আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন ,৪র্থ পর্ব,৫

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন ,৪র্থ পর্ব,৫
লেখা: জবরুল ইসলাম
৪র্থ পর্ব

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। ছাদের চারপাশে পিনপতন নীরবতা। বাড়ির উঠোনে দু’একটা কুকুর মাঝেমাঝে ‘ঘেউ-ঘেউ’ করছে। হাওরের জমি থেকে পানির মেশিনের ডাক থেকে থেকে ভেসে আসছে। নাম না জানা অসংখ্য পোকারা অনবরত অদ্ভুত শব্দে ঘোর লাগানো ‘খেউ-খিউ খেউ-খিউ’ করছে।
ঠিক তখনই রাতের সমস্ত নীরবতাকে ফালাফালা করে মোবাইল বেজে উঠলো।
জিসান রুম থেকে বের হয়। সতর্কভাবে চারদিক দেখে এসে ফোনটি রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে কেউ রাগান্বিত গলায় বলল,
– ‘তুই আবার লিখালিখি শুরু করেছিস জিসান?’

– ‘হা-হা-হা আমি থামব না।’

– ‘কেন থামবি না? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন এসব করবি? তোকে তারা চিঠি, ইমেইল সবকিছুর মাধ্যমেই সতর্ক করেছে৷ তবুও পাগলামি করছিস কেন?’

– ‘যা সত্য তা আমি বলে যাব।’

– ‘অসুস্থ মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা এসব জিসান। এখনও বুঝার চেষ্টা কর। তোর এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কি দরকার? তুই কি দেশের প্রেসিডেন্ট? তুই কি কবি-সাহিত্যিক না-কি বিজ্ঞানী? এসব বাদ দিয়ে সুন্দর সুস্থ জীবন-যাপন কর।’

– ‘আমি এভাবে থাকতে পারি না। ইচ্ছা করে মনের সমস্ত জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে দেই। আমার চিন্তাকে বদ্ধঘরে আঁটকে রাখতে যাব কেন? আমি কোনো অদৃশ্যের বিধানে প্রভাবিত হতে চাই না। ইচ্ছে করে অন্যদেরও মনোজগতে তীব্র আঘাত করি। যুগ যুগ ধরে যারা ধোঁয়াশা শক্তির দাসত্ব করে আসছে। অদৃশ্যের বিধানে বিভেদ হয়ে আছে। আমার অনেককিছুই আজকাল সহ্য হয় না। তাই প্রকাশ করি। তাতে কার কোথায় আঘাত লাগল দেখতে চাই না।’

– ‘তুই কোন চ্যাটের বাল রে ভাই? তোর ভালো না লাগলে চুপচাপ থাক। তোকে কেউ টানছে না দাসত্বের জন্য। আর নিজের জিজ্ঞাসা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যদের বিভ্রান্ত করবি কেন? এটা কি ভালো লক্ষ্য? ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ। অন্তর্যামী এক সর্বশক্তিমানের ভয় থাকা কিন্তু মানব সমাজের জন্য উপকারী। মানুষ সেই ভয়ে নিরাপদে, অগোচরে, বদ্ধঘরেও অন্যায় অবিচার করতে ভয় পায়।

– ‘আমার জিজ্ঞাসা ছড়িয়ে পড়লে যদি মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায় তারমানে তার অন্ধ বিশ্বাসী। যারা প্রকৃত বিশ্বাসী তারা কেন বিভ্রান্ত হবে? তাদের কাছে অই জিজ্ঞাসার উত্তর নাই কেন? থাকলে তো বিভ্রান্ত হবে না। আর মিথ্যে শক্তি দিয়ে ভয় দেখানো কি অন্যায় নয়? কেন মিথ্যে এক অদৃশ্য শক্তির ভয় দেখিয়ে অন্যায় থেকে দূরে রাখতে হবে। নিজের বিবেক-বিবেচনার বিচারে মানুষ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে না?’

– ‘না পারে না৷ মিথ্যের ভয় থাকা দরকার আছে। অবুঝ মূর্খদের জন্য হলেও ভয় থাকা ভালো। তুই দেখ, আমরা শিশুদেরকে কি মিথ্যে ভয় দেখাই না? আমরা কি বাচ্চাদেরকে দুষ্টামী থেকে বিরত রাখতে মিথ্যে বলি না বাঘ আসছে, ওখানে শেয়াল আছে, দুষ্টামী করলে ভূত এসে নিয়ে যাবে। সেরকম মূর্খ অবুঝ মানুষের জন্য হলেও অদৃশ্যের ভয় থাকা দরকার। তাই যারা অবিশ্বাসী তাদের চুপ থাকা ভালো৷ যারা বিশ্বাসী তাদেরকে বিভ্রান্ত না করা সমাজের জন্য মঙ্গল।’

– ‘হা-হা-হা ভালোই যুক্তি দিচ্ছিস।’

– ‘হ্যাঁ যুক্তিগুলো মেনে নিয়ে সহজ সুন্দর জীবন-যাপন কর। জীবনকে জটিল করে ফেলেছিস তুই। সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারলেই জীবনের অর্ধেক জটিলতাই দূর হয়ে যায়। আমরা যখন খুব ছোট ছিলাম তখন পরিবারের উপর দিয়ে হাজারটা বিপদ-আপদ ঝামেলা এলেও দুশ্চিন্তা করতাম না। নিজেদের মতো খেলাধূলা করে কাটিয়ে দিতাম। এর কারণ কি জানিস? কারণটা হলো আমাদের বাবা ছিলেন৷ আমরা জানি উনি সবকিছু সামলে নিবেন। ঠিক তেমনি পৃথিবীর সব মানুষের একজন সর্বশক্তিমান বড় বাবা থাকা দরকার। যার উপর কিছু কিছু বিষয়ে ভরসা করে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। অবিচারের বিচার দেওয়া যায়৷ জীবনটা অনেক সহজ করা যায়। সুতরাং এখনও সময় আছে। এসব বাদ দিয়ে নিজের মতো চল। তাছাড়া এসবের বিরুদ্ধাচরণ করে অনেকেই রাস্তাঘাটে তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরেছে। সুতরাং কমপক্ষে নিজের ভালোর জন্য হলেও চুপ থাক। ভালো থাকিস, রাখছি।’

ফোন রেখে এই ব্যাপারটা জিসান পুরোপুরি মাথা থেকে মুছে ফেলল। সে এখন ভাবছে টেবিলের উপর থেকে পারফিউম গেল কোথায়। প্যান্টের পকেটে একশো টাকার নোট ছিল। সেটাও নাই। ঘুম এলো তার রাত দু’টার দিকে। এক ঘুমে ফজর। ইমরাজ সাহেবের ডাকে ঘুম ভাঙলো। দু’দিন থেকে তারা এক সঙ্গে নামাজে যান। ফজরের ওয়াক্তে ডেকে নেন ইমরাজ উদ্দিন। আজও দু’জন ফজরের নামাজ পড়ে এলেন। জিসান সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় গুনগুন আওয়াজ শুনতে পেল। আওয়াজ লক্ষ্য করে সে কান পেতে এগুলে বুঝতে পারে কোনো এক তরুণী অসম্ভব সুন্দর গলায় কোরআন তেলাওয়াত করছে। কিন্তু কে সে? সায়মা না-কি? এ বাড়িতে সায়মা ছাড়া কোনো তরুণী আছে বলে সে এখনও জানে না।
সায়মা পড়তে এলে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে৷ ঠিক তখনই পেছন থেকে বক্কর আলী সালাম দিল। জমিলার ওখান থেকে সে ফিরেছে। ভালোমন্দ কথা বলতে বলতে দু’জন সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে গেল। খানিক্ষণ গল্পগুজব করে গরু নিয়ে মাঠে যাবে বক্কর। ঘাস কাটবে। সারাদিন নানান কাজ আছে তার।

– ‘কোথায় ছিলেন বক্কর ভাই? কাল থেকে দেখলাম না।

– ‘মাস্টার সাব গেছলাম বাবা বালতিশার মাজারে। উরছ আছিল। আফনার লাগি আল্লা পাকের কাছে দোয়া করছি। আফনে বড় ভালা মানুষ মাস্টার সাব।’

– ‘তাই না-কি? কি দোয়া করলেন?’

– ‘এসব বলতে নাই মাস্টার সাব। সফন আর দোয়া খইলিলে শেষ।’

– ‘ও আচ্ছা।’

রুমে গিয়েই জিসানের মনে পড়ে গেল পারফিউম আর একশো টাকার কথা।
সে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
–‘বক্কর ভাই আমার টেবিলে পারফিউম ছিল আর এই প্যান্টের পকেটে একশো টাকার নোট৷ কিন্তু এখন পাচ্ছি না।’

বক্কর আলীকে খুবই উত্তেজিত দেখা গেল। অবাক হয়ে বলল,
–‘কিতা খইন মাস্টার সাব। পারফিউম নাই৷ কারবারটা দেখছইন্নি খবিশ জীনের।’

জিসান ভুরু কুঁচকে বলল,
-‘খবিশ জীনের কারবার মানে?’

– ‘আফনে জানইন না খবিশ জীন কারা? এরা হইছে গিয়া ফেরতনী। চুরিচামারি করে বুচ্ছইন্নি। ভূত, ফেরত, জীন ইতা যে বেতালা জিনিস।’

ইমরাজ সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-‘কিতা বকবক করছিস রে বক্কইরা।’

জিসান আগ বাড়িয়ে বলতে গেছিল ‘কিছু না’ তার আগেই বক্কর আলী বলল,
– ‘চেয়ারম্যান চাচা মাস্টার সাব ওর পাফোম না কিতা খবিশ জীনে নিচেগি।’

– ‘জীনে না তুই নিচত?’

– ‘ইয়াল্লা ইয়াল্লা চাচা কিতা খইলা৷ আল্লাহ পাকের আরশ কাইপা উঠব৷ কসম কইরা খইলাম আমি যুদি নিয়া থাকি মরার পর কুত্তার গু খাইমু। ফেরেশতা উস্টা মাইরা আমারে হাবিয়া দোজখে ফালাইবা। মাস্টার সাবরে আমি বড় ফছন্দ খরি। ইতা ফেরত্নীর খাম চাচা।’

– ‘আচ্ছা যা, মাস্টার সাবরে নাস্তা দেওয়ার ফর গরু লইয়া যা।’

কথাটি মুখ থেকে ডেলিভারি দিয়ে জিসান খুবই বিব্রতবোধ করছে। বিষয়টি জেনে গেলেন ইমরাজ সাহেবও। বক্কর আলী বের হয়ে যাবার পর ইমরাজ সাহেব বললেন,
-‘মাস্টার সাব বারইয়া গেলে দরজা তালা মাইরা যাইবা, তালার ব্যবস্থা খইরা দিরাম আমি।’

জিসান সম্মতি জানাল। বক্কর আলী দু’জনের নাস্তাই এখানে দিয়েছে।
ইমরাজ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
– ‘বক্কইরার খতা ফালাইবার নায় মাস্টার সাব। ফেত্নী ছোট থাখতে আমি নিজের চৌকে দেখছি…।’
শুরু হল ইমরাজ সাহেবের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভূত-পেত্নীর গল্প।
যা অবিশ্বাসী জিসানের কাছে বেশ হাস্যকর লাগছে।

—-
বাড়ির পেছনের একটি রুমে বসে ঘনঘন সিগারেট টেনে চলছেন চেয়ারম্যান ইমরাজ৷ এখানে তাদের বৈঠকখানা। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছে আগামীতে মেম্বার পদপ্রার্থী আখলাছুর রহমান। তার বয়স এখনও পয়ত্রিশ পেরোয়নি। তবুও মাতুব্বরি করার জন্য চেহারায় এবং কথাবার্তায় বয়স্ক সাজার চেষ্টা লক্ষণীয়। যেমন চাদর গায়ে দিয়ে পেছনে হাত নিয়ে গম্ভীরমুখে ঝুকিয়ে ঝুকিয়ে হাঁটবে। কথায়ও মুরব্বিয়ানার স্পষ্ট ছাপ।
এই মূহূর্তে বেশিরভাগ কথা হচ্ছে নারায়ণ দেবকে নিয়ে। চেয়ারম্যানও খুব দুশ্চিন্তায় আছেন।
নারায়ণ ছিলেন ইলাশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখন তিনি অবসরে আছেন। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি ফার্মেসিতে চাকুরী করতেন। সেই সুবাদে ঔষুধ-পত্রের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্টেথোস্কোপেরও ব্যবহার জানেন। অল্প কিছু বিদ্যা দিয়ে চাকুরী জীবনের অবসরে এলাকায় ফ্রী সেবা শুরু করেছেন। প্রতিদিন ঘুরে বেড়ান। শরীরের জন্যও ভালো হয়। মানুষের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাৎ হয়। বড় ভালো লাগে নারায়ণের। বহু বছর আগে স্ত্রী-পুত্র সব ইন্ডিয়া চলে গেছে। তিনি একা একা থাকেন। ইন্ডিয়া কালেভদ্রে যান৷ তখন পরিবারও দেশে ফিরতে দিতে চায় না। কিন্তু সেখানে যেন নারায়ণ মাস্টারের দমবন্ধ লাগে। নিজের জন্মভূমিতে আবার ফিরে আসেন। শুধু এলাকা ঘুরে ফ্রী সেবা নয়। গরীব ছেলে-মেয়েকে ফ্রী টিউশনি করান। সারাদিন পাখির মতোন বাচ্চাদের কিচিরমিচির বাড়িতে লেগে থাকে। বড় ভালো লাগে নারায়ণ মাস্টারের। এই নিয়ে চারবার ইলাশপুরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান হচ্ছেন ইমরাজ উদ্দিন। এটার জন্য তিনি খুব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটান। কিন্তু মার খেতে যাচ্ছেন নারায়ণের কাছে। লোকটি ধীরে ধীরে এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইমরাজ উদ্দিনের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল এলাকার মানুষজন আজকাল গাছের প্রথম লাউটা পর্যন্ত নারায়ণকে আগে দিয়ে পাঠায়। তখন খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পাত্তা দেয়া উচিত ছিল। এলাকার কিছুসংখ্যক মানুষ নারায়ণকে চেয়ারম্যান প্রার্থীতে দাঁড় করাতে চাচ্ছে।

অন্তরা চুলোয় চা বসিয়েছে। টুলে বসে আছে বক্কর আলী৷ বৈঠক খানায় চা নিয়ে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে তার আর কোনো কাজ নেই।
– ‘অন্তরা আফা মাস্টার সাব আস্কে তোমার কোরান পড়া শুনছে।’

চুলোর আগুনে চুঙ্গা ফুঁকে অন্তরা অবাক গলায় বলল,
– ‘কিতা খও? কোন সময়?’

– ‘ফজরের বাদে দেখলাম স্যার দেয়ালের লগে কান মেরে শুনছেন।’

অন্তরার লজ্জায় মুখ লাল৷ পরক্ষণেই আবার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম দিনের ভালো লাগা সে বুকের ভেতর কবর দিয়ে দিয়েছে৷ তাছাড়া সায়মা যার জন্য পাগল হয়ে আছে৷ তার দিকে তাকানোও পাপ। অন্তরা মাস্টারের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বলল,
– ‘বক্কর ভাই খয় কাফ চা? মানুষ খয়জন?’

– ‘আরজন.. বলেই বক্কর আলী জিভ কামড়ে বলল, ‘আটজন।’

মুচকি হাসল অন্তরা। তারপর গুনে গুনে আটটি কাপে চা ঢেলে বক্কর আলীর হাতে ট্রে দিল। নিজে একটি কাপ নিয়ে গেল চাচীমার রুমে। চেয়ারে বসে আছেন রাশেদা বেগম। অন্তরা চা’র কাপটি হাতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চা সহ গরম কাপ উড়ে এলো অন্তরার দিকে। রাশেদা বেগম মাঝেমাঝে এভাবেই রেগে যান। অন্তরা এই বাড়িতে আসার পরেরদিন সন্ধ্যায় রাশেদা বেগম বাথরুমে পা পিছলে খুব বাজেভাবে পড়ে যান। এরপর থেকে পঙ্গু। বিছানা থেকে কোলে করে অন্তরাই চেয়ারে বসায়, টয়লেটে নেয়। তবুও সেই প্রথম থেকে দোষী মনে করেন অন্তরাকে৷ কথায় কথায় বলেন কুলক্ষী, অপেয়া, সর্বনাশী। অন্তরা প্রতিবাদ করে না। খারাপও লাগে না। কেবল কেউ মারলে ব্যথা পায়। মাঝে মাঝে কাঁদে। শিশুদের মতন কাঁদে। মেয়েটি নারী হয়ে উঠেছে কেবল শরীরে। মননে এখনও শিশু। গৃহবন্দী জীবনের অভিজ্ঞতাও এই এতটুকু। পড়ালেখাও করা হয়নি। তবে কাজকর্ম শিখেছে বেশ। এ বাড়িতে আসার পর থেকে একাই এই পরিবারের সমস্ত কাজ করে যাচ্ছে।
চা’র কাপটি এসে অন্তরার গলায় পড়েছে। গরম চা গলা থেকে কোমল শরীর বেয়ে নেমেছে পেট অবধি। প্রথমে যন্ত্রণায় চিৎকার দিতে গিয়েছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়েছে নিজেকে৷ চিৎকার দেওয়ার পরের অভিজ্ঞতা অন্তরার হাড়েহাড়ে মুখস্থ-ঠোঁটস্থ আছে। সে কেবল তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে জগ নিয়ে কলতলায় চলে গেল।
–চলবে–
লেখা: জবরুল ইসলাম

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৫ম পর্ব
.
রোজকার মতো আজও পড়তে এসেছে সায়মা। আসার আগে নিজের সমস্ত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টাও করা হয়েছে।
পড়ানোর একপর্যায়ে জিসানের মনে পড়ে গেল ভোরের কোরআন তেলাওয়াতের কথা।
– ‘সায়মা তোমাদের বাসায় তো আর কোনো মেয়ে নাই। সকালে কার কোরআন তেলাওয়াত শুনলাম?’

– ‘আছে তো, অন্তরা।’

– ‘তাই না-কি। আগে কখনও দেখিনি তো। কে সে?’

– ‘আমাদের বাসার কাজের মেয়ে।’

– ‘বাহ, মেয়েটি খুব সুন্দর তেলাওয়াত করে।’
সায়মার মন মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে বাসায় যেইই এসেছে শুধু অন্তরার প্রশংসা।
ভাবনায় ছেদ করে জিসান বলল,
– ‘বাই দ্যা ওয়ে। তুমি এখন পুরোপুরি শুদ্ধ করে কথা বলতে পারছো দেখছি।’

এতটুকু প্রশংসাতে সায়মা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল। মন খারাপ ভাবটাও পুরোপুরি কেটে গেল।
জিসান খানিক ভেবে আবার বলল,
– ‘আচ্ছা একটা ব্যাপার বল তো। আমি জানি তোমার মা অসুস্থ৷ এর আগে কাজের মেয়ে আছে বলেও জানতাম না। ভেবেছিলাম এতো সুস্বাদু রান্নাটা তুমিই করো। তবুও তোমাকে যতটুকু জেনেছি বিশ্বাস হতো না তুমি এতো ভালো রান্না করতে পারবে। এখন বুঝলাম অই কাজের মেয়েটিই রাধুনি। তাকে দেখি না কেন? কোরআন তেলাওয়াত আর রান্না সব মিলিয়ে একদিন দেখতে ইচ্ছে করছে৷’

সায়মার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। অই কুলক্ষী অপেয়া মেয়েটি তাদের মাঝখানে ঢুকে যাচ্ছে না তো? তবুও সে ভদ্রতার জন্য বলল,
-‘আচ্ছা একদিন দেখা করিয়ে দেব।’

– ‘ঠিকাছে। এখন আমরা পড়ায় আসি। শোন আমাদের দেশের শিক্ষকরা কিন্তু পরীক্ষার পেপার দেখায় মোটেও সৎ না। তাই একটা স্টুডেন্টের হাতের লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংলিশ যেমনই হোক৷ বাংলা লেখা কিন্তু মাস্ট সুন্দর এবং গতিময় হতে হবে৷ পরীক্ষায় যা পারো তা আগে লিখে সময় থাকলে সব আনসার করে আসতেই হবে। কারণ আগেই বলেছি পেপার দেখায় সৎ না। হাবিজাবি খাতায় সুন্দর করে লিখে আসলেই মার্ক…।’

সায়মা মনযোগ দিতে পারছে না৷ স্যারের চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কালো সিল্কি চুল। ইচ্ছা করছে ছুঁয়ে দিতে। কেমন ঘোর লাগানো ঘ্রাণও আসছে। স্যারের সবকিছু এমন কেন? কেমন যেন অন্যরকম। কথাও বলেন অনেক সুন্দর৷
এই মানুষটির জন্য সে সব করতে পারে। আচ্ছা সে কি রান্না করা শিখবে? অন্তরার মতন রাঁধবে। স্যার তখন তারও প্রশংসা করবেন। সে কি কোরআন তেলাওয়াতও শিখে নেবে? অবিকল অন্তরার মতন।
– ‘সায়মা অন্যমনস্ক কেন? মনযোগ দিয়ে শোন।’
—-
রাত এগারোটায় বক্কর আলী জানালায় নক দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘জমিলা হজাগ আছোনি?’

জমিলা প্রথমে শুনলো না। কয়েকবার নক দেবার পর জমিলা জানালার খিল খুলে বিস্মিত হয়ে বলল
– ‘বক্কর ভাই তুমি অতো রাইত!’

–‘তাড়াতাড়ি আগে দরজাটা খোলে দেও জমিলা সব বলিব।’

জমিলা চুপিচুপি দরজা খুলে দিল। বক্কর আলী ঘরে ঢুকেই বলল,
– ‘শহর থাকি আইলাম জমিলা। ব্যাংকের চাকরি খইরা লাভ নাই। যে বেতালা মেয়ে মানুষ। শহরের মেয়েরা তোমার মতো ভালা নায় জমিলা।’

– ‘কিতা খও ফুরিন্তে কিতা খরছে।’

– ‘শহরে মাইয়ালোক ল্যাংটা থাখে জমিলা।’

– ‘ধুর মিচা খতা খও।’

– ‘মিচা খতা নায় জমিলা। ফরমান দেখতায়নি? দেখতে চাইলে বও দেখাই।’

বক্কর আলী বুদ্ধি করে হারিকেনের আলো কমিয়ে মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়। জমিলাকে টেনে আনে কোলে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে অনেকগুলো উলঙ্গ ছেলে-মেয়েদের ছবি বের করে। প্রাপ্ত বয়স্ক ম্যাগাজিনের অধিক উষ্ণ ছবিগুলো সে ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে সংগ্রহ করে এনেছে।
জমিলা ছবি দেখে বিস্মিত হয়ে বলল,
–‘ইয়াল্লা ইতা কিতা। ইতার হায়া শরম নাইনি।’

বক্কর আলী সুর মিলিয়ে বলল,
–‘ইতা মেয়েরার এখেবারে লজ্জা-শরম নাই জমিলা। ওউ যে দেখরায় এক মাইয়া ওগুই তো আমার লগে ব্যাংকও চাকরি খরতো। আমারেনো এখদিন খয় আইলাবু বক্কর।’
কথাটি বলে খিকখিক করে হাসে বক্কর। জমিলা আরও অবাক হয়ে বলে,
– ‘ইয়াল্লা হাচানি?’

– ‘অয় জমিলা আল্ল পাকের কসম। খালি আইলাবু নায়। আরো কিতা খরতো চাইছে দেখাইতামনি?’

– ‘কিতা?’
চতুর বক্কর আলী এবার হারিকেন নিভিয়ে প্র‍্যাক্টিকালি দেখানোর প্রস্তুতি নেয়।
—-

ইমরাজ উল্লাহ মেয়ের কোনো আবদার ফেলতে পারেন না। তাই হাজার রকম ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে সায়মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর খালার বাসায়৷ খালাতো বোন নিপাকে নিয়ে সায়মা অনেক কেনাকাটা করেছে। পোশাক, কসমেটিক মেয়েদের নানান প্রসাধনী ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছে। গতবার বেড়াতে গিয়ে বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেছিল৷ এবার কি এক টানে পরেরদিনই বাবাকে নিয়ে ফিরে এসেছে।
মেয়ের এসব অস্থিরতার কারণ চেয়ারম্যান প্রথম থেকেই বুঝতে পারছেন। মৌন সম্মতিও দিয়ে যাচ্ছেন। মাস্টারকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে।

সায়মা স্কুল থেকে ফিরেই সবকিছু বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হুলস্থুল কান্ড।
রাজ্যের কাজকর্ম ফেলে অন্তরারও সঙ্গ দিতে হচ্ছে।
– ‘আপু সত্য করে বল তো কোন ড্রেস পরব?’

– ‘শাড়ী ফিন্দো। ওউ যে খচুপাতার লাখান রং।’

– ‘আপু শুদ্ধ করে কথা বলা শিখ তো। খুব সহজ। খালি শরম না পেয়ে একটু চেষ্টা করলেই পারবে। ‘

– ‘আচ্ছা।’

– ‘কচুপাতা রঙের শাড়ী নিপা আপু পছন্দ করে দিছে। আমার পছন্দ হয়নি। তাছাড়া এই শাড়ী পরে স্যারের সামনে যেতে লজ্জা লাগবে।’

– ‘খেনে শরম লাগতো৷ সুন্দর আছে শাড়ি। ফিন্দিলাউ।’

– ‘আপু আবার অশুদ্ধ করে কথা বলছো।’

– ‘আচ্ছা একন থেকে শুদ্ধ মাতমু।’

– ‘আচ্ছা তুমি সাজিয়ে পরিয়ে দাও। কোনোদিন শাড়ি পরিনি। কেমন লাগবে জানি না।’

অন্তরার কচুপাতা রঙের শাড়িটি ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এই কারণে কি-না কে জানে। সে খুব আয়েশ করে সায়মাকে শাড়ি পরাল। অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। এক অভিনব কায়দায় চুলও আঁচড়ে দিল। অন্তরার ভেতরে যেন চুপটি করে এক শিল্পীর বসবাস। সেই শিল্পীর রংতুলিতে সায়মার ভেতরে থাকা নারী সৌন্দর্যের সবটুকু আজ প্রকাশ পেয়েছে। অন্তরা খুব যত্ন করে ভুরু পর্যন্ত আঙুল দিয়ে ঠিক করে দেয়। বিছানা থেকে সবকিছু নিজেই প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করে। সায়মার কিছুই বলে দিতে হল না। সব শেষে যখন সায়মা নিজেকে আয়নার সামনে দেখল নিজেকে ভিন্ন এক নারী মনে হল। এতো সৌন্দর্য বুঝি নিজের মধ্যে লুকিয়ে আছে?
বই হাতে বিব্রত ভঙ্গিতে জিসানের রুমের দরজাটি খুলে সালাম দিল সায়মা।

জিসান চমকে উঠলো শোয়া থেকে। অচেনা যেন লাগছে সায়মাকে।
– ‘ওয়াও প্রেমে পড়ে গেলাম, চেনাই যাচ্ছে না তোমাকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।

উত্তুরের একফালি শীতল হাওয়া যেন ছুঁয়ে দিল সায়মার শরীর, মন। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়টা কিসের ছোঁয়ায় যেন পবিত্র হয়ে গেল। জিসানের সামান্য প্রশংসার স্পর্শে মনের সকল হিংসা-বিদ্ধেষ ভেসে গেল শহরের নর্দমায়৷ এখন এই মন দিয়ে কেবল মানুষকে ভালোবাসা যায়।

– ‘কিন্তু এভাবে সাজাল কে? তোমাদের এখানে তো পার্লার আছে বলেও মনে হয় না।’

– ‘অন্তরা আপু সাজিয়েছে।’

– ‘বাবা। অনেক যত্ন করে সাজিয়েছে। মেয়েটির হাতে জাদু আছে বলতে হয়। রান্নার স্বাদ জিভে থেকে যায়। অইদিনের কোরআন তেলাওয়াতও কানে লেগে আছে। এখন তোমার চেহারাও চোখে ভেসে না থাকলেই হলো৷ হা হা হা।’

মুচকি হাসল সায়মাও৷ এবার একটুও হিংসা হল না। উল্টো অন্তরার জন্য ভালোবাসায় মনটা যেন কানায় কানায় ভরে গেল। নিচে গেলেই অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে সে।
– ‘গুণবতী কাজের মেয়েটিকে দেখাবে বলছিলে।’

– ‘আচ্ছা এখনই নিয়ে আসছি।’

সায়মা যেন আজ নিষ্পাপ এক শিশু।
তার মনে হল একমাত্র অন্তরার জন্যই ইতোমধ্যে জিসানকে নিজের করে পেয়ে গেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে অন্তরাকে আনতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
–চলবে–
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here