আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৩

আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ৩
Ipshita_Shikdar (samia)

এসব ভাবতেই এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছিলাম যে খেয়ালই করিনি রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। তখনই খেয়াল করলাম আমার বাড়ির বিপরীতে অর্থাৎ রাস্তার সামনে একটি কার পার্ক করা এবং কারের উপরে বা ছাদে কেউ একজন শুয়ে শুয়ে আমার ব্যালকনির দিকে বিশেষ করে আমার দিকেই বাজপাখির মতো তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আসলে মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর, সেটার দ্বারাই হয়তো বুঝতে পারছি। কিন্তু রাতের আধারে বুঝা মুশকিল কে সেখানে… বাড়ির সামনের স্ট্রিট লাইটটিও বোধহয় নষ্ট যদিও গতকাল তো ঠিক ছিলো… ছায়াদেহ দ্বারা বোঝা যাচ্ছে ব্যক্তিটি পুরুষমানুষ। হঠাৎই মাথায় আসলো কাব্য নয়তো! ভার্সিটি জীবনে প্রায়শয়ই রাতে সে বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। তবে ভিতরে কখনো ঢুকেনি বলতে হবে ছেলেটার চরিত্র শুধু প্রশংসনীয়ই নয় আদর্শবানও!

সে যাই হোক ব্যক্তিটি কাব্যই নাকি সেটা কি করে বুঝবো? ইশ! কি গাঁধা আমি! দাড়োয়ানকে কল করে বলি বাড়ির প্রবেশদ্বারের লাইটগুলো অন করে দিতে তাহলেই তো বুঝতে পারবো কে এই মহাপুরুষ! আর না ভেবে করে ফেললাম মুসাফিরকে কল।

—- হ্যালো! আপামণি আপনি এতো রাতে? কোনো সমস্যা হইসে নাকি!

—- নাহ! নাহ! মুসাফির তোর মনে আছে কাল তোকে ছোট ভাইয়া কেনো বকেছিলো? তুই তো আজকেও সেই ভুল করছিস ভাইয়া তো তোকে বছিলার ময়লা পানিতে চুবাইবো কাল!

—- কি ভুল করছিলাম আপামণি? আমার তো একটুও মনে নাই। তাড়াতাড়ি বলেন না আমি ওই ময়লা পানিতে ডুব দিতে চাই না।

—- হায় আল্লাহ! তুই আবার ভুলে গেলি? ভাইয়া তোকে মেইনডোরের লাইটস জ্বালিয়ে রাখতে বলছিলো, মনে পড়ছে?

আমার কথায় মুসাফির খাণিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

—- কিন্তু কখন?

আমি অনেক কষ্ট নিজের হাসি চেপে রেখে রাগী গলায় বললাম,

—- ছিহ! তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? আমি যে কিনা তোকে সবার বকা থেকে বাঁচায় দিই তাকে তুই মিথ্যাবাদী অপবাদ দিচ্ছিস! রাখ তুই কল তোর জন্য ভাইয়ার মারই শ্রেয়।

আমার কথায় সে কিছুটা ভয় পেয়ে ভীতু কণ্ঠে আমতা আমতা করে বললো,

—- নাহ! নাহ! আপামণি আমি আপনাকে কিছু বলি নাই তো। আমি এখনই লাইট জ্বালায় দিচ্ছি আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারে কাল আমি আপনার পছন্দের মুরগির মোমো আর ঐ যে একপদের চা খান না সেটা সক্কাল সক্কাল খাওয়ামুনে!

—- তন্দুরি চা বলে ওটাকে বোকা। এগুলো পরে ভাবিস এখন নিজের কাজ করতে যা।

মুসাফিরের কলটা কাঁটার পর পেট চেপে ধরে হুহা করে হাসছি যেনো একটু পরই বারান্দায় গড়াগড়ি করে হাসবো। ছেলেটা বেশ সরল-সোজা এবং বিশ্বস্ত… আমাদের বাড়িতে বছর পাঁচেকের থাকতে এসেছিলো আর যায়নি। আমি মুসাফিরকে বারান্দার ফ্লোরের সবচেয়ে অন্ধকার কোণে বসে কল করায় আই এম ড্যাম শিউর অন্ধকারের জন্য শায়িত ব্যক্তিটি আমাকে দেখেনি। লাইট জ্বালানো হলে আমি ফোন চালানোর ভঙ্গিমায় রেলিংয়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে গাড়িটির উপরের শায়িত ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখি আমার সন্দেহই ঠিক। ইশ! ছেলেটাকে আরেকটু পোড়ানো যাক। যার ভালোবাসায় আমি শান্তির ঘুম হারিয়ে নির্ঘুম হয়েছি, যার জন্য আমি আজ তৃষ্ণার্ত হয়েছি, চিন্তিত হয়েছি। সে কি করে আমায় দেখে তৃষ্ণা মেটাতে পারে?

কিছু না ভেবেই বারান্দার বেতের দোলনায় বসে কাউকে কল করার ভঙ্গিমায় ফোন কানের উপর ফোন রেখে কারো সাথে কথা বলার অভিনয় করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঝেমাঝে হাসিঠাট্টার ভঙ্গিমায় কথা বলতে বলতে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি। একটু পর দেখি মহারাজের কল এসেছে ফোনে। বলা বাহুল্য আমার পারসোনাল ফোনটি সুইচ অন করেছি এবং সেটি দিয়েই চলছে অভিনয়। ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে কল কেটে আবার কথা বলার অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বেচারাকে দেখে হাসিই পাচ্ছে কারণ শান্তি মতো গাড়ির উপরে কাঁথা ও বালিশ বিছিয়ে শুয়ে ছিলো। আর এখন বসে পড়েছে! কলের পর কল দিয়েই যাচ্ছে আর আমি একই ভাবে কেটে দিচ্ছি। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখলাম গাড়ির ছাদ থেকে নেমে রাগে এখন হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছে।

তার এই অবস্থা দেখে আমি আনমনেই বলে উঠলাম,
যাক মাই ডিয়ার সুইটু বেবি আমার পোড়ানোর কার্যক্রম শেষ আমি গেলাম ঘুমোতে। তুমি থাকো একা একা। চাইলে ভুতপ্রেত ও মশাদের শাথে আড্ডাও দিতে পারো।

—- ইপশি উঠ তো বোন আমার! আরে মেয়ে আর কত ঘুমুবি আজ তোর বিয়ে গাঁধি! আমার বিয়ের সময় তো আমাকে দশ্যুর মতো ঘুম থেকে উঠিয়েছিলি সেটাও ভোর ছয়টায়। আর এখানে মহারাণী বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছে।

—- আরে বড় ভাবি তুমি জানো না এই বাসায় কেউ দশটার আগে উঠে না তার ওপর ইপশু তো কাল রাতে নিশ্চয়ই জামাইয়ের সাথে ফোনে… বুঝোই তো তোমারও তো বিয়ে হইসে, তাইনা?

—- তুমি জানো না কণা এখন যদি ওকে না উঠাই তাহলে তোমার ভাসুর আমাকে ঝাড়বে আর আম্মা এই মহারাণীকে। উঠ তো সামিয়া!

—- সামি উঠো বেবি!

এই ছিলো আমার দুই ভাবির আজাইরা কথোপকথন যা শুনে আমার ঘুম পলাই পলাই করে চলে গিয়েছো। খাণিক… না! না! অনেকটা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে তাদের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু এই দুজনের কাছে কি আমার অগ্নিদৃষ্টি টিকে! কারণ দুজন তো আমার শুধুমাত্র ভাবি না, একজন খালাতো বোন তো আরেকজন মামাতো বোন। আমার ভাইদেরও বলি হরি কাজিনদেরই বিয়ে করার দরকার ছিলো! অন্যকেউ হলে তো একটু সম্মান দিতো এরা তো বজ্জাত বান্ধুবীদের মতো আমাকে টিজ করেই শেষ পায় না!

সে যাই হোক বিরক্তিমাথা কণ্ঠে তাদের দুজনকে বললাম,

—- তোমাদের কি আমার আরামের ঘুম সহ্য হয় না নাকি! আর মারিয়াপু তোর সমস্যা কি বল তো! সেই কোন বয়সে তোকে আমি ঘুম থেকে উঠেছিলাম আর তুই সিরিয়ালের বজ্জাত, শয়তান, ভ্যাম্প আন্টিদের মতো প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস! উফফফ!

ভাবির দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেললো আমার কথায়। আমি তাদের এমন হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালে মারিয়াপু দুষ্টু হেসে বললো,

—- দেখ ইপশু রাগ করবি না আমরা তোর ভালোর জন্যই তোকে উঠিয়েছি। দেখ তোকে এখন ঘুম থেকে না উঠালে আম্মা এসে তোকে তোর হলুদের দিনই বকাবকি করা শুরু করে দিতো। হলুদের দিন বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমুলে চলবে! ইট’স ইউর স্পেশাল ডে, রাইট? আগামীকাল তুই নতুন এক রঙিন জীবনের জন্য পা বাড়াবি। আজই তোর শেষ দিন তোর ছোটবেলা থেকে কাটানো জীবনের সাথে। আগামীকাল থেকে পথ চলতে শুরু করবি তোর ভালোবাসার সাথে। অনুভব কর সেই শিহরণকে, অনুভূতিগুলোকে, এক্সাইটমেন্টকে।

মারিয়াপুর কথায় আনমনেই ভেবে উঠলাম, এ আর কি নতুন জীবন! যেই নতুন জীবন কেমন হবে তারই কোনো নিশ্চয়তা নেই। যা রঙিন হবে নাকি রংহীন সেটাও অজানা। ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে কি আদৌ আমার পথচলা হবে, এই প্রশ্নটিরও উত্তর নেই। আর অনুভব! কি অনুভব করা উচিত প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয়? এই বিবাহের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের খেলায় কতটা ক্ষত-বিক্ষত হবে তার শিহরণে শিহরিত হবো? এমন অনিশ্চিত জীবনে মিশে যাওয়ার এক্সাইমেন্ট তো হওয়াই উচিত, তাই না?

আমাকে নিজের ভাবনার অথৈজলে ডুবে থাকতে দেখে মারিয়াপু আমাকে হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে বললো,

—- এই ইপশু! কি ভাবছিস এতো? কাব্য ভাইয়ার কথা ভাবা বাদ দিয়ে গোসল করতে যা নাহলে আম্মা ঘাড়ে ধরে গোসলখানাতে ঢুকাবে। যা! যা!

আমি উত্তরে কিছু বলবো তার আগেই দুই ভাবি মিলে আমাকে জামা কাপড় ধরিয়ে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে আমার বেডরুম গোছাতে শুরু করলো। অগত্যা আমিও শাওয়ার নিয়ে ভাবির দেয়া বাটিকের লং স্কার্ট, হাতের কাজ করা ক্রপ টপ আর শাড়ির আচলের মতো সুতিকাপড়ের ওড়নাটা মুড়িয়ে নিলাম শরীরে। দেখতে খারাপ লাগছে না বরং নিজের মুখে অন্যরকম এক স্নিগ্ধতা, উজ্জ্বলতা খেলা করতে দেখতে পারছি। কিন্তু কেনো? আর পাঁচটা কনের ক্ষেত্রে বিষয়টি স্বাভাবিক হলেও পরিস্থিতিভেদে আমার জন্য তো নয়। আসলে প্রিয় মানুষটি অপ্রিয় হয়ে গেলেও আছে তো #আমার_আমি হয়েই… #আমার অপ্রিয় আমি!

শাওয়ার নিয়ে বেড় হতেই দেখি আম্মু খাটের উপর বসে আছে হাতে আমার পছন্দের ইলিশ মাছ ভাজা ও চিনাবাদামের ভর্তা সাথে গরম ভাত। আমাকে দেখতেই বলে উঠলো,

—- তাড়াতাড়ি খাটে বসে যা মা। অনেক কাজ পড়ে আছে আমার তবে তুই না খেয়ে থাকবি বলে আমি সব কাজ ফেলে আগে তোর খাবার নিয়ে আসলাম। খাওয়ায় না দিলে তো আবার খাবি না নাহলে খাবার নিয়ে টালবাহানা করতি।

আম্মুর কথায় অবাক হয়ে গেলাম। কারণ আমি প্রায় রোজই বকা খাই নিজের হাতে ভাত না খাওয়ার অভ্যাসের জন্য, আর আজ সেই আম্মুই কিনা নিজের এতো কাজ ছেড়ে আমাকে নিজ হাতে খাওয়ানোর জন্য বসে আছে। আম্মু খায়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। আর আমিও নিজের ফেসবুকে ঢুকে স্ক্রলিং করতে লাগলাম। আম্মু বেড় হওয়ার পরই আব্বু ঢুকলো লাচ্ছি এবং আমার এলার্জির মেডিসিনস নিয়ে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পান করিয়ে চলে গেলো।

ভেবে দেখলাম, “বাবামা সত্যিই অদ্ভুত, তাদের আড়ালের ভালোবাসার বুঝার ক্ষমতা তখনই আসে সন্তানদের মাঝে যখন বাবামা তাদের থেকে দূরে চলে যায় কিংবা তারা বাবামা হয়ে যায়।”

সে যাই হোক ঔষধ খাওয়া আমার জন্য কেন পুরো মানবজাতির জন্য প্রচুর বিরক্তির বিষয় তাই মুখটাকে বিকৃত করে বসে আছি। খাণিক বাদেই দেখি পাপ্পা ঘরে এসেছে, আর তার হাতে আমার পছন্দের ফালুদা। ছোটবেলা থেকেই পাপ্পার হাতের ফালুদা আমার পছন্দের খাবারের মাঝে অন্যতম। পাপ্পা কিছু না বলেই আমাকে খায়িয়ে দিতে লাগলো। শিশুকালে পাপ্পা আমার প্রথম শিক্ষক, খেলার সাথী, কথা বলার সাথী ছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে কেমন একটা দেয়াল এসে পড়ায় আর তেমনভাবে সরাসরি কথা বলতে পারি না। তাই আজও কিছু বলতে পারলাম না। শুধু চোখজোড়া কেনো যেনো ছলছল করে উঠলো… পাপ্পাও কেমন যেনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে তার সেই ছোট্ট আম্মুটা যাকে কিনা প্রতিবেলায় বাড়ি এসে খাবার খায়িয়ে দিয়ে যেতো আজ সে এতো বড় হয়ে গিয়েছে যে নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে যাচ্ছে। আমাকে চামচ দিয়ে খায়িয়ে কিছু না বলেই এক হাতে চুমু দিয়ে চলে গেলো।

আজ নতুনভাবে জানলাম, “কোনো কোনো সম্পর্কে ভালোবাসা প্রকাশে মুখের বলির দরকার পড়ে না। সেই ভালোবাসার গভীরত্ব বোঝার জন্য চোখের ইশারা কিংবা সেই সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা মানুষদের অঙ্গভঙ্গিই যথেষ্ট।”

দুপুরবেলা দুই ভাবি এসে খাবারের জন্য ডাকলে না করে দিলাম। প্রথম কারণ হলো আজ ঘুম থেকে উঠার পর থেকে অনেক খেয়েছি। আর দ্বিতীয় কারণ সুমু, নাজ ও সাবুকে আদর করছি, একাকী সময় কাটাচ্ছি তাদের সাথে। আর শুধুমাত্র খাওয়াদাওয়ার জন্য এই কাজে আমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাই না।

শুনেছি, “বিশেষ সময়গুলো সহজে ফিরে পাওয়া যায় না। তাই বিশেষ সময়গুলোকে খুব ভালোভাবে অনুভব করা, নিজের মন-মস্তিষ্ক দিয়ে উপভোগ করা এবং মনের স্মৃতিরপাতায় লিপিবদ্ধ করা খুব জরুরি।”

তাদের সাথেই ব্যস্ত ছিলাম এর মধ্যেই ভাইয়ারা ঢুকলো। একজনের হাতে ক্যাপাচিনো তো আরেকজনের হাতে শর্মা।

—- সামিয়া খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেল। আর তোর ভাবি বললো এক ঘণ্টা পর নাকি তোকে সাজাতে লোক আসবে তাই ফাস্ট এগুলো খেয়েনে। পাপ্পা বললো নাজিয়া আর সাবিরা নাকি খায় নাই তাই আপুনিগুলো তোমাদের তো খাওয়া লাগবে তাই চলো! সুমু আম্মু তুমিও…

বড় ভাইয়ার মুখের উপর তেমন একটা কথা বলার সাহস আমার নাই তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খাওয়া শুরু করলাম। তাই খেতে খেতেই বলে উঠলাম,

—- ভাইয়া থাক না ওরা আমি নিজে খাওয়ার সাথে ওদেরও খায়িয়ে দেই! আমি তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করবো, প্রমিস!

ছোট ভাইয়া আমার কথায় দুষ্টু হেসে বললো,

—- হ্যাঁ! হ্যাঁ! দে শেষবারের মতো খায়িয়ে তারপর তো তোর মতো পেত্নী আমাদের জীবন এন্ড বাড়ি থেকে বিদায় হবে। কোনো পেত্নী আর সবার কানের সামনে যেয়ে বলবে না আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে। কি যে শান্তিই! ইশ! বেচারা তোর জামাই যে কি মনে করে তোরে বিয়ে করছে। তুই তো শপিংয়ের টাকা দিতেই দিতেই ফকির হয়ে যাবে।

ভাইয়ার কথা রেগে দিলাম এক চিৎকার,

—- ভাইয়াহ! ভাইয়া ভাইয়াকে কিছু বলো!

—- আহহা! সানিফ! তোরা কি বাচ্চা নাকি বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া লাগায় দিয়েছিস। আর সামিয়া তোর বিয়ে আগামীকাল এখনো বাচ্চাদের মতো সবকিছুতে এভাবে রিয়েক্ট করলে চলবে?

আমি মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বললাম,

—- সরিই ভাইয়া! কিন্তু ছোট ভাইয়াই তো…

—- ধুর! তোমরা থাকো এই আজাইরা প্যাঁচাল নিয়ে আমি গেলাম আমার নাচের চর্চা করতে হবে। আমি তো আজ পাগলের মতো নাচবো। কারণ শেষ পর্যন্ত এই পেত্নি বিদায় হবে।

—- তোমার চর্চা করা লাগবে না পাগলের মতো নাচার জন্য। কারণ তুমি এমনিতেই পাগল! পাবনার পাগলাগারদ থেকে পলাতক পাগল তুমি! হুহ!

—- তোর চেয়ে ভালো আছি। যাই হোক শোন যা বলতে আসছি বিয়ে তো করছিস নিজের মানুষের সাথেই। তাই কোনো সমস্যার কথা না তবুও যদি কোনো সমস্যা বড় ভাইয়াকে…

—- বড় ভাইয়াকে জানাবো, তাইতো? আচ্ছা সেটাই করবো।

—- আরে না গাঁধি! বড় ভাইয়াকে মোটেও জানাবি না কারণ ভাইয়া ঠাণ্ডা ভাবে ব্যাপারটা সমাধান করবে যেটাতে সাময়িক সমাধান হলেও স্থায়ীভাবে সমাধান হবে না। কারণ ইউ নো মাইরের কাজ কথায় হয় না! তাই আমাকে সর্বপ্রথম জানাবি, বুঝলি?

—- তাহলে বুঝি তুমি তাকে কেলিয়ে সোজা করে ফেলবে?

বলেই হাসতে লাগলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম ভাইয়ারা আমার দিকে কেমন যেনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এর কারণ খুঁজতে তাদের দিকে তাকাতেই দেখলাম বড় ভাইয়া চোখের কোণে মুছে বেড়িয়ে গেলো, আর ছোট ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বেড়িয়ে গেলো। বড় ভাইয়াকে কখনো আগে কাঁদতে দেখিনি। বাবা যখন পরিবারের খরচাদি সামলাতে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে বড় ভাইয়া তখন দৃঢ়ভাবে সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেয়। আর ছোট ভাইয়ার আদর নাকি আমি হওয়ার পর কমে গিয়েছিলো। তাই ছোটবেলা থেকেই কিছুটা খুনিশুটি লেগেই থাকতো আমাদের মাঝে। সময়ের সাথে বড় ভাই ও ছোটবোনের সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে সেই খুনিশুটি কমে গেলেও সমাপ্ত হয়নি কখনো। তবে একে অপরের প্রতি বিদ্যমান ভালোবাসাও কখনো ব্যক্ত করা হয়নি নিজেদের মাঝে।

“ভাইবোনের ভালোবাসাটাই বোধহয় হাজারো রাগ, অভিমান, মনমালিন্য, খুনিশুটির মাঝে চাপা পড়েও সতেজ থাকে সর্বদা। তবে আমরা তো সবসময় বুঝতে সক্ষম থাকি না বরং কিছু বিশেষ মুহূর্তে তার প্রমাণ আমরা পেয়ে থাকি।”

সুমু, নাজ ও সাবুকে খায়িয়ে দিতেই পার্লারের আপুরা দরজার সামনে এসে হাজির। তাদের দেখে চেহারায় খাণিকটা বিরক্তিই ফুটে ওঠলো। এমন না যে আমি সাজতে বা রূপচর্চা করতে খুব একটা অপছন্দ করি। তবে পার্লার ব্যপারটা আমার কাছে বড্ড বিরক্তিকর যদিও আমি মিতব্যয়ী কিংবা কিপটে নই তারপরও এই পার্লার জিনিসটা আমার কাছে নিছকই টাকা ও সময়ের অপচয় মনে হয়। তবে বিয়ে তো অন্যকারো না আমারই তাই ফর দ্য ফাস্ট টাইম…

চোখজোড়া বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছি এবং আপুগুলো আমার মুখের উপর নিজের মতো করে চিত্র অঙ্কনে ব্যস্ত। এদিকে আমি ভাবছি আজ কত সম্পর্কে গভীরতর সত্যগুলো জানতে পারলাম, কিছু অনুভূতি নতুন করে বুঝতে শিখলাম, অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলোর প্রকাশ ঘটলে আমার সম্মুখে। মনে প্রশ্ন জাগলো, প্রতিটি মেয়েই কি বিয়ের পূর্ব মুহূর্তগুলোতে এইসব উপলব্ধি করে? করেই হয়তো তবে উপলব্ধিকরণের দ্বারা মনের মাঝে এক অসামান্য চিনচিন ব্যথা অনুভব করছি। যা কয়েকদিন পূর্বেও ছিলো না এই পরিবার ত্যাগের জন্য।

পরেরদিন,
বাসর ঘরে বসে আছি। অবশ্য বসে আছি বললে ভুল হবে বিরক্ত হচ্ছি কিংবা ঝিমুচ্ছি বলা অধিকতর সঠিক। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় একটা তাই কাব্যর জন্য আর অপেক্ষা না করে চলে গেলাম কাপড় বদলাতে। গোসল করে একটা কালো রংয়ের সুতি শাড়ি সাথে অফ হোয়াইট ব্লাউজ পড়ে বেড়িয়ে আসলাম। কাব্য বিয়ের পর সবসময় শাড়ি পড়ার আদেশ করায় বিয়ের শপিংয়ের সময় অনেকগুলোই সুতি, টাঙ্গাইলি, তাঁত ও জামদানী শাড়ি কিনেছিলাম। কারণ খুব দামী কিংবা কাজ করা শাড়ি প্রাত্যহিক পরিধানের যোগ্য অবশ্যই নয়।

বেড় হয়ে দেখলাম কাব্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে কারো সাথে কথা বলছে। কাছে যেয়ে কিছু কথোপকথনের দ্বারা বুঝলাম তা ইশা। আড়িপাতা কোনোকালেরই পছন্দ নয়, এটি ইসলামে এবং সমাজজীবনে অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম বেডরুমে। কারণ আমি গুপ্তচর হয়ে সত্য জানতে চাই না বরং চাই যে, কাব্য নিজে এসে আমাকে বলুক।

কিছুক্ষণের মাঝেই কাব্য কথা শেষ করে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো আর আমি তাকে উপেক্ষা করে ফোনে গেমস খেলতে ব্যস্ত হয়ে থাকলাম। সে কিছু বলবে তার আগেই আমি চোখ তুলে তার তাকিয়ে বলে উঠলাম,

—- আম্মু নামাজ পড়তে বলেছে একসাথে আই মিন তোমার আম্মু নট মাইন! সো ওজু কি করেছো নাকি করে আসবে?

কাব্য কিছু না বলে ওজু করে আসলো তারপর একসঙ্গে নামাজ পড়ে নিলাম। আমার ফোনে একটা কল আসায় ব্যালকনিতে চলে গেলাম। কলটা আম্মু করেছিলো এবং কল ধরতেই সে আমার ঔষধসহ সবকিছু মনে করিয়ে দিতে লাগলো। আসলে মায়েদের কাজই তো এটা। আম্মুর সাথে কথা বলা শেষ করে ব্যালকনির ফুলের গন্ধে সৌরভময়ী হাওয়ায় এক সুদীর্ঘ শ্বাস নিলাম। কাব্যর বেডরুমে ব্যালকনিটা আমার অনেক পছন্দের। কারণ আমার ব্যালকনিটাই পুরোটাই রেলিং দেয়া। আর তার ব্যালকনিতে অর্ধেক রেলিং, বাকি অর্ধেক খোলা। তার উপর ব্যালকনির নিচে ছাদ টাইপের যেখানে ফুলের বাহার। এসব আকাশকুসুমই ভাবছিলাম কিন্তু টের পেলাম একজোড়া ঠাণ্ডা হাত আমার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে।

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে কাব্যকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,

—- কি সমস্যা তোমার? এভাবে হুটহাট আমার গায়ে হাত দিবে না তো কাব্য। ভালো লাগে না আমার এসবকিছু। সো প্লিজ!

কাব্য আমার এক হাত নিজের হাতের মাঝে রেখে বললো,

—- কি বলছো এসব ইপশুপাখি? কয়েক ঘণ্টা আগেই তো আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় পেলাম। আমাদের ভালোবাসা পবিত্রতা এবং বৈধতা পেলো। তাহলে এমন করছো কেনো?

তার কথা কিছুটা বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গিমায় বললাম,

—- সো হোয়াট? যেখানে ভালোবাসা আদৌ উপস্থিত আছে কিনা তারই ঠিক নাই সে আবার বিবাহবন্ধন! সেটাও পবিত্র বিবাহের বন্ধন। হাহ!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here