আয়না,পর্ব:০১
শাপলা
বিয়ের পর ১০ বছর আমি সন্তানহীন ছিলাম।ডাক্তার বলেছিল আমি কখনোই মা হতে পারবোনা।আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার স্বামীর সাথেও আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না।আমি বুঝতাম সে সন্তান চায় যেকোনো উপায়ে কিন্তু সেই উপায় মুখ ফুটে আমাকে বলতে পারতো না।কারন, আমার বড় ভাইয়ের অধীনে সে চাকরি করে।আমিই নিজেকে প্রস্তুত করলাম যে ওকে বলবো, তুমি ২য় বিয়ে করো। কিন্তু, কোনোদিনই পেরে উঠতাম না।বুক ভারী হয়ে আসতো কষ্টে। এভাবেই রসকষহীন জীবন কাটাচ্ছিলাম রোবটের মত। হঠাৎ,১ দিন অনুভব করলাম মাতৃত্বকালীন লক্ষনগুলো আমার মধ্যে দৃশ্যমান।টেস্টের রেজাল্টও পজিটিভ আসলো।আমি এতো খুশি হয়েছিলাম। আমার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিল আমার স্বামী।দেখতে দেখতে আমাদের ১টা পুত্র সন্তান হয়। অপারেশন থিয়েটারে আধোহুঁশে শুনতে পাচ্ছিলাম ডাক্তার-নার্সরা বলাবলি করছিল,বেবির শরীরের তাপমাত্রা এতো বেশি কেন?আমি বেশিক্ষণ ওদের কথা শুনতে পারলাম না।বাবুর কান্নার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরলাম।একটু পর যখন ওকে নিজের চোখে দেখলাম আমি অবাক হয়ে রইলাম।এতো সুন্দর শিশুর মা আমি….ওর চোখ দুটো গাঢ় সবুজ রঙের। বেশিক্ষন এক নাগাড়ে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।তবুও, আমি তাকিয়ে থাকি।সত্যিই,ওর শরীর অনেক গরম ছিল। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার হাত পুড়ে যাচ্ছে। তবুও, আমি ওকে ছাড়ছিলাম না। বুকে জড়িয়ে ধরে রাখছিলাম।ওর নাম রেখেছিলাম শুভ।শুভ হওয়ার পর আমার স্বামী আর আমার মধ্যকার সমস্ত সমস্যার সমাপ্তি ঘটে। খুবই সুখী মনে হতো নিজেকে। কিন্তু,শুভ যতই বড় হচ্ছিল ততই ওকে আমার অস্বাভাবিক লাগতো।এমনিতে তো ওর গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই থাকতো,যেকেউ ওকে ছুঁলেই বলতো,এমা! বাচ্চাটার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও শুভ অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতো না।একা একা আয়নার সামনে বসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলতো।এটা অবশ্য আমি কিছু মনে করতাম না।কারন, বাচ্চা মানুষ একাই কথা বলবে। কিন্তু, খানিকটা বড় হওয়ার পরও ওর আয়না রোগ গেলো না। যদিও,এখন আর কথা বলে না একা একা, কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার মা মজা করে বলতো, আমার নাতি নিজের রূপে নিজেই পাগল। কিন্তু আমার ভাল্লাগতো না।দিনের বেলাটায় ও বেশিরভাগই ঘুমাতো।খুবই চুপচাপ থাকতো, একেবারেই কম কথা বলতো।আর,ও ওর বাবাকে একদমই পছন্দ করতো না।এমনকি বাবা ডাকতোও না।ও-ই মনে হয় একমাত্র শিশু যে কিনা ৫ বছর বয়স থেকেই মাকে রেখে আলাদা ঘরে ঘুমাতে চাইতো।৬ বছরেই ওকে আমি আলাদা ঘর দিলাম। ভাবলাম রাতে ভয় পেয়ে আমার কাছে চলে আসবে। কিন্তু,আসলো না।আমি ওকে ভূতের ভয় দেখালাম। বললাম,একা ঘুমালে তোমার কাছে ভূত আসবে।ও বললো, আমি ভূত ভয় পাই না মা।মাঝরাতে ওর ঘরে গেলেও দেখতাম ও জেগে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওকে বকতাম।ও ঘুমোতে বিছানায় যেতো। কিন্তু, আমার মনে হতো ও ভান ধরছে।ও আসলে ঘুমায় না।ওর আচরণে আমি খুবই বিরক্ত হতাম। সবচেয়ে বিরক্ত হতাম ওর কথা-বার্তায়। বকতাম ওকে। একদিন,ওর বাবা বাসায় ফিরতে দেরী করছে।ফোনও বন্ধ।আমি দুশ্চিন্তা করছি।আর ও আপন মনে আয়নার সামনে বসে হাসছে।ওর বয়স তখন ১৩… ১৩ বছরের ছেলে নিশ্চয়ই এতোও ছোট না যে বাবা ফিরছে না আর তাতে তার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে না। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,”শুভ তোর কি বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে না?”
ও বললো,”নাহ! তোমার জন্য হচ্ছে।”আমি অবাক হয়ে কারন জানতে চাইলাম।ও বললো,”কারন বললে তুমি আমার উপর রাগ করবে।তবে,১টা কথা শোনো আজকে তোমার স্বামী তোমার জন্য রেইনবো কেক আনবে কিন্তু ঐটা তুমি খেওনা।”
শুভর কথা শুনে আমার খুবই রাগ হলো, “তোমার স্বামী”কি ধরনের ভাষা শুভ?বাবা বলতে পারিস না?
শুভ নিরুত্তর। আমি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,”তোর বাবা রেইনবো কেক আনবে এটা তোকে কে বলছে?”
ও বললো, “আমি জানি।”ওর এমন আধ্যাত্মিক কথাবার্তায় আমি অভ্যস্থ।তাই,আর জিজ্ঞেস করলাম না যে সে কিভাবে জানে… কারন, আমি জিজ্ঞেস করলেও সে উত্তর দিবেনা।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তোর বাবা কেক আনলে আমি খাবো না কেন?তুই আমাকে কারন না বললে আমি কিন্তু খাবোই। “শুভ নির্লিপ্ত ভাবে বললো,”কেকের মধ্যে বিষ মিশিয়েছে তোমাকে মেরে ফেলার জন্য।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম,”আমাকে কেন মারবে ?”
শুভ আগের মতোই ভাবলেশহীন ভাবে বললো,”কারন উনার রিমি নামের ১টা মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক। তোমাকে পথ থেকে সরিয়ে ওর সাথে বিয়ে করবে।”
আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।কষিয়ে শুভর গালে ১টা চর মারলাম। বললাম, “আর ১টাও ফালতু কথা বলবি না। রেইনবো কেক এই শহরে পাওয়া যায় না। তার উপর রাত বাজে বারোটা।”শুভ কিছুই বললো না।খালি আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। খানিক বাদে কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখি শুভর বাবা এসেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ফিরতে এতো লেইট হলো কেন?আর ফোন ধরোনি কেন?
সে বললো, আমার কলিগ আসাদের বাসায় গিয়েছিলাম।আজ ওর বিবাহ বার্ষিকী ছিল। তুমি তো এমনিতেও কোথাও যাও না।তাই তোমাকে বলিনি। আর, ফোন হ্যাং হয়ে গিয়েছিল।একটু আগে ঠিক হয়েছে। বাসার কাছেই ছিলাম তাই তোমাকে আর ফোন করিনি।
বলেই শার্ট খুলে হাত-মুখ ধুতে গেল। তখন, শার্টের বুক পকেটে থাকা ওর ফোন বেজে উঠল।আমি রিসিভ করলাম, ওপাশে ১টা মেয়ের কন্ঠ শোনা গেল।আমি বললাম, আপনি কে?সে বললো,আমি রিমি।সাদিক ভাই ঠিকমতো বাড়ি ফিরেছে?
আমি ১টা ধাক্কার মতো খেলাম।শুভও তো রিমি নামের কারো কথাই বলেছিল। ততক্ষণে শুভর বাবা চলে এসেছে আমার সামনে।এসে ফোন নিয়ে তার ঠিক ভাবে ফিরার কথা বলে রেখে দিলো।বললো,রিমি আমার কলিগ আসাদের বউ।
আমি নিজেকে সামলালাম। ছি: কিসব ভাবছি আমি।
তখন হঠাৎ,শুভর বাবা বললো,ও আচ্ছা ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার জন্য রেইনবো কেক এনেছি। আমার ব্যাগে দেখো।
আমি ওর কথায় ১টা ধাক্কার মতো খেলাম………
চলবে….