#আমার_হৃদয়ে_সে,৩৫,৩৬,৩৭
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৫
নভেম্বরের শেষ সময়।চারপাশ কেমন গুমোট বাঁধা মেঘলা।গত দুইদিন ধরে ঝাপটা বাতাসের সাথে বৃষ্টি নামছে।বৃষ্টি নামারও কোনো নিয়ম নাই।এই নামছে।আবার থামছে।আবার নামছে।এভাবে চলছে বৃষ্টির মেলা।শীতকালে বৃষ্টি দেখে ভার বিরক্ত লাগছে।আবার বিরক্ত হয়েও লাভ নেই।এটা বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব।আর বৈশ্বিক উষ্ণতা আমাদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে।শাশুড়ী মা আমার পাশে বসা।তিনি মনোযোগ দিয়ে সিরিয়াল দেখতেছেন।সিরিয়ালে বসেছেন মিনিট ত্রিশেক হবে।আমি বসেও সিরিয়াল না দেখার মতন।উনার কথাতে এখানে এসে বসেছি। উনার একা একা সিরিয়াল দেখতে নাকি ভালো লাগে না।হাসনাকেও বলেছেন উনার সাথে সিরিয়াল দেখতে।হাসনা সিরিয়াল দেখার বিপক্ষে।শোনা মাত্রই রুমের দরজা বন্ধ করে ফেলে।এখনো বন্ধ।হয়তো ফোন টিপতেছে।আমিও হাসনার মতন।সিরিয়াল দেখা আমার একদম পছন্দ না।তবে উপায় নেই।শাশুড়ী মা জোর করেছেন।না বসলে ব্যাপারটা কেমন খারাপ দেখাবে।বাইরে থেকে ধেঁয়ে আসা বাতাসের কারণে সিরিয়াল দেখতে উনার বোধহয় সমস্যা হচ্ছে।কেননা এরমাঝে উনি বার কয়েক কেঁপে উঠেছেন।আমি বলে উঠি,
“মা?জানালাটা বন্ধ করবো?”
শাশুড়ী এতক্ষণে যেন আমার এ’কথারই অপেক্ষায় ছিলেন।ছট করে বলে ফেলেন,
“হ্যাঁ বউমা, হ্যাঁ।জানলাটা বন্ধ করে।শীতের কারণে দেখার আমেজটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
আমি উঠে জানলা বন্ধ করতে গেলাম।এমন সময় সদর দরজায় কলিংবেল বাজে।শাশুড়ী মার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলাম।দরজ খুলে দেখি একজন প্রৌঢ়বয়সী লোক।অবশ্যি হৃদয়ের বাবার বয়সীই হবেন।উনি আমাকে দেখে হেসে বলে উঠেন,
“বউ মা, বুঝি?”
“জ্বী!তবে আপনি কে…!”
“তুমি চিনবে না।তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই চিনবে।”
“আচ্ছা ভেতরে আসুন।”
বলে সামনে থেকে সরলাম।উনাকে ভেতরে ঢুকার জায়গা করে দিলাম।উনাকে আমার শাশুড়ী মা দেখে ফেলেন।দেখেই হেসে বলেন,
“আরেহ ভাই যে!হঠাৎ আমাদের বাসায়?কি মনে করে?”
“বলবো।বলবো।আপনার বউ মা জিজ্ঞেস করে আমি কে।বলছি সে ছাড়া এ বাসার সবাই আমাকে চেনবে।”
“বউ মা নতুন এসেছে তো তাই চিনতে পারে নি।”
“সেটা তো বুঝেতে পেরেছি।তা বউ মা?”
বলে উনি পাশ ফিরে আমার দিকে তাকান।আমি এতক্ষণে আগের জায়গাতে ছিলাম।উনার ডাকে এবার শব্দহীন পায়ে এগিয়ে গেলাম।বললাম,
“জ্বী?”
“আমি তোমার শ্বশুর মশাই আছে না?”
“জ্বী…”
“তোমার শ্বশুর মশাইয়ের পুরনো বন্ধু।তোমার শ্বশুর এখানে আসার পর থেকেই তোমার শ্বশুরের সাথে আমার পরিচয়।”
“ওহ আচ্ছা।আচ্ছা আপনি বসুন আঙ্কেল।আমি আপনার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসতেছি।”
পাশ থেকে শাশুড়ী মা বলেন,
“হ্যাঁ বউ মা তাই করো।”
আমি কিচেনে চলে এলাম।চা, বিস্কুট,দুই পদের ফলে সহ উনার সামনে ট্রে টাকা রাখলাম।উনি হেসে উঠলেন,
“কি দরকার ছিল বউ?এত কষ্ট করার?”
“আরেক ভাই কি যে বলেন!কতদিন পর আমাদের বাসায় এলেন।নিন ভাই।”
লোকটি চায়ের কাপ হাতে নিলেন।আমি চলে এলাম আমার রুমে।কিছুক্ষণ পর শাশুড়ী আমাকে আবার ডাকলেন।আমি বের হলাম।গিয়ে উনাকে আর দেখি নি।সম্ভবত চলে গেছেন।মা বললেন,
“যিনি এখন আসলেন না? মানে মুস্তাফা ভাই?উনার বড় মেয়ে ফারিহার আগামী সোমাবারে বিয়ে।আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে।বলেছে যেভাবেই হোক যেতে।এই যে কার্ড।”
কার্ডটা হাতে নিলাম।আর বললাম,
“বাবার হাতে দিলে ভালো হতো না কার্ডটা?যেহেতু বাবার বন্ধু?”
“গতকাল নাকি দোকানে দেখা হয়েছিল তোমার শ্বশুরের সাথে মুস্তাফা ভাইয়ে।কার্ড তোমার শ্বশুরের হাতেই দিতে চেয়েছিলো।তোমার শ্বশুর নাকি বললো কার্ডটা আমাদের হাতে দিতে।”
“বাবা যাবেন বিয়েতে?”
“মুস্তাফা ভাইকে বললো নাকি যাবে। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ।টেনশন মুক্ত হলাম কিছুটা।তারমানে আমরা পরিবারের সবাই যাচ্ছি?”
“হু।”
৫৫.
আজ সোমবার।মা আজ সকাল সকালই রান্না ঘরে ঢুকেছেন।টার্গেট দশটার ভেতর রান্নাটা শেষ করে ফেলবেন।তারপর লম্বা সাঁজ দিয়ে মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসায় ছুটবেন।বিয়েতে যাওয়ার খুশিতে হাসনা একটু আগে থেকেই তার সাজার সবগুলোই সরন্জাম নিয়ে বসেছে।কসমেটিকস,জামাকাপড়, জুতো আরো অনেককিছু। কোনটা পড়লে মানাবে,কোনটা মানাবে না।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চয়েজ করতেছে।তার ওহেন কান্ড হেসেছি।আর আমার জামাইটা কোথায় এখন জানেন?রুমে!একটুপর নাস্তা করতে ডাইনিং এ আসবে।নাস্তা শেষ করে কলেজে ছুটবে।এক,দুই ক্লাস করিয়ে প্রফেসরের থেকে ছুটি নিয়ে চলে বাসায় ফিরবে।তারপর আমাদের সাথে বিয়েতে যাবে।গতকাল রাত অনেকবার বলেছি আজ সারাদিনের জন্যে ছুটি নিয়ে আসতে।মানে নি আমার কথা।সে কিছুতেই কলেজ মিস দিতে পারবে না।এক রেসপন্সিবিলিটিজ নামক ব্যাপার আছে তাই!আর আমার শ্বশুর কি করে এখন জানেন? উনার রুমে!আমি এখন উনার জন্যে নাস্তা নিয়ে যাবো।আপনারা হয়তো একটা বিষয় এখনো জানেন না।সেদিনের পর থেকে আমার শ্বশুর আমার সাথে এবং হাসনার সাথে হালকা পাতলা কথা বলেন।একদম বেশি কথা না আবার।প্রয়োজনীয় কথা বলেন।এই যেমন খাবার নিয়ে গেলে কোনোদিন খান।আবার কোনোদিন খান না।না খেলে বলেন,”খাবো না।নিয়ে যাও।”নিয়ে আসি।আর যেদিন খাবেন চুপ করে থাকেন।জবাব দেননা।আমি বুঝে ফেলি।খাবার রেখে চলে আসি।উনার দিকে ভালোভাবে তাকালে বুঝি আমার উপর থেকে এখনো রাগটা উনার পুরোপুরি যায় নি।তবে ইনশাআল্লাহ আমি পারিসা চেষ্টা চালিয়েই যাবো।হাল ছাড়বো না।দেখি শ্বশুর কয়দিন আমাদের সবার উপর রাগ করে থাকতে পারেন!
৫৬.
ঠিক দুপুরে আমরা সবাই রেডি হয়ে বাসা থেকে নামি।আমরা সবাই বলতে হৃদয়,মা,হাসনা,রুনু এবং আমি।আর বাবা আমাদের আগেই চলে গেছেন।যাওয়ার আগে আমাদের কিছু বলে যাননি।বাসা থেকে বের হবার সময় সেজেগুজে বেরিয়েছেন।তাই দেখেই বুঝলাম মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসায় যাচ্ছেন।আমরা দুইটা এপার্টমেন্ট পার হলেই মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসার সামনে এসে দাঁড়াই।আমি কৌতূহলী হয়ে যাই।সড়গড় পেছনে তাকাই।চোখ বড় করে হৃদয়কে বলি,
“আপনাদের বাসা থেকে তো এই বাসার দূরত্ব খুবই কম!”
হৃদয় হেসে দেয়।ওর হাসিটাতে আমার চোখ আঁটকে যায়।এতক্ষণে আমিতো হৃদয়কে খেয়ালই করিনি।পড়নে লাইট ব্লু জিন্স।স্লিভলেস ডেনিম করা পিংক কালারের শার্ট।শ্যাম উজ্জল মুখটায় বেশ মানিয়েছে ড্রেসাপ!এবার আরেকটু গভীরে তাকাই।গভীরতার দৃষ্টি নাকের দিকে।নাঁকের ঢগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ছেলেটার!মাথার উপর সূর্য।তার এক রশ্মি মৃদু আলো নাঁকের উপর পড়েছে।বিন্দুগুলো মুক্তোর মতন চিকচিক করছে যেন।উইু!মন চায় সেখানে একটুখানি ছুঁয়ে দিই।
“পারিসা?দাঁড়িয়ে আছো যে?চলো না?”
টনক নড়লো এবার!চমকানোর মতন আশপাশে তাকাই।মা,হাসনা এবং রুনু অনেকখানি উঠে গেছে সিড়ি বেয়ে।হৃদয় আমার সাথে নিচে দাঁড়িয়ে আছে।মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসা দু’তালায়।আমি হৃদয়ের হাত ধরে দু’তালায় উঠি।এসে পুরো ডাইনিং এবং হলরুম জুড়ে মেহমানের ঢল!মাকে,হাসনা এবং রুনুকে দেখছি না।এত মেহমানের মাঝে তারা যেন হাওয়া হয়ে গেল!হৃদয়ের কান বরাবর আমার মুখটা এগিয়ে এনে চাপা গলায় বলি,
“মা,হাসনা এবং রুনু কোথায়?তাদের দেখছি না!”
“আছে কোথাও।”
আবার বলি,
“বউকেও তো দেখছি না!বউ কোথায়?”
এ’কথার পিঠে হৃদয় আমার দিকে সরু চোখে তাকায়!তার তাকানোর ভঙ্গিতেভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যাই! হৃদয়কে এ আবার কি কথা বললাম!সে জানবে কি করে যে বউ কোথায়!আমিও না মাঝে মাঝে কেমন উদ্ভট কথাবার্তা বলে ফেলি!দাৎ!ভাবনার মাঝে কোথা থেকে মুস্তাফা আঙ্কেল আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান।বলেন,
“এসেছো তোমরা?”
হৃদয় সালাম করে উঠলো।আমিও সালাম করলাম।তিনি হাসিমুখে জবাব নিলেন।বললেন,
“আচ্ছা,এভাবে না দাঁড়িয়ে ওখানে গিয়ে আগে বসো।আঙ্কেল একটু পর এসে কথা বলতেছি।”
দেখেই বুঝা যাচ্ছে মুস্তাফা আঙ্কেল ভীষণ ব্যস্ত।ব্যস্ত না হয়েও উপায় নাই।মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ব্যস্ততা
থাকবেই।হৃদয় মাথা নাড়ে।তারপর আমার হাত ধরে লোকসমাগম এড়িয়ে একটা রুমের সামনের কিছু অংশ খালি।সেই খালি জায়গাটা দুইটা লাল চেয়ার দখল করে আছে।হৃদয় সেখানে নিয়ে সে একটা চেয়ারে বসে।এবং আমাকে অপরটিতে বসায়।
বসার কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে হাসনা এসে আমার বাম বাহু চেপে ধরে।উৎফুল্লতার সুরে বলে উঠে,
“আরেহ এখানে বসে আছো কেন,ভাবী?বউকে দেখবা না?বউকে যা সুন্দর করে সাজিয়েছে না ?দেখলে ফিদা হয়ে যাবা!আমি মাত্র দেখলাম।মাও এবং রুনু আপা বউয়ের রুমেই আছে।”
হৃদয় বলে,
“আচ্ছা,তাহলে তুমি হাসনার সাথে সেখানে যাও।আমি এখানেই আছি।”
বউকে দেখাতে হাসনা আমাকে করিডোর দিয়ে বড় একটা রুমে নিয়ে আসে।রুমে অনেক মানুষজনই আছে দেখছি।।মাকে এবং রুনুকেও দেখেছি।হাসনা টেনে একেবারে বউয়ের সামনে আমাকে এনে দাঁড় করায়।বলে,
“ফারিহা আপু?এই যে দ্যাখো?এই হলো আমার ভাবী।আর ভাবী?ইনিই ফারিহা আপু।মানে বউ!”
শেষ কথাটা বলে হাসনা কটকট করে হেসে দেয়।ফারিহা নামের নববধূ কিছুটা লজ্জার মতন করে মাথা নুইয়ে নেয়।তারপর ফারিহার সাথে আমি পরিচিত হলাম।ফারিহাও হলো।অনেকক্ষণ বসে বসে দুইজন অনেক কথা বললাম।কথা বলার ফাঁকে কেউ একজন পেছন থেকে বললো,
“আচ্ছা?তোমার মাথাটা একটু সরাও বউকে দেখতে পাচ্ছি না।”
আমি ফারিহার কিছুটা সামনে বসা ছিলাম।আমার কারণে হয়তো ফারিয়াকে আমার পেছন থেকে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল।আমি সরে এবার আরেকটু দূরে বসলাম।বসে পেছন থেকে বলা মহিলার দিকে কেনজানি অজান্তে তাকালাম।দৃষ্টিটা মুহূর্তে সেখানেই আঁটকে গেলো!আমার সেই স্থির দৃষ্টির সামনে অভির মা দাঁড়িয়ে আছেন এখন।মানে আমার প্রথম শাশুড়ী মা!
চলবে,,,,
#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৬
আমি ফারিহার কিছুটা সামনে বসা ছিলাম।আমার কারণে হয়তো ফারিয়াকে আমার পেছন থেকে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল।আমি সরে এবার আরেকটু দূরে বসলাম।বসে পেছন থেকে বলা মহিলার দিকে কেনজানি অজান্তে তাকালাম।দৃষ্টিটা মুহূর্তে সেখানেই আঁটকে গেলো!আমার সেই স্থির দৃষ্টির সামনে অভির মা দাঁড়িয়ে আছেন এখন।মানে আমার প্রথম শাশুড়ী মা!তিনি প্রথমে আমাকে খেয়াল করলেন না।যখন ফারিহার দিকে হেসে এগিয়ে আসতে নিলেন তখন আমাকে দেখলেন।মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো উনার মুখের হাসি।চলন্ত পা স্থির হয়ে গেল।তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখের দিকে।আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠলো যেন।আমি বিছানা থেকে নেমে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম।আর আলতো জড়িয়ে ধরলাম।বললাম,
“মা?কেমন আছেন,আপনি?”
সাথে সাথে জবাব এলো না।কয়েক সেকেন্ডস বাদে বললেন,
“এইতো আল্লাহ রাখছে..।তুমি?”
“ভালো,মা।বাসার সবাই কেমন আছে মা? বাবা?রিমি আপু?টিপি?সবাই ভালো আছে?”
“ভালো।”
এবার কাঁধ থেকে মাথা তুললাম।উনার দিকে ক্ষীণ চোখে তাকালাম। আগের মতন উনার মুখে আজ খুশি খুশি ভাবটা পেলাম না।কেমন মনমরা মনমরা করে আছেন!ভেতরটা আমার আরেক দফা মুচড়ে উঠলো।চারপাশে আলতো চোখ বুলালাম।উপস্থিত সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।মা,হাসনা এবং রুনুও।তবে তাদের চোখেমুখে বিস্ময়তার ভাব।হয়তো ভাবছে, ইনি কে?আর ইনাকে মা বলে সম্বোধন করলাম কেন?!আমি ফের আবার অভির মার দিকে তাকাই।বলি,
“অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে মা!ভাবতেই পারি নি আজ দেখা হবে!”
উনি হাসলেন।হাসিটা কেমনজানি মলিন ছিল।আমার কাছে একদম স্বস্তি বোধ লাগলো না।এত হাসিখুশি মানুষটা এভাবে হাসছে কেন!?ভাবনার মাঝে কেমন উদাসীন গলায় বলেন,
“আমিও।”
“একা এসেছেন,মা?”
“নাহ।”
“কে এসেছে সাথে?”
“অভির বাবা।”
“কোথায় উনি?”
“বাইরে আছে হয়তো।”
এমন সময় আমার বর্তমান শাশুড়ী মা এগিয়ে আসেন আমাদের দিকে।এসে আমাকে বলেন,
“ইনি সম্পর্কে তোমার কি হোন, পারিসা?”
“মা ইনিই অভির মা।যার কথা তোমাকে ওইদিন বললাম!”
আমার বর্তমান শাশুড়ী মার মুখটা মুহূর্তে হাসোজ্জল হয়ে উঠলো।হবেই না বা কেন,বলুন?আমার প্রথম শাশুড়ী মা যে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো।ঠিক পরের বিয়েতে প্রথম শাশুড়ী মার মতন দ্বিতীয় আরেকটা মারও যে ভালোবাসা পেলাম সে কথা কি আর না বলে থাকতে পেরেছি?পারি নি!হৃদয়ের মা বলেন,
“তাই নাকি?আপা জানেন?পারিসার থেকে আপনার অনেক কথা শুনলাম!আপনি খুব ভালো।ওকে খুব আদর করেছেন!”
অভির মা বলেন,
“আপনি পারি সার শাশুড়ী? ”
“জ্বী।”
“পারিসার বিয়ে হয়েছে?”
এ’কথা বলামাত্র আমি মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে আনলাম।হৃদয়ের মা বলেন,
“জ্বী।আমার ছেলে হৃদয়ের সাথে পারিসার বিয়ে হয়েছে।”
“ওহ।দোয়া করি পারিসার সংসারিক জীবন সুখী এবং আরো সুখময় হোক।”
বলে শাশুড়ী মা দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়েন।আমার শাশুড়ী মা হাসেন।আমি হাসতে পারলাম না।উনার দীর্ঘশ্বাসটির প্রতিটি কণা আমার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলো!হৃদয়টা ব্যদনায় ভরে গেল।আমার কেনজানি মনে হচ্ছে শাশুড়ী মা আগের মতন খুব একটা ভালো নেই।যদি সত্যিই ভালো না থাকে তবে ভীষণ জানতে ইচ্ছে কেন ভালো নেই! এই মুহূর্তে উনাকে একটা প্রশ্ন করতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে!প্রশ্নটি হলো,”মা?অভির বউ কেমন?ভালো ত?”
কিন্তু পারলাম না।কেনজানি বিবেকে বাঁধা পড়লো!তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলেন আমার শাশুড়ী মা এবং অভির মা।আমি আর কিছু বলিনি।পাশে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি উদাসীন মনে!কিছু কথা উনাদের হয়তো মস্তিষ্ক ঢুকেছে আবার হয়তো ঢুকেও নি!
৫৭.
রাতে খাবার খেতে বসেছি সবাই।খাবার খাওয়ার মাঝে হঠাৎ শাশুড়ী মা,
“অভির বউ বোধহয় ভালো পড়ে নি!শুনলাম সে নাকি তার বউকে নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে তোমার শাশুড়ী যে বললো আজ আমাকে।আজকালকার বউরা না ভীষণ খারাপ!শ্বশুর-শাশুড়ীকে কীভাবে শ্রদ্ধা করবে তা জানে না!”
আমার ভাত খাওয়ার হাত চলা শ্লথ হয়ে গেলো
হৃদয় আমার ডানপাশের চেয়ারে বসা।সে ভাতের নালা মুখে ফুঁড়ছে আর বলছে,
“কোন অভির কথা বলছো?”
“পারিসার প্রথমে যেখানে বিয়ে হয়েছিলো!”
“ওহ!উনার সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে আবার?”
“বিয়েতে!”
“মুস্তাফা আঙ্কেলের কি হোন উনি?”
“তোর মুস্তাফা আঙ্কেলের দূরসম্পর্কের আত্মীয় অভির বাবা।অভির বাবাও তো আজ এসেছিলো নাকি বিয়েতে!”
“ওহ!পরিচয় তো আর করিয়ে দিলে না!”
বলে হৃদয় মৃদু হাসি টানলো।মার থেকে চোখ সরিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালো।ওপর দৃষ্টিতে আমি ভাতের নালা ঢলতে শুরু করলাম।শাশুড়ী মা বলেন,
“আর অভি ছেলেটা আসলেই খারাপ!প্রথম বউকে বুঝে নি!এখন দ্বিতীয় বউকে বুঝেছে।দ্বিতীয় বউকে বুঝে মা-বাবাকে পর করে দিয়েছে!কত যে অভিশাপ নিতেছে!”
“মা দয়া করে এই টপিক বাদ দাও।ভাত খেতে বসেছো ভাত খাওয়া শেষ করো!”
বলে হৃদয় নিজেও খাবারে মন দেয়।অধীর মনোযোগ দেয়!প্রসঙ্গত সে অভির ব্যাপারটা এড়াতে খাবারের তাগাদা দেয়।বিয়ের পর থেকেই দেখতেছি হৃদয় অভির বিষয়ে উদাসীনতা।সে অভি নামের কেউ আমার অতীতে ছিল বা অভির সাথে আমার আগে বিয়ে হয়েছিল এটা যেন সে মানতেই চায় না।সে বুঝাতে চায় আমিই তার প্রথম।এবং সেও আমার প্রথম!মাঝখান দিয়ে কোনো ভিলেনটিলেন নাই!আর থাকবেও না!বিয়ের এই পনেরো দিনের মধ্যে হৃদয়ের এই বিষয়টা আমাকে বেশ নজর আসে।যদিও সে আমাকে বুঝতে দেয়না।তবে আমি বুঝি!
৫৮.
আরো অনেকগুলো দিন এভাবে দেখতে দেখতে পার হয়ে যায়।এরমাঝে খালামণিদের বাসা থেকে আমি এবং হৃদয় কয়েকদিন থেকে বেড়িয়ে আসি।এবং আমাদের বাসা থেকেও বেড়িয়ে আসি!মোটামুটি সবকিছুই স্বাভাবিক চলছে আরকি।এ বাড়ির, মানে হৃদয়দের বাড়িও স্বাভাবিক।আমার শ্বশুরের অস্বাভাবিকতা আগের মতন এখন আর তেমন নেই।এই যেমন তিনি আগে মন চাইলে বাসায় হালকাপাতলা খাবার খেতেন।আর বেশি সময় বাইরে খেতেন। এখন আর তা নেই।এখন তিনি সব খাবার বাসায়ই খান।কোনোদিন আমার হাতের খান।কোনোদিন মার হাতের।উনার মাঝে এই পরিবর্তন দেখতেছি মুস্তাফা চাচার মেয়ের বিয়ের পর থেকে ই!হুটহাট উনার ওহেন পরিবর্তনের মানে আমরা কেউই বুঝি নি।যেদিন বাবা বাসায় খাওয়া শুরু করলেন মা এই রুম থেকে ওই রুম।আবার ওই রুম থেকে এই রুম!একদম দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিলেন আমাদের বিষয়টা জানাতে।আমাদের দেখামাত্রই চট করে এক্টা উদ্ভট কথা বলে উঠলেন,
“হয়তো মুস্তাফা ভাই উনার মেয়ের বিয়ের খাবারে তোদের বাবাকে তাবিজ খাইয়ে দিয়েছে।নাহলে রাগটা কোথায়?রাগ থাকলে তো খেতো না!এখন খাচ্ছে!রাগ আর নাই!”
মার কথা শুনে সেদিন আমাদের খুব দমফাটা হাসি!খুব হেসেছি।তবে মার কথাটা পুরোপুরি সত্য হয়নি!বাবা খাবার টা বাসায় খাচ্ছে ঠিকা আছে।কিন্তু আমাদের সাথে কথাবার্তা সেই আগের মতনই রয়ে গেছে।পরিবর্তন শুধু খাওয়াতে!আর কিছু না!
৫৯.
ছাদে টবে অনেকগুলো গাছের ফুল ফুঁটেছে।লাল গোলাপ ফুঁটেছে।গোলাপী গোলাপ!গন্ধরাজও ফুঁটেছে দেখছি অনেক।ফুল বাগান করা আমার শ্বশুরের শখ বেশি।এই ছাদে প্রায় দশটা জাতের ফুলগাছ আছে।যারমধ্যে আটটা জাতেরই গাছ লাগানো আমার শ্বশুরের হাতের।আর বাকি দুইটা হাসনা লাগিয়েছে।সেও পছন্দ করে ফুলবাগান করতে।এই অভ্যেস টা হয়তো সে বাবার থেকে পেয়েছে।শাশুড়ী মা আবার এটা পছন্দ করেন না।তিনি শুধু সবজির বাগান করতে ভালোবাসেন।ছাদে কিন্তু মিষ্টি কুমড়া,বেগুন,পুইশাক, ঢেঁড়স এবং ঝিঙ্গার গাছ আছে।সেগুলো শাশুড়ী মা বাবার হাতে বাজার থেকে আনিয়ে নিজে রোপণ করেছেন হয়তো।কয়েকটা কুমড়াও হয়েছে।লম্বা দড়ির মতন ঠাঁটার সাথে ঝুঁলে আছে।আমি সেগুলোতে তাকালাম না বেশিক্ষণ।ছুটে গেলাম লাল গোলাপের দিকে।গোলাপে আলতো হাত বুলালাম।আর দুই তিনটা গোলাপ থেকে প্রাণভরে সুভাসও নিলাম।এমন সময় ঘাড়ে চিমটি খেলাম কারো।”আহ”শব্দ তুলে চোখমুখ কুঁচকে আনতেই পেছন থেকে,
“এত গোলাপ ছুঁইতে হবে না।ক’মাস পরতো আমাদের কোলেই গোলাপ ফুঁটবে!তখন প্রাণভরে ছুঁইয়ো। ”
বলে হৃদয় আবারো হাসে।আমি মাথাটা আলতো নুইয়ে ফেললাম লজ্জায়!আর না চাইতেও পেটের দিকে নজর আওড়ালাম।আজ আমি একমাসের অন্তঃসত্ত্বা! গতকাল বিকেলে বেলকনির দড়িতে জামাকাপড় রোদে শুকাতে দিলে হঠাৎ আমি মাথা ঘুরিয়ে নিচে পড়ে যাই।পরে হৃদয় বাসায় ডাক্তার নিয়ে আসে।ডাক্তার পরিক্ষা নিরীক্ষা করে।পরিক্ষা নিরিক্ষা করার পর এই তথ্য দেয় যে, হঠাৎ ঘুরিয়ে পড়ি একমাস অন্তঃসত্ত্বার কারণে!
চলবে….
#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৭
ইদানীং ভারী শরীরটা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ!তারপরও ডানহাতে সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে অতি সংযতে উঠে দাঁড়াই।আলতো রুমের দরজা খুলে চারপাশে তাকাই।ডাইনিং,হলরুমে কেউ নেই।থাকলে আমাকে এতক্ষণে এখানে আসতে দেখলে বকাবকি শুরু করে দিত।বিশেষ করে মা সবথেকে বেশি।সন্তান পেটে আসার পর থেকে তিনিতো কোনো কাজেই আমাকে হাত দিতে দেননি।হাত দিতে গেলেই বলতেন,”আমার নাত/নাতনীর যদি কিছু হয় তাহলে তোমার খবর আছে!অনেক শখ বেঁধে রেখেছি মনে তাতো তুমি জানোই!”উনার শখ হলো উনি উনার নাত/নাতনীর সাথে খেলা করবেন।দুষ্টুমি করবেন।তাকে গোসল করিয়ে দেবেন।খাইয়ে দেবেন।আবার ঘুম পাড়িয়েও দেবেন।এমনকি জানেন?উনি আমাদের চক্ষু আড়ালে একটা দামী গাড়িও কিনে রেখেছেন!সেদিন হৃদয় তার কলেজের কি দরকারী কাগজ নিতে আলমারী খুলতে যেয়ে দেখে একটি খেলনা গাড়ি।অবশ্যি প্রথমে বুঝতে পারে নি খেলনা গাড়িটি মা কেনো কিনেছিলেন।সে খেলনা গাড়িটি হাতে নিয়ে ডাইনিং এ এসে মাকে বলে,
“মা,এটা কারজন্যে?”
উনি হঠাৎ ছেলের এহেন কথায় কিছুটা বিব্রতকর হয়ে যান।বাচ্চা এখনো হয়নি অথচ তারজন্যে গাড়ি!ছেলে বিষয়টি শুনলে কেমন দেখাবে না?আমি সেখানেই ছিলাম দাঁড়িয়ে তখন।হৃদয় জবাব পাওয়ার অপেক্ষায়!মা উপায়ন্তর না পেয়ে বলে উঠেন,
“আসলে বাবা,আমার নাত/নাতি হলে তাকে গাড়িটা দেব তাই আর কি কিনে…!”
বাকিটুকু বলতে পারেননি।হৃদয় ভারী অবাক হয়।আমিও।আমার চোখেতে পানি চলে এসেছিলো প্রায়।নিজেকে সংযত করে মাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরি।তাই এই মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোকিছুই করতে পারি না।ইচ্ছা হলেও পারি না।হয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।নাহয় পাশ কেঁটে চলে আসি।এই আটটা মাস এভাবেই গেছে আমার!আমি ধীর গতিতে পা ফেলে টেবিলের কাছে আসি।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে নিলে তার থেকে কিছু পানি গদগদ করে নিচে পড়ে যায়।তাতে আর পাত্তা না দিয়ে গ্লাসের পানিটা শেষ করে পেছন ঘুরে এক কদম পা ফেলতে পা পিচলে যায়।পড়ে যেতে আর সময় দিই নি আমি।ওমনি টেবিলের পায়া ধরে ফেলি!পেটে টান পড়ে। কিছুটা কুঁকড়িয়ে উঠি আমি।আমার কুঁকড়ানোর শব্দ হয়তো আমার শ্বশুরের রুম থেকে শোনা যায়।কেননা তিনি অমনি দরজা খুলেন আমার দিকে এগিয়ে আসেন।আমাকে উঠাতে আমার বাম হাত ধরতে ধরতে বললেন,
“তোমাকে কে বলেছে একা একা পানি খেতে আসতে?রুনু ছিলো!তোমার শাশুড়ী ছিলো!বা আমাকেও তো ডাকতে পারতে!”
তারপর উনার সাহায্যে উঠে দাঁড়াই।উনি এবার আমার বাম হাতটা ছেড়ে বলেন,
“যাও রুমে যাও।এরকম আর করবে না!”
বলে চোখমুখ ভারী শক্ত করলেন!আমি কিছু আর বলতে পারলাম না।উনার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে থেকে ঘোর স্তব্ধতা মুখে রুমে ফিরে এলাম!দরজা বন্ধ করলাম।বিছানার এককোণে গিয়ে বসলাম।পঞ্চাশ সেকেন্ডের মতন চুপচাপ বসে থাকলাম।চোখজোড়া এরমাঝে ভিঁজে উঠলো।সাথে ফুঁটে উঠলো ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
হৃদয়ের সাথে আমার বিয়ের আজ দশমাস হতে চললো। এই দশমাসে বাবা আমার সাথে আজ এই প্রথম ভালো মতন কথা বললেন তাও নিজ থেকে!!
এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না উনি যে আমার সাথে কথা বলবে ।আমাকে এসে ধরবেন!হয়তো আমার পেটে বেড়ে উঠেছে উনারই একমাত্র ছেলের একমাত্র সন্তান যার ব্যথা পাওয়ার সংবাদটা উনার মস্তিষ্কে আপনাআপনিই পৌঁছে গেছে।তাই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি।ছুটে আসেন নাত/নাতীকে বাঁচাতে।হ্যাঁ,এইসবকিছুই শেকড়ের টান।ভালোবাসার টান।মায়া-মমতার টান।এই টানে রাগ থাকে না।অভিমান থাকে না।পেটে হাত বুলালাম।
“বাবু?তুমি খুব লাকী।তোমার কারণে তোমার দাদু আজ আমার সাথে কথা বলেছে।তুমি তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে আসো।খুব তাড়াতাড়ি ।এসে তোমার দাদুর রাগ ভাঙ্গিয়ে দাও!”
৬০.
লাবণ্য আসাতে এই বাড়ির সবাই খুব খুশি!সবার সবার মতে লাবণ্যের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন আদর!লাবণ্যের আজ ছয়মাস।বসতে শিখেছে সবে মেয়েটা।এই এইটুকুন বাচ্চার জন্যে ওর দাদু,বাবা এমনকি দাদাও খেলনাপুতুল এনে ভরিয়ে ফেলেছে।দাদা খেলনাগুলো আমার রুমে এসে লাবণ্যকে সরাসরি দেয়না।কীভাবে দেয় জানেন?হাসনাকে ডেকে নিয়ে ওর মাধ্যমে লাবণ্যকে আমার রুম থেকে নিয়ে তারপর লাবণ্যের হাতে খেলনাগুলো দেন।সাথে খুব আদরও করে দেন!হাসনা বললো।হাসনার মুখ থেকে আমি এবং শাশুড়ী মা কথাগুলো শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি।খুশির মাঝে শাশুড়ী মা আবার অভিমানও করে বসেন।বলেন,
“এই আমি দেখবো,এই জোহারা বেগম দেখবে তোমার শ্বশুর ক’দিন আমাদের সাথে রাগ করে থাকতে পারে!যেচে যেয়ে কোনোদিনও কথা বলবো না!এই জোহারাকে সে চিনে না এখনো!”
আমি হেসে উঠলাম।বললাম,
“মা?বাবা হয়তো লজ্জায় কথা বলতে পারছেন আমাদের সাথে।আগে আমরা কথা বলে উনার রাগের লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিই?”
“চুপ করো বউ মা!পুরুষ মানুষের আবার লজ্জা কীসের?!”
৬১.
লাবণ্যের এগারোমাসে পা পড়েছে।হাঁটি হাঁটি পা ফেলে দিনে দশ বারোবার ওর দাদার রুম,দাদীর রুম,হাসনার রুম এবং আমাদের রুমে হাঁটাহাঁটি করে।হাঁটতে যেয়ে পড়ে যায়।তারপরও হাঁটে।আমরা পেছন থেকে ওকে ধরতে গেলে আরো দৌঁড় মারার চেষ্টা করে।এরকম দুষ্টু মেয়েটা!ওদিন সদর দরজা খোলা ছিল। ও কি করলো? দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।আমি আতঙ্ক মনে ওর পেছনে ছুট লাগাই।কারণ নিচতলায় যাওয়ার আবার সিড়ি আমাদের দরজার একদম বাম কর্ণারে।মেয়েটা যদি ঘুরে সেদিকে একবার যায় তাহলে আর রক্ষা নেই!বেরিয়ে দেখি ও সত্যিই সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নিচে পা ফেললে সিঁড়ির প্রথম ধাপ!জোর গলায় “লাবণ্য” বলে ওকে ধরতে গেলে ও পাশ থেকে দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ায় ।আর আমি পা পিচলে কেনজানি সিঁড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ে যাই।অস্ফুট একটা চিৎকার করে দেয়ালের সাথে মাথা ফাঁটাবার আগে কেউ যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।আর সে দেয়ালের সাথে পিষে যায়।আমি পিটপিট চোখের পাতা মেলে সামনে তাকিয়ে আমার জামাইটা!কলেজ থেকে ফিরেছে।কপাল,মুখ,গলা,বুক,শার্টের উপরের অংশে ঘাম লেপে আছে।ঘাম থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে।মানুষ বলে ঘামের গন্ধ দুর্গন্ধ।কিন্তু হৃদয়ের গাঁয়ের এই গন্ধটা আমার ভীষণ প্রিয়!কেমন যেন বকুল ফুলের মতন লাগে নাকে গন্ধটা।নাক ফুলিয়ে গন্ধটা নিই কিছুক্ষণ।তারপর কোনো কিছু না ভেবে হৃদয়কে জড়িয়ে ধরি খুব জোরে!হৃদয় কুঁকড়ে যাওয়ার মতন আর্তনাদ করে উঠে একটু।আমি অসংযত হয়ে ওকে ছাড়িয়ে বলে উঠি,
“কি হয়েছে?আপনি একরকম করতেছেন কেন?”
হৃদয় বলে,
“তোমাকে বাঁচাতে যেয়ে আমি নিজেই শেষ!দেয়াল আমার পিঠটা আর রাখলো?এভাবে বেপরোয়া ভাবে চলো কেনো?দেখেশুনে চলতে পারো না?এখন যদি আমি না থাকলে তোমার কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত!কি করতে তখন?”
“আমার কি দোষ?আপনি যেমন ছোট্টবেলায় শাশুড়ী মার নাকে দঁড়ি বেঁধে মাকে পুরো বাসায় ঘুরিয়েছেন!তেমনি আপনার মেয়েটা আপনার সেই বদভ্যাসটা পেয়ে এখন আমার সাথে তাই করতেছে।আগে গিয়ে থামান আপনার মেয়েকে!!”
হৃদয় হেসে উঠলো।তারপর জোরে জোরে দুইটা বড় শ্বাস ছেড়ে আমার দুইকাঁধে আলতো হাত রেখে বললো,
“মেয়েটা কোথায় আমার?”
হৃদয়ের কথায় আমি পেছন ঘুরে উপরে তাকাই।লাবণ্য নেই।হয়তো আবার ঘরে ভেতর চলে গেছে।হৃদয়ের দিকে ফের আবার ফিরলাম। বললাম,
“গিয়ে দেখুন?এখন আবার কার নাকে জানি দড়ি বেঁধে দিয়ে তাকে ঘুরচ্ছে?”
“এই চুপ!আমার মেয়ের নামে একদম বাজে বকবে না!লক্ষী মেয়ে আমার!”
“লক্ষী?অলক্ষী আপনার মেয়ে একদম আপনার মতন।”
হৃদয় আমার কথা শুনে আবারো মৃদু হাসলো।তারপর আমার কাঁধ থেকে হাতজোড়া নামিয়ে বাসায় ঢুকার শশব্যস্ত হতে হতে বললো,
“আমার মেয়ে তোমার মতন লক্ষী হয়েছে ব!অলক্ষী বলবে না একদম!”
বলে দাঁড়ালো না আর।পাশ কেঁটে উঠে চলে গেলো।ও চলে যাবার পর আমার মুখেও আপনাআপনি হাসি ফুঁটে উঠলো।
“পাগল একটা!”
চলবে…