধারণা সত্যি নয়তো ?

– নাফিস স্যার নাদিরা ম্যামের বাসায় যাচ্ছেন না তো ? কেন যেন মনে হলো তার মনটা নাদিরা ম্যামের অসুস্থতার খবর পেয়ে ভালো নেই ।

মোহি এইসব উপলব্ধি করতে তো পারছিল বেশ । কিন্তু কারো কাছে খুলে বলতে পারছিল না সে ।

জুঁইয়ের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাফিস । ডোরবেল ৪/৫ বার দেয়া শেষ তার । তবুও দরজা খুলছে না জুঁই । দুপুর প্রায় দেড় টার উপর হয়ে গেছে , জুঁইয়ের কোন পাত্তাই নেই । আবারও ডোরবেল দেয় নাফিস , ৮ম ডোরবেল দেয়ার পরেই জুঁই গিয়ে দরজা খুলে দেয় ।

দরজা খোলার পর জুঁইকে দেখে নাফিস । পুরো মুখ লাল হয়ে আছে , চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে । চোখ দুটো লাল হয়ে আছে । ওড়নাটাও ঠিক মত গায়ে নেই তার । জ্বর একদম কাবু করে ফেলেছে তার কাদম্বরীকে । ভেতরে বাচ্চা মেয়েটা কি অবস্থায় আছে কে জানে ।

এদিকে জুঁই নাফিসকে দেখে পুরাই অবাক । এই সময়ে তার বাসায় নাফিস । কি করে সম্ভব এটা । নাফিস সোজা ভেতরে ঢুকে যায় । এরই মাঝে জুঁই নাফিসকে বলে উঠে ,

– তুমি এই অসময়ে ?

জুঁই কথাও বলতে পারছে না ঠিক মত । গলাটাও বসে গেছে । দাড়াতেও তার কষ্ট হচ্ছে । সিংগেল খাট টায় ধুপ করে বসে পড়ে সে । কোকিয়ে উঠছে বার বার । নাফিস তার কাদম্বরীর বেহাল অবস্থা দেখছে ।

– এতগুলা ফোন দিছি রিসিভ কেন করো নাই ?
– ফোন কই আমি কই , জানি না ।
– ইফসি কোথায় ?
– খেলে ,
– এত অসুস্থ একবার ফোন করলেও তো পারতে ।
– উফফফফ , আহহহ ।। খেয়াল ছিল না । ইফসিকে কিছু খাওয়াও তো ।
– কিহহহ , ও এখনও কিছু খায় নি ?
– নাহ , আমি তো উঠতেই পারছিলাম না । রান্না ঘরে কৌটায় বিস্কিট রাখা আছে । এনে খাওয়াও তো , দেখো খায় কিনা ।
– আন্টিকে ফোন দিলেই তো পারতে ।
– আমার কাউকে ফোন করার মত শক্তি নাই নাফিস ।

এটা বলেই জুঁই সেখানেই শুয়ে পড়ে । নাফিস আগে ভেতরের রুমে ইফসির কাছে যায় । নাফিস দেখে ইফসি খাটে বসে পুতুল দিয়ে খেলছে । নাফিস দরজা থেকেই ইফসিকে ডেকে উঠে ,

– ইফসি মামুনি,,,,,,,,,?

কারো আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকায় ইফসি । দরজায় নাফিসকে দেখে খুব খুশি হয় ইফসি । খিল খিল করে হেসে উঠে দাঁড়ায় সে । তারপর খাটের পাশে এসে দাঁড়ায় সে আর দুইহাত উচিয়ে কোল দেখায় নাফিসকে । নাফিসও এক গাল হেসে দিয়ে ভেতরে ঢুকে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় । ইফসি এমন ভাবে নাফিসকে আঁকড়ে ধরে মনে হচ্ছিলো তার বাবা নাফিস । বাচ্চা তো , তাই এত কিছু তার মস্তিষ্কে কাজ করে না ।

ইফসি নাফিসের গলা জড়িয়ে ধরে আছে । নাফিস ইফসিকে চুমা দিয়ে খাটের উপর দাড় করায় আর বলে ,

– কিছু খেয়েছো মামুনি ?
– আম্মুন দেয় না , আম্মুন দেয় না
– আম্মুন এর অসুখ মামুনি , বিস্কিট খাবা মামুনি ?

তারপর নাফিস ইফসিকে কোলে তুলে রুম থেকে বের হয়ে সামনের রুমে যায় । সেখানে গিয়ে দেখে জুঁই খাটে শুয়ে আছে , দুনিয়ার খবর নেই তার । নাফিস ইফসিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায় । খুঁজে খুঁজে বিস্কিটের কৌটা বের করে প্লেটে করে বিস্কিট এনে ইফসির সামনে দেয় ।

– মামুনি তুমি বিস্কিট খাও , কেমন ?

নাফিস রুমে গিয়ে আগে রুমের সব গুছিয়ে বিছানা ঝাড়ু দেয় , ইফসির খেলনা গুলো গুছিয়ে রাখে পাশে । পুরো রুমটা পরিষ্কার করে দেয় সে । সামনের রুমে এসে জুঁইকে ডেকে তুলে নাফিস ।

– জুঁই,,,,,,?
-…………….
– জুঁই ,,,, এই জুঁই শুনছো ?
– হুউউ,,,,,,
– উঠো ওই রুমে আসো ।

নাফিসের কথা শুনেও শুয়ে থাকে জুঁই । শরীরে শক্তিও নেই মনে হচ্ছে৷। নাফিস জানে জুঁইয়ের যখন জ্বর হয় তখন তার দিন দুনিয়ার খবর থাকে নাহ । জুঁইয়ের কপালে হাত রেখে জ্বরের পরিস্থিতি অনুভব করে নাফিস । জুঁইয়ের শরীরে নাফিসের হাত , এ যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত । যেখানে স্বাক্ষী শুধু সে আর সময় । কারণ জুঁই তখন জ্বরের ঘোরে । দেড় বছরের বাচ্চা মেয়েটা তখন পুতুল কোলে বিস্কিট খাচ্ছে । নাফিস জুঁইকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে শুইয়ে দেয় । নাফিসের কোলে উঠে নাফিসের শরীরের গন্ধ অনুভব করে জুঁই তার নাকে কিন্তু নাফিসকে জড়িয়ে ধরার শক্তিটাও তার নেই ।

জুঁইকে শুইয়ে দিয়ে বাকি কাজ গুলো করে ফেলে নাফিস । রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের ভাত ছাড়া আর কিছুই নেই । এখন এই দুপুর বেলা এত অল্প সময়ে রান্না করা যাবেও না । তাই এক বন্ধুকে ফোন করে কিছু খাবার আনায় নাফিস । খাবার এনে আগে ইফসিকে খাইয়ে দেয় নাফিস । তারপর জুঁইকে তুলে ভাত খাইয়ে দেয় । জ্বরের তাড়নায় মাথায় কিছুই নেই জুঁইয়ের । গায়ে যে তার ওড়না নেই সেই জ্ঞানটুকুও নেই তার । নাফিস নিজের মত করে সবটা সামাল দিচ্ছে আজ । একবার ইফসিকে দেখছে আবার জুঁইকে দেখছে । সব গুছিয়ে জুঁইয়ের মাথায় পানি ঢেলে দেয় নাফিস । অন্যদিকে ইফসি নাফিসকে জ্বালাচ্ছে , নাফিসের সাথে খেলছে । বাচ্চাটা তো আর বুঝছে না তার মা অসুস্থ ।

একদিকে জুঁইকে দেখছে সে অন্যদিকে ইফসিকে সামলাচ্ছে সে । যেন আজ নাফিস একজন আদর্শ স্বামী আর একজন আদর্শ বাবা । এই মুহুর্তে নাফিসের অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই ।

এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত প্রায় ৯ টা । জুঁইয়ের জ্বর যেন আরও বেড়ে গেছে । এদিকে মোবাইলে একটার পর একটা ফোন বেজেই চলেছে । বাসা থেকে ফোন আসছে । নাফিসের সেদিকেও খেয়াল নেই । প্রায় অনেক্ষন পর শান্তার ফোন রিসিভ করে নাফিস ।

– ভাইয়া তুই কই ? কয়টা বাজে আসিস না কেন এখনও ? ভাইয়া তুই ঠিক আছিস তো ?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে নাফিস আস্তে আস্তে সব বলে তার বোনকে ।

– তুই এখন জুঁই আপুর বাসায় ??
– হ্যাঁ ,
– বাচ্চাটা কি করে ?
– খেলে ,
– আপু ?
– পড়ে আছে , খবরও নেই ।
– আপুর তো বরাবরই এমন হয় ।
– হু
– বাচ্চাটার একটা ছবি দে তো আমাকে দেখি ।
– অনেক কিউট রে , একদম যেন আমার কাদম্বরী ।
– আচ্ছা তুই ছবি পাঠা আর আমি মাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নিবো ।
– আচ্ছা ।

বোনের সাথে কথা বলে খাটে এসে জুঁইয়ের পাশে বসে নাফিস । এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে দেখে যাচ্ছে জুঁইকে সে । যেন ঘোর লেগে গেছে তার চোখে ।

– আমার কাদম্বরী , যাকে আমি কথা দিয়েও ফিরে আসি নি । আজ আমার সেই কাদম্বরী আমার সামনে । আমি তোমায় ভালোবাসি , হ্যাঁ কাদম্বরী আমি তোমায় ভালোবাসি । অনেক অনেক ভালোবাসি । ফিরে এসেছি আমি , হয়তো দেরি করে ফেলেছি তবুও ফিরে এসেছি আমি ।

.
.

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here