#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,পর্ব-০৪,০৫
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#চতুর্থ_পর্ব
৭.
পরেরদিন খুব সকালে চন্দ্রা ঘুম থেকে উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বাড়ি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেল। চন্দ্রা কোন সময়ই বেশি মানুষ পছন্দ করে না। যে জায়গায় বেশি মানুষ থাকে সে সেসব জায়গা এভয়েড করে। কিন্তু এখন সে যে পরিস্থিতিতে আছে সেখান থেকে উঠতে পারবে না। রাশেদের সব আত্মীয় স্বজনদের মাঝখানে তাকে বসিয়ে রেখেছে। সবাই বিভিন্ন রকম কথা বলছে। তবে এসবের মধ্যে সব থেকে বেশি যে কথা হচ্ছে তা হলো রাশেদ শশুরবাড়ি থেকে উপহার কী পেল? চন্দ্রাকে তার বাবা মা ঘর সাজিয়ে দিয়েছে কি না?
বয়স্ক এক মহিলা এসে চন্দ্রাকে বললে, দেখি রাশেদের বউ কেমন হয়েছে? বিয়ের দিন তো মেকআপ করা ছিল। চেহারা বোঝা যায় নি।
বলেই উনি চন্দ্রার মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে দিলেন। চন্দ্রার মুখ বিভিন্ন পজিশনে দেখতে লাগলেন। চন্দ্রার পরিবারের সবাই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আর কেউ না জানুক তারা জানে চন্দ্রা এসব পছন্দ করছে না। একসময় উনার দেখা শেষ হলো তারপর তিনি চন্দ্রাকে প্রশ্ন করলেন, বাবার বাড়ি থেকে কী এনেছো?
চন্দ্রা মাথায় ঘোমটা তুলে দিতে দিতে বললো, যে গয়না গুলো পড়ে আছি সেগুলোই দিয়েছে।
ব্যস এইটুকুই? আর কিছু দেয়নি?
চন্দ্রা মিষ্টি করে হেসে বললো, হ্যাঁ দিয়েছে তো এর থেকেও দামি।
কী?
আমার বাবার প্রিয় জিনিসটাই যে দিয়ে দিলো।
সেটা কী?
সেটা হলাম আমি। আমার বাবার সবচেয়ে দামি ও প্রিয় জিনিস ছিলাম আমি। বাবা সবসময় বলতো। সেই আমিকেই সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিল। এর থেকে বেশি আর কী দিবে?
বলেই চন্দ্রার ছলছল চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। তার বাবাও তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মেয়ে কতটা অভিমান থেকে কথাটা বলেছে তা অন্যকেউ না বুঝলেও তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছেন। সাধে কেউ প্রিয় জিনিস কাউকে দিয়ে দেয় না। বাধ্য হয়ে দিতে হয়।
সেই মহিলা গলা খেঁকিয়ে উঠলো। উচ্চ স্বরে রিমা আহমেদকে ডাকতে লাগলেন। অভিযোগ একটাই। যে মেয়ে বিয়ের দুই পরই মুখে খই ফুটছে তার ভবিষ্যৎতে কী হবে? পরিস্থিতি সামাল দিতে চন্দ্রার শাশুড়ী ছুটে এলো।
রিমা আহমেদ এসে চন্দ্রাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ঠিকই তো বলেছে ভাবি। একদম ভুল বলেনি। ওর বাবার প্রিয় জিনিসটাই আমরা নিয়ে এসেছি আর কী দিবে নতুন করে? চন্দ্রা তুমি ঘরে যাও। রাতে অনেকটা ধকল যাবে রেষ্ট নাও।
চন্দ্রা নিঃশব্দে ঘরে চলে গেল। চন্দ্রা যাবার পর রিমা আহমেদ সেই বয়স্ক মহিলা যিনি সম্পর্কে রাশেদের চাচি হয় তাকে বললেন, আপা আপনি এসব কী বললেন?
কেন সবাই যা জিজ্ঞেস করে তাই করলাম?
ভাবি আপনার দেওর শুনলে খুবই রাগ করবে। চন্দ্রার বাবা আমাদের সবকিছু দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা আনিনি। তাই বলে আপনি মেয়েটাকে লজ্জা দিবেন?
রিমা তুমি তোমার বউকে ঘরে পাঠিয়ে আমাকে অপমান করছো?
ভাবি আমার যদি আপনাকে অপমান করার হতো তাহলে সবার সামনে এমনকি চন্দ্রার সামনেই করতে পারতাম। আর আমি আপনাকে এখানে আড়ালে ডেকে এনেছি কারন সেখানে চন্দ্রার পরিবারের সবাই ছিল কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাই এখানে ডেকে কথা বলছি। এখানের অপমানের কী দেখলেন?
হয়েছে হয়েছে আমাকে আর বুঝাতে হবে না।
রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অবুঝকে বুঝানো যায় কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে বুঝানো যায় না। তিনি উনাকে রেখে রান্নাঘরে পা বাড়ালেন। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন। রাতে অনুষ্ঠান সেন্টারে হলেও দুপুর বেলা সবাই বাড়িতেই খাবে। সেই আয়োজন তো করতে হবে।
রাতে চন্দ্রা সাজলো সোনালি রংয়ের শাড়িতে। সাথে সোনার গয়না হালকা মেকাপ। চন্দ্রার চোখে সমস্যা তাই চোখের প্রসাধনী ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু বিয়ে উপলক্ষে তিনদিন ধরে সবকিছু দিতে হচ্ছে। রাশেদ ফর্মাল ড্রেস পরলো। পুরো অনুষ্ঠানে সে খুবই ব্যস্ত ছিল। তার হাসপাতালের সিনিয়র ডক্টরদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদেরকে সময় দিতে হচ্ছে। চন্দ্রা হঠাৎ করে খেয়াল করলো রাশেদের সিনিয়র ডক্টরদের মধ্যে সেই বয়ষ্ক ডক্টরকে যে বারসাতের ট্রিটমেন্ট করিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশেদ সবাইকে নিয়ে এলো চন্দ্রার কাছে। চন্দ্রাকে সেই বয়স্ক ডক্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
সে চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা ইনি হচ্ছেন আমাদের হাসপাতালের সবচেয়ে সিনিয়র ডক্টর। উনার নাম অরুন রায়।
তারপর অরুন রায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, স্যার আমার ওয়াইফ চন্দ্রা আহমেদ।
অরুন রায় চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটিকে তার খুবই চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছেন না। বয়স হলে এই এক সমস্যা কাউকে চিনতে খুবই অসুবিধা হয়। মেয়েটি কী তার কোন পেসেন্ট? না তা হবার কথা নয় কারন রাশেদ বলেছে ওরা সিলেট থাকে। তবে সিলেট থেকেও অনেকে আসে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে।
তিনি চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, কেমন আছো মা?
চন্দ্রা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। বারসাতের মারা যাবার দিনটা তার চোখের সামনে ভাসছে। সবকিছু জীবন্ত মনে হচ্ছে। অরুন রায় চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তার সাথে সাথেই তার মনে পড়লো চন্দ্রাকে সে কোথায় দেখেছে। একবার একটি ছেলে মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ছেলেটি কোমায় চলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে দেখতে গিয়ে তখন এই মেয়েটিই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কোমায় থাকলে কোন রোগী কথা শুনতে পায় কিনা? এই মেয়েই যে রাশেদের বউ তা ভেবে তিনি অবাক হচ্ছেন। সেই ছেলেটি বাঁচে নি। সেদিনই মারা গিয়েছিল তবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটিকে খুবই ভালবাসে।
সেদিনের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে চন্দ্রার।
একজন বয়ষ্ক ডক্টর এলো বারসাতকে চেক-আপ করতে। চন্দ্রা ডক্টরকে একপলক দেখে বারসাতের দিকে তাকিয়েই কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,কী দেখছেন ডক্টর? ও কী ভালো আছে?
ডক্টর দেখলো শ্যামলা ধরনের একটি মেয়ে। যার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। যার চোখমুখ নাক লাল হয়ে আছে এবং তা যে কান্নাকাটির জন্য তা ডক্টর অরুন রায় অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে পারলেন। রোগীর অবস্থা খুব একটা ভাল না। কিন্তু এই মেয়ের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে প্রাণপণে চাচ্ছে যেন ডক্টর পজেটিভ কিছু বলে। কিন্তু কাউকে মিথ্যে আশ্বাস দেওয়ার কোন মানে হয় না। ডক্টর হওয়ার সুবাদে দুঃসংবাদ তিনি খুবই স্বাভাবিকভাবেই বলতে পারেন। প্রথম প্রথম খুবই খারাপ লাগতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা ফিকে হয়ে গেছে।
তাই তিনি অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো, দেখো আমি তোমাকে মিথ্যে আশ্বাস দেব না। তাই যা বলার সরাসরি বলছি। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আর ভগবান যদি সহায় হয় তাহলে রোগী বেঁচে যেতেও পারে। তবে কোমায় থাকবে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ হবে কিনা বলতে পারছি না।
চন্দ্রা চোখ মুছে বললো,সে কোমায় থাকুক তাহলেই হবে। আমার আর কিছু লাগবে না। আমি চাই ও শুধু আমার চোখের সামনে থাকুক। আচ্ছা ডক্টর ও কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছে?
তা তো জানি না মা। হয়তো পাচ্ছে হয়তোবা পাচ্ছে না।বলেই উনি চলে গেলেন।
চন্দ্রা বারসাতের হাতটা ওর মাথায় ঠেকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, আমি জানি না তুমি আমায় শুনতে পাচ্ছো কিনা তবুও বলছি আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ। উঠো প্লিজ উঠো। এমন তো কথা ছিলো না। তুমি তো কথা দিয়েছিলে যে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে আর ছেড়ে চলে যাবে না। তাহলে কেন চলে যাচ্ছো? আমাদের বিয়ের তো একমাসও হয়নি। এখনো অনেকটা পথ বাকি।
চন্দ্রাকে পাশ থেকে রাশেদের বোন নীলা ধাক্কা দিল। তারপর ফিসফিস করে বললো, ভাবি উনি তোমাকে কিছু বলছেন?
চন্দ্রার ঘোর কাটলো। সে চোখভর্তি জল নিয়ে অরুন রায়ের দিকে তাকালো। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তারপর চন্দ্রাকে আবার প্রশ্ন করলেন, কেমন আছো মা?
চন্দ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ভালো। আপনি?
আমিও ভালো। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক আর্শিবাদ করি।
বলেই তিনি স্টেজ থেকে নেমে পড়লেন। রাশেদ পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় সবটা দেখলো। এটা বুঝলো চন্দ্রা কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। না হলে কাঁদার কথা না। মেয়েটিকে আজকে খুবই সুন্দর লাগছে। চোখে জল থাকায় মনে হচ্ছে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। রাশেদ অবাক হলো অরুন রায়ের আচরন দেখে। সে স্টেজ থেকে নেমে অরুন রায়ের কাছে দাঁড়ালো।
তারপর বললো, স্যার কোন প্রবলেম? আপনি চলে এলেন যে।
অরুন রায় বললেন, রাশেদ তোমাকে কিছু বলার ছিল বলবো?
স্যার পারমিশন নেওয়ার কি হলো? আপনার যা বলার বলতে পারেন।
চন্দ্রাকে কী তুমি আগে থেকেই চিনতে?
ছোটবেলায় একবার দেখেছিলাম। মাঝখানে আমার সাথে যোগাযোগ ছিল না তবে বাবার সাথে চন্দ্রার বাবার খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপ। আমাদের লাষ্ট দেখা হয়েছিল একবছর আগে।
বিয়েটা কী পারিবারিকভাবে হয়েছে?
জি।
ওর সম্পর্কে সব কিছু জানো তুমি?
হ্যাঁ। কিন্তু স্যার এই কথা বলছেন কেন?
তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা জানিনা। তারপরও বলছি।
তিনি সবকিছু বললেন। রাশেদ এতোক্ষনে বুঝলো চন্দ্রার কাঁদার কারন আর উনার ওখান থেকে এভাবে চলে আসার কারন।
রাশেদ হেসে বললে, স্যার আমি আর আমার পরিবার সবাই সবকিছু জানে।
অরুন রায় বললেন, যাক ভালো হয়েছে। আমি আরো ভাবছিলাম এটা তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা?
না স্যার সমস্যা নেই। চলুন স্যার খেয়ে নিবেন। দেরি হয়ে গেছে।
হ্যাঁ চলো।
বৌভাতের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চন্দ্রাদের বাড়িতে গেল রাশেদ। তবে এইবার গাড়িতে আর চন্দ্রার শরীর খারাপ করে নি। বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছিল গাড়িতে উঠতে। চন্দ্রা গাড়িতে উঠেই ঘুম দিল। একঘুমে সিলেট এসে পৌছায়।
৮.
পরেরদিন থেকে রাশেদ খুবই বিরক্ত। খাবারের অত্যাচার থেকে বড় অত্যাচার বোধহয় আর কিছু হয় না। এখানে আসার পর থেকে রাশেদকে ঘন্টায় ঘন্টায় খাবার দেওয়া হচ্ছে। পেটে জায়গা নেই বলার সত্বেও দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যাপারটায় সে খুবই আপসেট। চন্দ্রা গুম হয়ে রয়েছে। ভেবেছিল তাকে বলবে এই অত্যাচার বন্ধ করতে করতে। কিন্তু সে কোথায় গিয়ে বসে আছে তা সে জানে না। রাশেদ এটাও ভেবেছিল একটু ঘুরতে যাবে চা বাগানে। সে শুনেছে চন্দ্রা এইচএসসি যে কলেজ থেকে দিয়েছে সেটা টিলার উপর। দুপুরে খাওয়ার সময়ও তাকে দেখা গেল না। রাশেদ মনে মনে ঠিক করলো এই খাবারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে একাই চলে যাবে ঘুরতে। তাই সে একা একাই ঘুরতে চলে গেল। সে একা একাই চন্দ্রার কলেজ দেখতে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে আশেপাশে ঘুরে দেখলো। রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরলো রাশেদ। ঘরে এসে দেখে চন্দ্রা ঘরে বসে আছে। রাশেদ যে ঘরে এসেছে সে খেয়ালই করে নি। সে দেখেছে এই মেয়ে তার সাথে থাকলেই নিশ্চুপ হয়ে যাবে। বাকি সবার সাথে ঠিক মতো কথা বললেও তার সাথে খুবই কম কথা বলে। বিয়ের পরের দিন একটু কথা বলেছিল। তারপর থেকে একেবারেই কথা বলছে না শুধু যতটুকু জিজ্ঞেস করা হয় তার উত্তর দেয়। সে সামনে এগিয়ে গেল।
তারপর চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা শুনো।
চন্দ্রা চমকে উঠলো। সে তাকিয়ে দেখলো রাশেদ এসেছে।
সে বললো, জি বলুন।
কালকে যেতে হবে। সকাল সকাল তৈরি হয়ে থেকো। ট্রেনে করে যাবো আমরা। তোমার তো কারে,বাসে করে গেলে সমস্যা হয়। সময় মতো না গেলে কিন্তু ট্রেন মিস করবো।
আচ্ছা।
রাশেদ চলে গেল ফ্রেশ হতে। রাতে খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেল।
পরের দিন চন্দ্রাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় সে আবার কাঁদলো। তার কান্নার জন্য তারা ট্রেন মিস করলো। তারপর বাসে করেই যেতে হলো।
চলবে……..
#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#পঞ্চম_পর্ব
৯.
রাশেদ হাসপাতাল থেকে ফিরে ফ্রেশ চন্দ্রার খোঁজে ছাদে এলো। এই মেয়ে রাতবিরাতে ছাদে এসে বসে থাকে। দরজা খোলা রেখেই মাঝে মাঝে চলে আসে।
চন্দ্রা এতো রাতে ছাদে কী করছো?
হঠাৎ পেছন থেকে কথা শুনে চন্দ্রা চমকে উঠলো। চন্দ্রা পেছন ফিরে দেখলো রাশেদ ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রাশেদের কথার উত্তর না দিয়ে চন্দ্রা বললো, নিচে চলুন খেয়ে নিবেন। অনেক রাত হয়েছে।
বলেই সে রাশেদকে পাশ কাটিয়ে নিচে চলে গেল। রাশেদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। সে অনেক চেষ্টা করছে সম্পর্কটা ঠিক করার জন্য। কিন্তু এটা ঠিক করার জন্য তার পাশাপাশি অপরজনকেও কো-অর্পারেট করতে হবে। যা চন্দ্রা করছে না। সে চাইছেই না সম্পর্ক এগিয়ে যাক। রাশেদের পক্ষে একা সবকিছু ঠিক করা সম্ভব না। এদিকে সে তাকে সময়ও দিতে পারে না। ডাক্তারি পেশায় নতুন জয়েন করায় তাকে অনেকটা সময় হাসপাতালে দিতে হয়। সবাই মনে করে ডাক্তারি পড়া শেষ হবার পরেই মোটা অঙ্কের টাকার বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা কতটা ভুল তা কেউ জানে না। অনেকের তো চাকরি পেতেই কষ্ট হয় সেদিক থেকে রাশেদ ভাগ্যবান তাকে চাকরি নিয়ে এতো খাটতে হয়নি। হয়ে গেছে কিন্তু এতে বেতন মোটামুটি তারপরও সে করছে। রাশেদ নিচে নেমে গেল। খেতে বসে দেখলো অনেক আইটেম।
রাশেদ বললো, এতো খাবার রান্না করেছো কেন?
আমি করিনি। দুইতলার চাচা দিয়ে গেছেন।
ওহ আমি তো ভুলেই গেছিলাম আজ উনার ছোট ছেলের ঘরের নাতির আকিকা ছিল। আমাদের তো দাওয়াত ছিল। তুমি যাওনি?
না।
ও আচ্ছা। আমিও ভুলে গেছিলাম। মনে থাকলে বাবুটার জন্য কিছু কিনে আনতাম। কাল আসার সময় নিয়ে আসবো তুমি গিয়ে দিয়ে আসবে।
আমি যেতে পারবো না আপনি দিয়ে আসবেন।
কেন? উনি তোমাকে কত স্নেহ করেন তুমি ওদের বাসায় গেলে উনি খুশি হবেন।
যাব না তো বললাম।
আচ্ছা যেতে হবে না।
বলেই রাশেদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার খাওয়ায় মন দিল।
দুইতলায় রাশেদদের বাসার মালিক থাকে। চন্দ্রাকে সাথে করে রাশেদের হাসপাতালের কাছাকাছি একটা বাসায় উঠেছে। ভাড়া বাসা। চারতলা বিল্ডিং। দুতলায় মালিক শাহাবুদ্দিন খান নিজে থাকে তার পরিবার নিয়ে, নিচতলায় গ্যারেজ তার উপরে তিনতলায় রাশেদ বাসা নিয়েছে। ছোট্ট একটা বাসা। একটা বেডরুম ড্রয়িং ডাইনিং রুম একসাথে তারপাশে একটা স্টোররুম, রান্নাঘর, বাথরুম আর ছোট্ট একটা বারান্দা। হাসপাতাল থেকে রাশেদের বাসা খুবই দূরে ছিল তাই হাসপাতালের কাছাকাছি এই বাসাটা নেওয়া।
এই বাড়ির মালিক কোন একটা কারণে চন্দ্রাকে খুবই পছন্দ করে। নাহলে কোন বাড়ির মালিক বাসার ছাদের চাবি ভাড়াটিয়ার কাছে দিয়ে বলে না,
মা এটা তুমি রেখে দাও। যখন ইচ্ছে ছাদে যাবে। আমি প্রায়ই দেখেছি তুমি ছাদে গিয়ে বসে বসে আকাশ দেখো। আকাশ দেখা ভালো। আকাশ দেখলে মানুষের মনও আকাশের মতো বিশাল হয়। প্রত্যেক মানবসন্তানের উচিত ভাত খাওয়ার মতো তিন বেলা আকাশ দেখা। ঠিক বলেছি না? নাও চাবি নাও আমার দরকার লাগলে আমি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিব। অবশ্য আমাদের বাসার কেউ ছাদে উঠে না। নিচে উঠোন থাকার সেখানেই কাপড় শুকায়।
বুঝলেন রাশেদ সাহেব আপনাদের আমার খুবই মনে ধরছে। আপনার বিবিও খুব ভালো মানুষ। মাটির মানুষ আপনারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে আপনারা এই গরীবের বাসায় দুইটা ডাল ভাত খাবেন। এইটা এই গরীবের আবদার।
ওইদিন কী কোন অনুষ্ঠান?
জি আমার ছোট ছেলের ঘরের নাতির আকিকা।
আমি তো যেতে পারবো না। হাসপাতালে থাকবো। চন্দ্রা যাবে ঠিক আছে?
বুঝলেন রাশেদ সাহেব আপনারা হচ্ছেন শিক্ষিত মানুষ। জ্ঞানের কথা জানেন। আপনাদের কথা বলতেই ভালো লাগে তাই আসি। আর চন্দ্রা মাকে নিয়ে কী বলবো! কী মিষ্টি চেহেরা মাশাল্লাহ! কথাও সুন্দর। আমি শুনলাম সে সিলেটি কিন্তু ভাষায় কোন সিলেটি টান নাই। একদম ফকফকা শুদ্ধ বলে।
আসলে ওর মা বাবা সবসময় ওদের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। তাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তবে এমন না যে সিলেটি জানে না। সিলেটি ভাষায়ও কথা বলতে পারে।
ও আচ্ছা। দেছেন তো কত সুন্দর কথা বলেন আপনারা! কথা বললে বলতেই মন চায়। আমার ঘরে তো এমন কথা বলার কোন জো নাই। বুঝলেন আমার ঘরে আছে দুই গাধা পুত্র। এরা গাধা এরা আনছেও গাধা বউ। একটারও বুদ্ধি নাই। এইযে আমারে দেখেন এই বয়সেও কাজ করতে হয়। এরা কাজ করে কিন্তু একটাকা সংসারে দেয় না। সব টাকা যে কী করে কী জানে? বুঝলেন শুধু মান ইজ্জতের ভয়ে কিছু করি না। না হলে কবেই এদের দুই ভাইরে বউসহ লাথি দিয়া বাইর কইরা দিতাম।
যে ছেলেদের দেখতে পারেন না তার ছেলের জন্য আকিকা দেন ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?
আরে ওই যে বললাম এলাকায় মান ইজ্জত আছে তাই না চাইতেও দিতে হয়। আচ্ছা, এখন উঠি। আপনার বিবি কোথায় গেল? তাকে ডাক দিন রাশেদ সাহেব। তাকেও বলে যাই।
চন্দ্রার শরীর বেশি ভাল না তাই বোধহয় শুয়ে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি আপনি বসুন।
না না ডাকতে হবে না। আপনি বলে দিয়েন। আচ্ছা রাশেদ সাহেব আমি এখন উঠি।
আচ্ছা। চাচা একটা কথা আপনি আমাকে তুমি করে বলুন আর শুধু রাশেদ ডাকেন। আপনি আমার বাবার বয়সী।
ঠিক আছে।
বলেই হেসে উঠে চলে গেলেন। ভদ্রলোক এম্নিতে ভালোই কিন্তু প্রত্যেক কথা একবার করে রাশেদ সাহেব বলেন এটা রাশেদের কাছে ভালো লাগে না।
রাশেদ খাবার শেষ করে শুয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে। বোধহয় চন্দ্রা কিছু করছে। ওর জন্য একটা কাজের মেয়ে ঠিক করে দিতে হবে। ছোট কম বয়সী যাতে সে চন্দ্রার সাথে কথা বলে সারাদিন। টুকটাক কাজও করে দেয়। শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বলে দেখতে হবে। উনি খুজে দিতে পারেন তার অনেক অনেক চেনা জানা। কালই বলতে হবে। চন্দ্রা শুতে এলো আধাঘন্টা পর। রাশেদ তখনো সজাগ। তার খুব ইচ্ছে করছে চন্দ্রার সাথে কথা বলতে, গল্প করতে। হাতপাতালে রোজ কত ঘটনা ঘটে সেসব বলতে অথবা চন্দ্রাকে বলতে, জানো তোমার মতো একজন আমার জীবনেও ছিল। তোমার সে চলে গেছে চাইলেই তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না কিন্তু আমার সে আমাকে স্বইচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছে আমি তাকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। রাশেদের চোখ লেগে গেল। হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে গেল তার মনে হচ্ছে চন্দ্রা কাঁদছে। তার পাশ ফিরে তাকালো। চন্দ্র অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে।
রাশেদকে চন্দ্রাকে ডাক দিয়ে বললো, চন্দ্রা তুমি কী কাঁদছো?
কান্নার শব্দ থেমে গেল। কিন্তু ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চন্দ্রা কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চন্দ্রা আবার আস্তে আস্তে শব্দ করে কাঁদছে।
রাশেদ চন্দ্রা কাঁধে হাত দিয়ে আবার বললো, চন্দ্রা তুমি কী কাঁদছো? কাঁদছো কেন?
চন্দ্রা জবাব দিলে না।
চন্দ্রা আমি শব্দ পাচ্ছি তুমি কান্না করছো। কান্নার কী হয়েছে বলো?
চন্দ্রা আচমকা পিছন ফিরে রাশেদকে হতভম্ব করে দিয়ে জরিয়ে ধরলো। উষ্ণ কোমলতা অনুভব করলো রাশেদ। কান্না শব্দ বাড়তে লাগলো। হেঁচকি তুলে কাঁদছে সে। রাশেদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। চন্দ্রার শরীর সামান্য গরম।
সে নিজেকে সামলে রাশেদকে বললো, চন্দ্রা কী হয়েছে? বাড়ির কথা মনে হচ্ছে?
চন্দ্রা মাথা নাড়লো দু’দিকে। যার অর্থ না।
তাহলে কী হয়েছে?
চন্দ্রা হেঁচকি তুলে বললো, কষ্ট হচ্ছে।
কেন?
আমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবেন?
যাব। কিন্তু তার আগে কান্না থামাও।
চন্দ্রা তা না শুনে বললো, আমাকে বারসাতের কাছে নিয়ে যাবেন?
রাশেদ তার হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠেছিল। কিন্তু আবার হতভম্ব হয়ে গেল। এই প্রথম কোন স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে তাকে তার প্রেমিকের কাছে নিয়ে যেতে। যে প্রেমিক মৃত।
কী বললেন না নিয়ে যাবেন কিনা?
হ্যাঁ। নিয়ে যাব। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিয়ে যাব। এবার ঘুমাও।
বারসাত বলেছিল সে আমাকে ছেড়ে যাবে না কেন গেল তবে? ও স্বার্থপর তাই না?
আমার জানা নেই চন্দ্রা।
আমাকে নিয়ে যাবেন?
হ্যাঁ।
সত্যি?
হ্যাঁ।
চন্দ্রা নিমিষেই ঘুমিয়ে গেল। রাশেদকে চন্দ্রার হাত ছাড়িয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। রাশেদ জানে এই জ্বরের ঘোরের কথাগুলো সকালে চন্দ্রার কিছুই মনে থাকবে না। রাশেদ নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আচ্ছা তানিয়া কী আমাকে চন্দ্রা যেমন বারসাতকে ভালোবাসে তেমন ভাবে ভালেবাসতে পারতো না। আজকাল তানিয়ার কথা মনে পড়ে না। তবে যখন দেখে চন্দ্রা বারসাতের কথা ভাবে বা ভেবে কাঁদে তখন বুকের ভেতর কেমন জানি চিনচিন করে ব্যাথা করে। বারসাতের কথা ভাবলে রাশেদের খুব হিংসে হয়। চন্দ্রা নামের এই মেয়েটা তার সমস্ত ভালোবাসা বারসাত নামের মানুষটিকে উৎসর্গ করে দিয়েছে যার অস্তিত্ব অনেক আগেই হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। তানিয়া তার জীবন থেকে নিজ ইচ্ছায় চলে গিয়েছিল। তবে রাশেদ তাকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো। কিন্তু তাই বলে যাবার সময় আটকায় নি। কারন যে থাকবে না তাকে আটকে রাখার কোন মানে হয় না। রাশেদের তানিয়াকে শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত একটা উক্তি বলতে ইচ্ছে করছে,
“আমি ঠকিনি, কারন আমি ভালোবাসতে পেরেছিলাম
কিন্তু ঠকেছে সে কারন সে ভালবাসতে পারেনি ”
চলবে……..