আমার_অপ্রিয়_আমি,পর্বঃ১১,১২
রিলেশন_সিরিজ
Ipshita_Shikdar
পর্বঃ১১
❤
আরাভ ভোররাতে বাড়ি ফিরায় তার মা বেশ চিন্তিত, তার ছেলে কখনো এমন দেরিতে ফিরে না। তাই তার ছেলে কোনো বিপদে পড়লো কিনা কিংবা ভুল পথে চলতে বসেছে কিনা! তবুও গতকাল কোনো প্রশ্ন করেনি সে কারণ ছেলের চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট দেখছিলো। কিন্তু সেই ক্লান্তি কাজের নাকি অন্যকিছুর বুঝতে পারছে না সে…
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসে আরাভ। ব্রেড খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল করে যে তার মা বেশ চিন্তিত। তাছাড়া বেশ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন, এতোটাই যে সে এখানে আসছে এটাও খেয়াল করেনি। কিন্তু কেনো এমন চিন্তা? ভাবতে ব্যস্ত হবে তার আগেই সে মনে মনে নিজেকে নিজে বলে উঠলো,
— ধুর! এতো ভেবে কাজ নেই আম্মুকেই জিজ্ঞেস করে নেই। সে-ই আসল কথা বলতে পারবে আমি ভেবে তো শুধুই গ্যাস করতেই পারবো সত্যিটা বুঝতে পারবো না।
আরাভ নিজের মায়ের পাশে বসে আলতো ধাক্কা দিতেই সে চমকে উঠে বললো,
— হ-হ্যাঁ! ওহ, আরাভ তুই? এতো বেলা হওয়ার পর উঠেছিস তাহলে… নে খেয়ে নে।
— নাহ, মা আজ আমি নিজের হাতে খাবো না তুমি খায়িয়ে দাও। তবে তার আগে বলো এতো মনোযোগ সহকারে কি এমন ভাবছিলে যে আমি এসেছি সেটাও খেয়াল করো নাই?
— ঐ তেমন কিছু না… এমনেই আর কি! তুই বস! আমি আজ এসব ব্রিটিশদের মতো ব্রেডবাটার আর কফি খাওয়া লাগবে না। আমি বেশি করে দুধ দিয়ে চা আর মোঘলাই পরোটা বানিয়েছি তা-ই খাবি।
— উফ! মা ওগুলো ব্রিটিশদের খাবার নয় হেলদি খাবার! যাই হোক তুমি নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি কারণ আমার তো শুনেই মুখে জল এসে পড়েছে।
আরাভের মা আয়েশা ছেলের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। কারণ আজ বহুদিন পর সে এভাবে প্রাণোচ্ছল ও হাসিখুশি হয়ে কথা বলছে। যেদিন থেকে ইপশির সাথে নিজ ইচ্ছেতে বিয়ে ভাঙলো সেদিন থেকেই কেমন চুপচাপ ও নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো। তারপর হুট করেই এব্রোড যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এবং চলেও গেলো। সবটাই কেমন ধোঁয়াশা আয়েশার কাছে তবে একটা বিষয় ঠিকই উপলব্ধি করে ফেলেছিলো, তা হলো তার ছেলেটা ভালো নেই। এর কারণ কেনো যেনো ইপশিকে লাগে তার কিন্তু পুরোপুরিভাবে জ্ঞাত না হওয়ায় নিজের মাঝেই রাখে তা। সে যাই হোক ছেলেকে এতোদিন পর ভালো থাকতে দেখে ভালোই লাগছে তার, সেই সাথে জানতেও ইচ্ছে করছো হাসির আড়ালের কারণ।
আয়েশা খাবার নিয়ে এসে ছেলেকে আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলেন,
— কালরাতে আসতে এতো দেরি হয়েছিলো কেনো বাবা? তোমার তো আরও আগে এসে পড়ার কথাছিলো কিন্তু তুমি আসলে সেই ভোররাতে। কোনো বিশেষ কারণ থাকলে আমাকে বলো।
আরাভের মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম কারণ মাকে যে লেট বাসায় ফিরার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সে নিজেকে সামলে ভীতু চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আসলে আম্মু মাঝরাস্তায় গাড়ির চাকা পাঞ্চার হয়ে গিয়েছিলো তো তাই তা ঠিক করতে করতে লেট হয়ে যাই। আচ্ছা সেটা বাদ দাও ইপশির রিসেপশনে কখন যাবে?
— এই দুটো কিংবা আড়াইটার দিকে বের হবো।
আরাভ মনে মনে বেশি স্বস্তি পেলো উত্তর দিতে পেরে। তবে মায়ের কথায় তার মস্তিষ্কে ও মনে সেই অচেনা মেয়েটির সাক্ষাৎ আলোড়ন তৈরি করলো। আনমনেই ভাবতে লাগলো,
— আচ্ছা, মেয়েটি কি তাকে মনে রেখেছে? নাকি ভুলে গিয়েছে শেষরাত্রির কথোপকথনকে? কারণ সে যে মাদকদ্রব্য খেয়ে মতাল ছিলো। যদিও এতোটাও না কারণ মেয়েটি সম্পূর্ণরূপে নিজের সেন্সে ছিলো। হয়তো পানীয়তে নেশা কম ছিলো নয়তো সে প্রতিনিয়ত এতো পরিমাণ পান করে যে এটা সাধারণ অন্যথায় কারো নেশায় এতোটা মাতাল হয়েছে যে মাদকের নেশা পুরোপুরি ধরে না। কিন্তু আমি কেনো তাকে নিয়ে ভাবছি? আমি কি কোনোভাবে তার থেকে ইম্প্রেসড হয়ে গিয়েছি? না! না! এটা হতে পারে না।
নিজের সাথে নিজে যুদ্ধি করতে করতেই খাওয়ার সময়টুকু কাটিয়ে দিলো আরাভ। আয়েশা বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করলো যে তার ছেলে কিছু একটা নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবছে। কিন্তু মুখে কিছু বললো না কারণ তার ছেলে এখন বড় হয়েছে ভালোমন্দ জ্ঞান যে ছেলের আছে তা সে ভালো করেই জানে।
ইপশিকে সাজাতে পার্লার থেকেআপুরা এসেছে। তারা বারবার জিজ্ঞেস করছে কিভাবে সাজাবো কিন্তু সে একটাই উত্তর দিচ্ছে প্রতিবার,
— আপনাদের যেভাবে ভালো লাগে।
একজন মেকআপ আর্টিস্ট মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
— বিয়ের বা বৌভাতের কনে মেয়েরা সাধারণত একবারই সাজে জীবনে। মুখে যতোই না না করুক তবে প্রতিটি মেয়েরই বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে জীবনে। এভাবে সাজবে, এটা পড়বে, এটা করবে আরও কত কি! এই স্বপ্ন কখনো সে কিশোরকাল থেকে সাজায় কখনো বা যৌবনকাল থেকে তবে সাজানো তো থাকেই। তাই আজকের দিনটা স্বপ্ন পূরণের প্রথম এবং শেষ সুযোগ। চাইলে পূরণ হবে অন্যথায় আজীবনের জন্য স্বপ্নই থেকে যাবে।
মেয়েটার কথাটা সত্যিই। একসময় কত পরিকল্পনা করতাম নিজের বিয়ে নিয়ে, কাব্যকে প্রায়শয়ই আমি এভাবে সাজবো, ওভাবে ছবি তুলবো। আজ দেখো! স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তো আছে তবে আগের মতো ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা নেই। কারণ এই বিয়ে বা সম্পর্কের কোনো স্তম্ভ বা ভিত্তিই খুঁজে পাচ্ছি না আমি, সবটা যেনো ধোঁয়াশা!
আমি আপুটাকে কিছু বলবে উত্তরে, এমনসময় হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো কাব্য। একবার ইপশির দিকে তাকিয়ে পার্লারের মেয়েদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমিও ভাবলেশহীন ভাবে আয়নার সামনে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর সে বের হয়ে গেলো, আর মেয়েগুলো আমাকে তৈরি করতে লাগলো। আমিও নিজ ভাবনায় ডুব দিয়েছি তাই সাজ দেখার সময় বা ইচ্ছে হয়নি।
— আপু সাজানো শেষ। একবার চোখ তুলে দেখে নিন কেমন লাগছে আর কিছু ভুল হলে সেটাও বলে দিন।
আমি চোখ তুলে তাকাতেই আশ্চার্য হয়ে গেলাম এবং মুখ থেকে আনমনেই অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হলো,
— ওয়াও! জাস্ট এক্সট্রাওরডিনারি।
মেয়েগুলো আমার বলা কথাটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,
— আপনি অনেক লাকি আপু। আপনার বর কত খেয়াল রাখে। কি সুন্দর আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেলো আপনার কেমন ভাবে তৈরি হওয়ার ইচ্ছে। সাথে ওয়ার্নিংও দিয়ে গেলো যে ইট’স হার স্পেশাল ডে সো আই ওয়ান্ট এভ্রিথিং টু বি পারফেক্ট এন্ড হাউ শি ওয়ান্টেড ইট টু বি। সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী আপনি।
এটুকো বলেই সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি একা একা দাঁড়িয়ে নিজেকে আয়নায় দেখছি। নিজের চাওয়া অনুযায়ী লাল ও কালো রঙা কাতান শাড়ি পড়নে, ব্রঞ্জি বেস মেকআপ, ব্রাউন স্মোকি আইস, পিঙ্গিশ ব্রাউন কালার লিপস্টিক এবং জুয়েলারি বলতে ওয়েভি কার্ল করা খোলা চুলের একপাশে ঝাপটা, কানে ঝাপটা স্টাইল কানের দুল জোড়া, নাকে ছোট্ট নথ, গলায় একটা সিম্পেল কণ্ঠহার ও দুই লহরের সিতাহার, একহাত ভর্তি কাঁচের চুরি আর অপর হাতে একজোড়া কঙ্গন। একদম আমার যেভাবে বউ সাজার স্বপ্ন ছিলো তেমন। মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি
নাহ, এটা বাস্তব। আর বাস্তবয়ান করেছে আমার ভালোবাসা ও স্বামী। কিন্তু কেনো ও কিভাবে? আমি তো শুনেছি ছেলেরা মেয়েদের এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে অপর কান দিয়ে বের করে। তাহলে সে কি করে মনে রাখলো আমার ছোট স্বপ্নগুলোকে। সে কি সত্যিই ভালোবাসা আমায় কিংবা আমাতেই মত্ত সে! যদি হয়েই থাকে তা তাহলে আমাদের মাঝে তৃতীয়পক্ষ কেনো বিদ্যমান?
আমার ভাবনাতে এক বালতি জল ঢেলে আমার ননদী ঘরে ঢুকলো এবং আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ওয়াও ভাবি! তোমাকে তো পুরো কিউটের বস্তা লাগছে! আজ তো ভাই আমার পুরোই পাগল হয়ে যাবে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। মেয়েটা একদম বাচ্চাদের মতো। সবসময় বাচ্চামি কথাবার্তা তার ঠিক যেনো আমার ছোট্টবোন নাজ। আচ্ছা অনেকে তো ননদকে বোঝা, অত্যাচারী, বেয়াদপ আরও কত কি মনে করে। তবে তাদের মাঝে নিজের ছোট বোনটিকে দেখতে পারে না কেনো? আমার তো এই পিচ্ছি মেয়েটিকে দেখলে আমার প্রিন্সেসের কথা মনে পড়ে যায়।
সে ও কাব্যর কয়েকজন কাজিন আমাকে নিচে নিয়ে গেলো। আমি মাথা নিচু করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি, মাথা তুলে তাকাতেই থমকে যাই। কারণ আমার সামনে যে নব সাজে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয়তম। পড়নে গ্লোসি ব্লাক কালারের কমপ্লিট স্যুট, রেড কালারের পকেট রুমাল, টাইও রেড কালার, হাতে একটা ব্রান্ডেড চামড়ার ঘড়ি ও রূপার ব্রেসলেট। সবমিলিয়ে হয়তো লোকচক্ষুতে বিশেষ বা অসাধারণ না লাগলেও আমার চোখজোড়া অমায়িক লাগছে তাকে, যেনো তাকে দেখে মুগ্ধতা খেলা করতে শুরু করেছে দুচোখে। সেও আমাকে একদৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে।
তাকে দেখায় এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে সে কখন আমার একদম সামনে চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে তা দেখে পাশে থেকে ননদিনী দিলো এক ধাক্কা। আমি নিজের ভাবনার থেকে বের হয়ে ননদের দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই সে সামনে দেখতে ইশারা করলো। তার কথা অনুসরণ করে সামনে তাকালাম, দেখলাম কাব্য হাটু গেড়ে বসে আছে।
আমার দৃষ্টি তার দিকে স্থীর হতেই সে হাতটা এগিয়ে মুচকি হেসে বললো,
— কেন আই প্লিজ?
আমার ও কাব্যর সব কাজিন উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
— সে ইয়েস! সে ইয়েস!
#পর্বঃ১২
আমিও তার হাতে হাত রাখলাম। সে আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেলো ডান্স ফ্লোরের দিকে। সেখানের মাঝ বরাবর পৌঁছুতেই শুরু হয়ে অতিপ্রিয় একটি গান এবং সেই তালে তালে সে আমাকে নিয়ে নাচতে লাগলো।
রাতের সব তারা আছে দিনের গভীরে,
বুকের মাঝে মন যেখানে রাখবো তোকে সেখানে,
তুই কি আমার হবিরে?
…
গানের তালে তালে নাচতে আমার বা কাব্যর বেশি একটা বেগ পেতে হলো না, কারণ হলুদের একসপ্তাহ আগে প্রযাকটিস করেছিলাম। আমাদের নাচ শেষ হতেই হলরুমের পরিবেশটা করতালিমুখর হয়ে উঠলো। কাব্য আমাকে নিয়ে ডান্সফ্লোরের উপরের স্টেজে গেলো। সেখানেই আমাদের বসার আসন সজ্জিত করা। একে একে সবাই নাচলো তবে আরাভ ভাইয়াকে কোথাও দেখলাম না আবার বিয়ের দিনও তাকে দেখিনি। তাহলে সে কি আমাদের বিয়ে ও বৌভাতে উপস্থিতই হয়নি। কিন্তু কেনো? আম্মু ও আমার বাড়ির সকলে আমার কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
— আম্মু, খালামনি আরাভ কোথায়? তাকে দেখছি না এমন কি বিয়ের দিনও দেখলাম না।
— হ্যাঁরে আয়েশা, আরাভ বাবা কোথায়? সে কি আসেনি?
— না! না! সে এসেছে আজ আর বিয়ের দিনও ছিলো। তবে কোথায় যে গিয়েছে আল্লাহ জানে… ইপশি তুই কল করে আসতে বল তো তাকে!
— হুম।
এদিকে আরাভ রহমান বাড়িতেই উপস্থিত তবে হলরুমে নয় বরং একাকী পিছনের বাগানে বসে আছে। ঠোঁটজোড়ার মাঝে সিগারেট গুঁজে আকাশপানে তাকিয়ে আছে, চোখজোড়া অশ্রুতে জলজল করছে। যতোই হোক নিজের ভালোবাসার মানুষকে অপরজনের সাথে দেখলে প্রতিটা প্রেমিক পুরুষেরই বুকে ঝড় উঠে। বেশ ভালোই ছিলো সে অপরিচিতার সাথে দেখা করে। তবে আজ আবার পুরোনো ক্ষতগুলো সতেজ হয়ে গেলো ইপশিকে কাব্যর বুকে দেখে। না চাইতেও কষ্ট ও অশ্রুগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
হঠাৎ ফোন রিংয়ের আওয়াজে আরাভ এক আঙুলে চোখের অশ্রুজল মুছে নিলো। ফোনটার দিকে দৃষ্টি স্থীর করতেই দেখলো ইপশির কল, মুহূর্তেই একরাশ অভিমান জড়িয়ে নেয় তাকে। সে মনে মনে বলে উঠে,
— এতক্ষণে… না! না! এতোদিনে আমায় মনে পড়লো তোর। আগে তো সবসময় আমার সাথেই দুষ্টামি করতি, কথা বলতি। তোর খেলার থেকে শুরু করে ঝগড়া করার সাথী ছিলাম শুধুই আমি তাহলে এতোটা কি করে পর করে দিলি আমায়, এতোটা কি করে ভুলে গেলি আমায়? কিভাবে? তুই কি একবারও উপলব্ধি করতে পারিসনি আমার ভালোবাসাকে! আমার ভালোবাসাতেই কি কোনো কমতি ছিলো নাকি কাব্যর ভালোবাসায় বেশি জোর ছিলো?
কে বলেছে অভিমান শুধু ভালোবাসায় জয় করা মানুষের উপর জমে? অভিমান তো ভালোবাসার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক বিশেষ অংশ। এর সাথে ভালোবাসা জয় করার বা প্রিয় মানুষটাকে পাওয়া, না পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অভিমানের জন্য শুধু কাউকে ভালোবাসাই যথেষ্ট। তবে তাকে না পেলে বা হারিয়ে ফেললে অভিমান করেও করাটা নিজ মনেই কেমন যেনো অধিকারহীন ও অযৌক্তিক লাগে।
কথাটা মাথায় আসতেই আরাভ নিজেকে সামলে নেয়। আর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
— ইপশুর তো কোনো দোষ নেই বরং সে তো সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত আমার অনুভূতি সম্পর্কে। তার সাথে অভিমান করার কোনো মানেই হয় না। সবাই তো পাওয়ার জন্য ভালোবাসে না কেউ কেউ ভালো রাখার জন্য ভালোবাসে। আমি নাহয় তাদের দলেয় গণিত হলাম। সে যদি আমায় ছাড়া ভালো থাকে ক্ষতি কি! আমি নাহয় তার সুখের মাঝেই সুখী হওয়ার কারণ খুঁজে নিবো।
এসব ভাবতেই এতোটা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো সে যে ইপশির কল পিক না করায় অনেক্ষণ বেজে কেটে গিয়েছে, তাও বুঝতে পারেনি। যখন দেখলো কল কেটে গিয়েছে তখনই কল করলো ইপশিকে। ইপশিও পিক করে একগাদা ধমক দিকে ঘরে সেরেমনিতে আসতে বলে কল কেটে দেয়। তাই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসিমুখে হলরুমে ঢুকে। বেশ ভালোভাবেই শেষ হলো অনুষ্ঠান।
প্রায় রাত সাড়ে এগারোটার দিকে শিকদার বাড়ি পৌঁছালো কাব্য ও ইপশি। একে ভারি বেশভূষা, ভারি মেকআপ, তাছাড়া গোল্ড জুয়েলারি। তাছাড়া এসব নিয়ে জার্নি করে আরও নেতিয়ে পড়েছে ইপশি। ঘরে ঢুকে তার মা বরণ করবে, এছাড়াও কত কি ব্যবস্থা বাড়ির নতুন জামাইয়ের জন্য,আবার ছোটোবড়ো কাজিন ও ভাবিরা কাব্যকে নিয়ে হাসিঠাট্টা ও মজমাস্তি করছে। সবমিলিয়ে হইচই ও উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। তবে আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছি সবার দিকে। ভাবছি এরা কি মানুষের কাতারে পড়ে? সেখানো এতো হইচই করে আবার জার্নি করেও ক্লান্ত হয় নাই। আমি আর বসে না থেকে কারো দিকে না তাকিয়ে হরহর করে আমার রুমে চলে গেলাম।
যেতে কানে আসলো মায়ের কাঙ্ক্ষিত বাণী,
— এই মেয়েটা কোনোদিনও বড় হবে না। এর নাকি আবার বিয়ে হইসে! হুহ! আল্লাহ মাবুত জানে আমার নাতিনাতনি কি করে পালবে এই অকর্মার ঢেঁকি!
আমি মায়ের কথা বিদ্রূপাত্মক হাসি দিয়ে আনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
— বিয়ে করে এখন পর্যন্ত সংসার পেলাম না সেখানে তুমি পরিকল্পনা করছে নাতিনাতনির। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ যে কোনো পরিকল্পনা নয় সম্পূর্ণ অবাস্তব কল্পনা।
বেডরুমে ঢুকতেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লা। ফ্যানের বাতাসে ক্লান্তি কিছুটা দূর হতেই গেলাম ড্রেসিংটেবিলের কাছে। মাথার বড় ঘোমটা খুলতে বসলাম আগে। কারণ বহুত পিন মেরেছে আপুরা যাতে কাব্যর কথা মতো আমার চুল না দেখা যায়, আমার ঝাপটা পড়া চুল নাকি সে-ই দেখবে। এজন্য জর্জেটের ডুপাট্টার জামানায় সে কিনে এনেছে ভেলভেটের ভারি ওড়না। পাগল একটা! কিন্তু আদৌ পাগলের মতো ভালোবাসে কিনা! অবশ্যই বাসে তা জানি আমি। কিন্তু সে কিছুতো লুকাচ্ছে আমার থেকে যার জন্য এই তৃতীয়পক্ষের আবির্ভাব।
আমি আনমনে নিজের ভাবনাতে ডুবে পিনগুলো খুলছি তখনই কেউ একজন আমার হাত সরিয়ে নিজে খুলতে লাগে। আমি আয়না দিয়ে কাব্যকে হাত গুটিয়ে বসে থাকি। কাব্য ডুপাট্টা খুলে দিতেই আমার চুলগুলো মুক্ত হয়ে আছড়ে পড়ে আমার কপালে। সে আমাকে বসানো থেকে উঠিয়ে তার সামনে দাঁড় করায়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার পানে তবে আমার দৃষ্টি ফ্লোরেই স্থীর। যেনো ক্যামিস্ট্রির বিক্রিয়া মনোযোগ সহকারে বোঝার চেষ্টা করছে।
কাব্য আমার থুঁতনি ধরে মুখটা উপর করে। তার দিকে তাকাতেই দেখতে পাই তার চোখেমুখে এক অন্যরকম নেশা কাজ করছে। যার মাঝে আমিও ডুবে যাচ্ছি। সে হঠাৎই ফুঁ দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কিন্তু সে কি বুঝতে পারছে তার এই পদক্ষপে শুধু চুলগুলোতে ঝড় বয়ে যায়নি আমার মনেও বয়ে যাচ্ছে। সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আমি এক পা এক পা করে পিছাচ্ছি। ভাবছি তাকে বাধা দিবো নাকি আজ মত্ত হবো তার ভালোবাসায়!
চলবে…