আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_১৩,১৪
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_১৩
আমি ফ্রেশ হইয়া আইসা রান্নাঘরে ঢুকলাম। আজকে ঐ মাইয়ার কেকের চক্করে আমার আরামের ঘুমটা গেল।
.
.
.
.
ময়দা মাইখা একেবার ময়দাময় হইয়া গেলাম। কেউ দেখলেই বলবো ময়দা সুন্দরী। ইস্ রে…। গুইল্লা টুইল্লা কেক চুলায় দিয়া আরাম কইরা বসলাম সোফায়। ঝিলিকরে কইলাম ক্রিমটা ঠিক করতে। ডেকোরেশন করা লাগবে। ঐ পটকা মরিচের কত বছর সেটাই জানি না। অথচ নাচতে নাচতে তার জন্মদিনে নাকি যামু। কি একটা অবস্থা! গেলে জিজ্ঞেস করা লাগবে। কেকটা হোক আমি ততক্ষণে একটু ফ্যানের হাওয়া খাই।
দুমিনিট পর কলিংবেল বাজলো। আব্বা বাজারে গেসিলো। ঝিলিক দরজা খুলতেই এক বস্তা বাজার ধরাই দিল। আমি গিয়া উঁকি দিলাম। আব্বা কি যেন টের পেয়ে কইল, বাজারের ব্যাগে আধা কেজি গাজর আনসি।
– আব্বু, তুমি কি খালি মনে করো আমি বাজারের ব্যাগ ঘাটি কেবল গাজরের জন্য?
আব্বা হাসল। হাসার মানেটা আমি ভালোই বুঝলাম। যাগ্গে আমি এমনিই দেখতেসি। আব্বারে চেরি ফল আনতে বলসিলাম। কেকের উপরে দিতাম ডেকোরেশানে। হঠাৎ মন হইলো, গাজর তোমার গাল দুইটা তো চেরি ফলের মতো দেখতে। গালগুলা কাইট্টা দিয়া দাও কেকের উপর দিবো নে। ভেবে হাসতেসি। ঝিলিক আমার হাতে চেরি ফলের প্যাকেট ধরাই দিয়া কইলো, তোমারে কি কিসু ধরসে?
– কিসে ধরবে?
– না মানে, প্রায়ই দেখি হুদা হুদা হাসো।
– আরে ধুর, যা তো বাজার সামাল দে। কেক হয়ে আসলে বলিস। আমি একটু ঘষামাজা করে নেই গোসলে গিয়া।
রোদে আমার সোনার রঙ তামা হইয়া গেছে৷ তাই ওয়াশরুম ঢুইকা ইচ্ছা মতো ঝামা দিয়া ঘইষা সোনার রূপ বাইর করলাম। মাথায় ইচ্ছে মতো সেম্পু দিয়া চুলগুলারে রেশমের মতো বানাইলাম। এমন সময় ঝিলিকের ডাক পড়ল। কেক হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি গোসল সেরে বাইর হয়ে কেক নামাইলাম। যাক ভালোমতোই হইসে। এবার ডিজাইন করার পালা। ক্রিম নিয়ে সাজাইলাম কতক্ষণ কেকটারে নয়া বউয়ের মতো। ক্রিমের ফুল বানাই কেকে বসাইলাম। চেরি দিয়া কলি দিলাম।
কেক বানুরে সাজাই এবার নিজেরে সাজাতেই বসলাম। পুরা বিছানা গোয়ালঘর বানাইয়াও নিজের জন্য একটা সুন্দর জামা বাইর করতে পারলাম না। আমি আলমারির দিকে তাকাই ভাবতেসি কি করা যায় এমন সময় দরজায় একজন উঁকি দিয়া কইল, গাজরের হালুয়া। আমি তাকাইলাম৷ পিচ্চি শাঁকচুন্নিটা আসছে আবার জ্বালাইতে। এমনিই বুঝতেসি না কি পরমু। আমি কইলাম, কিতা চাই?
– কেকটা সুন্দর হইসে।
– সুন্দর করলে তো সুন্দর হবেই। (মনে মনে) সুন্দর না করলে তো আবার তোমার মুখ দিয়া কি বাইর হয় ঠিক নাই।
– আমার মনের মতো হইসে। এখন কি করো? বিছানার এ অবস্থা কেন?
– কি পরবো বুঝতেসি না।
– এগুলা গুছাও। আমি তোমার জন্য একটা গিফট আনসি।
– কি গিফট?
– আগে গুছাও।
আমি সব কাপড় তুইলা কোনোমতে আলমারিতে পুরলাম। তারপর কইলাম, এবার বলো। ও আমার কারবার দেইখা মাথা নাড়াইলো। তারপর একটা বক্স ধরাই দিল। আমি বক্সটা খুইলা দেখলাম একটা নীল শাড়ি, একজোড়া নুপুর আর এক গাছি নীল কাচের চুড়ি। দেখেই বোঝা যাইতেসে এগুলা কেউ ব্যবহার করসে। আমি জিগাইলাম, এগুলা কার?
– তোমার।
– মানে আমি জানতে চাইছি কার জিনিস আমাকে দিচ্ছো?
– তোমার জিনিসই। এখন চটপট এগুলা পরে নাও।
– অন্যের জিনিস আমি পরবো কেন?
– এত কথা বলো কেন? পরো বলছি। যদি দেখসি পরো নাই তাহলে সবার সামনে আম্মু ডাকবো।
আল্লাহ… কি দিনকাল পড়লো, এটুকু মাইয়্যাও খালি ব্ল্যাকমেইল করে। আজকে আমি ফান্দে পড়সি দেইখা। সে তাড়া দিয়া কইলো, কি হল পরো। আমি কইলাম, আমি কি তোমার সামনে পরমু? যাও বাইরে। সে চইলা গেল। শাড়িটায় একবার হাত বুলাইলাম। বোঝা যায় অনেক যত্ন করে রাখা। নুপুর জোড়া নতুন করে ইলেকট্রোপ্লেটিং করসে। কিন্তু অনেক সুন্দর কাজ। চুড়িগুলাও কেমন মায়ায় টানতেসে। আমি শাড়িটা সুন্দর করে পরলাম। ছোট চুলে কেমন কেমন জানি লাগতেসিলো। কিন্তু কি করা। কোনো দোয়া থাকলে এখুনি পইড়া রুপানজেল হই যাইতাম। সুন্দর করে একপাশে সিঁথি করলাম। চোখে কাজল দিলাম, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দিলাম। কানে ছোট নীল দুল পরলাম। পায়ে নুপুর পরার পর চুড়িগুলো হাতে পরে আয়নায় তাকালাম। নিজেকে দেখে কি যেন চোখের সামনে জ্বলে উঠল। কাকে যেন দেখলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মাথাটা ব্যাথা করতেসে। মাথায় হাত দিয়া বিছানায় বইসা ডাকলাম, ঝিল….। আমার ডাকে ঝিলিক আসতেই কইল, কি হইসে ছোঁয়াপু?
– আমার ওষুধটা দে। মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ওষুধটা খাওয়ার পর ব্যাথাটা একটু কমল। ব্যাথা কমতে না কমতে পর্ষী হাজির। হাতে কাঠবেলির থোকা। কোথায় থেকে আনসে কে জানে। আমি বেশ বিরক্ত হইয়া কইলাম, আবার কি? সে আমারে উঠে বসাইয়া চুলের নিচ দিয়া অপটু হাতে কাঠবেলির থোকা লাগাই দিলো। সামনে আইসা কইলো, এবার হইসে। ঠিক আগের মতো লাগতেসে।
– তুমি আমারে আগে দেখসো নাকি?
সে কিসু না কইয়া রহস্যের হাসি দিল।
.
.
.
.
সাইজা গুইজা বইসা আছি। বিকালেই কেক নিয়া গেসে গা। আমি খালি চিন্তা করতেসি যামু কি যামু না। তখনই পর্ষী আসলো আবার। এসে কইলো, কি হলো গাজরের হালুয়া। সেই কখন তৈরী হইসো। সাজও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাসায় আসো না কেন? আমি কিসু না কইয়া তাকাই রইলাম। এত মানুষের সামনে যদি গাজরের হালুয়া ডাকে কেমন লাগবো! সেটা না হইলে আবার আম্মু আম্মু কইয়া মাথা পানি করে ফেলবে। কোনদিকে যে যাই!
– পর্ষী একটা কথা বলি? ভালো মেয়ের মতো শুনবা, কেমন?
– কি কথা?
– আমাকে ছোঁয়াপু ডেকো।
– ইহ্, আম্মুকে কেউ আপু ডাকে? শুনেছো কখনো?
– আমি তো তোমার আম্মু না।
– তুমিই আমার আম্মু। এই যে গলার দাগটা আমার আম্মুর।
এই রে! আমি তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে গিয়া দেখলাম দাগটা চান্দের লাহান চকচক করতেসে ঘাড়ে। আজকে ফাউন্ডেশন দিয়া লুকাইতে ভুইলা গেসি। অনেকদিন এই দাগটা নিয়া চিন্তা করসি। কোন রাক্ষসের খপ্পরে পড়সিলাম কে জানে। একেবারে কামড়াই বারোটা বাজাই দিসে। সবাই কি কইবো এ ভেবে ফাউন্ডেশন দিয়া ডাইকা দেই। আজকে গোসলের পরে দিতে ভুলে গেসিলাম। এখন তাড়াতাড়ি কইরা ফাউন্ডেশন লাগাই দিলাম। লাগানো শেষ হইতেই পর্ষী হাত ধরে টাইনা ওদের বাসায় নিয়া গেল।
আমার নুপুরের শব্দে সবাই আমার দিকে তাকাইলো। সাথে সাথে পিন পতন নীরবতা। আমি তো লজ্জায় খালি কুচিমুচি করতেসি। সে নিয়া কেকের সামনে দাঁড় করাইলো। বাসায় বেশি মানুষ নাই। আবার কমও না। অন্তত জনা ত্রিশ তো হবে। যা বুঝলাম কাছের মানুষদেরই নিমন্ত্রণ করসে। আমি মানুষের থেকে বাসাটার দিকে তাকাইলাম। সুন্দর করে সাজাইসে। কেমন যেন আপন আপন গন্ধ। দেয়াল ছুলে অন্যরকম অনুভূতি। কানে যেন কারা হেসে খেলে বেড়ানোর শব্দ। দেয়ালে হাত দিয়া একটা রুমের দিকে আগাইতেই সাহেদা এসে হাজির। সে একটা হলুদ থ্রিপিস পড়সে। আমারে কইলো, আমি কনে হইয়া শাড়ি পড়ি নাই। হঠাৎ তুই পড়লি? আমি পর্ষীর দিকে ইঙ্গিত কইরা কইলাম, এই ধানি লঙ্কার কান্ড। আমারে খালি ব্ল্যাক না ব্লু হোয়াট সব মেইল কইরা এখন এই শাড়ি গায়ে।
– ভালা করসে। সুন্দর লাগতেসে তোরে।
– ধুর, সবাই আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাই আছে।
– তাকানোর কারণ আছে।
– কি?
– সেটা পরে কমু।
– তা তো বলবাই। আয়ান স্যারের সাথে আমারে না জানাই ডেইটে গেসো, আর এটা কেন লুকাইবা না।
– হইসে ঢং করিস না। ডেইট ফেইট কিসু না। ঐ একটু দরকারে ডাকসিলো। বাই দা চিপা রাস্তা, তুই জানলি কেমনে?
– হে হে, তোমরা ডেইট করবা আর আমি জানমু না?
– হ।
– তুই আসলি যে? ওরা কি বিল্ডিংয়ের সবাইরে ইনভাইট করসে নাকি?
– সবাইরে করবে কেন?
– তাইলে তুই…
– আমি সম্বন্ধী তাই করসে।
– কেমনে?
– পর্ষী আমার নাচের স্টু না?
– অ। বুলেই গেসিলাম।
সাহেদা মিষ্টি করে কইলো, ছোঁয়া, এই ছোঁয়া। শুন না। এত মিষ্টি সুর শুইনা সন্দিহান চোখে কইলাম, কি?
– তুই না আমার বেস্টু। আমি ভাবতেসি আমার হবু ভাসুরের সাথে তোর বিয়ে দিবো। কেমন? আমরা দুই বেস্টু মিলে একসাথে থাকবো।
আমি কইলাম, বোইন আমার জন্য আর কত ক্যান্ডিডেট আইবো? আমার গাজর, পর্ষীর আব্বু আর এখন কস তোর ভাসুর।
– আরে, এত বেশি কোথায়? পর্ষী তো আমার হবু ভাসুরেরই মেয়ে।
আমি তো সেই শক খাইয়া চোখ বড় বড় কইরা তাকাইলাম। এটা কি শুনসি! আমি ঢোক গিলে কইলাম, কেমনে?
– আয়ান স্যার আর পর্ষীর বাবা মামাতো ফুফাতো ভাই। তার মানে পর্ষী আব্বু আমার হবু ভাসুর। সিম্পল।
আমি না বুঝা লেদা বাচ্চার মতো ওর দিকে তাকাই আছি। ও আবার মধু মিশানো হাসি দিলো। আমি ও মন গলানো হাসি দিয়া কইলাম, থাক বইন। তোর ভাসুর তোর পুটলিতে রাখ। আমার গাজর বর আছে। তারে নিয়াই হ্যাপি। সাহেদা আবার রহস্যের হাসি দিলো। কি জ্বালা, সবাই এত রহস্যের হাসি দেয় ক্যান!?
হঠাৎ কে যেন আমার উপর হামলাই পড়লো। আমি বুঝার আগে সে কাইন্দা কাইটা একসার।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️
#সাহেদা_আক্তার
#সিজন_২
#পর্ব_১৪
হঠাৎ কে যেন আমার উপর হামলাই পড়লো। আমি বুঝার আগে সে কাইন্দা কাইটা একসার।
একটা পোলা এসে কইলো, কি হচ্ছে মুন। পর্ষী এসে মুখ চাইপা কইলো, খাম…মি……। এবার চিনলাম। মেয়েটারে দুইবার দেখসি। একবার পর্ষীকে যেদিন প্রথম দেখসি সেদিন ওকে আনতে গিয়েছিল। আর আরেকদিন নাচের ক্লাসে। মুন নাক মুখ মুইছা হাসিমুখে কইলো, কেমন আছিস ছোঁয়া? এমনভাবে কইল যেন অনেকদিনের সম্পর্ক। আমি কইলাম, জ্বি ভালো।
– কতদিন পর তোকে দেখলাম। অনেক শুকিয়ে গেছিস।
– আমি আপনাকে চিনি?
– যা শুনেছিলাম সত্যিই তাহলে।
মুনের চেহারা কালো মেঘের মতো হইয়া গেল। কোথা থেকে একটা পিচ্চি পোলা এসে আমার ঠ্যাং দুইটা জড়াই ধইরা কইলো, খাম্মি……খাম্মি কেমন আছো? আমি তাকাই বললাম, ভালো। তারপর ভাবলাম এটা কেডা!? মুন এসে বলল, ও লাবিব। আমার ছেলে। আর ও আমার হাজবেন্ড রেদোয়ান। লাবিব পর্ষীর কাছে গিয়া বলল, হ্যাপি বাডডে।
– থাংকু ভাই।
রেদোয়ান বলল, এই নিয়ে কতবার বোনকে উইশ করেছে! তাও শেষ হয় না। পর্ষী বলল, থাক না খালু। কিচ্ছু হবে না। আমার কটু কটু ভাইটা। বইলা গাল টিইপ্পা দিলো। আমি মনে মনে কইলাম, আমার প্রতিও যদি এমন উদার হইতো পিচ্চি শাঁকচুন্নিটা!
দরজায় কে যেন নক করল। পর্ষী গিয়া দরজা খুলতে আমার গাজর জামাইটা ঢুকলো। আমি হা কইরা আছি। কি কিউট লাগতেসে। একটা সাদা শার্ট পরা, বুকের উপর হাতের কাজ। তার সাথে নীল জিন্স। রোদে পোড়া চেহারায় দারুন লাগতেসে। চুলগুলা সেম্পু করা দেখেই বুঝা যাইতেসে। গালগুলার কথা তো বাদই দিলাম। ওগুলার কথা নতুন করে কিছু বলার নাই। আমি তো ফিদা। সে আমার দিকে তাকাইতেই লজ্জাবতীর মতো গুটাই গেলাম। গাজরের আম্মা মানে আমার কল্পনার সংসারের কিউট শ্বাশুড়ি আম্মা আমার কাছে এসে কইলেন, কতদিন পর এই সাজে দেখছি। ঠিক আগের মতোই আছিস। বলেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। সবাই এমন বিহেভ করতেসে যেন আমি তাদের অনেক আগের চেনা। হইতে পারে। আমার যেহেতু আগের স্মৃতি মনে নাই তাই চেনা সম্ভব না। আমি কেবল হা করে সবার কথা শুনতেসি। এরপর দুজন আসলো, সম্পর্কে মুনের বাবা মা হন। আমারে অনেক আদর করলেন। তারপর মুনের বোন আর তার দুই পোলা মাইয়া। একটু পরে একজন ভদ্রলোক এলেন। তিনি চোখের কোণার পানি মুইছা বললেন, কেমন আছিস ছোঁয়া মা? আমি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাইতেই শ্বাশুড়ি আম্মা কইলো, আকাশের আব্বু। আমি তড়িঘড়ি কইরা সালাম দিয়ে কইলাম, সরি আঙ্কেল চিনতে পারিনি। তিনি কিছু না বলে মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। সবাই কত্ত আদর করতেসে আমারে। ভাবতেই কি যে ভালো লাগতেসে! ইস্ একবার যদি কইতো, মা তোমাকে আমার পোলার জন্য অনেক পছন্দ হইসে। উফ! সবাই নিজেদের মতো গল্প করতেসে। আমি সাহেদারে খুঁজলাম। একলা ময়দানে আমারে ফেইলা কোন চিপায় ঢুকসে। ওকে খুঁজতে গিয়া আয়ান আর তার বাপ মারে চোখে পড়ল। সাহেদাও তাদের সাথে। বুঝলাম আপাতত ঐদিকে না যাওয়াই ভালো।
সাতটা বাজতেই পর্ষী আমারে আর গাজররে টাইনা ওর পিছনে দাঁড় করাইলো। কেক কাটবে। আমার সেদিকে হুশ নাই। আমার মন কেবল মৌমাছির মতো উইড়া উইড়া বলতে, পাশে ফুল আসছে, মধু নিতে হবে। আমি আকাশের দিকে তাকাইতেই দেখলাম সে আমার দিকে তাকাই আছে। আমি একটা ভেটকি মারলাম। ভেতরটা ভয়ে কাঁপতেসে কেন জানি। পর্ষী বলল, একটা ছবি তুলে দাও। সবাই ওর কথা শুনে ফোন বের কইরা ছবি তুলা শুরু করলো। আহা, নিজেরে সেলিব্রেটি সেলিব্রিটি লাগতেসে। ছবি তোলা শেষ হইতেই কেক কাটল। সবাই তালি দিয়ে হ্যাপি বার্থডের গান গাইতে লাগলো। কাটা শেষে প্রথম পিসটা সে আমার দিকে বাড়াইলো। এত আপনজন থাকতে আমারে দিলো! কেমন একটু লজ্জা করতে লাগল আমার। পরেরটা গাজররে দিলো। এরপর সবাইরে দেওয়া হলো পিস পিস কইরা। পর্ষী আমার দিকে একটা বিশাল ভেটকি দিয়া চোখ টিইপা কইলো, অনেক ভালো হইসে, আম্ মু। আমি খালি হাসলাম। মনে মনে কইলাম, ভালো না হইলে তো আমার পিন্ডি চটকাইতা। আমি কেবল কাচুমাচু করতেসি আর ফাঁক পাইলে গাজররে দেখতেসি। মাঝে মধ্যে মনে হয় সবাই যেন আমার দিকে কেমন অদ্ভুত করে তাকায়।
আমার বাসায় চইলা যাইতে মন চাইতেসে। এত মাইনষের ভীড়ে আমি এক অবুঝ শিশু। পর্ষী আমার হাত ধইরা চিপকাই রইসে সারাক্ষণ। তাই যাইতেও পারতেসি না। গাজররে খুঁজতেই দেখলাম গল্প করতেসে সবার সাথে। আমারে একটু পাত্তাও দেয় না গাজর জামাইটা। আমি ভাবতেসি আর সোফায় আঙুল নাড়াই খেলতেসি। হঠাৎ পর্ষী আমারে কইলো, গাজরের হালুয়া, আমার গিফট কই?
– গোটা একটা কেক বানাই দিলাম না?
– ঐটা তো আমি কিনসি।
– কেমনে?
– ওমা, গাজর দিলাম না? এখন আমার গিফট দাও।
আমি কি দিমু? কিসু তো কিনি নাই। খেয়ালও করি নাই। সব কিসুর মাঝে পইড়া ভুইলা গেসি। পর্ষী কইলো, আনো নাই যখন আমি যা চাইবো দিবা। কোনো কথা নাই। আমি ঢোক গিললাম। সে হঠাৎ লালুমিয়ার মতো জুলুজুলু কইরা তাকাই কইলো, আম্মু আজকে আমি তোমার কাছে থাকবো। কতদিন থাকি না। আমি কি কমু খুঁইজ্যা পাইলাম না। মেয়েটারে দেখে মায়া লাগল। যতই মায়া লাগুক একটা পিচ্চি শাঁকচুন্নি। আমারে জ্বালাইয়া কয়লা কইরা ফেলল। আমি কিসু কইলাম না। কারণ না কইলেও চিনা জোঁকের মতো লাগি থাকবে।
রাতে অনেক কষ্টে চিনা জোঁক ছাড়াই বাসায় আসলাম। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলাম। শাড়ি, নুপুর আর চুড়িগুলো যত্ন করে রাখলাম আলমারিতে। কেমন মায়ার জিনিস। কার কে জানে, কিন্তু আমার দেখে অনেক মায়া লাগে। ইসরে… ওর আম্মু আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করা হয় নাই। মাইয়াটা আমারে আম্মু বলে ক্যান? জানা লাগবে। কালকে জানমু নে ওর খালামনি থেকে। এখন ঘুম দেই। বহুত ক্লান্ত লাগতেসে। শোয়ার আগেই একটা টেডি বিয়ার নিয়া পিচ্চি শাঁকচুন্নির প্রত্যাবর্তন। আমি কিছু বলার আগেই ঝিলিক কইলো, ছোঁয়াপু, ও নাকি আজ তোমার সাথে থাকবে।
– হুম, আজকে আমি আম্মুর কাছে থাকবো। এটা আমার গিফট।
– আমি কোথায় থাকবো তাইলে?
– তোমরা শোউ না। আমি তো আম্মুর সাথে চিপকে শুয়ে পড়বো। বেশি জায়গা নেবো না।
আমি মনে মনে কইলাম, এটুকু মেয়ে, পাকনা বেশি। সে আমার সাথে এসে শুয়ে পড়ল৷ আমি আর কি কইতাম। থাকুক তাইলে। এক রাতেরই তো ব্যাপার।
.
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ঝিলিক উঠে গেছে আগেই, পর্ষী আমারে কোলবালিশের মতো জড়াই ঘুমাইতেসে। মাথা আমার হাতের উপর। সরাইতে গিয়াও সরাইলাম না। মেয়েটারে কিউটই লাগে। কিন্তু এমন ঝাল তাই প্রসংশা করতে মন চাইল না। আমি তাকাই আছি হঠাৎ সে চোখ মুখ কচলাই আমার দিকে তাকাইলো। কিউটটটটটট! আমি কইলাম, ঘুম ভাঙসে? সে আম্মু কইয়া একেবারে আমার বুকে মুখ গুজে আবার ঘুম দিলো। মনে হইলো বুকের কোনো ভাঙা অংশ জোড়া লাগল। আমিও ওরে জড়াই ধইরা ঘুম দিলাম আবার।
সাহেদা আইসা দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙাইলো। আমি তাকাইতে দেখলাম চম্বুকের মতো বিকর্ষণে দুইজন বিছানার দুই মেরুতে শুই আছি। আরেকটুর জন্য আমি বিছানা থেকে পড়ি নাই। আমি উঠলাম আস্তে ধীরে। সাহেদা কইলো, কেন যে মরার মতো পড়ি পড়ি এত ঘুমাস!
– কি করতাম? ঘুম আসে।
– মা মেয়ে তো ভালোই ঘুম দিলি। ঝিলিক কই ঘুমাইসে কাল?
– আমাদের সাথেই।
– তিনজন আটছিস?
– বহু কষ্টে।
– কেমনে যে থাকলি। যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি বসার ঘরে যাই। আন্টি মাত্র এল। যাই আচারের খোঁজ করি গা।
আচারপাগলি চইলা গেল। আমি ফ্রেশ হইয়া বসার ঘরে গেলাম। বড় একটা আচারের ডিব্বা নিয়া বসছে দুই পাগল। সেই সাথে টিভিতে জসীমের ঢিসুম সিন। ঝিলিকও অতি উৎসাহে বলতেসে, মার, মার। আমি আচারের বয়ামে বড় এক থাবা মাইরা কইলাম, ঝিল, তুই তো গিয়ে একটু কয়টারে পিটাই আসতেই পারস তাইলে নায়কের কষ্ট কম হইতো। ঝিলিক দাঁত কেলাই আবার সিনেমায় মন দিল। আমি সাহেদার দিকে ফিরে কইলাম, আমাদের তো বনভোজনে যাওয়ার প্ল্যান চলতেসে ডিপার্টমেন্ট থেকে।
– কবে!?
– এইতো কদিন পর। কক্সবাজার যাবে। তুই তো গেলি না সেদিন ক্লাসে।
– বাহ ভালো তো।
– হুম, ওখানে গিয়া দ্বিতীয় ডেইট করবি।
– আরে ধুর।
এমন সময় পর্ষী টেডিবিয়ার হাতে নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বসার ঘরে এসে আম্মু আম্মু করতে লাগল। তারপর আমার কাছে এসে ঝুরতে লাগল। আমি বললাম, পর্ষী আজ তোমার স্কুল নেই? পর্ষী আমার কোলে মাথা রেখে বলল, হু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয়টায়? ও বলল, নয়টায়। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে। এখন আর স্কুলে গিয়া কাজ নেই।
এমন সময় কলিংবেল বাজল। সাহেদা গিয়া দরজা খুলল। মুন এসে হাজির। সাথে লাবিব। পর্ষী আমার কোল থেকে উঠে বইসা বলল, খাম্মি আসছো? মুন সোজা আমার কাছে এসে জড়াই ধরে রইল কতক্ষণ। মনে হলো যেন কানতেসে। তারপর চোখ মুছে বলল, কেমন আছিস?
– ভালো।
– তোকে দেখে কি যে ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। একটা বছর কি যে গেছে!
– আপনারা আমাকে চেনেন?
– তা চিনি।
আমি ভাবতে বসলাম। পর্ষী আমারে আম্মু ডাকে ওর খালামনিও আমারে চেনে। ভাইবা মনে ভয় ঢুইকা গেল। তাইলে কি এই জন্মে আমার আর গাজররে পাওয়া হইবো না!? ওর বাপরে বিয়া করা লাগবো? ওয়েট! যদি আমার আগে বিয়া হয় তাইলে তো আব্বা আম্মা জানতো। কই কখনো তো কয় নাই। বন্ধুও আমারে বলে নাই। ধুর মাথায় কিছু ঢুকতেসে না। আমি জিগাইলাম, আচ্ছা পর্ষীর আব্বু কোথায়? তাকে দেখলাম না যে কাল।
আমার কথা শুইনা পর্ষী হঠাৎ আমার কোল থেকে উইঠা বলল, খাম্মি, আমি তো ভুলেই গেছি। একটা জায়গায় আমাদের না যাওয়ার কথা? চলো চলো। পর্ষী তারে ঠেইলা নিয়া চইলা গেল। কি হইলো ব্যাপারটা? ওর তো স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। ঘুমের জন্য যায় নাই। এখন হঠাৎ অন্য কোথাও যাওয়ার প্ল্যান হইলো কোন সময়? ধুর বাবা, ভাল্লাগে না। আমি বেশ বিরক্ত হইয়া আচার খাওয়ায় মন দিলাম।
চলবে…