এক_ফালি_রোদ ৩য়_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩য়_পর্ব

যুদ্ধ তো মাত্র শুরু। অয়নের মুখোমুখি হওয়া যে এখনো বাকি। আয়নার ভেতর থেকে আবরারকে একবার দেখে নিলো। এখনো ঘুমে কাঁদা সে। এখনই সময়, অয়নের সাথে তাকে কথা বলতে হবে। কাল রাতে বাসায় দেখে নি তাকে। এখনো এসেছে কি না জানে না। তবুও তাকে অয়নের একটা খোঁজ নিতেই হবে। চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। ঘর থেকে বের হতেই কারোর সাথে ধাক্কা লাগে রাইসা। মাথা তুলে তাকাতেই পা জোড়া যেনো জমে যায় তার। কারণ সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি আর কেউ নয়, সেই ব্যক্তি যার নাম তার মনের কোঠরে জ্বলন্ত প্রদীপের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। তার প্রাক্তন এবং সম্পর্কে যে তার বর্তমান দেবর অয়ন। অয়নের মুখখানা দেখতেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হয় রাইসার। চুল উসখো খুসখো হয়ে রয়েছে, গতকালের কোট প্যান্ট এখনো গায়ে রয়েছে; চোখ জোড়া টকটকে লাল, হয়তো কাল রাতে ঘুমায় নি সে। অয়ন কিছুক্ষণ অবাক নয়নে তার প্রাক্তনকে দেখে নিলো। কি স্নিগ্ধ লাগছে তাকে, ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। ফর্সা মুখখানায় পানির বিন্দুগুলো লেগে রয়েছে। ঠোট জোড়া যেনো ফুটন্ত গোলাপের পাঁপড়ি। অয়নের মনে হলো তার সামনে নীল শাড়িতে যেনো ফুটন্ত কোনো অপরাজিতা ফুল দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুগ্ধ নয়নে যখন রাইসাকে দেখতে ব্যস্ত তখন হুট করেই রাইসার গলার নিচে কামড়ের দাগটা চোখে পড়লো তার। দাগটা জ্বলজ্বল করছে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো অয়ন। এই অপরাজিতা ফুলটি তার ভাগ্যে নেই সেটা সে ভুলতে বসেছিলো। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই রাইসা পেছন থেকে ডেকে উঠে,
– অয়ন

রাইসার কন্ঠটি কানে আসতেই থেমে যায় সে। রাগে গা শিরশির করছে অয়নের। খুব সুখেই তো আছে সে। এখানে তো পিছুটানের কোনো মানেই নেই। তবুও কেনী মন মানতে চাইছে না। বেহায়ার মতো এখনো তার কন্ঠে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এখনো তাকে দেখলে বেহায়া চোখজোড়া আটকে যায়। নিজের উপর নিজের ই রাগ হচ্ছে অয়নের। অয়নের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মনটা বসে যায় রাইসার। ধীর কন্ঠে বলে,
– আমার সাথে কথা বলতেও কি তোমার ঘৃণা হয় অয়ন?

রাইসার কন্ঠে এক অজানা কষ্ট ছিলো। চাপা কষ্ট, যা এখনো বুঝতে দেরি হলো না অয়নের। কিন্তু এই চাপা কষ্টের কারণ কি! নাকি এখনো ছলনা করছে তার সাথে। রাইসার দিকে দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো অয়ন। ভ্রুযুগল একত্রিত করে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– ঘৃণা করতে যাবো কেনো? ঘৃণা করার কি কোনো কারণ রয়েছে ভাবী
– অয়ন আমার কথাটা একটু শোনো। আমি তোমাকে সব খুলে বলছি। একটু সময় দেও
– কি খুলে বলবেন ভাবী? বলুন, শুনছি
– এখানে না, একটু আলাদা
– আপনার মনে হচ্ছে না আমার কাছে এভাবে আবদার করাটা অনুচিত! মানুষ কি বলবে? ভাবী দেবরের অবৈধ সম্পর্ক। নাকি আপনি এটাই ভেবে রেখেছেন। একসাথে দুই ভাইকে রুপের জালে ফাসিয়ে রাখবেন? আসলে আপনার মতো মেয়েদের দ্বারা এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
– অয়ন

রাইসার কন্ঠ কাঁপছিলো। অয়নের কথাগুলো কানে বাজছিলো। এক একটা শব্দ এক একটা বিষাক্ত তীরে মতো বুকে বাঁধছিলো। সে তো সমস্ত সত্যিগুলো অয়নকে বলতে চেয়েছিলো, ভেবেছিলো অয়ন হয়তো তাকে বিশ্বাস করবে। কিন্তু তার ভাবনাগুলো ভুল। অয়নের অপমানগুলো যতনা কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে অয়নের তার প্রতি চিন্তাভাবনাগুলো ভাবতে। এতোটা নিচু কিভাবে ভেবে নিলো অয়ন তাকে। চোখের কোনায় নোনাজলের ভিড় হতে লাগলো। আর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হলো না রাইসার৷ ধীর কন্ঠে বললো,
– বেশ, তুমি যখন চিন্তা করেই নিয়েছো। তবে আমার আর কিছুই বলার নেই। আমি ভুলে যাবো আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিলো।
– সম্পর্কটাকে গলা টিপে হত্যা কিন্তু আপনি ই করেছিলেন। ভুলে যাচ্ছেন কেনো? সম্পর্কটা তো তখন ই শেষ হয়ে গিয়েছিলো যখন আপনি আমাকে না জানিয়ে আমারই ভাইকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
– কি জানো তো অয়ন। আমাদের হাতে কিছুই থাকে না, সব পরিস্থিতির কবলে পড়ে করতে হয়। কিন্তু এসব বলে কোনো লাভ নেই। কারণ তুমি বিশ্বাস করবে না। এর থেকে বরং ছলনাময়ী নামটাই আমি মেনে নেই। এটাই আমার নিয়তি।

রাইসা আর কথা বাড়ালো না। নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো। তার নিয়তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়া করিয়েছে যেখান থেকে তার পিছপা হবার জায়গা নেই। আবরার নামক লোকটার সাথেই মৃত্যুর আগ অবধি তাকে থাকতে হবে। আত্নহত্যা মহাপাপ নয়তো সেটাকে মেনে নেওয়াটাও হয়তো সহজ হতো তার জন্য। অয়ন রাইসার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। কি বলে গেলো রাইসা। কিসের পরিস্থিতি যার কবলে পড়ে তাকে এভাবে ঠকালো রাইসা। মনের এতো দ্বিধাদন্দের বিরোধ করলো মস্তিষ্ক। যাদের পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে চাইলেও তো তাদের এক কথা যাবে না। তবে কেনো বেহায়া মনটা মানতে চাইছে না। যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। কারণ যেটাই হোক না কেনো এখন আর রাইসা তার নয়। এখন সে মিসেস রাইসা আবরার সিকদার। এই কথাটা পানির মতো স্বচ্ছ। যা চাইলেও বদলানোর ক্ষমতা নেই অয়নের। বুক চিরে অচিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয় অয়নের। চোখ বুঝতে নোনাজলের রেখা গড়িয়ে পড়লো অয়নের। চাপা আর্তনাদ থেকে যদি এবার মুক্ত হওয়া যায়!

রুমে ঢুকতেই দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো রাইসাকে আবরার। রাইসা ভেবেছিলো সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার চিন্তাকে পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত করে দিলো আবরার। আবরারের মুখের দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠে রাইসার। রাগে মুখখানা লাল হয়ে রয়েছে আবরারের। চোখ থেকে যেনো আগুন বের হচ্ছে। এতো শক্ত করে চেপে রেখেছে যে নড়তে পারছে না রাইসা। হাত যেনো ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো করে ফেলবে। নিজের ভয়কে নিজের মাঝেই রেখে শক্ত কন্ঠে বললো,
– ছাড়ুন, লাগছে।
– কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
– সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে? ছাড়ুন, লাগছে আমার
– লাগুক, কোথায় গিয়েছিলে আগে সেটা বলো আমাকে! অয়নের সাথে দেখ করতে গিয়েছিলে তাই না? সে তোমার দেবর ভুলে যেও না। এখন তুমি চাইলেও তার কাছে ফিরতে পারবে না।

বজ্র কন্ঠে কথা গুলো বললো আবরার। রাগে ফুসছে সে। নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছে না। কেনো বারবার মানা করার পরও যায় রাইসা অয়নের কাছে। কেনো আবরারের কথাটা একটা বারও চিন্তা করে না সে। আবরারের কথা শুনে এবার রাইসা যেনো আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, একটা ভাই হয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে এমন কেউ কিভাবে করতে পারে? সব জেনে শুনে জোর করে রাইসাকে সে বিয়ে করেছে। প্রতিবাদ কন্ঠে বলে উঠলো রাইসা,
– হ্যা, গিয়েছিলাম অয়নের কাছে। কি করবেন? মারবেন আমাকে? মারুন। নাকি কাল রাতের হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাপিয়ে পড়বেন? কোনটা? আমার না আপনাকে আর ভয় হয় না। বুঝলেন, আমি আপনার কেনা গোলাম নই। সে এক কদম হাটতেও আপনাকে বলে হাটতে হবে। দুশ্চরিত্র লোক কোথাকার। আরে যে নিজের আপন ভাইয়ের সাথে এমন করতে পারে সে আবার আমার সাথে কতটা ভালো ব্যাবহার করবে। আমি তো একটা জিদ মাত্র আপনার কাছে। একটা খেলনা। যাকে যখন ইচ্ছা তখন আপনি খেলতে পারেন। আমি গিয়েছিলাম অয়নের কাছে। বারবার যাবো। হাজার বার যাবো। কি করবেন! কি করবেন!

আবরার যেনো নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। রাগে গা গজগজ করতে লাগলো আবরারের। গলা টিপে ধরলো রাইসার। রাইসা নড়লো না, ছাড়াবার চেষ্টাও করলো না। এক দৃষ্টিতে আবরারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এভাবে মৃত্যুটাই যেনো তার কাছে শ্রেয়। রাইসার মুখটা লাল হয়ে আসছে, তার চোখ থেকে পানি বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে ছেড়ে দিলো আবরার তাকে। ছেড়ে দিতেই মাটিতে ধুপ করে বসে পড়লো রাইসা। শ্বাস আটকে আসার কারণে কাশতে লাগলো সে। এখনো যেনো দম আটকে আছে তার। তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো আবরার। রাইসার বেশ রাগ হলো। নিজেই আঘাত দিবে, নিজেই মলম লাগাবে এ কেমন পাগলের পাল্লায় পড়েছে। ঘৃণার পরিমাণটা কমার বদলে যেনো বেড়েই চলেছে আবরারের প্রতি। রাইসা মুখ ফিরিয়ে নিলে আর সেখানে বসে থাকে না আবরার। পানির গ্লাসটা সেখানে রেখেই উঠে যায় সে। যাবার সময় বলে উঠে,
– ভুলে যেও না তুমি আমার কেনা একটি দামী খেলনা মাত্র। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

বলেই বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। রাইসা সেখানে বসেই কাঁদতে থাকে। মরে গেলে হয়তো মন্দ হতো না। এই নরক যন্ত্রণা থেকে অন্তত মুক্তি পেতো সে।
___________________________________________________________________________________________________

সন্ধ্যা ৭টা,
আজ আবরার এবং রাইসার বৌভাত। স্টেজে বসে রয়েছে রাইসা। সাদা লেহেঙাতে বেশ মানিয়েছে রাইসাকে। কিন্তু মুখের হাসিটা যেনো কোথাও উধাও হয়ে আছে। জোর করে হাসতে হচ্ছে তাকে। শেফালী বেগম তো নতুন বউ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মহীমা বেগমের বয়স হওয়াতে তিনি হলে আসেন নি। নাসির সাহেব এবং আবরার অতিথিদের আপ্পায়নে ব্যস্ত। রাইসার বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত। এক কোনায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অয়ন। রাইসাকে এক নয়নে দেখেই যাচ্ছে সে। আজ হয়তো আবরারের জায়গায় সেও থাকতে পারতো। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! শুধু দেখেই যেতে হবে তাকে। বাবার ঝাড় খাওয়াতে বাধ্য হয়ে আজকের অনুষ্ঠানে থাকতে হয়েছে তাকে। প্রতিদিন নাসীর সাহেবের টন্ট শুনতে ভালো লাগে না অয়নের। সারাক্ষণ আবরারের উদাহরণ দিয়ে তাকে নিচু করা। তাই মা এবং দাদীর দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠানে রয়েছে সে। হল থেকে বেড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো সে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো সে। বুকের কষ্টগুলো নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়ানোটাই যথার্থ বলে মনে হলো তার। সিগারেটটা খাওয়া শেষ হলেই ফিল্টারের অংশটুকু ফেলে দিয়ে ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়ালো সে। তখনই কানে এলো….…………..

চলবে

[গল্পের রেসপন্স অনেক কম, রিচ ও হচ্ছে না। আপনাদের কি ভালো লাগছে না গল্পটি? যদি ভালো না লাগে বলতে পারেন। তাহলে আমি এতো লেনদি করবো না😔😔। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here