আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন,১৪ পর্ব,১৫
লেখা: জবরুল ইসলাম
১৪ পর্ব
.
পিয়াস তার পোষা শালিকটির জন্য হাওরে যাবে ঘাস ফড়িং ধরতে। বন্য ঘাস এবং পানায় শালিকের প্রধান খাদ্য ফড়িং পাওয়া যায়। ফড়িং ধরে ধরে একটি বোতলে ভরে সে। অসংখ্য ছোট ছোট ফুটো করা সেই বোতল। শালিকের সামনে বোতল ধরলেই ‘হা’ করে ডাকতে ডাকতে অস্থির হয়ে যায়। হস্ত তৈরী একটা বাঁশের খাঁচা আছে তার জন্য। এলাকায় কনাই চাচা খাঁচা তৈরীতে ওস্তাদ। কেবল এক প্যাকেট নাসির বিড়ির টাকা হাতে দিলেই হয়ে গেল।
জিসানের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে এসে শালিকের গল্পই করছে পিয়াস। কথা একটু বেশি বলে তা বুঝাই যাচ্ছে।
জিসান চায়ের কাপে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে মুখে দিল। এতদিনে তার ধারণা হয়ে গেছে গ্রামে চায়ের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় টোস্ট বিস্কুট।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
— ‘শালিক ধরলে কীভাবে।’
পিয়াস দরজা খুলে বাইরে এসে বলল দেখে যান কীভাবে ধরি৷ কৌতূহলী হয়ে বেরুল সে। পিয়াস তর্জনী দিয়ে একটা লম্বা সুপারি গাছ দেখলো। গাছের মাথায় একটা মাটির হাড়ি বাঁধা।
— ‘ওই হাড়িতে শালিক বাসা বেঁধে বাচ্চা ফুটাইছিল।’
— ‘দারুণ তো। আমি আজ তোমার সঙ্গে ফড়িং ধরায় যেতে চাই। সমস্যা নাই তো?’
— ‘যেতে পারবেন। তবে লুঙ্গি পরে যেতে হবে। কাদাপানি আছে।’
— ‘সমস্যা নেই লুঙ্গি আছে।’
পিয়াস গরু নিয়ে বেরুল। প্রতিদিনই গরু মাঠে দিয়ে ফড়িং ধরতে যায়। জিসানের কাদা পানিতে হাঁটতে খারাপ লাগছে না। সবকিছু বেশ ভালোই লাগছে।
— ‘স্যার কি আজ মাদ্রাসায় যাবেন না?’
— ‘না। আজ তোমার সঙ্গে ঘুরবো।’
— ‘ও।’
জিসান চাচ্ছে কোনো কৌশলে চেয়ারম্যানের বাড়ির রাস্তা চিনতে।
পিয়াস প্রথমে গরু দিল। তারপর হাটঁতে লাগল ফড়িংয়ের খুঁজে৷
জিসান ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
— ‘আচ্ছা চেয়ারম্যানের বাড়ি কোনদিকে এখান থেকে?’
পিয়াস আঙুল দিয়ে অনেক দূরের কিছু গাছগাছালি দেখিয়ে বললো,
— ‘এইটা চেয়ারম্যানের বাড়ি। আমি প্রতিদিন ওখানকার একটা বিলের পাড়েই ফড়িং ধরি। আজকে আপনি সাথে তাই ওদিকে যাব না।’
জিসান অবাক হয়ে বলল,
— ‘আমি সাথে থাকলে যাবে না কেন?’
পিয়াস মুচকি হেঁসে বলল,
— ‘গ্রামের মানুষ বাতাসে সব খবর পায় স্যার। চেয়ারম্যানের বাড়ি থাইকা আপমার লজিং কেন গেল সেটা সবাই জানে। তবুও সমস্যা নাই কারণ এলাকার মানুষ চেয়ারম্যানকে পছন্দ করে না।’
কি বলবে খানিক্ষণ ভেবে পেল না জিসান। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটি ডোবার সামনে এসে পড়েছে। চারপাশে ঘাস আর পানা৷ পিয়াস লুঙ্গি কাছা মেরে নেমে পড়েছে। জাপ্টে জাপ্টে ফড়িং ধরায় ব্যস্ত হয়ে গেল। জিসানের হঠাৎ মনে হল সমস্যার মুখোমুখি তো তাকে দাঁড়াতেই হবে। তাছাড়া পিয়াস বিষয়টি জানে।
আমতা আমতা করে বলল,
— ‘পিয়াস তুমি কি চেয়ারম্যানের ভাতিজি অন্তরাকে চেনো?’
বোতলে একটা ফড়িং ঢুকিয়ে বলল,
— ‘দেখিনি কখনও। গ্রামগঞ্জে এক বাড়ির মানুষ আরেক বাড়ি কি দিয়ে কোন বেলা ভাত খায় সেটাও জানে। কার বাড়ি মেহমান এসেছে কোনদিন গেল সবকিছু জানে। কিন্তু শালার চেয়ারম্যানের বাড়ি আলাদা। শহরের মতো বিচ্ছিন্ন পরিবার যেন। তাদের খাস লোক ছাড়া কেউ কিচ্ছু দেখে না, জানে না।’
— ‘তাই না-কি?’
— ‘হ।’
— ‘আচ্ছা এলাকায় চেয়ারম্যানের এতো প্রভাব কেন?’
— ‘আগে থেকেই প্রভাব। বড় গোষ্ঠী ছিল, জায়গা সম্পত্তি আছে। এখন আবার প্রশাসনিক পাওয়ার। পুলিশ আর এমপি মন্ত্রীদের লগে শুনছি ভালো খাতির।’
— ‘ও আচ্ছা।’
জিসান কথাটি গুছিয়ে আনতে পারছে না। কীভাবে বলবে, পিয়াসও কথাটি কীভাবে নেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
শেষপর্যন্ত আমতা আমতা করে বলল,
— ‘আমার মনে হয় অন্তরার সঙ্গে দেখা করা দরকার। চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর ওর প্রতিক্রিয়া কি জানতে চাই। সে চাইলে তো আমরা পালিয়েও বিয়ে করতে পারবো। তাছাড়া ক’দিন হয়ে গেল তাকে দেখি না৷ অসুস্থও শুনলাম। এখন কেমন আছে। ওরা তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করছে কি-না জানতে ইচ্ছে করছে।’
পিয়াস বোতলের ছিপি লাগিয়ে জিসানের পাশে এসে আইলে বসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিক্ষণ ভেবে বলল,
— ‘বিষয়টা জটিল করেছেন আপনি নিজে। অন্তরাকে আগে প্রস্তাব দিয়ে রাজি হইলে পালানোই উত্তম ছিল। আমি সিক্তার পরিবারের কাছে কোনো প্রস্তাব মারাতে যাইনি। কারণ জানি বিয়ে দিবে না। আল্লাহ যা করে বলে, সোজা পালিয়ে নিয়ে আসলাম। ব্যস খেলা খতম।’
— ‘আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব দিলে চেয়ারম্যান রাজি হবে।’
— ‘তাও ঠিক বলছেন। কিন্তু এখন দেখা করা এতো সহজ না। এই মেয়ে বাইরে কোথাও যায় না। বাড়ির ভেতরেও যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু দেখা করে রাজি হইলে কাম সোজা। রাতে কোনোভাবে অন্তরা বের হইলেই নিয়া পালাইবেন। বাঙালী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন খুব কম হইছে, যা হইছে তার বেশিরভাগ পালিয়ে। হা-হা-হা।’
— ‘দেখা করার রাস্তা একটা আছে পিয়াস। অন্তরা বাড়ির বাইরে চুলোয় রান্নাবান্না করে। সন্ধ্যায় বাড়ির পেছনের বিল পাড়ি দিতে পারলেই দেখা করা সম্ভব। চেয়ারম্যানও সব সময় বাড়িতে থাকে না। কবরস্থানে খানিকক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে পরিবেশ বুঝে নিয়ে তারপর সামনে যাব।’
পিয়াস অদ্ভুত এক নয়নে তাকালো। তার কাছে মনে হলো এই মানুষটি গভীর জলে পড়ে গেছে।
— ‘আপনি কি সন্ধ্যায় বিল পাড়ি দিয়ে কবরস্থানে যেতে পারবেন?’
— ‘হ্যাঁ পারবো।’
— ‘ওখানকার কবরস্থান নিয়ে অনেক জ্বিন ভূতের গল্প কিন্তু শুনেছি।’
— ‘আমি ওসব বিশ্বাস করি না পিয়াস। তুমি কেবল সন্ধ্যায় বিলের পাড়ে নিয়ে দিতে পারবে কি-না সেটা বলো।’
— ‘আপনি তো দেখছি প্রেমে পড়ে হুলস্থুল কাণ্ড। আপনারে সহযোগিতা না করলে নিজেরেই অপরাধী মনে হইব। কোনদিন দেখা করতে চান?’
— ‘আজ সন্ধ্যায়।’
বিলের পাড়ের একটা টিলার ওপর বসে আছে পিয়াস। ঘন অন্ধকার। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে ব্যাঙ ডাকছে। দূরে কোথাও শিয়ালের কান্না। তার ঘন ঘন হাই উঠছে। ঘুমে খানিক পর পর ঝিমাচ্ছে। নিজেকে চাঙ্গা রাখার জন্য একটা সিগারেট ধরালো।
জিসান বিল সাঁতরে এখন কিনারায় এসেছে। কিন্তু অন্ধকারে কোথায় এলো ঠিক বুঝতে পারছে না। হাতের মুঠোয় অবশ্য পলিথিন দিয়ে পেঁচানো স্লাইড লাইট ছিল। সাঁতরাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই পানিতে পড়ে গেছে। তার টার্গেট ছিল কবরস্থান। কিন্তু এই জায়গাটা মনে হচ্ছে ঝোপঝাড়। অন্ধকারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে হয়তো অন্যদিকেই চলে এসেছে। হঠাৎ মাথায় এলো পিয়াসের অবস্থান আন্দাজ করে সনাক্ত করতে পারলেই কবরস্থান কোনদিকে ধরতে পারবে। অন্ধকারে ওপারের চারদিকে তাকাল। হঠাৎ চোখে পড়লো বিন্দুর মতো লাল আলো বাড়ছে কমছে। অন্ধকারে বসে কেউ সিগারেট টানছে। মানুষটি পিয়াসই হবে। বোধহয় উত্তরদিকে অনেক বেশিই চলে এসেছে। লাল বিন্দুকে লক্ষ্য করে কিনারা ধরে হাঁটতে লাগলো৷ হঠাৎ যন্ত্রণায় অস্ফুটে ‘উফ’ করে উঠলো সে। বাম পা বোধহয় কাঁচের কোনো ভাঙা বোতলে পড়ে গেল। অন্ধকারে পায়ে হাত দিতে গিয়ে আঙুলও কেটে গেছে। বসে পড়লো মাটিতে। আন্দাজে টান দিয়ে বের করে দূরে ছুড়ে ফেলল টুকরোটা। মাথা তুলে আবার তাকাল বিলের ওপারে। লাল বিন্দু আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও দক্ষিণদিকে হাঁটতে লাগলো পা টেনে টেনে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বিল সাঁতরেই হাঁপিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার পা-হাত কেটে গেছে। ইচ্ছে করছে এখানেই শুয়ে পড়তে। খানিক্ষণ হেঁটে এসে একটা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। হ্যাঁ কবরস্থান। দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। এপাশ থেকে ওপাশের দেয়ালে চলে গেলে গিয়ে উঁকি দিলেই দেখা যাবে অন্তরার রান্নাঘর। পা টেনে টেনে এগুচ্ছে। হঠাৎ নিচের দিকে চলে গেল কোমর অবধি। হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত পেল। পুরাতন কোনো কবরের বাঁশ ভেঙে বোধহয় নিচে পড়ে গেছে।
–চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম
আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৫ পর্ব
.
অন্ধকার কবরস্থানে বাম পা টেনে টেনে এগুচ্ছে জিসান। খুব সম্ভব সামনের দেয়াল দিয়ে উঁকি দিলেই অন্তরাকে দেখা যাবে। হাঁটতে হাঁটতে আচমকা মাটির নিচে চলে গেল কোমর অবধি। হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত পেল। পুরাতন কোনো কবরের বাঁশ ভেঙে বোধহয় নিচে পড়ে গেছে। দুই হাতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে শুকনো বাঁশ ভেঙে আবারও পড়লো মুখ থুবড়ে। থুতনিতে ভীষণ ব্যথা পেল। অস্ফুটে ‘ওমা’ বলে হাত দেয়, না রক্ত বের হয়নি। এবার খানিক সচেতনভাবে ভর দিয়ে উঠে পড়ে কবর থেকে। দুই হাত সামনে দিয়ে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে যতটুকু বুঝতে পারছে সামনে ছনের ঝোপঝাড়। একটু এগুতেই পায়ের ক্ষতস্থানে ভাঙা ছনের খোঁচা লেগে চোখে পানি এসে গেল তার। বসে রইল খানিক্ষণ। হঠাৎ মনে হল অন্তরার রান্না শেষ হলে ভেতরে চলে যাবে। আবার উঠে গেল। দাঁত কামড়ে বাম পা টেনে দেয়াল পর্যন্ত এলো। ধারণা থেকে খানিকটা উঁচু দেয়াল। হাত বাড়িয়ে শেষপ্রান্ত পেল না। লাফালাফি করেও ওপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। কপাল চেপে ধরে খানিক্ষণ বসে রইল৷ হঠাৎ মনে হল কবরের কোনো পাশের দেয়াল নীচু কিংবা মাটি উঁচু থাকতে পারে। দেয়াল ঘেঁসে হাঁটতে থাকে। খানিক এগুতেই টিলার মতো কিছু একটা পায়ে লেগে একটুর জন্য পড়ে যাচ্ছিল। ছোট বাচ্চাদের মতোন হামাগুড়ি দিয়ে টিলায় উঠে দাঁড়াল। অসংখ্য সুপারি এবং নারিকেল গাছের ফাঁক গলে দৃষ্টি গেল চুলোর সামনে বসা অন্তরার দিকে। তবে এখান থেকে ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেবল পেছন দেখা যায়। আশেপাশে আর কেউ নেই। অন্তরা মাথা নুইয়ে চুঙ্গা দিয়ে চুলোয় ফুঁ দিচ্ছে। জিসান বুঝতে পারে। এখনই মোক্ষম সময়। সে টিলা থেকে দেয়ালে দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। খানিক্ষণ জিরিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে ডান পা আগে দিয়ে নেমে যায়। সতর্কভাবে চারদিকে তাকায়। তারপর আহত পা টেনে টেনে চুলোর কাছে গিয়ে ডাকল, ‘অন্তরা।’
চমকে উঠে পেছনে তাকায় সে। বিস্মিত হয়ে যায় মানুষটিকে দেখে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছে না। ভেজা কাপড় থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। দাড়ি গোঁফ লম্বা হয়ে গেছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা।
— ‘আরে আপনি? আপনি এখানে কীভাবে এলেন? আপনার এই অবস্থা কেন?’
জিসান এগিয়ে গেল, অন্তরার দুই বাহু ধরে বলল,
— ‘তোমার ঠোঁট ফোলা কেন? কি হয়েছে?’
অন্তরা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
— ‘আরে আপনি পাগল হয়ে গেছেন না-কি? এখানে কেন এসেছেন? তাড়াতাড়ি যান বলছি। কেউ দেখলে কি হবে বুঝতে পারছেন না আপনি।’
— ‘অন্তরা আমি চলে যাব। শুধু কথাগুলো একটু মনযোগ দিয়ে শোন, তোমাকে বিয়ে করতে চাই। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। চেয়ারম্যান রাজি হননি। এখন কি করবে? তোমার মতামত জা..।
কথা শেষ করতে পারলো না জিসান। চেয়ারম্যানের গলায় ভেসে এলো, ‘অন্তরা বৈঠকখানায় চা দে তো।’
জিসান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চেয়ারম্যানের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। তিনি বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছেন।
চেয়ারম্যান বিস্ময় কাটিয়ে ডাকলেন,
— ‘আখলাছুর, মতিন তাড়াতাড়ি সবাই এদিকে আয়।’
তাদের হাতে ধরা পড়ে গেল জিসান। অন্তরার মতামত জানতেই পারলো না। সবাই যখন জিসানকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তখন চতুর আখলাছুরের মাথায় অন্যকিছু খেলে গেল। সে তাড়াতাড়ি পাওয়ার ওয়ালা লাইট নিয়ে বিলের পাড়ে গিয়ে চারদিকে আলো ফেলে। তখন দূরের টিলার ওপরে তন্দ্রায় ঝিমাচ্ছিল পিয়াস। চোখে আলো লাগায় ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। চিনে ফেলে আখলাছুর। ফোন দিয়ে অন্যদিকে লোক পাঠিয়ে ধরিয়ে আনে তাকেও।
এরপরের সবকিছু হল খুব দ্রুত। চেয়ারম্যানকে আখলাছুর পরামর্শ দিল জিসানকে এলাকা ছাড়া এবং ময়নুল মাস্টারকে শায়েস্তা করার। চেয়ারম্যান ভাতিজির ইজ্জত নিয়ে ভাবতে গেলেন না। জিসানকে বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে এলাকার সকল মাতুব্বর এবং মসজিদের নতুন ইমামকে খবর দিলেন। রাত দশটার ভেতরেই উঠোনে গ্রাম পঞ্চায়েত বসে গেল। সেখানে ডাকা হয়েছে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং সভাপতিকেও। মতিন মিয়া জিসান এবং পিয়াসকে সবার মাঝখানে মাটিতে নিয়ে বসায়।
চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে সবার সামনে বলতে শুরু করেন,
‘এখানে যে দু’জনকে দেখতে পাচ্ছেন। এর একজন হচ্ছেন আমাদের মাদ্রাসার ইংলিশ টিচার। আরেকজন ময়নুল সাহেবের ছেলে। সন্ধ্যায় আখলাছুররা এসেছিল। তারা মাঝেমধ্যে আসে গল্পগুজব করি এই আরকি৷ তো আমি গেলাম ভাতিজিকে চায়ের কথা বলতে। গিয়ে দেখি মাস্টার আমার ভাতিজিকে টানাটানি করছে৷ টানাটানি কেন করছে আপনারা বিজ্ঞ মানুষেরা বুঝবেন। আমার মনে হইল তিনি আমার ভাতিজিকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। না হলে কেন বিল পাড়ি দিয়ে বাড়িতে ঢুকবেন। আর যদি টেনে নেওয়ার চেষ্টা না করেও থাকেন৷ এই এলাকায় কি কোনো বেগানা মেয়েকে আইসা রাত বিরাতে হাতে ধরে টানাটানি করা যায়? আমরা ধর্মপ্রাণ মানুষ৷ এলাকায় মাদ্রাসা আছে। পীর ফকিরের গ্রাম। এগুলো সহ্য করি কীভাবে? আরেকটা কথা বলে ফেলি। ময়নুল মাস্টারকে দিয়ে তিনি আমার ভাতিজির জন্য বিয়ের আলাপ দিয়েছিলেন৷ আমি না করে দিয়েছি৷ এলাকার মানুষ ভাববে লজিং থাইকা প্রেম পিরিত কইরা বিয়া হচ্ছে৷ এসব হইলে লোকে মাদ্রাসা শিক্ষক লজিং দিবে না। তাই আমি রাজি হইনি। তাতে কি এমন অপরাধ করলাম যার লাইগা ময়নুল সাহেব উনার ছেলেকে দিয়ে মাস্টারকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে মান-সম্মান নষ্ট করতে চাইলেন। এখানে মসজিদের ইমাম আছেন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সভাপতি আছেন। বর্তমান মেম্বার সহ গ্রাম পঞ্চায়েতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আছেন। আমি থানা-পুলিশে যাইনি৷ আপনারা ইমাম সাহেবকে নিয়ে এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের বিচারে যা করার করেন।’
বর্তমান মেম্বার ইজাজ মিয়া দাঁড়িয়ে বললেন,
— ‘মাইয়া আসতে বলছে কি-না জানা দরকার। তারা দুইজনের সম্মতিতে দেখা করতে পারে।’
আখলাছুর তখন দাঁড়িয়ে বলল,
— ‘সম্মতিতে দেখা সাক্ষাৎ মানে? এইটা কি শহর নি? বেগানা পুরুষ বাড়ির ভিতরে আইসা আরেক মেয়েরে টানাটানি করবে কের লাইগা?’
ইজাজ মিয়া বললেন,
— ‘ টানাটানি করছে বইলা কি বুঝাতে চান?কেউ কিন্তু একা বাড়ির ভিতরে চলে আসবে না ধর্ষণ করতে।’
— ‘একটা বেগানা মেয়েকে টানাটানি করবো কেন বাড়ির ভেতরে ঢুইকা? আর একা কীভাবে আরেকজন সঙ্গে ছিল।’
মাদ্রাসার সভাপতি তাদেরকে থামিয়ে বললেন, ‘আমরা মাস্টারের কাছ থেকে উনার বক্তব্য শুনি। আপনারা অনুমতি দিলে মাস্টারকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি।’
সবাই সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতি দিল।
সভাপতি জিসানকে লক্ষ্য করে বললেন,
— ‘মাস্টার সাব, আপনি তো এবাড়িতে লজিং ছিলেন। তারপর মেয়েটির জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আপনাদের মধ্যে কি প্রেম জাতীয় কোনো সম্পর্ক ছিল।’
জিসান খানিক্ষণ ভাবলো, আসলেই তো তাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক নাই। অন্তরা কখনও বলেনি তাকে ভালোবাসে। কোনো আশ্বাসও দেয়নি। জিসান সভাপতির উত্তরে মাথা নেড়ে ‘না’ করলো। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না তার। নিজের শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছু যেন আজ তুচ্ছ লাগছে। এদের সামনে নিজেকে অবুঝ শিশু মনে হচ্ছে। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে যেটা ছোট্ট বিষয় মনে হয়েছিল সেটা যেন এরা কীভাবে অনেক জটিল করে ফেলেছে।
সভাপতি আবার বললেন,
— ‘মেয়েটি কোনো মাধ্যমে কি আপনাকে দেখা করতে খবর পাঠিয়েছিল?’
— ‘জ্বী না।’
— ‘আপনি যখন মেয়েটির হাত ধরলেন তখন সে কি করল?’
— ‘সে ছাড়িয়ে নিয়েছে হাত।’ জিসান সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো সে ফেঁসে যাচ্ছে। তারপর আমতা-আমতা করে বলল, ‘আসলে আমি এসেছিলাম ভালোবাসার কথা বলতে। আর কিছু না। আমি তাকে পছন্দ করি সেটা জানাতেই এসেছি।’
আখলাছুর দাঁড়িয়ে গেল, ‘শুনছেন কথা। ভালোবাসার কথা বলতে আইয়া হাত ধরছে৷ এইটা কি ইউরোপ আমেরিকানি? বেগানা মেয়ের লগে কিসের প্রেম পিরিত? তাও রাত-বিরেতে হাত ধরে টানাটানি। ইমাম সাহেব আপনিই বলুন এগুলো কি জায়েজ? ইসলাম কি সমর্থন করে?’
ইমাম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন
— ‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! এগুলো ইসলাম সমর্থন করে না৷ একটা বেগানা যুবতী মেয়ের সঙ্গে গোপনে দেখা করাইতো পাপ। তাছাড়া সে হাত ধরেছে প্রেম পিরিতির কথা বলতে চাইছে। মেয়ে নিজেকে রক্ষা করনের লাইগা হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে৷ মাস্টার তো জঘন্য অপরাধ করেছেন উনি।’
এবার চেয়ারম্যান দাঁড়ালেন, ‘সভাপতি সাবের জিজ্ঞাসায় স্পষ্ট যে আমার ভাতিজির সঙ্গে উনার কোনো সম্পর্ক নাই। এবং মাস্টার হাত ধরেছেন। আমার ভাতিজি হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে৷ উনি নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। এটা ভ্যাবিচারের সামিল৷ ইমাম সাহেব এবার বলুন ভ্যাবিচারের শাস্তি কি? আর তাকে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের বিচার এলাকাবাসী দেখবেন। ময়নুল সাহেব বাড়িতে নাই৷ লোক পাঠিয়ে পাইনি। উনার ছেলের বিচার পরে দেখা যাবে। এখন ইমাম সাহেব বলুন ভ্যাবিচারের শাস্তি কি।’
— ‘একশো বেত্রাঘাত দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া।’
গ্রামের একজন প্রবীণ দাঁড়িয়ে বললেন,
— ‘অতিরঞ্জিত কিচ্ছু ভালা না চেয়ারম্যান সাহেব। ইমাম দিয়ে এমন পরিস্থিতিতে ফতোয়া দেওয়াতে আপনারে কে বলছে? এইটা আর যাই হউক ভ্যাবিচারের শাস্তিতে পড়ে না। আমার কথা হইল মাস্টারকে এখনই গ্রামের বাইরে ফেলে আসো গ্রামে যেন আর না আসতে পারে। মাদ্রাসায়ও চাকুরী নাই। আর ময়নুল সাহেব আসলে উনার ছেলের নামে বিচার দেওয়া হবে।’
উপস্থিত সবাই প্রবীণ ব্যক্তির কথায় সমর্থন দিল। কিন্তু বর্তমান মেম্বার সহ আরও কিছু মানুষ মনে মনে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বিরুদ্ধাচারণ করলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ পেল না। রাতের আঁধারে একদল লাঠিয়াল জিসানকে ফেলে এলো করিমগঞ্জ বাজারের পেছনের মাঠে। জিসান অন্ধকার রাতে একটি গাছের নীচে গুটিশুটি খেয়ে পড়ে রইল।
–চলবে..