আলো-১৩,১৪
রোকেয়া পপি
১৩
শরতের সকাল। চারদিকে হালকা কুয়াশা কুয়াশা ভাব। মবিনুর রহমানের গায়ে সাদা ধবধবে একটা কাশমেরী শাল।
রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। সকালটা একটু ঠান্ডা ঠান্ডা।
এতো তাড়াতাড়ি শীত আসার কথা নয়।
কিন্তু কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা।
তিনি ভোরের নামাজ পড়ে শাল জড়িয়ে নিচে বাগানে নেমে এসেছেন হাঁটতে।
বাগানে এসে তার মনটা অসম্ভব রকমের ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল।
শিউলি ফুলের গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে।
মাটিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ফুল।
এতো সুন্দর একটা দৃশ্য তার একা একা দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তার খুব ইচ্ছে করছে আলোকে ডেকে তুলতে।
ওর উচ্ছলতা উপভোগ করতে।
তিনি মনে মনে ভাবছেন আলোকে কি একবার ডাকবো নাকি।
তাছাড়া আজ তাকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে বিজনেস পারপাসে।
তার ইচ্ছে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে।
মেয়েটা না উঠলে আজ আর হয়তো দেখা ও হবে না।
আবার ভাবলেন থাক।
মেয়েটা হয়তো আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক।
তিনি মনে মনে যখন ডাকার চিন্তা বাদ দিলেন।
তখন দেখলেন আলো হাই তুলতে তুলতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
তিনি মেয়েকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন।
আলো এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রভাত জানালো।
এতো ভোরে উঠে গেলি যে?
ঘুম আসছে না বুঝি?
আলোর আসলেই ভালো ঘুম হয়নি। কিন্তু সেটা বাবাকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
না বাবা ঘুম হয়েছে। খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম আসছে না জন্য বেলকোনিতে দাঁড়াতেই, দেখলাম তুমি নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছো।
তাই চলে এলাম।
হঠাৎ করে আলোর চোখ গাছের নীচে পড়লো।
সে আনন্দে চিৎকার করে ছুটে গেল গাছের নিচে।
ওয়াও বাবা দেখেছো কি সুন্দর ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে চারদিক।
আলো আপন মনে ফুল কুড়ানো শুরু করলো।
মবিনুর রহমানের চোখ আনন্দে ছলছল করছে।
তার খুব ভালো লাগছে তার মেয়েটার কোচর ভরে ফুল কুড়ানোর দৃশ্য দেখতে।
ছেলে বেলার মধুর স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
তাদের গ্রামের বাড়িতে ও একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল।
প্রতিদিন ভোরে উঠে তার বড়োপার সাথে ফুল কুড়াতো। তারপর বসে বসে ফুলের মালা গেঁথে স্কুলে নিয়ে যেতো।
তার সবচেয়ে প্রিয় ম্যাডাম হাবিবা আপা বাংলা ক্লাস নিতো।
আপা আসার সাথে সাথে সে সালাম দিয়ে আপার টেবিলে সেই ফুলের মালা রেখে লজ্জায় লাল হয়ে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসতো।
আপা হাসতে হাসতে বলতো কিরে মবিন প্রতিদিন তুই আমার জন্য মালা গেঁথে আনিস।
আমার হাতে দিস না কেন?
মবিনুর রহমানের মাথাটা তখন আরো নিচে নেমে যেতো লজ্জায়।
আলোর কথা শুনে মবিনুর রহমান ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলেন।
বাবা কি ভাবছো?
চলো মা খেতে ডাকছে।
তেমন কিছু না রে মা।
চল খেতে চল।
আজ একটু ঢাকার বাইরে যাবো। আমার তাড়া আছে।
একসাথে সকালের নাস্তা খেয়ে নেই।
বাবা আমি ও তাহলে তোমার সাথে বের হবো।
কোথায় যাবি মা এতো সকালে?
আলো মিষ্টি করে হেসে বললো, অহনার সাথে একটু কাজ আছে বাবা।
তুমি আমাকে ফুপির বাসায় নামিয়ে দিও।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তাহলে নাস্তা শেষ করে রেডি হয়ে নে।
আলো যখন তার ফুপির বাসায় আসলো, সবাই ঘুম।
শুধু মাত্র ওর ফুপি সহকারী কে সাথে নিয়ে নাস্তা তৈরি করছে।
আলোকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো।
কিরে সাত সকালে চাঁদ মুখ দেখলাম ঘটনা কি?
ভাইজান কে দেখলাম তোকে নামিয়ে দিতে।
ভাইজান আসলো না কেন রে?
দাঁড়াও দাঁড়াও ফুপি।
একসাথে এতো প্রশ্ন করলে কোনটা থুয়ে কোনটা বলবো?
তোমার ভাই তার বিজনেসের কাজে ঢাকার বাইরে গেলো।
আর আমার একটু কাজ আছে।
অহনা কে নিয়ে বের হবো।
তাই এখানে আসলাম।
আচ্ছা ঠিক আছে কাজ থাকলে যাবি।
কি খাবি বল?
আজকে তোর পছন্দ মতো নাস্তা বানাবো।
ওহ্ ফুপি, বাবার সাথে নাস্তা খেয়ে বের হয়েছি।
একদম পেট ভরা।
ওসব বললে তো চলবে না।
আমাদের সাথে আবার খাবি।
পরী তার ফুপিকে খুশি করার জন্য বললো, তাহলে ঘিয়ে ভাজা পরোটা, গরুর মাংস ভূনা, ডুবা তেলে মুড়মুড়ে আলু ভাজি আর ঘনো দুধের পায়েস।
তারপর ঘনো করে তোমার হাতের স্পেশাল দুধ চা।
পরীর কথা শুনে আলোর ফুপি হা করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, সে কি রে!
তোর কি এটা হোটেল মনে হচ্ছে নাকি রে?
আলো উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে ওপরে চলে গেল।
সে জানে ফুপি খাওয়াতে খুব ভালোবাসে।
তার কষ্ট হলেও সে সব কিছু ঠিক করে ফেলবে।
আলো প্রথমে রন্জুর রুমে উঁকি দিলো। বিছানা খালি।
তারমানে উঠে গেছে।
হয়তো ওয়াশ রুমে।
কাল অনেক রাত জেগে সে রন্জুর সাথে কথা বলেছে।
ইদানিং অভ্যাসে পরিণত হয়েছে রন্জু ভাইয়ার সাথে রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা।
রাতে যখন মন্টু মামা বারবার ফোন করছিল, সে তখন রন্জুর সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত।
ফোন রাখার পর মামার তিনটা মিসকল সে দেখেছে।
কিন্তু যতোবার ব্যাক করেছে, সুইচ অফ।
সারা রাত সে টেনশনে ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি।
এতো রাতে মামা কেন ফোন দিলো।
আবার সুইচ অফ কেন?
আলোর ইচ্ছে ছিল সকালে বাবার কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে সাভারে মন্টু মামার কাছে যাওয়ার।
কিন্তু সকালে যখন জানলো, বাবা ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। সাথে সাথে প্লান চেন্জ করলো।
অহনাদের দুই দুইটা গাড়ি।
একটা নিয়ে সাভার যাওয়া যাবে।
আলো অহনার রুমে এসে দেখে অহনা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ও এসেই অহনাকে টেনে তুললো।
ওঠ ওঠ অনেক ঘুমিয়েছিস।
এখন ওঠ। আমার সাথে এক জায়গায় যাবি।
অহনার বুঝতে সময় লাগলো ঘটনা কি।
তারপর চোখ কচলে আবার শুয়ে পড়লো।
আলো অবাক হয়ে বললো, কিরে আবার শুচ্ছিস কেন?
অহনা আলোকে টেনে ওর পাশে শুয়ায় দিয়ে বললো, যেখানে যেতে বলবি যাবো।
কোন সমস্যা নেই।
কিন্তু তার আগে আমাকে আরেকটু ঘুমাতে দে।
অনেক রাতে শুয়েছি।
ঠিক মতো ঘুম না হলে শরীর খারাপ লাগবে।
তুই ও আমার সাথে একটু ঘুমা।
কথা গুলো বলতে বলতে অহনা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
আলো কিছুক্ষণ উছপিস করে অহনার গলা জড়িয়ে ধরে সেও ঘুমিয়ে গেল।
যখন ঘুম ভাঙ্গল, তখন ঘড়িতে দশটা বেজে পার।
ওরা ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে দেখে ফুপা, রন্জু ভাইয়া কেউ নেই।
দুজনে দুই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছে।
আলোর একটু মন খারাপ হলো।
কিন্তু টেবিলে বসে মন ভালো হয়ে গেল।
ও যা যা বলেছে, ওর ফুপি সব করেছে। সাথে ডিম পোচ ও আছে।
কিরে তোদের ঘুম ভাঙলো।
একবার গিয়ে দেখে আসলাম দুজনে জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছিস।
তাই আর ডাকলাম না।
আলো খেতে খেতে বললো, ডাকলে ভালো করতে ফুপি। অনেক দেরি হয়ে গেল।
ফুপি তোমার রান্না বরাবরের মতো চমৎকার হয়েছে।
অহনা তুই চা শেষ করে ওপরে যা।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে নাম।
আমি ফুপির সাথে গল্প করি।
ওরা দুজনে যখন বাসা থেকে বের হয়েছে। তখন এগারোটা বেজে গেছে।
চারদিকে কড়া রোদ।
অহনা বললো, কোথায় যাবি কিছু তো বললি না?
আলো মুখ টিপে হেসে বললো, আমরা দুজন আজ সাভার যাবো।
সারাদিন তুই আজ আমাকে সময় দিবি।
অহনা রাস্তার মধ্যে থমকে দাঁড়ালো।
কি বলছিস তুই?
আলো অবাক হয়ে বললো, কেন কি হয়েছে?
সাভার যাবো বলছি।
গাড়ি ছাড়া এতো দূর কিভাবে যাবি?
আরে বাসে যাবো।
কোন ব্যাপার না।
গাড়িতে তো সবসময় উঠিস। আজকে বাসে উঠে দেখ।
অসম্ভব ব্যাপার। আমি বাসে উঠবো না।
তোর সাথে আমি নেই। তুই একা যা ভাই।
আরে ধুর। সব রকম অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
এই যে তুই গরীব একটা ছেলের প্রেমে পড়ছিস।
ও তো সবসময় বাসে চলাফেরা করে তাই না?
তুই যদি ওকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকিস, তাহলে তো ও কেমন করে জীবন ধারণ করে সে অভিজ্ঞতা তোর ও থাকা চাই।
তাই না?
অহনা এবার চুপ।
ওর মুখ লাল হয়ে গেছে, মুখে কোন কথা নেই।
আলো হাত ধরে টানতে টানতে বাসে উঠালো।
চল চল তাড়াতাড়ি ঐ বাসটায় উঠি। একদম ফাঁকা আছে।
এই সময়ে বাস যেমন ফাঁকা ছিল, রাস্তা ও বেশ ফাঁকা। ওরা খুব দ্রুত সাভারে চলে আসলো।
আলো অবাক হয়ে দেখলো, মন্টু মামা বিছানায় শুয়ে আছে। দেখতে ঠিক কঙ্কালের মতো লাগছে।
বিছানার সাথে শরীর একদম লেগে আছে।
ও ব্যাস্ত হয়ে পড়লো মামাকে নিয়ে।
মামা কি হয়েছে তোমার?
কপালে হাত দিয়ে দেখে, গা বেশ গরম।
আলোর চোখ ভিজে উঠছে।
তোমার শরীর এতো খারাপ করেছে, তুমি আমাকে জানাওনি কেন?
আর ফোনটাই বা অফ করে রেখেছো কেন?
আহ্ আলো কি শুরু করলি মা আসতে না আসতেই।
সাথে করে মেহমান নিয়ে আসছিস, সে যে দাঁড়ায় আছে।
সে খেয়াল আছে।
অহনা এতোক্ষণ আলোর কীর্তিকলাপ দেখছিলো।
ও ভেবে পাচ্ছে না, এমন একটা নোংরা জায়গায় আলো থাকতো।
বিছানার চাদর বালিশ সব নোংরা, তেল চিটচিটে।
ওর কেমন যেন গা গোলাচ্ছে। ঘরের ভেতরে ও একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
আলো ছলোছলো চোখে অহনার দিকে তাকিয়ে বললো, ও মেহমান নয় মামা।
আমার কাজিন।
অহনা তুই চেয়ারটা টেনে বোস।
অহনা ইতস্তত করে বললো, আমি বরং বাইরে হাঁটি।
তুই কথা বল।
আচ্ছা ঠিক আছে।
চেয়ারটা বাইরে দিচ্ছি। তুই বারান্দায় বোস।
অহনাকে বারান্দায় বসতে দিয়ে আলো পূর্ণ দৃষ্টিতে মামার দিকে তাকালো।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি সারা মুখে। গায়ে একটা ময়লা পাঞ্জাবি। স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গেছে। চেনা যায় না এমন।
কয়দিন আগে যখন আসছিল, স্বাস্থ্য খারাপ দেখে গেছে। কিন্তু এই কয়দিনে তা যে এতটা খারাপ হয়েছে, তা কল্পনাও করেনি।
নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে গিয়ে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে মামাকে!
ও আলো কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম।
কাল রাতে তোকে খুব মনে পড়ছে।
আলো অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলো না। বার বার মনে হল এরপর আসলে মামাকে হয়তো আর পাবো না।
আলো উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, মামা তোমার আর এখানে থেকে কাজ নেই।
তুমি আমার সাথে চলো।
এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে তুমি।
মামা পরিষ্কার কোন উত্তর দেন না। একবার বলেন,
আমি আর কয়দিন রে মা।
আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না। এই বেশ ভালো আছি।
আবার বলেন, তুই যে ভালো আছিস, তোর যে একটা গতি হয়েছে এতেই আমি খুশি।
আমার আর কিছু চাইবার নেই রে মা।
আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মামাকে লক্ষ্য করি। কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। আমার ওখানে কোন অসুবিধা হয় কিনা, পড়াশুনা শুরু করছি কিনা, বাবা মা আমাকে ঠিক মতো আদর করে কিনা এইসব খুব আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করলেন।
আমি জোর করে হোটেলে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সারাপথ গল্প করতে করতে চললেন। এখন আর গল্পের ধরন সে রকম স্বাভাবিক মনে হল না।
হাঁটছে ও কেমন ঢলে ঢলে।
ঝাল ঝাল গরুর মাংস ভূনা দিয়ে গরম ভাত মামার খুব পছন্দ।
আমরা গরুর মাংস দিয়ে গরম ভাত, ডাল চচ্চরি আর আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম।
মামা তেমন কিছু খেতে পারলো না।
এতো পছন্দের গরুর মাংস, সেটা নাকি গন্ধ লাগছে।
ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে খুব সামান্য খেলো।
আমি জোর করে মামাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।
ওষুধ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে বের হতে হতে সন্ধ্যা।
অফিস ছুটির সময়। সব বাস প্রচুর ভিড়।
আধা ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ভিড় ঠেলে আমরা কোন রকমে একটা বাসে উঠলাম।
কোন সিট খালি নেই।
আমরা দুজনেই ইঞ্জিনের ওপরে সিট পেলাম।
অহনা তো পারলে কেঁদেই ফেলে।
আমি ওকে মজার মজার গল্প করে ভুলয়ে রাখলাম।
গাবতলীতে যখন বাস থামলো।
হুরহুর করে দুনিয়ার সব লোক যেন বাসে উঠলো।পারলে সবাই আমাদের গায়ের ওপরে উঠে আসে।
অহনার সামনে বিশাল দেহি পাহাড় সমতুল্য এক লোক দাঁড়িয়ে আছে।
বাস চলছে।
আমরা দুজন মজার মজার কথা বলছি আর হাসছি।
এর মধ্যে হঠাৎ করে বাস এমন ভাবে ব্রেক কষলো,
আমি শুধু দেখলাম পাহাড় সমতুল্য লোকটা অহনার গায়ের ওপরে পড়ছে
আর অহনা দুই হাত সামনের দিকে দিয়ে চিৎকার করে বলছে না না…
চলবে….…
আলো-১৪
অহনার বাবা ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তার সেই দিনের ছোট্ট মেয়েটি আজ বাবার মুখে মুখে কথা বলছে। সে নাকি প্রেম করে!
তাও আবার চাল চুলো হীন এক ছেলের সাথে!
প্রেম করবি কর। স্ট্যাটাস মেইনটেনেন্স করে তো করবি।
রাগে তার পুরো শরীর কিড়মিড় করছে রন্জুর কাছে ঘটনা শোনার পর থেকেই। সে আজ সবাইকে ডেকেছে তার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।
তার বন্ধুর ছেলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শরাফাত খানের সাথে আগামী সপ্তাহে অহনার বিয়ে। সে সবকিছু ফাইনাল করে ফেলেছে। তার কড়া নির্দেশ এই কয়দিন অহনা যেন বাড়ির বাইরে বের না হয়।
অহনা কপাল কুঁচকে বললো, আমি আসিফকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না। এটাই আমার শেষ কথা।
তাছাড়া শরাফাত ভাইয়াকে আমার তেমন পছন্দ ও না।
তোমার যে পছন্দ কেমন সেটা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। সারা জীবন আরাম আয়েশের জীবন যাপন করে এখন ফকিন্নির ছেলে বিয়ে করে কষ্ট করবে। আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না।
শরাফাত ডক্টরেট করা ছেলে। টাকা পয়সা ধন দৌলত কোন কিছুর অভাব নেই।বাবা মা হিসেবে আমরা তোমার জন্য যেটা মঙ্গল, সেটাই করবো।
তাহলে আমি এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
আমার পক্ষে শরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
আসিফ খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে।
ও ভবিষ্যতে খুব ভালো কিছু করবে। আমার মনে হয় না আমি কোন ভুল করেছি আসিফকে ভালোবেসে। অহনা রাগে গজগজ করতে করতে তার নিজের রুমে চলে গেল। রেস্ট নেওয়া বা সবাইকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নয়।
সে এসেছে পোশাক চেন্জ করতে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে এ বাড়িতে। সে আর থাকবে না এখানে।
মতের বিরুদ্ধে কিভাবে তার বাবা তাকে বিয়ে দেয়, সেও দেখতে চায়।
সে একটা ব্যাগ নিয়ে হাতের সামনে যা পেলো তাই ভরে নিয়ে গটগট করে বের হয়ে আসলো রুম থেকে।
কারো দিকে না তাকিয়ে সে হনহন করে বের হয়ে যাচ্ছে বাসা থেকে।
রন্জু সেই মুহুর্তে অহনার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। তুই কি পাগল হয়েছিস?
কোথায় যাচ্ছিস এভাবে?
আমার হাত ছাড়ো ভাইয়া। আমাকে যেতে দাও।
অহনার কান্ড কারখানা দেখে তার বাবা হতভম্ব।
তার এমনিতেই কপাল কুঁচকানো স্বভাব।
মেয়ের সাথে কথা বলার পর থেকে তার কপাল এমন ভাবে কুঁচকে আছে, আর মশৃন হচ্ছে না।
সে উঠে অহনার গালে কষে একটা চড় মেরে অহনাকে রুমে নিয়ে বাইরে থেকে দরোজা লক করে চাবি সরিয়ে রাখলো। কঠিন স্বরে বললেন, কেউ ওকে কোন রকম সহযোগিতা করবে না।
ওর খাবার দাবার সব ওর রুমে দিয়ে আসবে।
কোন ভাবেই যেন ও ঘরের বাইরে বের হতে না পারে।
অহনার মা এতোক্ষণ চুপচাপ এদের বাপ মেয়ের নাটক দেখছিলো। এবার আর মুখ না খুলে পারলেন না।
এতোটা বাড়াবাড়ি বোধ হয় ঠিক না।
দুজনে যদি এভাবে জেদ দেখাও, ফল ভালো হবে না বলে দিলাম। এতো বড়ো মেয়ের গায়ে হাত তোলা ও ঠিক হয়নি তোমার।
উনি চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
আলোর পড়াশোনা করতে একদম ভালো লাগে না।
বাসায় একজন টিচার রাখা হয়েছে। একদিন পর পর সন্ধ্যায় এসে দুই ঘণ্টা পড়ায়। ওর ব্রেন খুব সার্ফ।
অল্পতেই সব কিছু শিখে ফেলে। কিন্তু পড়ার চেয়ে দুষ্টুমি করে বেশি। সুযোগ পেলেই স্যারের কলমটা সরিয়ে ফেলে। কখনো স্যারের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দেয়।
সৈকত খুব আন ইজি ফিল করছে এই চঞ্চল মেয়েটাকে পড়াতে। কিন্তু ওর টাকার খুব দরকার।
এখানে যে নাস্তা আর বেতন দেয়, ওর জন্য এটা খুবই দরকার।
সৈকত হালকা কেশে বললো, আলো তুমি কি জানো তোমার মেধা কত ভালো?
তুমি একটু চেষ্টা করলেই খুব দ্রুত সব কিছু শিখতে পারবে। পড়ার সময় এমন দুষ্টুমি না করলেই কি নয়?
আলো কলমটা ঠোঁটে কামড় দিয়ে মিষ্টি হেসে আবার চোখ টিপে দিলো। আমি দুষ্টুমি করলাম কখন স্যার?
আমি তো অংক করছি।
হুম তুমি অংক করছো। কিন্তু কোন এক ফাঁকে তুমি প্রতিদিনই আমার কলমটা সরিয়ে ফেলো।
আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম কলম আনতে হয়তো ভুলে গেছি।
কিন্তু আজ আমি প্রথম থেকেই তোমার ওপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখছি। তোমার হাত ছাফাইয়ের প্রশংসা না করলেই না।
আলো একটু ঘাবড়ে গিয়ে সামলে নিলো নিজেকে।
সে হাসতে হাসতে বললো, ও স্যার এটা তো মজা করে করি।
তোমার কাছে যেটা মজা, আমার কাছে সেটা অভাব।
এই তুচ্ছ কলম কিনতে গেলে ও আমাকে টাকার হিসেব করতে হয়।
সরি স্যার।
আপনার সব কলম আমি এক জায়গায় করে রাখছি।
আমার কাছে তেতাল্লিশটা কলম জমেছে।
আপনি বসুন। আমি এনে দিচ্ছি।
আলো লজ্জিত ভঙ্গিতে কলম গুলো ফেরত দিলো।
সৈকত হালকা হেসে বললো, শুধু কলম ফেরত দিলেই চলবে না। আমাকে কথা দাও এমন কাজ আর কখনো করবে না। মজা করার জন্য ও নয়।
আলো মাথা নিচু করে ফেলল। আসলে স্যার আমি ইচ্ছে করে ও করি না। আপনি জানেন কিনা জানিনা।
আমি ছোট বেলায় হারিয়ে গেছিলাম। একজন পকেটমারের কাছে বড়ো হয়েছি। সেখানে ট্রেনিং পাওয়া এবং এটাই ছিল আমার একমাত্র পেশা ।
তাই নিজের অজান্তেই এই কাজ গুলো করে ফেলি।
সরি আলো। আমি এই ঘটনা জানতাম না।
তবে এটা সত্যি যে, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, স্যারের এতো টাকা। অথচ তার মেয়ে কেন পড়াশোনা জানে না!
আচ্ছা ঠিক আছে। এগুলো তোমার অতীত।
তোমার বর্তমান হলো তুমি খুব ভালো একটা পরিবারের মেয়ে। তোমার বাবার সন্মাণ রক্ষা করার জন্য হলেও এগুলো ছাড়তে হবে।
আমাকে কথা দাও। এখন থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। হাজার পছন্দ হলেও না বলে কারো কোন জিনিস হাতে নিবে না।
আমি চেষ্টা করবো স্যার। আসলে এভাবে আমাকে কখনো কেউ বোঝায় নি।
ধন্যবাদ স্যার।
এরপর সৈকত একদিন মবিনুর রহমানের অফিসে দেখা করে আলোর ব্যাপারটা খুলে বলেন। তাকে একজন ভালো মানুষিক ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ ও দিলেন।
আলো এখন বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শায়লার আন্ডারে নিয়োমিত কাউন্সিল করছে।
বলা যায় এখন সে অনেকটা ভালো। স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
অহনা দুই দিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে রেখেছে।
ওর কাছে ফোন ও নেই। সব কিছু সরিয়ে ফেলেছে ওর বাবা। বাসায় একটা বিয়ের আয়োজন, অথচ কোন আনন্দ নেই।
অহনার মা আর সহ্য করতে পারছে না, মেয়ের কষ্ট।
দুপুরে খাবার সাধাসাধি করে না খাওয়াতে পেরে ইচ্ছে করে দরোজা খোলা রেখে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
অহনার পাঁচ মিনিট সময় লাগলো বুঝতে যে ওর রুম লক করা হয়নি। ও সুযোগ পেয়ে আস্তে আস্তে পা টিপে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা আসিফের ম্যাচে এসে হাজির হলো।
আসিফ তো অহনাকে দেখে সারপ্রাইজড। ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। তারপর উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো,
কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
তোমার মোবাইল অফ কেন? এই দুই দিন কোথায় ছিলে?
এক দমে এতো গুলো কথা বলে আসিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
আসিফ থামা মাত্র অহনা বললো, আমি পালিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি কোর্টে চলো। আমরা এই মুহূর্তে বিয়ে করবো। একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমার বাবা আর কিছুই করতে পারবে না।
আসিফ বিস্মিত হয়ে বললো, কি বলছো পাগলের মত!
আমার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। আমি কেন এখন বিয়ে করতে যাবো! তাছাড়া আমার নিজের চলে না।
তোমাকে খাওয়াবো কি? কোথায় রাখবো তোমাকে?
অহনার চোখ দিয়ে বাঁধ ভাঙা পানি নেমে আসছে।
আসিফ তুমি বুঝতে পারছ না, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। দুই দিন পর আমার বিয়ে।
তুমি যদি এখন বিয়ে না করো, চিরদিনের জন্য তুমি আমাকে হারিয়ে ফেলবে। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না আসিফ?
আসিফ অহনার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি । খুব বেশি ভালোবাসি অহনা।
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পক্ষে কোন ভাবেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে মাফ করে দাও অহনা।
অহনা চোখের পানি মুছে বললো, ওকে ফাইন।
বিয়ে করতে হবে না। আজকে আমি আমার জীবন শেষ করে দিবো। আমি যদি তোমাকে না পাই।
তবে আমাকেও কেউ পাবে না।
অহনা ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আসিফ হাতটা ধরে ফেলল। কি পাগলামি করছো।
আসিফ জানে, অহনার জেদ কতো বেশি।
এর আগে ও একদিন ভার্সিটির ছাদে উঠে গেছিলো লাফ দেওয়ার জন্য। ওকে বিশ্বাস নেই।
আসিফের রুমমেটরা অহনাকে দেখে অন্য রুমে চলে গেলেও পাশের রুম থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলো।
ওরাও এগিয়ে আসলো।
আসিফ ভাইয়া, আপনি অহনা আপুকে ফিরিয়ে দিয়েন না। রিজিকের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ ঠিক একটা ব্যাবস্থা করবেন।
সেদিন ভর দুপুরে আজিমপুর কাজি অফিসে মাত্র এক হাজার এক টাকা কাবিনে ওদের বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে আলোও ছিল।
বিয়ের পর আলো এক রকম জোর করে ওদেরকে ওর ফুপির বাসায় নিয়ে গেল।
অহনা কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিল না। আলো বুঝালো, বাবা মায়ের সাথে রাগ করতে নেই বোন।
তাদের আশির্বাদ নিয়ে নতুন জীবন শুরু কর।
এদিকে অহনার বাবার প্রেশার বেড়ে গেছে। চারদিকে খোঁজ লাগানো হয়েছে মেয়েকে খুঁজে বের করার জন্য।
এর মধ্যে আলো ওদের নিয়ে হাজির।
অহনাকে বউ সাজে দেখে অহনার মা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, ওর বাবা কোন কথা না বলে অহনার হাত ধরে আবার রুমে নিয়ে বড়ো একটা তালা ঝুলিয়ে দিলো।
অহনা চিৎকার করে বলছে, বাবা আমার হাত ছাড়ো বলছি। আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।
তুমি এখন হাজার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারবে না। কিছুতেই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
তোদের এ বিয়ে আমি মানি না।
অহনার বাবা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে টেলিফোনে ডায়াল করার জন্য হাত দিতেই আলো এসে খপ করে ফুপার হাতটা ধরে ফেললো।
কি করছো তুমি?
আলো আমার হাত ছাড়ো।
আমি পুলিশে সোপর্দ করবো এই ফকিন্নির বাচ্চাকে।
ওর এতো বড়ো সাহস। ও আমার কলিজায় হাত দেয়। আমার মেয়েকে বিয়ে করে!
ওকে আমি জেলের ভাত খাওয়ায় ছাড়বো।