আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_২৭ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৭
#Esrat_Ety

বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে ছিলো সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় রাত প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছে। ডাক্তার এখনও ফেরেননি। তবে খুব সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবেন।
উর্বী অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে। ধীরপায়ে হেটে সে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলমারি খুলে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটা বের করে হাতে নেয়। শায়মী বিকেলে যখন বলছিলো শাড়িটা পরতে উর্বীর তখনই শাড়িটা পরে নিতে মন চাচ্ছিলো কিন্তু তার দস্যি ননদ আর জা’দের জালাতনের কথা কল্পনা করে তখন পরেনি। তবে এই রাতে,যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে তখন তো একটু সাজাই যায়!

উর্বী শাড়িটাতে হাত বোলাতে বোলাতে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। কি লাভ! ডাক্তার থোরাই তাকে খেয়াল করে দেখবে! শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে,”আনারের জুস খেয়েছিলে? দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
দেখবে কি! সে হয়তোবা ভুলেই গিয়েছে এই শাড়িটা সে কিনেছিলো উর্বীর জন্য পছন্দ করে।

উর্বী তবুও শাড়িটা পরবে। সে ডাক্তারকে দেখানোর জন্য পরছে না। সে পরছে নিজের জন্য। তার স্বামীর দেওয়া প্রথম উপহার সে গায়ে জরিয়ে রাখবে।

****
রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার পা ধরে বসে থাকা তরুণী তাকে ছাড়ছে না। রাওনাফ নিজের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একসময় সে ধ’ম’কে ওঠে।
“স্টপ রুপা। পা ছাড়ো বলছি। যা বলার ওখানে বসে বলো। ”

রুপা উঠে বসে। রাওনাফ খুবই বিব্রত বোধ করছে। রুপা নামের মেয়েটি নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে, বলে,”স্যার আমি চাকরি টা হারাতে চাই না। আমি শেষ হয়ে যাবো স্যার। আমার ফ্যামিলি শেষ হয়ে যাবে। ”

_দেখো এখন তো আমি কিছু করতে পারবো না রুপা। তোমার জন্য আজ দুজন রোগীর জীবন যেতে বসেছিলো। রোগীর ফ্যামিলি রীতিমতো মামলা করতে গিয়েছিলো হসপিটালের নামে। এটা আমার হসপিটালের ইমেজের ব্যাপার রুপা।

মেয়েটি কাঁদতে থাকে। রাওনাফ বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ।
মেয়েটি ফোপাতে থাকে। “স্যার আমি এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করবো না। আমার চাকরি টা আমি চাই। প্লিজ আমাকে বের করে দিবেন না।”

রাওনাফ চুপ করে আছে।
মেয়েটি বলে,”আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। বলুন কি করতে হবে। প্রয়োজনে আপনার সাথে রাত কাটাতেও আমি রাজি কিন্তু দয়া করে আমার চাকরি টা আপনি কেড়ে নেবেন না স্যার।”

রাওনাফ রুপা মেয়েটির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।‌ মুহুর্তেই দাঁতে দাঁত চেপে সে টেবিলে সজোরে একটি চাপর দেয়।

রুপা লাফিয়ে ওঠে।
রাওনাফ ধ’ম’কে বলে,”আউট! যাস্ট গেট লস্ট। আই সেইড আউট!!”

রুপা কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে যায়।

রাওনাফ কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থেকে দু হাত দিয়ে চুল গুলো পেছনে ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ১৬ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই জ’ঘন্য অভিজ্ঞতা তার কখনোই হয়নি।

****
উর্বী শাড়ির আঁচল গায়ে তুলে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আয়নায়। সব ঠিকঠাক। তবে সমস্যা হচ্ছে তার গাঁয়ের ব্লাউজটা লাল রঙের। সবুজ রঙের শাড়ি,সাথে লাল রঙের ব্লাউজ। উর্বীর কাছে নিজেকে বাংলাদেশের পতাকা লাগছে,যেমনটা শর্মী বলেছিলো। কিন্তু তার কাছে সবুজ রঙের ব্লাউজ নেই। এই শাড়ির সাথে আর কোন রঙটা যাবে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে উর্বী কপাল কুঁ’চ’কে চলে যায় কাবার্ডের কাছে,কাবার্ড খুলে সে এবার বেছে বেছে একটা সাদা রঙের ব্লাউজ বের করে। তার হঠাৎ মনে হলো সাদা রঙটা সব একরঙা শাড়ির সাথেই মানায়। ব্লাউজ পাল্টে সে শাড়ির আঁচল ঠিক করে আবারও আয়নায় নিজেকে দেখে। কিন্তু এইবার সে নিজেকে দেখে রীতিমত হতাশ! সাদা-সবুজের সংমিশ্রণে এখন তাকে একটা পাকিস্তানের পতাকার মতো লাগছে। উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সে দ্রুত গিয়ে সাদা রঙের ব্লাউজ পাল্টে লাল রঙের ব্লাউজটাই পরে নেয়। পাকিস্তানের পতাকা হওয়ার চাইতে বাংলাদেশের পতাকা হওয়া ভালো। উর্বী দেশপ্রেমী!
এসব করতে করতেই উর্বীর আধাঘণ্টা কেটে যায়। তখন ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে বারোটা।

বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। উর্বী দোতলার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে, তারপর গিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকে। এতো রাতে ডাক্তার যদি দেখে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নটাঙ্কি করছে সেটা উর্বীর কাছে খুবই লজ্জার। তবে সে খুব করে চাচ্ছে রাওনাফের দেওয়া শাড়িটাতে রাওনাফ তাকে দেখুক,খেয়াল করুক, সে তো আর নিজে নিজে বেহায়াদের মতো বলতে পারবে না,”শুনছেন? আমাকে কেমন লাগছে!”

রাওনাফ ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই উর্বী বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ চোখ তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীর ঠোঁটে ছেয়ে আছে স্বামীর প্রতি আন্তরিক হাসি। রাওনাফ হঠাৎ টের পেলো ঐ হাসিতে তার সারাদিনের ক্লান্তি,গ্লানি,বিরক্তিভাব হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেলে। কেমন স্বস্তি লাগছে খুব। চারপাশটা অদ্ভুত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে। ঐ যে কথায় বলেনা? “ইটস্ মাই প্লেস!” সেরকম প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই চারদেয়ালের কামড়াটা। যেটা দীর্ঘ দশ বছর তাকে খুব একটা স্বস্তি দিতো না। দিনের শেষে বাধ্য হয়ে ঢুকতো এখানে। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করতো। বিছানাটাকে,এই ঘরটাকে তার কাছে একটা অন্ধকার মরুভূমি মনে হতো,যেখানে সে পরে থাকতো একটা বিন্দুর মতো।

রাওনাফ এগোনোর আগেই উর্বী গিয়ে তার হাত থেকে ব্যাগ আর এপ্রোন নিয়ে নেয়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের দৃষ্টি ধরতে না পেরে বোকার মতো বলে ওঠে,”কি দেখছেন! আমি আনারের জুস খেয়েছি কিছুক্ষণ আগে!”

রাওনাফ হেসে ফেলে তারপর হাই তোলার ভান করে বলে,”শাড়িটাতে ভালো লাগছে তোমাকে। মোটেও গাছের মতো লাগছে না।”

উর্বী ঘুরে দাঁড়ায়। তার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয় হাসিতে। মানুষটা তাহলে খেয়াল করেছে!

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ওয়ারড্রব থেকে টুপি বের করে। উর্বী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাওনাফকে দেখে বলে ওঠে,”মুড অফ আপনার?”

_না তো! একটু স্ট্রেসড্ !

আজ জামাতে এশার সালাত আদায় করতে পারেনি। দেরী হয়ে গেছে অনেক। উর্বী বিছানায় বসে বসে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সালাত আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই উর্বী বলে,”কিছু খাননি তো বোধ হয়।”

_হু,সময় পাইনি। আজ মেন্যুতে কি কি ছিলো?

_গ্রিলড পমফ্রেট, ভেজিটেবল চিকেন, চিকেন রোস্ট আর বিফ।

_এতোকিছু! কে রেঁধেছে? তুমি?

_হ্যা।

রাওনাফ হাসে। বলে,”ওরা তোমাকে দিয়ে বড্ড খাটায় তাই না?”

উর্বী মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমার খাটতে ভালো লাগে।”

রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। এতো রাতে আমি কিছু খাবো না আর। এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পরবো। আর তুমিও রোজ রোজ এতো রাত অবধি জেগে থেকো না। যাও শুয়ে পরো।”

_আমি আপনার জন্য ডাব চিংড়ি করেছিলাম।
আটকে আটকে কথাটা বলে উর্বী।

রাওনাফ প্রথমে শুনতে না পেয়ে বলে,”কি?”

_ডাব চিংড়ি।
নিচুস্বরে বলে উর্বী।

রাওনাফ কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আচার আচরণ, কথাবার্তা, সবকিছুতে তরুণী বধুদের মতো সংসারের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায়, এই আগ্রহ টুকু উপেক্ষা করা কোন পুরুষের সাধ্যি?

তারপর একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলে,”চলো। তবে ভাত খাবো না। শুধু মাছটা খাবো।”

উর্বী মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।

খাবার টেবিলে রাওনাফকে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। রাওনাফ খেতে খেতে বলতে থাকে,”তুমি আজ স্বামীকে ফেলে খেয়ে নিলে, তোমার শাশুড়ি মা কিছু বলেনি?”

কথাটা বলে রাওনাফ হাসে। উর্বী হেসে জবাব দেয়,”মা নিজেই আজ জোরাজুরি করেছে সবার সাথে খেতে।”

রাওনাফ বলতে থাকে,”এতো বাধ্যতা। এতো জোরাজুরি। হাঁপিয়ে ওঠো না?”

উর্বী মাথা নেড়ে জবাব দেয়,”আমার বাধ্য হতে আপত্তি নেই যদি বাধ্য করার মানুষ গুলো এমন হয়!”

রাওনাফ হাসে। মুখে কিছুই বলে না । উর্বী উঠে কিচেনে চলে যায়। টেবিলের ওপর ঢেকে রাখা সব খাবারের বাটি গুলো ফ্রিজে তুলে রাখে।

রাওনাফ খেতে খেতে উর্বীর সাথে টুকটাক কথা চালিয়ে যেতে থাকে। উর্বীর এই জিনিসটা খুব ভালো লাগে ইদানিং। লোকটা এমন ভাবে অতি সাধারণ টপিক গুলো নিয়ে উর্বীর সাথে কথা বলবে যেন মনে হয় উর্বী গুরুত্বপূর্ণ কেউ, উর্বীর সাথে এই জিনিস গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত ।

রাওনাফ কথা বলছে। উর্বী যদিও হু হা তে উত্তর দিচ্ছে কিন্তু সে মনে মনে হাসে। বাচ্চাগুলো একেবারেই লোকটার মতো হয়েছে। এতো কথা জানে অথচ প্রথমে মনে হতো বোমা পরলেও একটা কথা বেরোয় না মুখ থেকে।

“শর্মীর আপডেট কি!”

রাওনাফের প্রশ্নে ঘোর কাটে উর্বীর। তারপর বলে,”ক্লাস টেস্টে ইয়া বড় বড় দুইটা জিরো পেয়েছে। আপনাকে দেখাবে না তাই আমাকে দিয়ে সাইন করিয়ে নিয়েছে টেস্ট পেপারে আর তুলতুল এখনও শর্মীকে উর্বী বলে কেন ডাকে সেটা নিয়ে তার আফসোসের শেষ নেই।”

রাওনাফ হাসে। উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে টিস্যু পেপারে ভেজা হাত টা মুছে নিয়ে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে বলে,”ময়দা দিয়ে কি হবে!”

উর্বী ময়দা দিয়ে ডো বানাচ্ছিলো। মৃদু স্বরে বলে,”ডো বানিয়ে রেখে দেবো। একটা নাস্তা বানাবো সকালে।”

রাওনাফ খুবই মনযোগী হয়ে দেখতে থাকে। উর্বীর মাথায় হঠাৎ করে দুষ্টু বুদ্ধি চাপে,সে আড়চোখে রাওনাফকে একপলক দেখে পাশের বক্স থেকে এক মুঠো ময়দা নিয়ে রাওনাফের মাথায় দিয়ে দেয়।

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে যায় পুরো। উর্বী কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিলিয়ে হাসছে। রাওনাফ হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মাথা ঝাড়া দিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। সে রীতিমতো অবাক ত্রিশোর্ধ ভদ্রমহিলার এমন কিশোরীসুলভ আচরণে!

নাবিল পানি খাওয়ার জন্য উঠেছিলো। দরজা খুলে সে উর্বী আর রাওনাফকে একসাথে দেখে। উর্বীর এমন কান্ড দেখে নাবিল খেয়াল করলো নাবিলের বিরক্ত লাগছে না, তার বরং হাসি পাচ্ছে। সে কয়েক মূহুর্ত দু’জনকে দেখে ঘরের দরজাটা আবারও লাগিয়ে দেয়।

দরজা লাগানোর শব্দে রাওনাফ আর উর্বী চ’ম’কে ওঠে। তারপর যে যার নিজেদের কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে!

***
রাত দুইটা তেরো মিনিট। পুরো এরিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু রওশান মঞ্জিলের দোতলার উত্তরপাশের ঘরটিতে বাতি জ্বলছে।

রাওনাফ সেই তখন থেকে হাঁচি দিচ্ছে। এতো রাতে শ্যাম্পু করে গোসল করার ফলে রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। তার পাশেই অ’প’রা’ধীর মতো তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে উর্বী। একটু পরপর সে তোয়ালে দিয়ে রাওনাফের মাথা মোছাতে উদ্যত হয় আর কাঁচুমাচু মুখ করে বলে,”ভুল হয়েছে। আ’ম সরি!”

রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায়। বলে,”আনবিলিভেবল তোমার বয়স ত্রিশ। আচরণে মনে হচ্ছে বাইশ-তেইশের কোনো তরুণী। যে নিজেও জানে না সে কি করতে যাচ্ছে।”

উর্বী তোয়ালে ফেলে রাওনাফের পাশে বসে পরে। তারপর বিষন্ন ভঙ্গিতে বলে,”আমি বাইশ-তেইশের সেই উর্বীই। মাঝখানের আট বছর নেই। আমার জীবনটা ওখানেই আঁটকে ছিলো,এখন চলতে শুরু করেছে!”

রাওনাফ তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বী আবারও হেসে ফেলে । খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। রাওনাফ মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখে বলে ওঠে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার মৃদুলা উর্বী!”

উর্বী হাসি থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফের কথার মানে সে বুঝতে পারে না। রাওনাফ উর্বীর একটা হাত নিজের হাতে বন্দী করে বলতে থাকে,”মানে দেখতেও তোমাকে বাইশ-তেইশের কোনো মেয়েই লাগে। তোমার পাশে আমাকে মানাচ্ছে না। ইউ ডিজার্ভ বেটার! কোন হ্যান্ডসাম ইয়াং…।”

উর্বী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ হাসি চেপে রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী আয়নায় সামনে গিয়ে হাতে ট্যালকম পাউডারের কৌটা নিয়ে পাউডার বের করে নিজের মাথায় লাগিয়ে সামনের চুলগুলো সাদা সাদা করে ফেললো। রাওনাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে উর্বীর দিকে। উর্বী ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”হ্যা। আপনি বুড়ো। কি আর করা,আপনার বয়সটা তো আর কমাতে পারবো না। তাই নিজের বয়সটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দু’জনকে মানানসই করে নিলাম। দেখুন এখন ঠিকাছে না?”

রাওনাফ হেসে ফেলে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ উঠে এসে উর্বীর সামনে দাঁড়ায়। তারপর উর্বীর চুল পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর কপালে চুমু খেয়ে বলে,”না। এই চঞ্চল উর্বীই ঠিকাছে।”

উর্বী নরম গলায় বলে,”ইউ ডিজার্ভ বেটার। আমিই আপনার যোগ্য নই…..”

রাওনাফ উর্বীর ঠোঁটে আঙুল রেখে উর্বীকে চুপ করিয়ে দেয়। উর্বী চুপ হয়ে দেখে মানুষটাকে। সে ধীরে ধীরে নিজের কোমরে রাওনাফের বা হাতের স্পর্শ টের পায়। সে এই স্পর্শে কোনো মলিনতা খুঁজে পায়না। অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক ঠেকছে এই স্পর্শ। রাওনাফ উর্বীকে ঘুরিয়ে নিয়ে আলতো করে তার কাঁধ থেকে চুল গুলো সরিয়ে উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায়। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে নেয়। রাওনাফ উর্বীর কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,”তুমি বেটার নও,কিন্তু একজন বিধ্বস্ত রাওনাফ করীমের জন্য যথেষ্ট মৃদুলা উর্বী।”

সামান্য কথা! সামান্য স্বীকারোক্তি! তবুও উর্বী শিহরিত হয়। পুলকিত হয়। অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পরে তার শিরা উপশিরায়। চোখ বন্ধ রেখেই ঘুরে রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে।
রাওনাফ আগলে নেয় উর্বীকে। তার পিঠের কাছের টি-শার্ট খামচে ধরে রেখেছে উর্বী। ছাড়ছেই না। খানিকবাদে অনুভূতির সাথে চুক্তি করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচু স্বরে বলে,”আর আপনি যথেষ্ট নন, আপনি আমার কাছে তার থেকেও বেশি শর্মীর পাপা। আপনি আমার ন’ষ্ট জীবনের ভজন শুনে কান না পচিয়ে ফেলা লোক।”

উর্বীকে নিজের থেকে আলগা করে হাত ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। উর্বী সম্মোহিত দৃষ্টিতে শান্ত,গোছালো, দায়িত্ববান, কেয়ারিং মানুষটাকে দেখতে থাকে।
রাওনাফ বিছানায় শুয়ে উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দেয়। উর্বী সব সংকোচ সরিয়ে নির্দ্বিধায় রাওনাফের বুকে মাথা রাখে। যেন এটা তার বহু বছরের অভ্যাস।
বুক থেকে মাথা না তুলে নিচু স্বরে বলতে থাকে,”আপনি আমার ক্ষ’ত ভুলিয়ে দেওয়া স্বস্তি।”

রাওনাফ ম্লান হেসে দুহাতে উর্বীকে আগলে নেয়। নিজের বাহুবন্ধনে উর্বীকে পুরোপুরি আবদ্ধ করে নিয়ে বলে ওঠে,”আর তুমি একটা আদুরে হাঁসের ছানা।”

উর্বী হেসে ফেলে। হাসতে থাকে রাওনাফও। নির্মল, স্নিগ্ধ হাসি। রাত তখন তিনটা প্রায়। শেষ রাতের পাখিটাও ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে, তখন কোনো দম্পতি “বেচারা” দু’টো মন নিয়ে রচনা করে যাচ্ছে মহা-মিলনের এক অদ্ভুত সুন্দর গাথা। তারা ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত। একে অপরের মাঝে খুঁজে পেতে ব্যস্ত-আশ্রয়,নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা,ভরসা, ভালোবাসা,সুখ আর আরেকটিবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা।

ভালোবাসা-বাসির এই সময়টিতে উর্বীর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়নি সে রাওনাফের জীবনে বাড়তি কেউ। বরং সে আপ্লুত হচ্ছে এটা টের পেয়ে , সে একটা বিশেষ স্থান পেয়েছে ঐ মনে। ঐ হৃদস্পন্দন,ঐ স্পর্শ,ঐ ব্যকুলতা তাকে জানান দিচ্ছে এসব শুধু শরীরী টান নয় বরং এটা সমর্পণ। এই পরম স্পর্শে শরীর থেকে সেই যন্ত্রনাদায়ক স্পর্শের চিহ্ন যেন মিলিয়ে যাচ্ছে,একটু একটু করে,উর্বী শুদ্ধ হচ্ছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে উর্বী। আবেগ গড়িয়ে পরে তার বন্ধ দু’চোখ থেকে। যা রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হয়না। সযত্নে,পরম স্নেহে,অতি সাবধানতার সাথে মুছিয়ে দেয় সেই আবেগ। যেন উর্বী নামের এই ভাঙাচোরা মেয়েটির স্ত্রী সত্তা অসম্মানিত না হয়।

দু’হাতে দুই গাল আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে রাওনাফ বলে,”হাঁসের ছানা!”
উর্বী কেঁদে ফেলে, নিজেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ,দামী কেউ আবিষ্কার করতে পারার খুশিতে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে,ফোপাতে ফোপাতে রাওনাফের হাতের ওপর একটা হাত আলতো করে রেখে দেয়,রাখে না! একপ্রকার আঁকড়ে ধরে রাওনাফের হাত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আমাকে আপনি আগলে রাখুন। আমার খুব দরকার আপনাকে। প্লিজ আগলে রাখুন আমায় শর্মীর পাপা।”

চলমান…..

#নোট_বার্তা: ১০ তারিখ এক্সাম। কাল পরশু গল্প পাবেন না। তারপর থেকে নিয়মিত হবো। প্লিজ মানিয়ে নেবেন 🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here