আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৩

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

অস্তমান সূর্য! মাথার উপর বিশাল আকাশ। নীলাভ আকাশ ছেয়ে আছে লালচে আলোয়। নীড়ের পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যে। কেমন একটা মায়াময় আভাস চারদিকে। রুহি আর বিভোরের প্রেমের শুরু সেখান থেকেই। বিভোর তো কোনোদিন ভাবেইনি তার রক্তজবা ওকে মেনে নিবে, ভালোবাসবে! এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ওকে বেশ ভাবাচ্ছে। কারণ এই কদিন রুহি ওর সাথে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আচরণ করেছে। হতেও তো পারে এটা একটা মজা, এতো খুশি হবার কোনোই কারণ নেই। বিভোর আলতো হাসলো। মুখে কেমন বিষাদের ছায়া। প্রশ্ন করলো,

‘মজা করছো?’

রুহি বলল,

‘না। সত্যি বলছি।’

‘আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। সত্যিই কী তাই?’

রুহি বিভোরের কনুইয়ে জোরে চিমটি কেটে বলল,

‘সব সত্যি।’

বিভোরের চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। ভারী হয়ে আসলো ওর গলা। খুশিতে কয়েক মুহূর্ত কথাই বেরুলো না ওর গলা দিয়ে। চোখের কোণে পানি জমে গেলো। রুহি দেখলো তার সুন্দর পুরুষটিকে এই মুহূর্তে কী অসাধারণ দেখাচ্ছে। এতো সুন্দর কোনো ছেলে হতে পারে ওর জানা ছিলোনা। আসলে ভালোবাসার মানুষটি সবসময়ই সবার চোখে সুন্দর দেখায়। এটাই বোধহয় নিয়ম। কালো ছেলেকে ভালোবাসলে সে-ই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, ফর্সা চামড়ার কাউকে ভালোবাসলে একইভাবে সেও ভালোবাসার মানুষের চোখে সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তি।

বিভোর অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

‘ইউ উইল ম্যারি মি?’

‘ইয়েস, আই উইল। কিন্তু আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’

‘আমি সেটা বলছিনা। আমি সবাইকে জানাতে চাই, তুমি আমার স্ত্রী। সেই হিসেবে কিছু একটা তো করতেই হবে। হোক না সেটা আবার আমাদের নতুন করে বিয়ে!’

রুহি বলল,

‘এসবের দরকার কী!’

‘দরকার আছে। আমার বউ আমি নিবো, সেটা কী যেনতেন ভাবে নাকি! অবশ্যই সবাইকে জানিয়ে, ধুমধাম করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।’

রুহি শুধু চুপ করে সব শুনছে৷ ওর হাসি পাচ্ছে। ডাক্তারদের কী এরকম সহজ-স্বাভাবিক মানায় নাকি! বিভোর এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বলল,

‘আব্বু যদি এই খবর শুনে, নির্ঘাত তার একশো একবার হার্ট-অ্যাটাক হবে।’

‘বাবাকে নিয়ে এরকম কথা বলতে নেই।’

‘স্যরি। আমি এটা বুঝাতে চাইনি। বলতে চেয়েছি খুশিতে হার্ট-অ্যাটাক করবে। আব্বু তো সেই কবে থেকে বলছে বিয়ে কর, বিয়ে কর। এই ক’দিন তো ভালো করে আমার সাথে কথাই বলছেনা। উঠতে, বসতে, খেতে, ঘুমাতে গেলেও আমাকে কথা শুনাচ্ছে। আজ সকালেও বললো আমি নাকি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। আমাকে নাকি এখন কেউ বিয়ে করবেনা, গ্রামের কচি মেয়েও না!’

‘আঙ্কেল তো ঠিকই বলেছে। হা হা।’

‘হাসবেনা একদম। তোমার এসব কান্ডকীর্তি দেখে আমি দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছি। খেতে পারছিনা। আমার এই সিচুয়েশন কী তোমার চোখে পড়ছেনা? তুমি যদি ওই নিরবকে বিয়ে করতে তাহলে স্ট্রোক ছাড়াই আমি কোমায় চলে যেতাম।’

‘আমি কি না খেয়ে থাকতে বলেছি? ইটস টোটালি ইউর প্রবলেম সো আমাকে এর জন্য দায়ী করবেন না। আমার এই বিষয়টা পছন্দ নয়।’

রুহির কথা শুনে বিভোরের মুখটা চুপসে গেলো।

‘রাগ করার কিছু নেই, আমিতো মজা করলাম।’

রুহি হেসে ফেললো। বোকা বানিয়েছে বিভোরকে। কয়েকটা ঘাস তুলে বিভোরের মুখে গুঁজে দিয়ে বলল,

‘ অনেকদিনের ইচ্ছে ডাক্তার সাহেব, আপনাকে ছাগলের খাদ্য ঘাস খাওয়াবো।’

‘তুমি বললে সেটাও খেতে রাজি আমি।’

বিভোর সত্যিই ঘাস চাবাতে লাগলো। রুহি বলল,

‘ফেলে দিন। ডায়রিয়া হয়ে যাবে।’

ততক্ষণে সেগুলো বিভোরের পেটে চলে গিয়েছে। কাশতে কাশতে বলল,

‘ছিঃ রক্তজবা। কি বিচ্ছিরি তোমার ছাগলের খাবার। আস্তাগফিরুল্লাহ!’

‘আমি ফেলে দিতে বলেছিলাম। রাক্ষসের মতো খেয়ে নিতে বলিনি।’

বিভোর বলল,

‘আব্বু যে আমাকে কী করবে, যখন শুনবে আরও পাঁচ বছর আগেই আমি বিয়ে করে নিয়েছি। তাও আবার তোমাকে। আমি জানিনা আব্বু কী রিয়্যাক্ট করবে!’

রুহি ভয়ার্ত গলায় বলল,

‘ওনারা কী আমাকে মেনে নিবেনা?’

‘ ধুর। পারলে এক্ষুণি কোনো পাগলিকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। সেদিন তো বলেই ফেললো আমাদের বাসার হাসেনা আন্টির মেয়েকে বিয়ে করবো কিনা।’

‘হাসেনা আন্টি আবার কে?’

‘আমাদের বাসায় কাজ করে আরকি। আম্মুর হাতে হাতে।’

রুহি থম মেরে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। বিভোর সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। ওর ছোট্ট বউ, ভালোবাসাটা। ওর লাল, মিষ্টি, ভোরের স্নিগ্ধতায় ঘেরা একমাত্র বউ রক্তজবা।

রুহি শান্ত দৃষ্টিতে বিভোরের দিকে তাকালো। তারপর ব্যথাভরা কন্ঠে বলল,

‘জানেন, আপনি যখন আমাকে অনন্যা আপুর কাছে আমার সব দায়িত্ব দিয়ে চলে গিয়েছিলেন তখন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। আপু আমাকে সবসময় সাহায্য করতো পড়াশোনায়। ভাবতাম নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রতি করা সব গাফিলতির মজা বুঝাবো আপনাকে।’

বিভোর মজা করলো,

‘তাই নাকি? তুমি ভীষণ ডেঞ্জারাস রক্তজবা, এটা কী তুমি জানো?’

রুহি কথাটা সিরিয়াসলি নিলো। অন্যদিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘না। আমি জানিনা। আমি খুবই সাধারণ একটি মেয়ে, যে ছোট থেকেই ভালোবাসার কাঙাল। ছোটবেলায় বাবার যত্ন পেলেও মায়ের ভালোবাসা পেতে চাইতাম, সে যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো অনেকদিন কেউ আর আমাকে ওদের মতো ভালোবাসেনি। এরপর আপনি এলেন হঠাৎ করেই, তেমন ভাবেই হারিয়ে গেলেন।’

‘খুব কষ্ট দিয়েছি তোমায় তাইনা?’

‘খুব। আমি তখন ছোট ছিলাম তাই হয়তো আবেগের বশে এমন করতাম।’

‘এখন বুঝি বড় হয়ে গিয়েছো?’

‘হুম। এখন মনে হয় আপনার প্রতি রাগ করা আমার উচিৎ হয়নি। আপনিও পরিস্থিতির শিকার। এমন করে বিয়ে হলে কে-ইবা মানতে চাইবে! আর আপনি যে প্রেমে মজেছিলেন সেসব ভুলে যাবার চেষ্টা করছি আমি।’

বিভোরের চোখেমুখে কৌতূহল খেলা করছে। বলল,

‘একটা কনফিউশানে আছি। তুমি প্লিজ আমাকে এই কথাটা ক্লিয়ার করে বলো!’

‘কোন কথা?’

‘তুমি ইভাদের বাসায় কী করে গেলে? ওদের সাথে পরিচয় কীভাবে তোমার?’

‘তার আগে জানতে চাইবেন না এই তিন বছরে আমি কোথায় ছিলাম? কী হয়েছিলো আমার সাথে?’

‘এটা তো জানা কথা, তুমি অনন্যার সাথেই ছিলে হয়তো।’

‘আপনি বিদেশে চলে যাওয়ার পরে অনন্যা আপুর সাথে কোনো যোগাযোগ করেছিলেন?’

বিভোর অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল,

‘দুর্ভাগ্য, আমি তার সেলফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ সাইটে ওর সাথে আমার কোনো কন্ট্রাক্ট ছিলোনা।’

‘এখন যে দেশে এসেছেন আপুর কোনো খোঁজ নিয়েছেন কী?’

‘নেওয়া হয়নি। আমিতো হোস্টেলে গিয়েছিলাম একদিন। ওকে খুঁজে পাইনি। সুপার বললেন অনন্যা নামের কাউকে চেনেন না,ওনি নতুন জয়েন করেছেন।’

রুহি কোনো কথা বললোনা। বিভোর এতোটা ইররেস্পন্সিবল কীভাবে হলো। একটা মেয়ের কাছে নিজের বউয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেলো। কারোর কোনো খোঁজই সে রাখেনি। এখন অবশ্য ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু অনন্যার সাথে কী হয়েছে সেটা কী করে বলবে কি করে? বিভোর কষ্ট পাবে নাতো! তখন রাত হয়ে গিয়েছে। লেকের কালচে পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলছে। অর্ধবাঁকা চাঁদটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঝোপঝাড়ে হাজারো জোনাকির মেলা বসেছে। অনেকদিন কোনো জোনাকি দেখেনি রুহি। শহরে আসার পর তো নয়ই৷ তাদের গ্রামে রাত হলেই দেখা যেতো জোনাকিদের। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ওদের হাতের মুঠোতে নিয়ে খেলা করতো। টিমটিম করে জ্বলতো জোনাককিদের পিঠ। রুহির খুব পছন্দের। কি সুন্দর ছিলো সেই স্মৃতিগুলো!

বিভোর আচমকাই রুহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। চোখ দুটো বন্ধ করে আনন্দসূচক হাসি উপহার দিলো। মুখে শুধু বলল,

‘আহ! কী শান্তি।’

রুহি ওর চুলে হাত বুলালো। কেমন নরম, সিল্কি চুল। তারপর ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

‘আপনার ফ্রেন্ড, আই মিন যার কাছে আমার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন অনন্যা আপু আর বেঁচে নেই। এই খবরটা আপনি জানেন?’

বিভোর লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী দৃষ্টিতে রুহির দিকে তাকিয়ে কাঁপানো গলায় বলল,

‘কি বলছো তুমি?’

‘সত্যি বলছি। আপুর বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সেখানেই স্পট ডেড!’

‘রুহি!’

‘হুম ডাক্তার সাহেব। এটাই সত্যি। আপনি দেখছেন আমার হাতের এই কাটা দাগ,এই যে পায়ের আঙুল নেই! কপালে সেলাই দেখছেন? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়ে গিয়েছে অনন্যা আপু।’

রুহি জুতো খুলে ওর পা দেখালো বিভোরকে। বাঁ পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলটা নেই। কপালে সেলাইয়ের দাগ, হাতেও! এতোদিন কেন চোখে পড়েনি বিভোরের? এতকিছু ঘটে গেলো ওদের জীবনে? অনন্যা, ওর বোনের মতো বন্ধুটিও আর বেঁচে নেই! কী বলছে এসব রক্তজবা? নিজেকে হঠাৎ ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগলো বিভোরের।

আপনাদের মতামত আশা করছি। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here