এক_ফালি_রোদ
১৫তম_পর্ব
সূর্যের তীর্যক কিরণ জানালা ভেদ করে চোখে মুখে আচড়ে পড়ছে আবরারের। মাথায় তীব্র ব্যাথা করছে। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার। পিট পিট করে চোখ খুললো সে। একটি হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে রয়েছে সে। সাদা দেয়াল, সাদা পর্দায় ঘেরা কেবিনটা। ডান হাতে ক্যানোলা লাগানো, চিনচিনে ব্যাথা করছে ডান হাতে। তখন মনে পড়লো সে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলো। পড়ে যাবার পর কিছুই মনে নেই তার। হঠাৎ অনুভব হলো সে রুমটিতে এক নয়। তার সাথে আরেকজনও রয়েছে রুমে। পিটপিট করে আশেপাশে তাকালে যা দেখিতে পায় তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। তার বেডের পাশেই কাঠের একটা টুলে বসে মাথাটা তার বেডের দিয়ে ঘুমোচ্ছে রাইসা। রাইসাকে তার সাথে কেবিনে এভাবে দেখবে আশা করে করে নি আবরার। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে রাইসার দিকে। মেয়েটিকে অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখের কোনে পানির কণাটা চিকচিক করছে। কপালের উপর ছোট ছোটে চুলগুলো হালকা বাতাসের দোলায় চোখের উপর বারবার আছড়ে পড়ছে৷ আবরারের খুব ইচ্ছে হলো চুলগুলো সরিয়ে দিতে। কিন্তু সে অপারগ, এক হাতে প্লাস্টার আরেক হাতে ক্যানোলা। এভাবে কি বউয়ের চুলে হাত দেওয়া যায়? মোটেই নয়। সারা শরীর ব্যাথা করার কথা, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হবার কথা, কিন্তু আবরারের কিছু অনুভব হচ্ছে না। তার ভালোথাকার খোরাকটি যে তার সামনে রয়েছে। কিন্তু রাইসা এখানে কেন? না চাইতেই প্রশ্নটা মনের কোনায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মেয়েটার শাড়িটা কাল রাতের, মানে সে রাত থেকে এখানে। তবে কি সে সারারাতে তার জন্য এখানেই ঠায় বসেছিলো? ব্যাপারটা অবাস্তব। কারণ রাইসা আবরারকে ঘৃণা করে। তাহলে? আবরারের মনে এক অজানা অস্থিরতা কাজ করছে। শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না তার। তাই জোর করে উঠে বসতে যায় সে। তখনই হাতে টান লাগে। ক্যানোলাযুক্ত হাতে টান পড়ায় ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়। না চাইতে মুখ থেকে আহ শব্দটি বেড়িয়ে যায় আবরারের। তখনই রাইসার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে সে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠে,
– কি হয়েছে? ব্যাথা করছে কোথাও? অস্বস্তি লাগছে?
রাইসার এমন প্রশ্নে বেকুব বনে যায় আবরার। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে আবরার। খুব অপরাধবোধ হচ্ছে। তার জন্য মেয়েটার ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলে,
– সরি, আসলে উঠতে যেয়ে টান লেগেছিলো। তুমি ঘুমাও
– কেনো এভাবে উঠতে গিয়েছিলেন? আমাকে ডাকা যেতো না? আমি কি অন্য গ্রহে ছিলাম? আপনার সামনেই তো ছিলাম।
ঝাঝালো কন্ঠে প্রশ্নগুলো করে রাইসা। রাইসার মুখখানা শক্ত, আবরার তার এরুপ রুদ্ররুপের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে বুঝতে পারছে না তার দোষটা কি! সে তো রাইসার ঘুমটা না নষ্ট করার জন্যই একা একা উঠতে গিয়েছিলো। ভুলেই গিয়েছিলো সেলাইনের নল তার হাতে ঢুকে আছে। কন্ঠটা নামিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
– আসলে, তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে। ঘুমের মধ্যে উঠানোটা কি ভালো হতো?
– মরে তো যাই নি। আসলে আপনার সমস্যা কি জানেন? আপনি নিজে নিজেই ঠিক করে নেন আমার জন্য কোনটা ভালো। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করার একটাবার চেষ্টাও করেন না আমার জন্য কি ভালো। কি অদ্ভুত না? কাল রাতেও একই কাজ করেছিলেন। তার ফলপ্রসূ এখন এখানে আমরা। কি প্রমাণ করতে চাইছেন বলেন তো? আপনি কত ভালো? আমার কত কেয়ার নেন? আসলে এসব কিছুই হচ্ছে না। আমার জীবনটা আপনি নিজ হাতে নষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন এসব নাটকের কোনো মানে হয় না।
একনাগারে কথাগুলো বললো রাইসা। আবরার তার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মনের মাঝের ক্ষীন আশাটা যেনো দপ করে নিভে গেলো। অদৃশ্য রক্তক্ষরণ অনুভূত হচ্ছে। চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে এলো তার। ঠোঁটের কোনায় মলিন হাসি টেনে আবরার বললো,
– তাহলে এখানে বসে না থাকলেই তো পারো। এর থেকে বাসায় গিয়েই রেস্ট করতে পারতে। আমাকে এতোই ঘৃণা করো তাহলে অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে তোমার সেবা করা লাগবে না। আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি৷
– মানে?
– মানে টা স্পষ্ট, তোমার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই আমার সেবা করার।
রাইসার মেজাজ অত্যধিক খারাপ হতে লাগলো। লোকটার মাথার দু তিনটা তার সত্যি হয়তো ছেড়া। সারাটা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি সে। না চাইতেও তার কাছে পুতুলের মতো বসে ছিলো। কারণ আবরারের প্রতি তার চিন্তা হচ্ছিলো। সকালে উঠে যখন দেখলো তার হাতের ক্যানোলা রক্তে ভিজে আছে মেজাজটা এমনেই বিগড়ে গেলো। লোকটা কোথায় তাকে সরি বলবে তা নয় উলটো চোটপাট দেখাচ্ছে। রাইসার আর কথা বলার ইচ্ছে হয় নি। উঠে দাঁড়ালো সে, রুম থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলো। আবরার তার যাবার পানে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। এর মিনিট পনেরোর মাঝেই একটা নার্স নিয়ে ফিরে আসে রাইসা। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– নার্স দেখুন তো, উনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে।
– এটা কিভাবে হলো?
নার্সের অবাক চাহনী র উত্তরস্বরুপ রাইসা বললো,
– সকাল সকাল একটা মানুষ ক্যানোলার কাছে যুদ্ধ কেন করে সেটা তো আমি জানি না! আবার বলাও যাবে না তাকে কিছু। আপনি একটু দেখুন তো।
রাইসার কথায় নার্স আবরারের ক্যানোলা বদলে দেয়। রাইসা এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আবরার বুঝতে পারছে না রাইসার মনে কি চলছে? সে তাকে ঘৃণাও করে আবার এখন তার খেয়াল ও রাখছে! রাইসার মনে তার জায়গাটা নিয়ে সে সন্দীহান_____________
সকাল ১০টা,
ভার্সিটির গেট দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঢুকলো প্রাপ্তি। আজ ঘুম থেকে উঠতে সত্যি দেরি হয়ে গিয়েছিলো। অয়নকে সকালে ফোন করেছিলো কিন্তু সে ফোনটা ধরে নি। হয়তো ব্যস্ত রয়েছে। ভার্সিটি প্রবেশ করতেই একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে প্রাপ্তির। সবাই যেনো কেমন চাহনীতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। খুব অদ্ভুত লাগছে। চাহনীটা বেশ সন্দেহজনক। কিন্তু কেনো! বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি। সবকিছু উপেক্ষা করে নিজের ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালো সে। ক্লাসরুমে প্রবেশ করেও একই ধরণের অনুভূতি হলো। সবাই যেনো তাকে দেখে কানাঘুঁষা করছে। কেমন বিদ্রুপের চাহনীতে তাকে দেখছে। খুব অস্বস্তি লাগছে প্রাপ্তির। নিজের মনের প্রশ্নগুলো মনের মাঝে চেপে স্নেহার পাশে গিয়ে বসলো সে। স্নেহা তার খুব ভালো বান্ধবী। মেয়েটি অন্যরকম, কখনো প্রাপ্তিকে দয়া দৃষ্টিতে দেখে নি। সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে তার সাথে প্রাপ্তির বন্ধুত্ব। প্রাপ্তি এসে পাশে বসতেই মেয়েটি ধীর কন্ঠে বলে,
– তুই ঠিক আছিস তো প্রাপ্তি?
– কেনো আমার কি হবে?
অবাক কন্ঠে প্রশ্নটি করে প্রাপ্তি। স্নেহা তখন ধীর কন্ঠে বলে,
– তুই কিছু জানিস না?
– না, কি হয়েছে?
স্নেহা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মোবাইল টা বের করে প্রাপ্তির সামনে রাখে। মোবাইলে চোখ রাখতেই পা থেকে মাটি খসে পড়ে প্রাপ্তির। মাথাটা ফাকা হয়ে গেলো মূহুর্তের জন্য। এটা কিভাবে সম্ভব। তখন একটি পিয়ন এসে বললো,
– প্রাপ্তি ইসলাম কে আছে এখানে?
প্রশ্নটা শুনেই ঘাবড়ে গেলো প্রাপ্তি৷ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
– আ….আমি
– হেড স্যার আপনাকে রুমে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন।
কথাটা শোনামাত্র প্রাপ্তির আত্না যেনো খাঁচা ছাড়া হয়ে গেলো। ছোট করে ‘”হুম” বলে পিয়নের পিছু পিছু হেড স্যারের রুমে গেলো সে। হেড স্যারের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে……..
চলবে
[সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনাদের ভালোবাসার জন্য আজ আমরা ৫কে সদস্যের একটি ফ্যামিলিতে পরিণত হয়েছি। সবাই অসংখ্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি