আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-১৬

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-১৬
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

ঝড়ো হাওয়া বইছে। বাতাসের দাপুটে শক্তির কাছে হার মেনে ধুলোবালি উড়ুউড়ি করছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন শহর। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। কাঁঠাল গাছের কয়েকটা পাতা জানালা দিয়ে উড়ে এসে বিভোরের ঘরের মেঝেতে পড়েছে। রুহি চুপচাপ বসে ডাক্তারের কর্মকাণ্ড দেখছে। এই মুহূর্তে বিভোর নিজেকে গোছালো প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সোফার কুশন তুলে রেখেছে, খাতাপত্র, ফাইল ডেস্কে রেখেছে। অতিরিক্ত বালিশগুলো ওয়ারড্রোবে ঢুকিয়েছে। ধোয়ার জন্য কাপড়গুলো বাস্কেটে রেখেছে। সবকিছু গুছিয়ে ঘরটা ভালো করে ঝাড়ু দিয়ে ফ্লোরটাকে মুছেছে। অতঃপর ওয়াশরুমের ফ্লোরের সাবানের ফেনা ধুয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে বসলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ এবার বুঝলে, আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারি।’

রুহি কিছু বললো না। বিভোর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে বলল,

‘ খাবে চলো।’

‘ একবার বললাম না খাবোনা আমি!’

বিভোর চোখগুলো ছোট ছোট করে রুহির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ওর হাতটা নিজের কোলে টেনে নিলো। তারপর পার্লস রেট চেক করলো, চোখগুলো টেনে টেনে দেখলো। তারপর কিছু হাবিজাবি প্রশ্ন করলো। রুহি অবাক হয়ে বললো,

‘ এসব আপনি কী করছেন?’

‘ তোমাকে চেক করছি।’

‘ চেক করার কী আছে?’

‘ তোমার না জানলেও চলবে।’

রুহি বলল,

‘ এতো ডাক্তারি দেখাবেন না, ওকে? আপনি যে একজন ডাক্তার সেটা মিনিটে মিনিটে প্রুফ করার দরকার নেই।’

বিভোর রেগে গিয়ে বলল,

‘ তোমার ফালতু কথাবার্তা বন্ধ করো।’

‘হুহ!’

বিভোর রুহির হাতটাতে মুচড়ে ধরে বলল,

‘ কী খাও তুমি? কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে তোমাকে। হাড্ডি ভেসে উঠেছে। শরীরে তো একদম পুষ্টি নেই, তার উপর বড়বড় বুলি ফুটছে মুখ দিয়ে। এই, তোমার ওজন কতো?’

বিভোরের ধমক শুনে রুহি গড়গড় করে বলল,

‘ ৪৫।’

বিভোর চোখ বড়বড় করে বলল,

‘ হোয়াটটট?’

‘ অবাক হওয়ার মতো কিছু তো হয়নি!’

‘ শুনো একদম বড়দের মতো কথা বলবেনা। তোমার জন্মের পাঁচ বছর আগে আমার জন্ম হয়েছে। মুখে মুখে তর্ক করা একদম সাজেনা তোমার। একদম মুখ বন্ধ করে থাকো।’

‘ আমিতো তর্ক করিনি।’

‘ আবার কথা বলছো? এতো বেয়াদব কবে থেকে হলে তুমি? দেখতে তো আলাভোলা মনে হয়।’

‘ আপনাকে দেখেও তো মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ আপনি।’

‘ কোনো ডাউট আছে?’

‘ জি। আপনি উপরে যেরকম সুন্দর দেখতে, ভেতর দিয়ে ততোটাই বিশ্রি।’

বিভোর রুহির মুখে নিজের সম্বন্ধে নিন্দা শুনে প্রচন্ড রাগলো। কী এমন করেছে ও!

‘ শুনো, তুমি বেশি কথা বলবেনা।’

‘ অবশ্যই বলবো। আপনি আমার কে যে আপনার কথা শুনবো? কিছু হন নাকি আপনি!’

রুহির কথায় স্পষ্ট অভিমান, অভিযোগ, রাগ ছিলো। যে কেউ তা টের পাবে। বিভোর বুঝতে পেরে আড়ালে মুখ টিপে হাসলো। তারপর উঠে অন্যপাশ দিয়ে ঘুরে একদম রুহির কাছে গিয়ে বসলো। সামনাসামনি বসে রুহির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার রুহিকে অস্বস্তি ঘিরে ধরলো। মানুষটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? যেন ধারালো কোনো সূঁচ। রুহি কেন বিভোরের চোখের ভাষা বুঝতে পারছেনা? এতো কঠিন কেন ওই চোখের ভাষা? রুহি মাথা নিচু করে ফেললো। ওর চোখগুলো ভিজে উঠেছে। ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে নিলো। রুহিকে আচমকা অবাক করে দিয়ে বিভোর ওকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রুহির মাথা বিভোরের উন্মুক্ত বুকের উপর সীমাবদ্ধ। ডাক্তারের হার্টবিটের জোরালো শব্দ রুহির কানে বাজছিলো। এই জড়িয়ে ধরাতে যেন কোনো গভীর অনুভূতি লুকোনো ছিলো। বিভোর রুহির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। রুহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বিভোরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো রুহি। আর যদি সুযোগ না আসে!

বিভোর ওর কপালে নাক ঘষে নরম গলায় বলল,

‘ এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে!’

আরও কিছু বলতে যাবার আগেই চুপ করে গেলো। মহারানি এখন কাঁদছে। বিরক্ত না করাই শ্রেয়। কাঁদুক, অভিমান না কমলেও কষ্ট তো কমবে। বিভোর হাসলো শুধু। যতোটা লুকোতে চায় মেয়েটা তারও বেশি ধরা পড়ে যায়। সবকিছু বুঝেও বিভোরের কিছুই বুঝেনা মেয়েটা। একপর্যায়ে রুহির হাত আলগা হয়ে এলো। ঝট করে উঠে বসলো। এতোক্ষণ কী করছিলো মাথায় আসতেই নিজের উপর রাগ হলো। এত শক্ত থাকার পরেও মানুষটার বুকে একটু আশ্রয় পেয়ে গলে আইসক্রিম হয়ে গেলো! ভালোবাসার কাঙাল বোধহয় একেই বলে।

ওকে এই অস্বস্তি থেকে সহজ করার জন্য বিভোর বলল,

‘ খেতে চলো। ব্যথা কমেছে? যেতে পারবে?’

রুহি মাথা নাড়িয়ে না করলো। পিঠে চিনচিনে ব্যথা করছে। বিভোর বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিছুক্ষণ পর হাতে করে সব খাবার-দাবার নিয়ে এলো। সবকিছু টি-টেবিলের ওপর রেখে একটা প্লেটে খাবার তুলে নিলো। সেটাকে মাখিয়ে এক লোকমা ভাত তুলে ধরলো রুহির সামনে। রুহি অবাক হয়ে বলল,

‘ কী করছেন?’

‘ বেশি কথা না বলে খাও। নইলে এখন তোমার হাতে আমি খাবো।’

‘ না না, খাচ্ছি আমি।’

বিভোরের হাতে খেতে গিয়ে রুহি দেখলো এই ডাক্তার ওকে লজ্জ্বায় ফেলার সকল ট্রিকস ট্রাই করছে। খাবার মুখের সামনে ধরে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বলছে,

‘ তোমার যে মুরগী খাবার প্রতি এতো শখ বললেই হতো। আমি সব মুরগী ভেজে দিতাম। শুধু শুধু মাছ-ডাল রান্না করালে।’

‘ আমি কোথায় মুরগী খাচ্ছি, আপনিই তো দিচ্ছেন।’

‘ ছিঃ। মোরগ জাতির প্রতি সমবেদনা রইলো। ওদের সাথে দেখা হলে মুখ দেখানোর জো থাকবেনা।’

রুহি বলল,

‘ কেন?’

‘ মোরগের বউকে তুলে নিয়ে এসেছি না তোমার জন্য, তাকেই কষা করে তোমাকে খাওয়াচ্ছি। সে ব্যাটা আমাকে দেখলেই তো জিজ্ঞেস করবে বেচারার বউ কোথায়। তখন আমি কী বলবো, কীভাবে মুখ দেখাবো ভাবতে পারছো!’

রুহি হেসে ফেললো। তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। বিভোর সবকিছু ধুয়েমুছে সেলফে রেখে দিলো। গুছানোর কাজ শেষ করে নিজের ঘরে গেলো। রুহি আগের মতোই বসে আছে। ওকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আমি ঘুমাবো কোথায়?’

বিভোর বলল,

‘ এখানে।’

রুহি চোখ বড়বড় করে বলল,

‘ এখানে মানে? এটাতো আপনার ঘর। আমি এখানে থাকবো না।’

‘ রিল্যাক্স হও। আমরা দুজনেই এখানে থাকবো।’

রুহি বলল,

‘ কখনোই না।’

‘ শুনো, এটাতে অবাক হওয়ার কিছুই হয়নি। ইট’স নরমাল কজ আমরা দুজনেই জানি আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কী।’

রুহি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘ জানলেই হয়না, মানতেও হয়। আপনি তো কিছু মানেনই না। আমাকে অন্য একটা ঘর ঠিক করে দিন। আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে থাকবোনা।’

রুহিকে রেগে যেতে দেখে বিভোর বলল,

‘ওকে ওকে। পাশের ঘরটাতে থাকতে পারো। তুমি কী ভাবছো আমি সুযোগ নেবো? কখনোই না। আমি এতোটাও খারাপ নয়।’

রুহি কিছু বললো না। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার উপরে। রুহির ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নিরবের নাম। রুহি কেটে দিলো। আবার ফোন দিলো নিরব। বিভোর সবটাই দেখেছে, তাকিয়ে দেখছে নিরবের কর্মকান্ড। রাগে গা কেঁপে উঠলো। এ তো আস্ত বেয়াদব। এতো রাতে একটা মেয়েকে কীভাবে কেউ ফোন দিতে পারে? মিনিমাম সেন্স নেই নাকি। তার উপর বিভোর ওকে সহ্য কর‍তে পারেনা। ওদিকে চারবার কল কাটার পরেও যখন নিরব ফোন দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে বাধ্য হয়ে রুহি ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নিরব হাসিমুখে বলল,

‘ কী করো রুহি?’

দাঁতে দাঁত চেপে রুহি বলল,

‘ কিছুনা। ঘুমাবো।’

‘ ওহহ। আচ্ছা তুমি তখন বিভোরের সাথে কোথায় গেলে?’

রুহি মনে মনে বলল তোকে বলবো কেন? কিন্তু উত্তর দিলো,

‘ কাজ ছিলো ওনার সাথে।’

নিরব আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

‘ কিন্তু এভাবে কেউ কারো হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নাকি? জানো, এটা দেখে কিন্তু আমি রেগে গিয়েছি। মনে হচ্ছিলো তোমার ওপর কত জনমের অধিকার আছে বিভোরের। পরবর্তীতে কাউকে নিজের হাত ধর‍তে দেবেনা।’

রুহি ওর কথায় বিরক্ত হয়ে গেলো। কত বড় সাহস! বিভোরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে। রুহি ঠিক করলো ভদ্রভাবে কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে ওকে ব্লক করে দিবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রুহি হেসে বলল,

‘ ঘুমাবো এখন। রাখি!’

নিরব বলল,

‘ এখনই না। চলো আজ ফোনে ফোনে গল্প করে রাত কাটিয়ে দিই। দুজ…!’

এরপর আর কোনো কথা শোনা গেলোনা। রুহির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিভোর ফ্লোরে আছাড় দিলো। দু’ টুকরো হয়ে গেলো ফোন। বিভোর রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে বলল,

‘ এতদূর? ওই বাস্টার্ডের সাথে তুমি সারারাত গল্প করবে? সেজন্যই আমার সাথে থাকতে চাচ্ছোনা? তুমি এতো আস্কারা দিয়েছো একে! ওকে, তুমি অন্যঘরে থাকতে চেয়েছিলে তাইতো? কিন্তু আমি এখন তোমাকে কোথাও যেতে দিচ্ছিনা। এখানেই, এই ঘরে, আমার সাথে এক বিছানায় থাকবে।’

রুহিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো বিভোর। রুহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

‘ ছাড়ুন আমাকে।’

‘ নড়াচড়া করলে কিন্তু কিছু একটা করে ফেলবো৷ তারপর আমার দোষ দিতে পারবেনা।’

রুহি আর নড়লো না। কেঁদে দিলো। বিভোর ধমকে উঠতেই আবার চুপ করে গেলো।

বিভোর শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ একটা গল্প শুনবে?’

রুহি ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,

‘ কার গল্প?’

‘ শুনলেই বুঝবে৷ এই গল্প তো তুমি জানো। গল্পটা একটা বিশাল অঙ্কের মতো। আমার কষতে বারণ আছে। তুমি এটা কষে ফল বের করবে।’

বিভোরের কথায় কিছুই বোঝা গেলোনা প্রায়। রুহি চুপ করে রইলো। ঝড়ো বাতাস এবার ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। মাঝেমধ্যে বাজ পড়ার শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই বিভোর রুহির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে গল্প বলা শুরু করলো।

গল্প কী একঘেয়ে লাগছে আপনাদের? মন্তব্য জানাবেন আশা করছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here