এক_ফালি_রোদ
৫ম_পর্ব
ইসমাইল সাহেবের প্রশ্নে অতীতের কালো অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসে রাইসা। খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো তার, না বাবা ভালো নেই, দম আটকে আসছে তার, সে মুক্তি চায়। কিন্তু কেনো যেনো কিছুই বলতে পারলো না। কারণ বাবা জানলে কষ্ট পাবে। রাইসা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরার তার পাশে উপস্থিত হয়। ইসমাইল সাহেবকে সালাম দিয়ে নম্র কন্ঠে বলে,
– বাবা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার মেয়েকে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।
আবরারের কথায় বেশ আশ্বস্ত হন ইসমাইল সাহেব। আবরারের কথা শুনে, রাইসা আবরারের চোখে চোখ রাখে। রাইসার চোখে শুধু এক রাশ ঘৃণা ছিলো যা অনুধাবন করতে কষ্ট হলো না আবরারের। ঘৃণার পরিমাণটা যেনো বেড়েই যাচ্ছে প্রতিটাক্ষণ। অবশ্য এটাই তো হবার কথা ছিলো। এর মাঝেই কেউ আবরারকে ডাকে। বিধায় আবরারকে সেখানে যেতে হয়। কথা ঘুরাবার জন্য রাইসা ইসমাইল সাহেবকে জিজ্ঞেস করে,
– বাবা প্রাপ্তি আসে নি?
– এসেছে, আশেপাশেই আছে। মেয়েটাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় আমার। ওর বিয়েটা হয়ে গেলে আমার চিন্তাটা কমতো।
– মাত্র তো একুশে পা রেখেছে। এতো তাড়ার কিছু নেই তো বাবা।
– অনাথ মেয়ে, সমাজের দিকটাও তো দেখতে হবে! সুযোগ পেলেই নানা কথা রটায়।
– যারা রটাবে তারা সমসময়ই রটাবে। বাদ দেও। ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেও। ছোট বেলা থেকে ও যতটা শক্ত, দেখবে একদিন ঠিকই ওকে মানুষ ওর জন্য ভালোবাসবে। অনাথ বলে হেও করবে না। আর ও তো অনাথ নয় বাবা, আমরা তো ওর পরিবার তাই না?
রাইসার কথায় খানিকটা দমে যান ইসমাইল সাহেব। প্রাপ্তির বয়স যখন এগারো তখন হুট করেই হার্টের ব্যাধিতে তার বাবা আবদুল্লাহ সাহেবের মৃত্যু হয়। আবদুল্লাহ সাহেবের মৃত্যুর পর নাফিছা বেগম একা হাতে মেয়েকে বড় করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারোর কোনো হাত থাকে না। প্রাপ্তি বয়স যখন পনেরো তখন একটা রোড এক্সিডেন্টে নাফিছা বেগমের মৃত্যু হয়। নাফিসা বেগমের মৃত্যুর পর থেকে তার বাসায় ই মেয়েটা বড় হয়েছে। আঁকাউকি ভালোবাসে বিধায় ফাইন আর্টস এ পড়াশোনা করে সে। মেয়েটির স্বভাবে তার বাবার ছাপ রয়েছে। খালা বাড়ি থাকলেও কখনো খালা খালুর উপর বোঝ হবার কথা চিন্তাও করে নি। মেয়েটি নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালিয়েছে। কলেজের সময় ভালো রেজাল্ট করে বৃত্তি পেয়েছে, রাত রাত জেগে নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছে যাতে বাড়তি শিক্ষকের প্রয়োজন না হয়। ভার্সিটিতে উঠার পর পড়াশোনার খরচ যেনো আরো বেড়ে যায় প্রাপ্তির। তাই টিউশনি করায় সে, যাতে কারোর উপর বোঝা না হয়। নিজের সকল খরচা যেনো নিজেই বহন করতে পারে। প্রাপ্তির এই স্বভাবগুলো একেবারেই পছন্দ নয় ইসমাইল সাহেবের। টিউশনি করাতে করাতে রাত হয়ে যায়। রাতে যখন বাসায় ফিরে তখন ইসমাইল সাহেবের নানা কথার সম্মুখীনও তাকে হতে হয়। বেশ বকাবকিও করেন। তার অবশ্য কারণ ও আছে। ইসমাইল সাহেব বেশ কয়েকটা ভালো বিয়ের সম্বন্ধ ও এনেছিলেন। কিন্তু লাভ হয় না, পাত্রপক্ষ অনাথ শুনতেই পিছিয়ে পড়েন। একেই অনাথ হবার ট্যাগ লাগাতে পাত্রপক্ষ পিছিয়ে পড়ে, উপরে যদি চরিত্রে দাগ পড়ে যায় তাহলে তো বিয়ের ধাপ পার হওয়া আর হয়ে উঠবে না মেয়েটার। রাইসার শ্বশুরবাড়ির মতো শ্বশুরবাড়ি প্রাপ্তির ভাগ্যে যদি লেখা থাকতো ব্যাপারটা মন্দ হতো না। ইসমাইল সাহেব রাইসার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
– মারে আমরা যা চাই তা যদি সত্যি সবসময় হতো তাহলে হয়তো জীবনটা এমন হতো না। জীবনে অনেক কিছুই আছে যা আমরা চাই না বা চিন্তাও করি না।
ইসমাইল সাহেবের কথাটার মর্ম বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয় নি রাইসার। ইসমাইল সাহেবের সাথে কথা বলার মাঝেই সেখানে নাসির সাহেব উপস্থিত হন। নিজের বেয়াইকে বন্ধুমহলে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য তাকে নিয়ে যান। ইসমাইল সাহেব যাবার পর রাইসার তার কথাটা ভাবতে থাকে। সত্যিই তো, মাঝে মাঝে আমরা যা চাই তা আমাদের জীবনে হয় না, আর যার জন্য আমরা প্রস্তুত ও থাকি না সেটাই হয়। আবরারের সাথে তার বিয়েটাও ঠিক তেমন। সে কখনো কল্পনাও করে নি আবরারের সাথে তার বিয়ে হবে। এই বিয়েটা সে হয়তো কখনো মন থেকে মেনেও নিতে পারবে না।
– নতুন বউ এতো চিন্তা করলে কি ভালো দেখায়?
কন্ঠটি কানে আসতেই মাথা তুলে তাকায় রাইসা। তার সামনে প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে।প্রাপ্তির সাথে বয়সের পার্থক্য থাকলেও রাইসার মনের কোনো পার্থক্য নেই। ছোটবেলা থেকে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুর কাতারে এই পিচ্চি মেয়েটি পড়ে। রাইসা তাকে দেখতেই তাকে জড়িয়ে ধরে। প্রাপ্তি তখন ধীর কন্ঠে বলে,
– কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস?
– ভালো না, তোমার বানানো কফি খুব মিস করছি। জানোই তো তোমার হাতের কফি ছাড়া আমার হাত চলে না। একটা ভালো ছবিও আকা হয় নি।
– এখন থেকে এটা স্বভাবে পরিণত করে ফেল৷ আমি এখন আর তোকে কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারবো না। যদি খুব খেতে ইচ্ছে করে তাহলে এখানে আসতে হবে।
– হু আধা ঘন্টা জ্যাম কাটিয়ে এখানে আসতে আসতে আমার কফি খাওয়ার ইচ্ছাই চলে যাবে।
– এতোক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? জানিস আমি তোকে খুজছিলাম। বাবাকেও তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি।
– আর বলো না, এক রোমিও এর পাল্লায় পড়েছিলাম। ব্যাটা আমার শাড়ি পুড়িয়ে৷ দিয়েছে জানো?
– কি বলছিস তুই? কে সে? কোথায় দেখা হয়েছে?
– আরে বাদ দাও না।৷ পাগল ছাগল লোক। তুমি বলো, সব ঠিক আছে তো?
প্রাপ্তির কথায় চুপ হয়ে যায় রাইসা। সবাইকে মিথ্যে বললেও কেনো যেনো প্রাপ্তিকে মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হলো না রাইসার। ধীরে ধীরে গত পরশু রাত থেকে সব ঘটনা খুলে বলে প্রাপ্তিকে। রাইসার কন্ঠ কাঁপছিলো। প্রাপ্তি সব শুনে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– কেনো নিজের সাথে এমনটা করছো রাইসাপু, জীবনটা অনেক লম্বা। এমন জানোয়ারের সাথে কি করে থাকবে? কিভাবে বাঁচবে?
– আমি তো মরেই আছিরে। শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছি। আমার জন্য মা-বাবা কষ্ট পাবে, এটা আমি মানতে পারবো না।
প্রাপ্তি কিছু বলতে যাবে তখনই সেখানে আবরার এসে উপস্থিত হলো। প্রাপ্তি আবরারকে দেখে কিছুই বললো না। আবরার ধীর কন্ঠে প্রাপ্তিকে বললো,
– শালিকা, আমার বউ টিকে একটু ছেড়ে দিন। ছবি তুলবে তো।
প্রাপ্তি কিছুই বলতে পারলো না। ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে লাগলো। রাইসা মেকি হাসি ঠোঁটের কোনায় ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। মেকি হাসির পেছনের চাপা কষ্টের আর্তনাদ কারোর চোখে না পড়লেও প্রাপ্তির চোখে ঠিকই পড়লো। বুক চিরে অচিরেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আফসোস হচ্ছে রাইসার জন্য। কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।
___________________________________________________________________________________________________
রাত বারোটা,
ছাদের এক কোনায় বসে রয়েছে অয়ন। একপাশে গিটার রাখা, হাতে নিকোটিন নামক স্লো পয়জনে পুরা সিগারেট। আজ পূর্ণিমা। আকাশে হলুদ রঙ্গের পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব হয়েছে। আজ এই চাঁদের ন্যায় সুন্দর লাগছিলো রাইসাকে। কিন্তু চাঁদ যেমন ছোয়া যায় না ঠিক তেমনই রাইসা তার ধরা ছোয়ার বাহিরে চলে গিয়েছে। সে কখনো চিন্তাও করে নি রাইসার প্রতি এতোটা দূর্বল হয়ে যাবে সে। তার এবং রাইসার সম্পর্কটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ছিলো। ভালোলাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যাবে কল্পনা করে নি। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে হাতে গিটারটা তুলে নিলো অয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে সুর তুললো সে,
আমি পারিনি তোমাকে
আপন করে রাখতে,
আমি পারিনি তোমাকে
আবার আমার করে রাখতে।
তুমি বুঝনি, আমি বলিনি
তুমি স্বপ্নতে কেন আসনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।
গানে গানে সুরে সুরে কত কথা
বলেছি তোমাকে,
তুমি বুঝনি, বুঝনি।।
কখনো যদি, আনমনে চেয়ে
আকাশের পানে আমাকে খুঁজো,
কখনো যদি, হঠাৎ এসে
জড়িয়ে ধরে বলো ভালোবাসো।
আমি প্রতি রাত, হ্যাঁ প্রতিক্ষণ
খুব অজানায় কত অভিনয়,
করে বসি তোমায় ভেবে।
আমার অযথা সব লেখা গান
সব শুনে মন করে উচাটন,
তুমি বোঝোনি কেন আমাকে?
তুমি বুঝনি, আমি বলিনি
তুমি স্বপ্নতে কেন আসনি?
আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে
সব গেয়েছি।
গানে গানে সুরে সুরে কত কথা
বলেছি তোমাকে,
তুমি বুঝোনি, বুঝোনি।।
গানটি শেষ হতেই খেয়াল করলো তার গাল ভিজে আছে। বুকের কোনায় জমে থাকা কষ্টগুলো নোনাজলের সাথে গরিয়ে পড়ছে। কি অসহ্য যন্ত্রণা! এটা যেনো বুকে বয়ে নেওয়াটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
– তাহলে অয়ন সিকদারেরও কষ্ট হয়?
কথাটা কানে আসতেই পেছনে তাকায় অয়ন। চন্দ্রমার মৃদু আলোতে লোকটাকে চিনতে কষ্ট হলো না অয়নের। গিটারটা একপাশে রেখে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– তুই এখানে কি করছিস ভাই? এখানে তো তোর থাকার কথা নয়।
– দেখতে এলাম তোকে। কেনো আসতে পারি না?
– না পারিস না, তোর বউ আছে। এতো রাতে এখানে তো তোর আসার কথা নয়।
– হ্যা ঠিক এখানে আমার কথা নয়। তবুও তোকে দেখতে এসেছি।
– আমার কষ্ট দেখে খুব ভালো লাগছে না তোর?
– কেনো বলতো?
– সবসময় আমার পছন্দের জিনিসগুলো।কেনো যেনো তোর ভাগ্যেই চলে যায়। আমি যাদের ভালোবাসি তারাও তোকে ভালোবাসতে লাগে। প্রথমে তোর জন্য বাবা, মা, দাদী সবাই আমাকে ভুল বুঝে। এখনতো আমার প্রাক্তন ও তোকেই পছন্দ করে। সবসময় আমার পছন্দের সবকিছুই তুই কেড়ে নিস
অয়নের কন্ঠ কাঁপছে। আবরার অয়নের কথাগুলো শুনে মুচকি হাসে। পাশে বসতে বসতে বলে,
– সত্যি কি আমি তোর জিনিস কেড়ে নেই অয়ন? আমি যতটুকু জানি ছোটবেলা থেকে এমনটা তুই করে এসেছিস। আর থাকলো কথা রাইসার। তুই ও জানিস আমিও জানি সত্যিটা কি! রাইসা কখনো তোর ছিলোই না…………
চলবে
[ পেজের কিছু ঝামেলার কারণে গল্পটি গতকাল দিতে পারি নি। তাই আগামীকাল দুইটি পর্ব পোস্ট করবো। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল দুপুরে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি