আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_১০ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১০
#Esrat_Ety

উর্বী বসে আছে। বাইরে সবাই খুব হৈ হুল্লোড় করছে। বহুদিন পরে সবাই সবাইকে পেয়েছে। তাছাড়া এ বাড়িতে আজমেরীর ছোটো ননদের বিয়ে। রুমা আর তার পরিবারও এসেছে। আত্মীয় স্বজনে গমগম করছে পুরো বাড়ি।

উর্বী আর রাওনাফের জন্য দেওয়া হয়েছে দোতলার সবথেকে কোনার দিকের একটি ঘর। বাড়িটা কিছুটা পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির মতো,অনেক বড়। আজমেরীর স্বামী হাফিজুরেরা একান্নবর্তী পরিবার। উর্বীর এই ঘরটি অনেক পছন্দ হয়েছে। বিশাল বড় জানালা আর বড় একটা টানা বারান্দা তাও আবার দক্ষিনমূখী। উর্বী খাটের উপর চুপ বসে আছে। আঙিনায় সবাই হেসে হেসে উচ্চস্বরে কথা বলছে। সে ভেবে পাচ্ছে না তার সেখানে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা।

উর্বীর ঘরের দরজার বাইরে থেকে গ্রামের কিছু মহিলা আর বাচ্চারা উকি দিচ্ছে বারবার। তারা উর্বীকে দেখছে, ডাক্তার সা’বের নতুন বৌকে দেখছে।
উর্বীর ভিষন অস্বস্তি হচ্ছে। আজমেরী এসে মহিলাদের সরিয়ে দেয়,”আরে আপনারা এখানে! যান গিয়ে আগে পান-মিষ্টি খান! যান,যান!”
সবাই তাদের কৌতুহল সাময়িক ভাবে দমিয়ে নিয়ে চলে যায়। আজমেরী ভেতরে ঢুকে উর্বীকে বলে,”এখানে বসে আছো কেনো। চলো সবাই কত মজা করছে। চলো চলো!”

-না আপা আমি এখানেই ঠিক আছি।
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

-নাবিলের জন্য যাচ্ছো না? ও নেই, আমার কিছু চাচাতো দেবর আছে ওর সমবয়সী তাদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। তুমি চলো।আমার আত্মীয়রা এসেছে তোমাকে দেখবে বলে, তাদের আর কতক্ষন অপেক্ষা করাবো !

উর্বী আঁচল টেনে উঠে দাঁড়ায়। তার যেতে এতটুকুও ইচ্ছ করছে না।

***
এ বাড়িতে আজ হাফিজুরের ছোটো বোন চিত্রার গাঁয়ে হলুদ। ছেলের বাড়ি তাদের ঠিক পাশের বাড়িই। প্রেমের বিয়ে।
দুবাড়ির লোক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একই প্যান্ডেলের নিচে দু বাড়ির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। গাঁয়ে হলুদও হবে একই সাথে।‌ সবাই যখন বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। উর্বী তখন জমিদার বাড়ির মতো বিশাল এই বাড়ির দোতলার সবগুলো ঘর পরিদর্শন করতে ব্যস্ত। দু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বিয়ে বাড়ীর প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সাউন্ড বক্সে নব্বই দশকের হিন্দি গান বাজছে। হাফিজুরদের বাড়ি পুরো ফাঁকা। সবাই গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। বাড়িতে শুধু রয়ে গিয়েছে রাওনাফ আর উর্বী। উর্বী নিজের মনে ফাঁকা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাওনাফকে দেখে এসেছে একটার পর একটা ফোনকল রিসিভ করে কথা বলতে। হসপিটালের ফোন।

হঠাৎ দোতলার সিঁড়ি ভে’ঙে উপরে উঠতে থাকে হাফিজুরের আরেক বোন লতা। বয়স আজমেরীর কাছাকাছি। তার পেছনে রয়েছে এই বাড়ির কিছু বৌ, যারা সবসময় ঘোমটার আড়ালে থাকে। কিন্তু এরা একে অন্যের সাথে সবসময় অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে মজা করে। উর্বী বিকেলে গোসল করেছিলো, উর্বীর চুল ভেজা দেখে ঘোমটার নিচ থেকে লাজুক একটা মুখ বলে ওঠে,”ডাক্তার দেখছি তোমাকে তিন বেলা গোসল করাচ্ছে নতুন ভাবী।”

উর্বী হা হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মহিলা কথাটি বলেই তার এক জা’য়ের গাঁয়ে হাসতে হাসতে হু’মরি খেয়ে পরেছে। উর্বী এখানে আসার পর থেকেই একটু এড়িয়ে চলে আজমেরীর জা’গুলোকে,সাথে আজমেরীর ননদ লতাকেও।

উর্বীকে অবাক করে দিয়ে লতা মহিলা গুলোকে নিয়ে হুরমুর করে পশ্চিমের ঘরটাতে প্রবেশ করে। উর্বী বুঝতে পারছে না তারা কিভাবে জানলো উর্বী ঠিক এই ঘরেই আছে, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লতা এসে উর্বীর হাত ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বেড় করে। উর্বী অবাক হয়ে বলে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে আপনারা?”

_ডাক্তারের কাছে।
হাসতে হাসতে জবাব দেয় লতা।

_কেন?

_ওষুধ দেবে ডাক্তার।

উর্বীকে কিছু বলতে না দিয়ে সবাই উর্বীকে টেনে রাওনাফের ঘরে ঢোকায়। রাওনাফ এই মাত্র ডক্টর কিশোরের সাথে কনফারেন্স কল শেষ করে ল্যাপটপ চার্জে বসিয়েছে। উর্বী আর লতাদের দেখে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। লতা বলে,”প্যান্ডেলে যেতে হবে।”

_মানে!
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে বলে। পর পর বলে,
_দেখো,আমি হাফিজুরকে বলেছি লতা তোমরা আনন্দ করো,আমার কল আসছে একটার পর একটা হসপিটাল থেকে!

লতা এগিয়ে গিয়ে বলে,”ওসব কিছু শুনতে চাই না। চিত্রা আর সাকিবের গাঁয়ে হলুদের সাথে সাথে আরো অনেকের গায়ে হলুদ হচ্ছে সেখানে, সামিউল আর অন্তরারও হচ্ছে। আপনার আর নতুন ভাবীর টা বাদ থাকবে কেন? চলেন। এক্ষুনি চলেন।”

রাওনাফ অস্বস্তি নিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লতা বলে ওঠে,”নতুন ভাবীকে কোলে তুলুন।”

উর্বী হতভম্ব হয়ে লতার দিকে তাকায়। রাওনাফ বলে ওঠে,”হোয়াট!”

_হোয়াট ফোয়াট আবার কি? এ বাড়ির বিয়ে কি প্রথম দেখছেন? বর বৌকে কোলে করে নিয়ে যাবে। নিন, তাড়াতাড়ি ভাবীকে কোলে তুলুন।

রাওনাফ ধমক দিয়ে কথা বলতে জানেনা, নয়তো অনেক বড় সর একটা ধ’ম’ক দিতো লতাকে আজ। সে শুধু ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,”তোমরা গিয়ে আনন্দ করো লতা। আমার ফোন এসেছে হসপিটাল থেকে।”

উর্বী ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হতে চাইলে অন্যান্য মহিলারা উর্বীর হাত ধরে ফেলে। লতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”আমরা আমরাই তো বেয়াই! অসুবিধা কি? বিয়ে করতে পেরেছেন এখন ল’জ্জা পাচ্ছেন কেন!”

রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার বাচ্চারা রয়েছে লতা। এসব বন্ধ করো!”

_তাই নাকি! তাহলে বাচ্চাদের সামনে ভাবীকে নিয়ে ঘরের দরজার সিটকিনি কিভাবে লাগান!

উর্বীর কান গ’রম হয়ে গিয়েছে। রাওনাফ থতমত খেয়ে লতার দিকে তাকিয়ে আছে। লতার পেছন আজমেরী লতাকে ধ’ম’কে ওঠে,”লতা! কি হচ্ছে এসব!”

লতা মাথা ঘুরিয়ে তার ভাবীর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের বলে,”বেয়াই সা’বের সাথে মস্করা করছি! তুমি নাক গলাতে এসো না!”

আজমেরী ঘরে ঢুকে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইজান মোল্লা বাড়ি থেকে মোর্শেদ চাচা আর ওনার ওয়াইফ এসেছে,তুমি চেনো। তোমাকে পাঁচ বছর আগে দেখেছে। চলো ওনাদের সাথে কথা বলবে।”

রাওনাফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এই লতার খপ্পরে পরলে আজ মান সম্মানের বারোটা বেজেই যেতো। মনে মনে সে আজমেরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয়।

আজমেরী আর রাওনাফ চলে যায়। উর্বী চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে, লতা বলে,”পারলাম নাহ!”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এমনিতে কোলে তোলে তো অসুখ সারানোর বাহানায়?”

লতার পাশে দাঁড়ানো ভাবী দুজন উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। উর্বী নিচু স্বরে বলে ওঠে,”আমি নিচে যাচ্ছি।”

_হ্যা যাও। তোমার স্বামী ওদিকেই গিয়েছে!

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে লতা এবং বাকি মহিলারা। উর্বী দ্রুত পা ফেলতে থাকে।
দূরের প্যান্ডেল থেকে গান ভেসে আসছে,”আজ ব্লু হ্যা পানি পানি!” এটা নিশ্চয়ই শর্মী আর তার দলবলের কাজ!

***
আজ সকাল টা বেশ চমৎকার! কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ নেই বরং চারিদিকে শুধু পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ।
উর্বী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নেয়। রাওনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাওনাফ, হাফিজুর, শাফিউল, রুমার স্বামী সোহেল আর হাফিজুরের ভাইয়েরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে। রাওনাফ রাতে কখন ঘরে এসেছে তা উর্বী জানে না তবে সম্ভবত ফজরের আজান যখন দিয়েছে তখন রাওনাফ মসজিদে গিয়েছিলো টুপি হাতে,ঘুম ঘুম চোখে দেছিলো উর্বী,একটু একটু মনে আসছে!

শরীরটা খুব কাহিল লাগছে ইদানিং,বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। একজন গাইনোকলজিস্টের সাথে কি কথা বলে নেবে উর্বী !

দরজায় টোকা পরে হঠাৎ। উর্বী দরজা খুলে দেখে অন্তরা দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে,”কিছু বলবে?”
-বড় আপা দেখতে বলেছে আপনারা উঠেছেন কি না। তাহলে যেনো খাবার ঘরে যেতে বলে দেই।

-তোমরা কখন উঠেছো?

-আমরা খুব ভোরেই উঠেছি।

এই বলে অন্তরা চলে যায়। উর্বী খাবার ঘরের দিকে না গিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখান থেকে আজমেরীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে,মোহনা এবং বাকি মহিলারাও রয়েছে এ বাড়ির। উর্বী রান্না ঘরে ঢুকতেই আজমেরীর বড় জা রুকাইয়া বলে,”আরে এই যে আসল লোক এসে গিয়েছে। কিগো নতুন বউ ঘুম ভালো হয়েছে?”

উর্বী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। আজমেরী একথালা পিঠা ভেজে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে খাবার ঘরের দিকে যায়। রুকাইয়া উর্বীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”চোখের নিচে কালি কেন? রাওনাফ ভাইয়া ঘুমাতে দেয়না ঠিকঠাক মতো?”
উর্বী হতবাক হয়ে তাকায়। সে বুঝতে পারে না এ ধরনের মশকরায় কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। এ বাড়িতে মেয়েলী আলাপ যেদিক থেকেই শুরু হোক না কেনো তা শেষ হয় উর্বী রাওনাফের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে। যেনো আর কোনো প্রসঙ্গ নেই কথা বলার। অথচ অন্যান্যদের নিয়ে এতটা রসালো মশকরা কেউ করে না।

উর্বী চোখে মুখে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মোহনা বুঝতে পেরে বলে,”উর্বী মানে ভাবী দেখো তো রুমার মেয়ে মিশফা কোথায়। ও সকাল থেকে বড়মামী বড়মামী বলে তোমায় খুজেছে ।”

উর্বী যেনো হাফ ছেড়ে বাচে। সে এক প্রকার পালিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।

***
বিয়ে বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েকে পাশের বাড়িতে অর্থাৎ তার শশুর বাড়ীতে তুলে নেওয়া হয়েছে। বাড়িতে এখনও রাজ্যের মেহমান। সারাক্ষণ হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকে। উর্বীর এতো হৈ হুল্লোড় ভালো লাগে না তবে রাওনাফ করিম খানের তিনটা গোমরামুখো ছানা এখানে এসে আনন্দে মেতে আছে। উর্বীর এই ব্যাপারটা দেখতে ভালোই লাগছে।

দোতলার বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে। জ্বর আসার আগে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। শীতকালের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর সর্দি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উর্বী বৃষ্টিতেও ভেজেনি। এমনিতেও উর্বীকে অসুখ বিসুখ চট জলদি কাবু করে ফেলে ইদানীং। বাইরে বৃষ্টি এখনও থামেনি। রাওনাফের আজ ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। সে কোনো কারণে যেতে পারেনি। উর্বীর সাথে সকাল থেকেই তার কথা হয়নি। দোতলার রেলিং ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় ডক্টর রাওনাফ করিম খান তার তিন ছানাকে ধমকে শীতের পোশাক পরাচ্ছেন। উর্বী সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। শর্মী তার পাপাকে জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আহ্লাদী কন্ঠে বলছে,”সোয়েটার পরে নিতে পারি যদি তুমি আমাদের রেখে ঢাকা না চলে যাও তো।”

বায়না করছে পাপার কাছে। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। সে খুবই নিচু স্বরে তার ছেলে মেয়েদের কিছু একটা বলছে। দোতলা থেকে উর্বী শুনতে পাচ্ছে না সেসব কথা। সে শুধু রাওনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা সুখী একজন মানুষ। যার খুবই সরল একটা জীবন,যার জীবনটা সরল রেখায় চলে। ফজরের আজান হলেই উঠে মসজিদে যায়। মসজিদ থেকে ফিরে নিয়ম করে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে হালকা কিছু খেয়ে ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের খাইয়ে হসপিটালে চলে যায়,সেখান থেকে চেম্বার, বাড়িতে ফিরে পরিবারকে সময় দেয়। ইনি হচ্ছেন পৃথিবীর সবথেকে ব্যস্ততম সুখী মানুষ। কত সরল জীবন তার, উর্বী নামের জটিলতার সাথে শুধু শুধু জরিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
রাওনাফ একজন সুখী মানুষ, উর্বী একজন দুঃখী মানুষ। রাওনাফ একজন সরল মানুষ, উর্বী একজন জটিল মানুষ। রাওনাফ একজন আশীর্বাদ প্রাপ্ত মানুষ,উর্বী একজন অভিশপ্ত মানুষ। কিছুর মিল নেই, কিচ্ছুটির নেই।
না বয়স, না চিন্তা ভাবনার, না অবস্থানের, সবকিছুর অমিল। পরিস্থিতি এসে বলেছে,”তুমি তোমার জীবনের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের একটা জীবন জরিয়ে ফেলতে চলেছো, বলো,কবুল, কবুল, কবুল।”

আর দুজন বোকা মেরুদণ্ডহীন প্রানী, রাওনাফ করিম খান এবং মৃদুলা উর্বী বলে ফেলেছে, কবুল।

এতো অমিল অথচ একটা রে’জি’স্ট্রেশন পেপারে দুজনের স্বাক্ষর খুব যত্নে আলমারিতে পরে আছে।

উর্বী বাবা ছেলে মেয়েদের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বাচ্চাগুলো একেবারেই রাওনাফের মতো হয়েছে। চেহারার গঠন তাই বলে। তিনটা বাচ্চাই চমৎকার দেখতে। উর্বীর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বাচ্চাগুলোর নাক টিপে দিতে।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উর্বী রাওনাফের হাতের দিকে তাকায়। ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা লোকটার। আজ দুপুরে এ বাড়ির পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলো এ বাড়ির বড় পুকুরে। ছিপে একটা মাছ না গাথলেও রাওনাফের হাতে ঠিকই গেঁথেছে হুকটা। কেমন অদ্ভুত লোক! বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ক্ষ’ত হয়েছে।

উর্বী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ইচ্ছে করছে বিছানার সাথে মিশে যেতে। তবে সে নিশ্চিত, এখন বিছানা নিলেই তিনদিনের জন্য পরে থাকবে সে। শরীর তাই বলছে। ধীরপায়ে হেঁটে সে ঘরে ঢোকে। তাদের যে ঘরটিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘরটিতে একটা বিশাল বড় বইয়ের আলমারি আছে। বই দেখে প্রথমে উর্বী অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আলমারি খুলে দেখে সব কিশোর সংকলন।
উর্বী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনটাতে চার্জ নেই। ভুল করে সে চার্জার টা ফেলে রেখে এসেছে। কারো কাছ থেকে চেয়ে আনারও প্রয়োজন বোধ করেনি সে,তার ফোনে বিশেষ কোনো কাজ নেই।

দরজা ঠেলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী ঘা’ড় ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফের হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ নিজের ব্যাগ গোছাতে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দেয়। উর্বী বলে ওঠে,”আপনি চলে যাচ্ছেন?”

রাওনাফ তার ব্যাগ এনে বিছানার উপরে রেখে বলে,”হু।”

এক হাত দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। উর্বী বলে,”হেল্প করবো?”

রাওনাফ ম্লান হেসে বলে,”পারবো।”

কথাটি বলতে না বলতে ব্যান্ডেজ করা হাতের সার্জিক্যাল গজ কাপড়ের সাথে চেইনের হুক আটকে যায়,রাওনাফ খেয়াল না করেই বাম হাত দিয়ে চেইন ধরে টান দিতেই ডান হাতে ব্যাথা পায়। টান লেগে যাওয়ায় হাত দিয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝ’রতে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্তের ঘটনায় উর্বী হতভম্ব। সে বেড সাইডের টেবিল থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে রাওনাফের মুখোমুখি বসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আমাকে বললেই হতো।”

রাওনাফ কিছু না বলে র’ক্তা’ক্ত ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলে। উর্বী রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলে,”জ’খম টা মারাত্মক। কাউকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতে বললেই তাকে জোর করা হয়না,তাকে অ’ত্যা’চার করা হয় না। বলতে পারতেন আমাকে।”

রাওনাফ চুপ করে থেকে উর্বীর দিকে একপলক তাকায়। উর্বী নতুন করে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে,”আপনি বসুন। আমি রুমা আপাকে ডেকে আনছি ‌। আপনার ব্যাগ গুছিয়ে দেবে।”

***
রাওনাফের ঢাকা যাওয়া হয়নি। শর্মী পাপাকে যেতে দেবে না তাই গাড়ির চাবি লুকিয়ে রেখেছে।

সন্ধ্যার পর থেকে উর্বীর শরীর টা খারাপ হতে শুরু করে। রাওনাফ নিচ তলায় গিয়েছে। উর্বী ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

বাইরে থেকে রুমা উকি দিয়ে ডাকে,”ভাবী বের হও না। সন্ধ্যা বেলায় কি শুয়ে আছো! নিচে সবাই গানের কলি খেলছে। মালাই চা আর আলুর চপ আছে সাথে।”

-আমার শরীর টা ঠিক লাগছে না আপা। তোমরা আনন্দ করো।

-সে কি! কি হয়েছে!
রুমা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে।

-মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর আসতে চলেছে। মাথা টা ভারি হয়ে আসছে।

রুমা এসে উর্বীর কপালে হাত দেয়।
-তাইতো! তোমার গা তো বেশ গরম হয়ে আছে। হঠাত এমন হলো কেনো!

-মাঝেমাঝে আমার সাথে এমন হয়। আমি অভ্যস্ত এতে।

-দাড়াও ভাইয়াকে ডাকি।

রুমা উঠে যেতে চাইলে উর্বী তার হাত টেনে ধরে। আস্তে করে বলে,”তোমার ভাইয়াকে ডাকতে হবে না আপা,কিছু হলে আমি ওষুধ খেয়ে নেবো।”
রুমা উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,”আমি ভাইয়াকে ডাকতে যাচ্ছিলাম কারন সে একজন ডাক্তার। এই সময় যদি তোমাকে জ্বর পেয়ে বসে তাহলে সবার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি চাও না ভাইয়া আসুক,এসে তোমাকে দেখুক।”

-না আসলে এই সামান্য ব্যাপারে তাকে ডাকার, তাছাড়া তার হাতে ব্যা’থা।

রুমা উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”বুঝেছি। ডাকবো না আমি। কোনো অসুবিধে হলে আমায় ডেকে নিও।”

রুমা চলে যায়। উর্বী এক দৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রাওনাফ রুমে ঢুকে দেখে উর্বী ঘুমিয়ে আছে। রাতে সে খেতেও যায়নি। রুমা ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছিলো। খাবারটা ঠিক সেভাবেই পরে আছে।
রাওনাফ গিয়ে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পরে। হাতের ব্যাথাটা কিছুটা কমেছে।

কিছুক্ষন পরে রাওনাফ খেয়াল করে উর্বী কি যেনো বিড়বিড় করছে।

রাওনাফ বুঝতে পারে না কিছু। সে উঠে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে উর্বী কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রাওনাফ ডাকে,”উর্বী!কোনো সমস্যা!”

উর্বী উত্তর দেয় না। সে জ্বরে প্র’লাপ বকছে। রাওনাফ শুনতে পায় উর্বী “মা মা” বলে কিসব বলছে। যেটুকু বলছে খুবই অস্পষ্ট!

রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে, কাউকে কি ডাকবে! সে অনেকটা সংকোচ নিয়ে উর্বীর কপালে হাত রাখে। কপালে হাত রাখতেই সে চ’মকে ওঠে। উর্বীর শরীর জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে। রাওনাফ উঠে দ্রুত তার ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিয়ে আসে। উর্বীর কপালে ধরতেই সে দেখতে পায় তাপমাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অথচ সন্ধ্যায় যখন দেখা হয়েছিলো তখন দেখে মনে হয়নি মেয়েটা অসুস্থ!
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে রুমাদের ঘরের কাছে যায়। রুমার দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পরে রুমা ঘুম চোখে বের হয়ে আসে,”কি হয়েছে ভাইয়া?”

-তুই একটু আমার রুমে আয় তো।
রুমা অবাক হয়ে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকেই রাওনাফ বলে,”বুঝতে পারছি না কি করা যায় বলতো।এতো জ্বর উঠেছে। ডাকলে সারাও দিচ্ছে না।”

রুমা দ্রুত উর্বীকে গিয়ে ধরে,”ও ভাবী। শুনতে পাচ্ছো কথা আমার!”
উর্বী কোনো কথা বলতে পারে না। কাঁ’পতে থাকে।

রাওনাফ বলে,”ইমেডিয়েটলি আমাদের জ্বর নামাতে হবে। তুই একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ নিয়ে আয়।”
রুমা দৌরে আজমেরীকে ডেকে তোলে। তারপর একটা মগ আর পানি ভর্তি বালতি নিয়ে আসে।
উর্বীর কাঁপুনি থামছেই না।

আজমেরী উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘরে ঢুকে বলা শুরু করে,”রাতে বললো ওষুধ খেয়েছে। বললাম ভাইজানকে বলি, বললো জ্বর হলে কি ওষুধ খেতে হয় তা আমি জানি। তোমার ভাইয়াকে বলতে হবে না। আজ তো আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজেছি। ভাবী তো ভেজেনি! হঠাৎ এমন জ্বর উঠবে কেন!”

রাওনাফ বলে,”ঠান্ডা থেকে এই জ্বর হয়নি। দেখেই তো মনে হচ্ছে ইমিউনিটি কম। মাথায় পানি ঢালতে থাক।”
রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালতে থাকে। রাওনাফ আজমেরী কে বলে,”তুই যা, গিয়ে ঘুমা। বিয়ে বাড়ির ধকল গিয়েছে তোর উপর দিয়ে। রুমা আছে,ও দেখবে।”

আজমেরী আরো কিছু সময় থেকে রাওনাফের জোরাজুরিতে চলে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালে, তাপমাত্রা একটু কমে আসতে শুরু করেছে।
হঠাত রুমার মেয়ে মিশফা কেঁদে ওঠে। রাওনাফ বলে,”তুইও যা।আর পানি ঢালার প্রয়োজন নেই। আমি দেখছি।”

-তুমি পারবে?
রুমা অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।

-হ্যা। তুই যা।
রুমা চলে যায়। রাওনাফ বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে পরে।

উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”উর্বী।”
উর্বী কোনো সা’ড়া দেয়না। রাওনাফের চোখ চলে যায় উর্বীর হাতের দিকে। ডান হাতের কব্জির কাছটাতে বিরাট ক্ষ’ত। এটা সে সেদিন খেয়াল করেছে পালস রেট চেক করতে গিয়ে। রাওনাফ ম্লান হাসে। সে একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছে তার ডাক্তারি জীবনে,তার কাছে এ পর্যন্ত সতেরো-ত্রিশ বছর বয়সী যতগুলো মেয়ে পেশেন্ট এসেছে,তাদের মধ্যে ৭০% মেয়েদের হাতে, কব্জিতে কাটার চিহ্ন। বাংলাদেশের এই স্টেজের মেয়েরা চারিত্রিক ভাবে খুব আবেগী থাকে। শিমালার কথা মনে পরে যায় রাওনাফের। শিমালার বাবা মা যখন জেনে গিয়েছিল রাওনাফের সাথে শিমালার সম্পর্ক রয়েছে তখন মেয়েটাকে প্রচুর মা’রধর করেছিলো। রাগে, দুঃখে, রাওনাফকে না পাওয়ার যন্ত্র’না’য় হাতের শিরা কাঁটার চেষ্টা করেছিলো শিমালা।
উর্বীও কি ঐ আবেগী কাতারের মেয়ে? দেখে তো মনে হয় না! এই মেয়েটিও কারো জন্য হাত কেটেছিল তরুণী বয়সে! ক্ষ’তটা দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছরের পুরনো।
হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায় রাওনাফ। শিমালার সাথে এই মেয়েটির চেহারার কোনো মিল নেই কিন্তু এই মেয়েটির থুতনিতে টোল আছে, যেটা শিমালারও ছিলো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফ আবার ডাকে,”উর্বী!”

উর্বী কিছুটা সময় নিয়ে “হু” বলে সারা দেয়। রাওনাফ বলে বলে, “কি কি ওষুধ খেয়েছিলে রাতে? নাম বলো।”

উর্বী আবারো “হু” বলে। রাওনাফ বুঝতে পারে উর্বী ঠিক নেই। সে উঠে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী। তুমি দেখছি দিনকে দিন আমাকে তোমার পার্সোনাল ডক্টর বানিয়ে ফেলছো। কি অদ্ভুত!”

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here