আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_২ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২
#Esrat_Ety

ঘড়ির কাটা টিক টিক শব্দ করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। রাত বারোটা সাঁইত্রিশ। মাথার ওপরে একটা ফ্যান চলছে। এই দুরকমের আওয়াজ ব্যাতীত অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ খানিকক্ষণ আগেও বাড়িটা মানুষের পদচারণায় গমগম করছিলো।বাচ্চাদের হাসি, চিৎকারে মুখরিত ছিলো। এখন পরিবেশটা নিশ্চুপ হয়ে আছে। বাইরে দূরে কোথাও থেকে মৃদু একটা গানের সুর ভেসে আসছে। উর্বী কান খা’ড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো,রবীন্দ্র সংগীত কি না। জানালা টা খুলে দিলে আওয়াজ টা ভালো করে শুনতে পেতো। জানালা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তার লাগেজ টা রুমের ভেতরেই দেওয়া হয়েছে,তাকে আলমারির নির্দিষ্ট কিছু যায়গা দেখিয়ে বলা হয়েছে তার কাপড়-চোপড় যেনো সে সেখানে গুছিয়ে রাখে। উর্বী ধীরেধীরে খাট থেকে নামতে গিয়ে আবার বসে পরলো।ডান পা টা ঝিম ঝিম করছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে সে একই ভাবে বসে ছিলো। পা ঝিমঝিম করাটা স্বাভাবিক। উর্বী মুখে “চ” কারন্ত শব্দ করলো। এতো ভারি শাড়ি গায়ে পরে থাকতে তার খুবই অসহ্য লাগছে, সাথে এতো গয়না। উর্বীর রীতিমত গা চুলকাচ্ছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে নিলে ভালো লাগবে। সে মাথা ঘুরিয়ে ওয়াশরুম খুজতে লাগলো,এমন সময় দরজায় টোকা পরলো। পুরুষালি গলায় দুবার গলা খাঁকারি দিয়ে দরজা ঠেলে রাওনাফ রুমে ঢুকলো। তার চেহারার কানায় কানায় অস্বস্তি ছেয়ে আছে। দরজার বাইরে সে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলো। তার ইচ্ছে করছিলো অন্য কোনো রুমে গিয়ে ঘুমোতে। কিন্তু এটা করা যাবে না। তার মা রওশান আরা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দেবে। এমনিতেই কিছুক্ষন আগে বড় সর একটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেছে বাড়িতে। সে আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না। ভোর পাচটায় একটা অপা*রেশন আছে,তার ঘুমানো দরকার। দরজা লক করার শব্দ হলো। উর্বী ব্যাগ থেকে একটা খয়েরী রঙের শাড়ী বের করে বিব্রত ভঙ্গিতে বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাওনাফ ঘামছে, তার ইচ্ছে করছে দরজা খুলে ছুটে পালিয়ে যেতে। এই বয়সে এসে এরকম শিশুসুলভ আচরণ করা যায়না,তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। উর্বী উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। রাওনাফ হাত থেকে ঘড়ি খুলে টেবিলের ওপর রাখলো। তাকে জোর করে হলেও ঘুমাতে হবে,কাল সকালে হয়তো বাড়িতে আরেকটা নাটক হবে,তাকে তার আগে হসপিটালে যেতে হবে। সে খাট থেকে একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে সোফায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে,আজ রাতটা সোফাতেই কাটিয়ে দিবে।

***
শাফিউল একমনে ফেইসবুক ব্যবহার করছে,তার সম্পূর্ণ মনোযোগ মোবাইলে। এই এলোমেলো পরিস্থিতিতে মোহনার অপ্রয়োজনীয় কথাগুলি সে এড়িয়ে যেতে চায়।
মোহনা শফিউলকেকে ধা’ক্কা দিয়ে বললো,”এই উত্তর দিচ্ছো না কেনো,এসব কি শুরু করেছেন আমার শাশুড়ি! আমরা লোকজনকে মুখ দেখাতে পারবো কাল থেকে?”

-মুখ দেখাতে না পারলে কাল থেকে বোরখা পরে বাইরে যেও। উত্তর দেয় শাফিউল।

মোহনা ভ্র কুচকে তাকিয়ে থাকে। সিরিয়াস মুহুর্তে শাফিউলের এই ধরনের রসিকতা মোহনার পছন্দ না। সে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
-না মানে,মা না হয় একটু সেকেলে চিন্তাভাবনার মানুষ,রাগের মাথায় নিজেদের বাড়ির মানসম্মানের কথা ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই বলে ভাইয়ার সেটা মেনে নিতে হবে? উর্বী মেয়েটা তার থেকে কত ছোটো,একবারো চিন্তা করলো না এই সম্পর্কের ভবিষৎ….

শাফিউল বলে,”শোনো মোহনা,ভাইয়া বা মা কেউই উর্বী বা তার পরিবারকে জোর করেনি,সবাই সুস্থ মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত টা নিয়েছে।তোমার তাদের সম্পর্ক বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার দরকার নেই,তুমি তোমার কাজ করো।”
মোহনা মিন মিন করে বলে,”সেটাই তো,দেখেছো কি লোভী পরিবার, এতো ভালো ফ্যামিলি যাতে হাত ফসকে না যায় সেজন্য হাটুর বয়সী মেয়েকে একটা….”

-তুমি থামবে।
মোহনাকে ধমকে থামিয়ে দেয় শাফিউল।

মোহনা কিছুক্ষন চুপ থাকে,তারপর আবার বলে,”সামিউলকে ফোনে পাওয়া গেল?”
শাফিউল বলে,”হু। কাল আসছে বাড়িতে। আল্লাহ জানেন কাল কি হবে।”

-কি আর হবে। এই ক’দিন তো কম ঝ’ড় হয়নি বাড়িতে,কাল টর্নেডো হবে।

***
উর্বীর নিজেকে এখন অনেকটা ফ্রেস লাগছে, সেই সাথে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার ফলে হাচিও দিচ্ছে। বাইরে বের হয়ে সে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার বিছানার দিকে তাকায়,একবার সোফার দিকে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে খাটের ওপর বসে পরে। তার হাতে বিয়ের গয়না। সোনার গয়নাগুলি নিয়ে সে বিপদে পরেছে,এতগুলো গয়না তার আর পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোথায় রাখবে সেটাও বুঝতে পারছে না। কাল সকালে সে এ বাড়ির কারো কাছে দিয়ে দেবে ঠিক করলো,আপাতত বিছানার উপরে থাক। রাওনাফ বলে লোকটা সম্ভবত ঘুমিয়ে গেছে। উর্বী তাকিয়ে আছে, ছ ফুটের মতো লম্বা একটা লোক,সোফায় ঘুমাতে ভিষন কষ্ট হচ্ছে বোধ হয়। লোকটা সোফায় কেনো ঘুমাচ্ছে উর্বী সেটাই বুঝতে পারছে না! বিয়েতে যে খুব একটা মত এই লোকের ছিলোনা তা তার আচরণেই টের পেয়েছে উর্বী। তবে রাজি কেনো হয়েছে বিয়েতে? মায়ের কথায়? এতো মা ভক্তি!
অবশ্য এরকম কাহিনী সে সিনেমা নাটকে দেখেছে, লাফিয়ে লাফিয়ে মায়ের কথায় বিয়েটা ঠিক করে নেয় কিন্তু বাসর ঘরে বলে,”এই বিয়ে আমি মানি না!”
নিশ্চয়ই ঐ লোকটা ঐসব দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে!

উর্বী ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ হেসে নেয়, পৃথিবীতে সেই সম্ভবত একমাত্র মহিলা যে সিরিয়াস মুহুর্তে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস চিন্তা করে! লোকটাকে সাত-আটবার দেখেছে উর্বী। উজ্জ্বল বর্ণের পুরুষ, বিয়াল্লিশ বছরে ত্বক যেরকম থাকার কথা সেরকম, নামাজ পড়তে পড়তে সম্ভবত কপালের মাঝখানে একটা দাগ বসিয়েছে। বাড়তি কিছুই নেই, হ্যা শুধু একটু লম্বা। তবে লোকটা খারাপ না দেখতে, বত্রিশ তেত্রিশ বছর সময়টাতে বেশ সুদর্শন ছিলেন, যার প্রমাণ তার চেহারায় আংশিক এখনও আছে।
তবে একটু বোকা বোকা লাগলো উর্বীর কাছে, নয়তো মায়ের কথায় নিজের বাচ্চাদের অনুমতি না নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়! এতো একেবারে দুদুভাতু ছেলে মায়ের! আর লোকটার চুলগুলো অস্বাভাবিক কালো,এটা ঠিক প্রাকৃতিক লাগলো না উর্বীর কাছে, সম্ভবত চুলে কালার করেছে, বয়স ঢাকার জন্য !

উর্বী রাওনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠিক করলো এখন থেকে সে সোফায় ঘুমাবে। এমনিতেও সে অযাচিত ভাবে রাওনাফের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে,তার জন্য কাউকে ভোগান্তি পোহাতে হবে না। উর্বী ঠিক করেছে জীবন তাকে যেদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়,সে সেদিকে ভেসে যাবে। জীবনের থেকে আর কোনো প্রত্যাশা নেই তার। যদি ওই সোফায় শুয়ে থাকা লোকটা এসে বলে উর্বীকে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হবে,সে তাতেও রাজি হবে। উর্বী শুয়ে পরে,সে এখন বুঝতে পারছে সে কতটা ক্লান্ত।তার দু চোখ ঘুমে জরিয়ে যাচ্ছে।

***
ফোনের রিং একবার বাজতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,”নাম্বারটি এই মূহুর্তে ব্যস্ত আছে।”
শায়মী ফোন রেখে দেয়,সে জানে নাবিল এখন আর ফোন ধরবে না।কোনোভাবেই না। তার চিন্তা হচ্ছে। রাগের মাথায় নাবিল অনেক উলটো পালটা কাজ করে। আজ কি ঘটাবে কে জানে।
শর্মী জেগে ছিলো,শায়মীর দিকে ফিরে শুয়ে জিগ্যেস করলো,”ভাইয়া ফোন ধরছে না আপু?”
-না,কেটে দিচ্ছে,মনে হয় আজ ধরবে না।
-তুমি কোথাও যাবে?
শায়মী তার জামাকাপড় একটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকাচ্ছিলো।বললো,”হু,কাল সকালে খালামনির বাসায় যাবো।”

শর্মীর মন খারাপ হয়ে যায়,সে এ বাড়িতে একা হয়ে যাবে। তার কান্না পাচ্ছে,তার ইচ্ছে করছে উর্বী নামের মহিলাটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে, কিন্তু শর্মীর অতো সাহস নেই তার ভাইয়ার মতো। সে খুব ভীতু।
শায়মী ডাক দেয়,”এই শর্মী, তুই ঘুমাবি না?”
শর্মী কথা বলে না,সে মনে মনে ভাবতে থাকে,বড়রা যা চায় তাই করতে পারে। তাদের কেউ কিছু বলে না। এইযে ভাইয়া আজ রাগ করে টিভি,জিনিষ পত্র ভাঙচুর করলো। পাপা তাকে কিচ্ছু বলো না,চুপচাপ দেখলো। অথচ রাগ করে সে একদিন প্লেট ভে’ঙেছিল, পাপা না বকলেও সে পাপার চাহনী দেখে খুব ভ’য় পেয়েছিলো। কাল সকালে আপু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে,পাপার ধমকেও কাজ হবে না। আপু যাবেই। শুধু সে কখনো জেদ করতে পারবে না।কারন সে ছোট। তারপর,সে আপু ভাইয়ার মতো মেধাবী না। অংকে কখনোই চল্লিশের উপরে পায় না। তাই হয়তো কেউ তার কথা শোনে না। শর্মীর ইচ্ছা করে তার আপুর সাথে খালামনির বাসায় থাকতে, কিন্তু সেটা সম্ভব না।

***
বাড়ির নাম,”রওশান মঞ্জিল”। রাওনাফ অনেক শখ করে তার মায়ের জন্য এই বাড়িটি বানিয়েছে। বাড়িটা দেখলে সবার চোখ আটকে যায়,ধবধবে সাদা রঙের এই বাড়িটায় মোট বারোটা টা শোবার ঘর। রাজ প্রাসাদের মতো না হলেও,এতো বড় ডু’প্লেক্স বাড়ি আজকাল কেউ বানানোর সাহস করে না তাদের শ্রেনীর ভদ্রলোকেরা যারা রয়েছেন, রাওনাফ সেই সাহস করেছে। তার মা আজীবন তাদের পাচ ভাইবোন কে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। তার মায়ের আজীবনের কষ্টের কাছে এই বাড়ি খুব সামান্য উপহার।

উর্বী চোখ বড় বড় করে রুমের চারপাশ টা দেখতে থাকে, টাকা পয়সা থাকলেও অনেকের রুচি থাকে না, কিন্তু এ বাড়ির মানুষের আছে। রাতে এতো টা খেয়াল করেনি সে। তার মনে হচ্ছে কোনো পাঁচতারা হোটেলের কামরায় বসে আছে। উর্বীর চোখে পরে বিছানার পাশের টেবিলে একটা ফটো ফ্রেম উপুড় করে রাখা, সে ফ্রেমটা তুলে হাতে নেয়, রাওনাফ আর তার আগের স্ত্রীর ছবি সম্ভবত। ভদ্রমহিলা অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। উর্বী একমনে তাকিয়ে থাকে, রাওনাফের মুখ হাসি হাসি, বৌ সুন্দরী ছিলো তাই মনে হয় খুশি একটু বেশিই চোখে মুখে। এক হাত দিয়ে সে তার স্ত্রীকে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে একটু বেশিই শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেনো তার সুন্দরী বৌকে কেউ ছো মেরে নিয়ে যাবে। দুজনকে বেশ মানিয়েছিলো। দুজনেই সুন্দর। উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে ডানপাশে একটা দরজা দেখতে পায়। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। বিশাল বড় একটা বারান্দা। কিছু সাদা রঙের কবুতর বসে ছিলো,উর্বীর দরজা খোলার শব্দে সব উড়ে গেলো। উর্বী দেখতে থাকে,হরেক রকমের ফুল গাছ আর ক্যাকটাস প্লান্টস দিয়ে বারান্দাটি সাজানো হয়েছে। সে হঠাৎ টের পায় তার ভিষন খিদে পেয়েছে। কাকে গিয়ে বলবে এটা ভেবেই সে অস্বস্তিতে পরে যায়। রুমের ভেতরে চলে যায় সে।
রাওনাফ নামের লোকটা নেই, ঘুম থেকে ওঠার পরে উর্বী তাকে দেখেনি , বালিশ আর চাদর ভাজ করে বিছানার একপাশে রেখে গিয়েছে। দরজা চাপানো, হয়তো বাইরে গেছে।
উর্বী খাটে বসতে যাবে অমনি দরজায় আওয়াজ হয়,কেউ ভেতরে আসছে। দরজা ঠেলে আমিরুন ভেতরে ঢোকে। তার হাতে একটা খাবারের থালা। ঠোট প্রশস্ত হয়ে আছে হাসিতে। সে খাবারের থালাটা বিছানায় রাখতে রাখতে বলে, “ঘুম ভালা হইছে ভাবি?”
উর্বী মাথা হ্যা সূচক নাড়ায়। সে বলে,”আপনি কে?”
আমীরুন উত্তর দেয়,”আমি আমীরুন,আমীরুন্নেছা। এই বাড়িতে কাম করি ভাবি,হেই ছুডো থেকে,এই হানেই থাকি। আপনার যখন যা দরকার আমারে বলবেন।”
উর্বী দরজার বাইরে তাকায়। আমিরুন দেখে আর বলে,”বড় ভাইজান রে খুজতাছেন? হে তো বাড়িত নাই,হাসপাতাল গেছে সকালে,অহন মনে হয় চেম্বারে। বারোটার আগে আইতো না।”

উর্বী অস্বস্তিতে পরে যায়। বলে,”আমি কাউকে খুজছি না। আচ্ছা এ বাড়ির সব মেহমান চলে গেছে?”
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে,”না, আমরা আছি, সবাই আছে,কেউ যায়নি”
কথাটি বলে আজমেরী। এ বাড়ির বড় মেয়ে,রাওনাফের ছোট বোন,তার থেকে চার বছরের ছোট । রুমে ঢুকেই বিছানায় বসে পরে উর্বীর পাশে। উর্বী তাকে চিনতে পারে না। আমিরুনের দিকে তাকায়।
আমীরুন বলে,”আপনের বড় ননদ গো ভাবি,এই বাড়ির বড় আপা।”

উর্বী সালাম দেয়।
আজমেরী সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”তোমাকে নাম ধরে ডাকবো নাকি ভাবি ডাকবো বুঝতে পারছি না।”
উর্বী আস্তে করে বলে,”আপনি আমায় উর্বী বলে ডাকতে পারেন আপা।”
আজমেরী হাসে,উর্বীকে দেখতে থাকে। উর্বীকে দেখতে যাওয়ার সময় সে ছিলো না, ছবি দেখেছিলো। উর্বী ছবির থেকে সুন্দর।
আজমেরী নরম গলায় উর্বীকে বলে,”খাচ্ছো না কেনো,খাও। খিদে পেয়েছে নিশ্চই অনেক,আসলে দেরী হয়ে গেলো নাস্তা দিতে,বাড়ির পরিস্থিতি তো বুঝতেই পারছো। কারো মন ভালো নেই। সবাই দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে।”

উর্বী বলে,”কোনো ব্যাপার না আপা আমার অতোটাও খিদে পায়নি।”

আজমেরী হেসে বলে,”আচ্ছা এখন খাও। এত বেলা অব্দি না খেয়ে আছো।”
উর্বী খাবারের থালায় হাত দেয়। পরোটা আর মাংসকষা দেওয়া হয়েছে। খিদের পেটে উর্বীর ভালোই লাগছে খাবার টা। আজমেরী আমিরুন কে বলে,”যা গিয়ে দেখ বাচ্চাদের খাওয়া হলো কি না”

আমিরুন চলে যায়। উর্বী খেতে থাকে। আজমেরী উর্বীর দিকে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা নাও।”
উর্বী মাথা তুলে তাকায়,”এটা কিসের চাবি?”
_ভাইজানের আলমারির চাবি,আম্মা দিয়েছে, তোমাকে দিতে বলেছে,গয়না গুলো এভাবে ছড়িয়ে রেখো না। পরতে ইচ্ছে না হলে তুলে রাখো,গা একেবারে খালিও রেখো না,ওই নেকলেস টা পরো।ওটা একেবারে সিম্পল।
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”এতো গয়না সব আমার কাছে রাখবো?”
_হ্যা,তোমার গয়না তোমার কাছে রাখবে এতে অবাক হচ্ছো কেনো।আর চাবিটা সাবধানে রেখো।

উর্বী খাওয়া শেষ করে,হাত ধুতে ওয়াশরুমে চলে যায়।
আজমেরী গয়না গুলো তুলে রাখে আলমারিতে।
হঠাত বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যায়,চেঁচামেচি করছে রাওনাফের সবথেকে ছোট বোন রুমা। চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে সে কাউকে আটকাতে চাচ্ছে।
উর্বী ওয়াশরুম থেকে বাইরে আসে। আজমেরী ছুটে যায় নিচ তলায়। উর্বীও সেদিকে যায়,বাড়িতে আবার ঝামেলা হচ্ছে,ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু যে উর্বী তা সে আন্দাজ করতে পারছে।

***
রুমা শায়মীর বাম হাত ধরে আছে,শায়মী হাত ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা করছে,তার ডান হাতে একটা ব্যাগ।
শায়মী দৃঢ় ভাবে বলছে,”আমার হাত ছেড়ে দাও ছোট ফুপি। আমাকে তোমরা আটকাতে পারবে না। আমি যাবোই। নাবিলকেও আটকাতে পারো নি,আমাকেও পারবে না। আমি এই বাড়িতে থাকবো না। ছাড়ো আমার হাত।
রুমা হাত ছাড়ে না,সে সবাইকে ডাকতে থাকে,”আম্মা,বড় আপা,মেজো ভাবি,কই তোমরা! দেখো শায়মী কি করছে। তাড়াতাড়ি এসো,শাফিউল ভাইয়া কোথায়,ভাইয়া এদিকে এসো তাড়াতাড়ি। ”

মোহনা,আজমেরী ছুটে আসে। শাফিউল বাজারে গিয়েছিলো,সবে মাত্র ফিরলো। সেও এসে শায়মীকে আটকাতে চায়।
উর্বী দূরে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে দৃশ্য টা।
শায়মী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে,বলে,”তোমরা বৃথা চেষ্টা করছো। আমায় তোমরা আটকাতে পারবে না। তোমরা ভুলে যেওনা,আমি হচ্ছি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের মেয়ে। বাবার জেদ কিছুটা আমিও পেয়েছি। আমাকে ছাড়ো তোমরা।”
শাফিউল শায়মীর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নেয়। ব্যাগটাকে দূরে ছুড়ে মারে। ব্যাগ টা গিয়ে উর্বীর পায়ের কাছে পরে। উর্বী হকচকিয়ে যায়।সবাই উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী সেখান থেকে রুমের দিকে যায়।
বাড়ির বাচ্চারা সব পর্দার আড়াল থেকে দেখছে। কাল রাত থেকে বাড়িতে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ছোট মামার বিয়েতে সবাই কত মজা করবে বলে প্লান করে রেখেছিলো। অথচ এখানে কোনো মজাই হচ্ছে না। সবাই শুধু রাগ করে ভাঙচুর করছে,বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। রাওনাফের গাড়ি। এই সময়ে রাওনাফের ফেরার কথা না। সে আজ চেম্বারে যায়নি। অপা*রেশন থিয়েটার থেকে বের হতেই তার ফোনে আজমেরীর ফোন আসে,আজমেরী সকালে শায়মীর ঘরে গিয়ে তার ব্যাগ গুছানো দেখতে পায়। সে দেরী না করে রাওনাফকে ফোন করেছিলো।
শায়মী রুমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,”বেশ ব্যাগ লাগবে না,আমি এক কাপড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছি। ঐ বুড়িকে জিগ্যেস করবে,এবার তার শান্তি হয়েছে কিনা।”
শায়মী যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই রাওনাফ এসে শায়মীকে ধরে ফেলে। শায়মী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
_ছাড়ো পাপা, তোমার সাথে আমি একটা কথাও বলতে চাই না, একটাও না। আমায় ভালোয় ভালোয় যেতে দাও নয়তো বাড়িতে আগুন জ্বা’লিয়ে দেবো।
রাওনাফ ছাড়ে না,সে তার মেয়েকে পরম মমতায় জরিয়ে ধরে রেখেছে। শায়মী কাঁদছে, একটু পরপর কেপে কেপে উঠছে। দুরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে শর্মী। এসব কি হচ্ছে তাদের বাড়িতে?

***
জেল*খানার ভেতরের এরিয়ায় দক্ষিণ পাশের বড় বটগাছটার নিচে বসে আছে কয়েদি নাম্বার আঠেরো। বটগাছের আসপাশটা শান বাঁধানো। হাঁটু গেড়ে বসে সে ইটের টুকরো দিয়ে মেঝেতে কিছু একটা লিখে যাচ্ছে।
তার থেকে কয়েকশ’গজ দূরে কিছু সংখ্যক কয়েদি শরীর চর্চা করতে ব্যস্ত। ওদের মধ্যে সবথেকে বদ হিসেবে পরিচিত মনজুরুল শরীর চর্চা থামিয়ে দিয়ে কয়েদি নাম্বার আঠেরোর দিকে তাকায়। তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,”শা’লায় এই সব কি করে?”

শাওন নামের একজন জবাব দেয়,”শিক্ষিত বড় ঘরের পোলা না? তাই দেখাইতে চায় সবাইরে,আমগো ধারে কাছে ঘেঁ’ষে না,মাটিতে সারাদিন কি সব লেইখা বেড়ায়।”

মনজুরুল খানিকটা কৌতুহলী হয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। খুব কাছে গিয়ে বলে ওঠে,”এই শোন।”

কয়েদি নাম্বার আঠেরো চুপচাপ। মনজুরুল বলে ওঠে,”তোর কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভারি এবং হাস্কি গলায় কয়েদি নাম্বার আঠেরো বলে ওঠে,”এখান থেকে যা । ভালোয় ভালোয় কে’টে পর।”

মনজুরুল খানিকটা অপমানিত আর ক্রো’ধিত হয়ে সেখান থেকে চলে যায়। এই মালটাকে সে পরে দেখে নেবে। কত্তবড় বেয়া*দব।

কয়েদি নাম্বার আঠেরো তার হাত থামিয়ে একদৃষ্টে মেঝেতে “Urbi” লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here