আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩,৪
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_৩
খালি ময়দানে উস্টা খাইলাম। ফলে আশে পাশের সবাই আমার দিকে হা করে তাকাই রইলো। ক্রাশও আমার দিকে তাকাইলো। হায়রে ফাডা কপাল। উস্টা খাইলি ভালা কতা তাই বলে ক্রাশের সামনে!
সাহেদা দৌঁড়ে এসে বলল, কি রে তুই? দেখি উঠ। উঠতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি টন টন করে উঠলো। বুঝলাম, আমার গোয়েন্দাগিরির বারোটা বাজছে। ভালো মতোই আছাড় খাইসি। বান্দরের মতো না লাফাইয়াও যদি আছাড় খাই মোর কপালে আর কি আছে! সাহেদারে ফিসফিস করে কইলাম, হাঁটতে পারুম না। কি করি ক তো। খেয়াল করি নাই ক্রাশ আমার কাছে আইসা বসছে। আমার পায়ে হাত দিতেই খেয়াল হইলো। সাথে সাথে পা সরাইয়া কইলাম, কি করছেন? যদিও মনে আনন্দের লাড্ডু ফুটতে লাগল। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। মন আমারে কইতেসে, বেটি, মন মে লাড্ডু ফুটা? আমি মনরে কইলাম, হা, ফুটা। উফ্! ক্রাশটা এত্তো কিউট ক্যান! গালগুলা লাল লাল। রোদে পোড়া চেহারা। চিকন ফ্রেমের চশমায় সেই লাগতেসে। ঠ্যাং তোরে আমি সোনা দি মোড়াই দেয়ালে ঝুলামু। তোর জন্য আজকে ক্রাশটারে এতো কাছে থেকে দেখতেসি।
– আপনার পা হয়তো মোচকে গেছে। আমাকে দেখতে দিন।
আমি পুরা ঠ্যাং বাড়াই দিয়ে কইলাম, দ্যাখেন। আমার পা দেখে বলল, হাড় নড়ে গেছে সামান্য। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কয়দিন প্লাস্টার করে রাখা লাগবে। আশা করি তিন চারদিনে ঠিক হয়ে যাবে। আমি জিগাইলাম, আপনি কি হাড়ের ডাক্তার?
– না।
– তাহলে?
সে আমাকে একটা কার্ড দিয়ে বলল, এইটা নিন। উনি অর্থোপেডিক্সের (অস্থি চিকিৎসাবিদ)। ওখানে যেতে পারেন। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে কইলাম, আমি তো হাঁটতে পারতেসি না। যদি একটু হেল্প করতেন নিচে যাওয়ার জন্য। সে আমার কথা বুঝছে কি না জানি না, যে ভঙ্গিতে দাঁড়াইলো, মনে মনে কইলাম, কোলে টোলে নিবে না তো আবার! সিনেমায় তো কত দেখি নায়িকার কিছু হইলেই নায়কের কোল ফ্রি। উফ্! আমার লজ্জায় বেহুঁশ হই যাইতে মন চাইতেসে। কিন্তু খচ্চর তো খচ্চর হয়। আমি যখন কোলে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেসি তখন সে কোথা থেকে একটা লাঠি এনে হাতে ধরাই দিয়া কইল, এটায় ভর দিয়ে হাঁটতে পারবেন। আর আপনার বন্ধু তো আছেই। এই বলে চইলা গেল।
আমার রাগে দুঃখে ইচ্ছা করতেসে এই লাঠি দিয়া ওর মাথায় দুইডা বাড়ি দি। ব্যাটা খচ্চর। তোর লাঠি কে চায়? এর থেকে গরু, ছাগল বহুত ভালা। তারপর ভাবলাম, আচ্ছা, গরু ছাগলের তো সবই ঠ্যাং, তাহলে ওরা ওদের জিএফরে কোলে নেয় কেমনে!? ধুর মাথাটাই খারাপ হই গেসে। সাহেদার সাথে আমারও একটা সিট বুকিং করা লাগবো পাবনায়। আমি সাহেদারে ধরে নিচে চইলা আসলাম। খচ্চরটার কোনো চিহ্ন নাই। চইলা গেসে। আমি মুখ বাঁকা কইরা রিকশা ডাকলাম।
দরজা নক করতেই ঝিলিক দরজা খুলল। আমি মুরগীর মতো এক ঠ্যাং ঝুলাই খাড়াই আছি। কিছু বলবার আগেই খালাগো কইয়া ঝিলিক চিল্লাইতে চিল্লাইতে আম্মুরে ডাকতে গেল। আমি আর কি করুম। সাহেদা আমারে বসার রুমে সোফায় গিয়ে বসালো। আম্মুটা কালকে রাতে নাইট ডিউটি করে আসছে। এখন বলদটা ডেকে তুলে আনবে ঘুম থেকে। চোখের পলক ফেলতেই আম্মা হাজির। প্লাস্টার দেখে বলল, কি করে হলো?
– আন্টি, পড়ে গিয়েছিল।
– কেমনে?
– জানি না। বেশ হাঁটছিল। হঠাৎ ঠাস করে পড়ে গেল!
– খালি জায়গায় কেমনে পড়ে?
সাহেদা কিছু না জানার ভঙ্গি করে সোফায় বসে পা ঢুলাইতে লাগল। আম্মা বলল, এত বড় ধামড়া মেয়ে যদি খালি জায়গায় পড়ে হাত ঠ্যাং ভাঙে… ঝিলিক ওকে রুমে নিয়ে যা। ঝিলিক আর সাহেদা আমারে রুমে নিয়া গেল। চারপাশে জিনিসপত্রে ছড়াছড়ি। কালকে বাসা পাল্টাইবার কথা আর আজকে আমি ঠ্যাং ভাইঙা বসি আছি। আমাকে বসাই সাহেদা এক প্লেট আচার নিয়ে এসে বসল আমার কাছে। আমি সেখান থেকে ভাগ বসাই কইলাম, ধুর বিরক্তি। ভাবছিলাম ঠ্যাং দুইটারে সোনায় বাঁধাই ঝুলাই রাখমু। প্লাস্টার কইরাই আধা পাগল লাগতেসে। সোনায় বান্ধি লটকাই থুইলে পুরা পাগল হই যামু।
– আরো গোয়েন্দাগিরি কর।
– সাহেদা……
– বল।
– আমি আজকে আবার ক্রাশ খাইসি। উফ্ কি চেহারা! চেরি ফলের মতো দুইটা গাল। ইচ্ছে করতেছিলো ……
– থাক। তোর ইচ্ছা তোর কাছে রাখ। এমনিতে তোর ক্রাশ খাওয়ার ঠেলায় আমার অবস্থা বারোটা।
– এমন করে বলিস না। তুই না বেস্টু।
আমি আচারের প্লেটের দিকে হাত বাড়াইতেই সাহেদা কইল, হ, খবরদার…… হাত দিবি না। এটা আমার আজকের পারিশ্রমিক। অলরেডি একটা খাইছিস। আর দিমু না। তুই কবে থেকে এত ভারি হইলি? তোরে ঝুলাই আনতে আনতে ঘাড়ে ব্যাথা হই গেল। আমি মুখ ভেঙাই কইলাম, তুই কবে থেকে এতো কিপটা হইলি? সাহেদাও আমারে ভেংচি মেরে মনোযোগ দিয়ে আচার খাইতে লাগল।
দুপুরে খেয়ে সাহেদা চলে গেল। আমি রুমে বসি আছি। পাশের রুমে ক্যাত ক্যাত শব্দ হইতেসে, আম্মা আর ঝিলিক সব গুছাইতেসে। আমি আকাইম্মা বসি আছি। ফোনটা নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করলাম। কিচ্ছু করার নাই। কি বিরক্ত লাগের। আজকে খচ্চরের রূপে পাগল হই উস্টা খাইলাম। দাঁড়াও আমি খাঁড়া হই তারপর তোমারে দেইখা নিমু খচ্চর।
.
.
.
.
পরদিন গাট্টি গোট্টা নিয়া নতুন বাসায় চলে আসলাম। আম্মার পরিচিত এক লোক সাহায্য করল। আমরা নতুন বাসায় রওনা দিলাম জিনিসপত্র নেওয়ার পর। আধা ঘন্টায় পৌঁছাই গেলাম সেখানে। দেখতে আগের বাসা থেকে একটু ছোট হলেও খারাপ না। বরং কেন জানি বাসাটাকে দেখে মায়া লাগতেসে। সুন্দর দেখতে। চেনা চেনা লাগতেসিলো কেন জানি। কিন্তু আমি আগে আসি নাই। সাহেদা অনেকবার ওদের বাসায় আসতে বলছিল, আসা হয় নাই। আমরা পৌঁছাতেই সাহেদা হাজির। এসেই বলল, চল আমাদের বাসায়।
– বোইন, আমার ঠ্যাং ভাঙ্গা। আগে ঠ্যাং সোজা হোক তারপর যামু।
আম্মু আর ঝিলিক জিনিসপত্র গোছানোয় লেগে গেছে। সাহেদাকে বলল, তুমি বসো, আমি কিছু দেই তোমাকে।
– আন্টি, আসলে আমিই দাওয়াত দিতে আসলাম। আম্মু বলসে আজকে আমাদের বাসায় খাইতে।
– এসেই তোমাদের কষ্ট দিচ্ছি।
– না আন্টি।
আমি কইলাম, চল, আমাকে রুমে নিয়ে যাবি। আজকে ঠ্যাং ভাঙা থাকার সুবিধা হলো আমার রুমটা আগে ঠিক করা হইসে। সাহেদা আমাকে রুমে নিতে নিতে বলল, আর গর্ব করতে হবে না। ভাবছিলাম এই সিটি পরীক্ষার পর তোকে নিয়ে একটু ঘুরমু৷ গোয়েন্দাগিরির ঠেলায় ঠ্যাং ভেঙ্গে ঘুরার বারোটা বাজাই দিলি। আমি বিছানায় বসে বললাম, শুননা, ফ্রিজ থেকে লালু মিয়া থুক্কু গাজর মিয়ার থলিটা থেকে গাজরগুলা ধুয়ে এনে দে না। সাহেদা মুখ বাঁকা করে চইলা গেল। ওরে আমার জ্বালাইতে বড্ড ভালা লাগে। বেস্টু হবে আর জ্বালাবো না, তা হয়? কিছুক্ষণ পর সে মাত্র একখানা লালু মিয়া নিয়া হাজির। আমি কইলাম, একটা!?
– হ, একটাই খাবা। আরো চাইলে নিজে গিয়া আনতে পারো।
– এই তুই এত কিপটা হইলি ক্যান?
– খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। আজকে তোর ঠ্যাংটা ভালো থাকলে ছাদে যাইতাম।
আমি গাজরে কামড় দিয়া ক্রাশের চিন্তায় মগ্ন হইলাম। কেমনে কি করা যায়। সাহেদা আমার সামনে হাত নাড়াই কইল, কোন দুনিয়ায় হারাইলি?
– কোন দুনিয়ায় আর হারামু? ক্রাশের কথা চিন্তা করতেসিলাম। এত্তো কিউট! ওরে আমি বিয়া করি শো কেসে সাজাই রাখমু।
– হ, সে তো তোরে ঘরে তুলার জন্য খাঁড়াই আছে। তুই টুকি কইবি আর সে তোরে ঘরে নিয়া যাইবো।
– এমন করে বলস ক্যান? না নিলে জোর করি ঢুকমু। এত্তো কিউট বর আর কই পামু।
– কি যে দেখলি তার মাঝে!
আমি খুশি মনে লালু মিয়ারে আরেক কামড় দিলাম। ক্রাশের চিন্তার ঠেলায় লালু মিয়াও সেই মিষ্টি লাগতেসে।
.
.
.
.
ঠ্যাংয়ের জ্বালায় আরো দুইদিন ঘরে বসি রইলাম।চারদিনের দিন প্লাস্টার খুলাই আনলাম ডাক্তারের কাছ থেকে। ঠ্যাং ঠিক হইতেই ক্লাসের প্যারা শুরু। আমরা দুইটা ক্লাস শেষেই শপিংয়ে চলি গেলাম। শালার গোয়েন্দাগিরিতে ঠ্যাং ভাঙ্গার জন্য কোথাও ঘুরতেও পারতেসিলাম না। এদিক ওদিক ঘুইরা একটা মার্কেটের সামনে আসলাম। তার বিপরীতেই একটা কিন্ডারগার্টেন আছে। সাহেদা কইলো, এই শুন না, ঐ কিন্ডারগার্টেনের সামনে ফুসকা, চটপটি বিক্রি করে। অনেক মজা। আমি খাইসিলাম। চল না ওখানে যাই। ফুসকা আর চটপটির কথা শুইনা আমার পেটের ইন্দুর বিলাইগুলার জিভেও পানি চলে আসলো। আমি চোখ টিইপা কইলাম, ডান।
গিয়া বসলাম ওখানে। সাহেদা কইলো, চাচা, দুই প্লেট ফুসকা আর চটপটি। তাড়াতাড়ি দিয়েন। নাহলে ছুটি হলেই বাচ্চা কাচ্চা সব এসে ভীড় করবে। পাঁচমিনিটেই আমগো খানা রেডি। চটপটিটা মুখে দিতেই গলে যায়। ফুসকাটাও এতো মুচমুচে। ইয়াম্মি! আমি কইলাম, সাহেদা, এবার থেকে এখানে আইসা খামু। কি স্বাদ! আমি গপ গপ করে খাইতেসি। সাহেদা মুখ বাঁকাই কইলো, তুই কত বছর খাস নাই? আমি উত্তরে মন গলানো হাসি দিলাম। যদিও এই হাসি সাহেদা ধারে কাছে নিল না। আমাদের খাওয়া শেষ না হইতেই কিন্ডারগার্টেনের ঘন্টার ধ্বনি শুনা গেল। আমরা পার্সেলও অর্ডার করসিলাম। তাড়াতাড়ি চাচারে কইলাম, চাচা, পার্সেলগুলো। পার্সেলগুলা নিতে নিতে এক গাদা বাচ্চা আমাদের ঘিরে হাতে টাকা নিয়ে লাফাইতে লাফাইতে চিল্লাইতে লাগল, আমাকে দেন, আমি খাবো। আমি সবার দিকে তাকাইতে হঠাৎ একটা বাচ্চারে নজরে পড়ল। সে সবার মাঝে দুই হাতে একটা গাজর শক্ত করে ধরে খরগোশের মতো কচর কচর কইরা খাইতেসে। দেখে আমার হাসি পাইলো। আমি সাহেদাকে কইলাম, ওই, বাচ্চাটারে দেখ কেমনে ভীড়ের মধ্যে গাজর খাইতেসে। সাহেদা দেখে কইলো, হাসিস না হাসিস না, গাজর খাইতে লাগলে তোকেও ঐ বাচ্চাটার মতো লাগে। সে হচ্ছে বাচ্চা খরগোশ আর তুই হচ্ছিস বুইড়া খরগোশ।
– হ। চল।
আমরা কোনোমতে ভীড় ঠেইলা রওনা দিলাম। গিয়া ঢুকলাম মার্কেটে। সেখান থেকে দুইজনে টুকটাক কিছু কিইনা অর্নামেনস কেনার জন্য একটা দোকানে ঢুকলাম। আমি যখন এক জোড়া কানের দুল আয়নায় পরে দেখতেছিলাম তখন দেখলাম আমাদের পাশের দোকানে ঝোলানো ওড়নার মাঝে একটা বাচ্চা আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেসে। চেনা চেনা লাগল। আমি ভাবলাম হয়ত বাচ্চাটা কারো সাথে আসছে। আমরা কেনাকাটা করে মার্কেট থেকে বের হইতেও কেন জানি মনে হইল কেউ আমাদের ফলো করতেসে। আমি সাহেদারে কইলাম, এই, সাবধানে পিছন ফিরে দেখতো কেউ আমাদের পিছু নিসে কি না। ও তাকাই কইল, একটা কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চা মেয়ে আমাদের পিছনে আসতেসে।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️
#সাহেদা_আক্তার
#সিজন_২
#পর্ব_৪
আমি সাহেদারে কইলাম, এই, সাবধানে পিছন ফিরে দেখতো কেউ আমাদের পিছু নিসে কি না। ও তাকাই কইল, একটা কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চা মেয়ে আমাদের পিছনে আসতেসে।
– বুঝছি, সেই লালু মিয়াওয়ালা আন্ডাবাচ্চা।
– লালু মিয়াওয়ালা আন্ডাবাচ্চা কিতা?
– আরে ঐযে ফুসকার ওখানে দেখাইলাম একটা বাচ্চাকে খরগোশের মতো লালু মানে গাজর মিয়া খাইতেসিলো। সেই আন্ডাবাচ্চা।
– আন্ডাবাচ্চা কি আবার?
– আন্ডাবাচ্চা হলো আন্ডাবাচ্চা।
আমরা উভয়ে পিছনে ফিরতেই বাচ্চাটাও দাঁড়াই গেলো। বাচ্চাটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাই আছে। উফ্! আন্ডাবাচ্চাটা এত্তো কিউট আর গুলুমুলু! গুবলু গুবলু লাল গাল। বড়ো বড়ো চোখ মেইলা আমার দিকে জুলুজুলু করি তাকাই আছে। ঠিক আমার লালুমিয়ার মতো। আমি হাঁটু ভাঁজ কইরা বইসা মিঠা হাসি দিয়া ওর গাল দুইটা কচলাইতে লাগলাম। বাচ্চাটা কিসু কইল না। চুপচাপ আমার দিকে ভেটকাই রইলো। সাহেদা আমারে ঠেলা দিয়া কইলো, কি করছিস? চল।
আমি উইঠা দাঁড়াইতেই হঠাৎ বাচ্চাটা ভেউ ভেউ কইরা কাঁইদা দিল। আমি জিগাইলাম, কি হল? বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে আমার ঠ্যাং দুইটা জড়াই ধরে কইল, আম্মু…… আম্মু……
– এই বাচ্চাটা মনে হয় ওর আম্মুকে খুঁজতেসে। আমাদের পিছন পিছন চলে আসছে।
– হয়তো ফুসকা খাবে। আমরা যে পার্সেল নিসি।
– হবে হয়তো। দাঁড়া।
আমি আমার ফুসকার প্যাকেটটা ওর এক হাতে ধরাই দিয়া অন্য হাত ধইরা কিন্ডারগার্টেনের দিকে হাঁটা দিলাম। ও ভালো মেয়ের মতো আমার হাত ধইরা হাঁটতে লাগল। চোখে মুখে আলো জ্বলকাইতেসে। সাহেদা পাশ থেকে কইল, মেয়েটা কি সুন্দর তোর হাত ধরে হাঁটতেসে। যেন তুই ওর আম্মু। আমি হেসে কইলাম, এসব কইস না। আমার জামাই কাঁনবো। আচ্ছা বাবু, তোমার নাম কি?
– আম্মু…… আমার নাম ভুলে গেসে…… এ্যাঁ…… আমাকে ভুলে গেসে…
মেয়েটা আবার ভেউ ভেউ কইরা কাঁদতে লাগল। আমি ওর চোখের পানি মুছে দিয়া কইলাম, ছিঃ, এভাবে কাঁদতে আছে? চলো তোমার আম্মুর কাছে দিয়ে আসি। কিন্ডারগার্টেনের কাছে আসতেই সাহেদা বলল, আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে ও তোকেই আম্মু ডাকছে।
– আরে ধুর পাগল, আমার এখনো বিয়া হয় নাই। জামাই হয় নাই। বাচ্চা আসবো কোত্থেকে?
– তোর……… বিয়ার বয়স হয় নাই!?
– না মানে, বিয়া হয় নাই আর কি……
আমি দারোয়ান চাচার কাছে গিয়া কইলাম, চাচা, ও আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছিল। দয়া করে অভিভাবকদের ফোন দিয়ে বলুন ওকে এসে নিয়ে যেতে। বইলাই আমরা হাঁটা ধরলাম। মেয়েটা দারোয়ান থেকে ছুটার জন্য ছটফট করতে লাগল আর আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে চিৎকার কইরা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আম্মু…… আম্মু……। আমি পেছন ফিরে একবার তাকাইলাম। দেখলাম আমার বয়সী একটা মেয়ে ওর দিকে দৌঁড়ে আসতেসে। ভাবলাম হয়তো সেই ওর আম্মু। আমি সামনের দিকে ফিইরা গেলাম। মনটা খারাপ হইয়া গেল।
আরো অনেকক্ষণ ঘুর ঘুর কইরা বাসায় আসলাম। সাহেদাকে বিদায় দিয়ে যখন বাসার দরজায় নক দিমু তখনই একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাইলাম। পাশের বাসার ভেতরে কাঁনতেসে। এত জোরে যে আমার মনে হইলো দেয়ালটা না ফাঁড়ি যায়। আমি সাবধানে গিয়া কান পাতলাম। বাচ্চাটা আম্মু আম্মু কইরা কাঁনতে কাঁনতে কাশি উঠাই ফেলল। আমি মনে মনে কইলাম, কি মা, বাচ্চারে ঘরে রেখে কোথায় চলে গেল! কান্না শুইনা অনেক খারাপ লাগতেসে কিন্তু কি করা!
.
.
.
.
পরদিন বিকালে সাহেদার সাথে আবার বের হইলাম। ওর নাচের ক্লাস। পিচ্চি পিচ্চি পোলাপাইনদের নাচ শিখায়। বলা যাইতে পারে পার্টটাইম জব। মনের দুঃখে কইলাম, আমি খুঁইজ্যাও একখান পার্টটাইম জব জুটাইতে পারলাম না। জীবনে কি করলাম! সাহেদা ভেংচি মেরে কইল, কেন? ক্রাশ খাইছিস না? রাস্তায় যাইতে যাইতে কইলাম, ধুর, ঐটা তো কথার কথা কইসিলাম।
– আমিও তাই কইলাম।
– তুই এত টেলেন্ট নিয়ে রাতে ঘুমাস কেমনে?
– আমার মধ্যে তুই কোত্থেইকা ট্যালেন্ট দেখলি?
– এই যে পড়াশোনার সাথে গান পারিস, নাচ শিখাস, গল্প লিখিস।
– এগুলা একটু আধটু সবাই পারে। তুইও তো পারিস। তোর গান শুনেছি আমি। তুই অনেক ভালো গান গাস। আমার থেকেও।
– হ, আমি বাথরুম সিঙ্গার।
– তোর মাথা। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুই আগে আরো ভালো গান গাইতি। তোর গলার কি অবস্থা?
– এইতো। মাঝে মধ্যে সামান্য অস্বস্তি লাগে গলায়। তাও ঠিক আছি এখন। তুই তো অপারেশনের পরের গলা দেখিস নাই। পুরা ফাড়া বাঁশ ছিল।
আমাদের কথার মাঝেই কতগুলা আন্ডাবাচ্চা দৌঁড়াই এসে ঘিইরা ধরল। আমি কইলাম, তুই তো ফ্যামাস। সাহেদা মুখ ভেংচাই কইল, হ। তারপর সবাইরে নিয়া নাচের জায়গায় চইলা গেল। জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগে আমার। এই নিয়ে তিনবার আসছি। চারপাশ খোলামেলা। চার কোনায় চারটা পিলারের উপর ছাদ। বাতাসে গুডগুডি খেলে ভিতরে। পাশে একটা দিঘি আছে। আশে পাশে কিছু বড়ো গাছপালা আর টবে ফুল গাছে ভর্তি। বাতাস বয়ে গেলে অনেক আরাম লাগে। সেখানে গাছের আড়ালে একটা বেঞ্চ আছে। আমি প্রত্যেকবার আসলে সেখানে গিয়া বসি। আজকে গিয়া দেখি সিট দখল। একটা আন্ডাবাচ্চা ওখানে বসি ফ্যাত ফ্যাত করতেসে। গিয়ে দেখি সেই লালুওয়ালা আন্ডাবাচ্চা। ফ্যাত ফ্যাত করতেসে আর গাজর চাবাইতেসে। আমি পাশে গিয়া সাবধানে বসলাম। আমার দিকে তাকাইতেই আন্ডাবাচ্চাটা আমারে জড়াই ধরে মরা কান্দা শুরু করল। কি জ্বালা! এ বাচ্চা এত কাঁনদে ক্যান? সে আমার জামায় ইচ্ছা মতো নাকের চোখের পানি মুছে মুখ তুলে কইলো, আম্মু তুমি আমাকে রেখে কই চলে যাও। আমি আশেপাশে তাকাই দেখি কেউ নাই। তাহলে এ আম্মু ডাকলো কারে? সে আমারে শক্ত করে জড়াই ধরে কইল, আজকে আর যেতে দিবো না। মুসিবত! কইলাম, তোমার আম্মু কোথায়? সে আমারে আরো জাপটে ধইরা কইল, এই যে। আমি মনে মনে রবীন্দ্রনাথের মতো কইলাম, ওহে আন্ডাবাচ্চা, তোমার চক্ষে কি ছানি পড়িয়াছে? ভালো করিয়া দেখো, আমি তোমার আম্মু নহে। আমার এখনো বিয়ার বয়স হয় নাই। পরে আবার কইলাম, তওবা, তওবা, কি কই! এই কথা ক্রাশ শুনলে তো বিয়াও করবে না।
– দেখো বাবু, আমি তোমার আম্মু না।
– তুমিই আমার আম্মু। আমাকে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলা? কালকে মুন খাম্মি আর আব্বুকে বলসি তোমার কথা৷ কেউ বিশ্বাস করেনি। সবাই বলসে তুমি মরে গেসো। আজকে সবাইকে বলব, দেখো, আমার আম্মু মরে নাই। আম্মু……
মেয়েটা আবার ভেউ ভেউ কইরা ফের কান্না জুইড়া দিল। সাহেদা কালকে ঠিকই কইসিলো। ও আমারেই আম্মু ডাকতেসিলো। আমি ওর মাথায় হাত বুলাই কান্না থামানোর চেষ্টা কইরা বললাম, তোমার নাম কি বাবু? সে কাঁদতে কাঁদতে কইল, আম্মু…… আমি পর্ষী। তুমি আমার নাম ভুলে গেছো! এ্যাঁ……
– এমা, কাঁদে না। তুমি না নাচ শিখতে আসছো? দেখো সবাই ওখানে। তুমি এখানো কাঁদতেসো জানলে ওরা কি বলবে? যাও নাচের ক্লাসে যাও।
– উহু, গেলে তুমি হারিয়ে যাবে।
– হারিয়ে যাবো কেন?
– তাহলে আমার সাথে আসো। আমি যতক্ষণ নাচ শিখবো তুমি সামনে বসে থাকবে। তারপর দুইজনে একসাথে বাসায় যাবো।
আমি বেকুবের মতো হাসলাম। কি কমু? এ দেখি আমার পিছুই ছাড়ে না। আমি আবিয়াত্তা (অবিবাহিত) মানুষ। এখনো কারো সাথে একটা প্রেমও করতে পারলাম না। আর এখন জামাইসহ বাচ্চা ফ্রি পাইতেসে। পর্ষী আমারে টাইনা নিয়া সামনে বসাই বাচ্চাদের সাথে নাচ শিখতে লাগল। ক্ষণে ক্ষণে আমার দিকে তাকাই চেক করতে লাগল আমি আছি কি না। যেন জেলখানার পলাতক আসামি।
নাচ শেষ হইতেই পর্ষী দৌঁড়ে আমার কাছে চইলা আসলো। আমার হাত শক্ত করে ধইরা বসে রইল পাশে। সাহেদা ক্লাস শেষে আমার পাশে বসছিল। আমি ওর দিকে অসহায়ের মতো তাকাইয়া ফিসফিস করে কইলাম, সাহেদা, ঐদিন তুই ঠিকই বলছিলি। এখন এর থেকে কেমনে বাইর হমু? সে তো আমারে আম্মু আম্মু কইয়া পাগল হই যাইতেসে। সাহেদা জুসের স্ট্র মুখে ঢুকাইতে ঢুকাইতে কইল, তাইলে ওর আম্মু হই যা। আমি মুখ বাঁকা করি কইলাম, ওর আম্মু হইলে, আমার ক্রাশ কানবো। আমার কথা শুইনা বেকুবটা হাসলো। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকাইলাম। বাচ্চাটা কি যে গুলুমুলু। ইচ্ছা করে সারাদিন গাল দুইটা টিপি। বাচ্চাটার মা হয়তো মরে গেসে তাই আমারে মা ভাবতেসে। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকাই রইলাম। হঠাৎ বাচ্চাটা খাম্মি বলে দৌঁড়াই গেল। আমি ভাবলাম, এই সুযোগ। আমিও উঠে লুকাই পড়লাম। নইলে কখন আবার আম্মু আম্মু কইয়া টানাটানি করে। শেষে না তার বাপরেই বিয়া করতে হয়।
পর্ষীটা টানতে টানতে ওর খালামনিকে আমার বসে থাকার জায়গায় নিয়া আসলো। সাহেদা আগের মতোই জায়গায় বসে জুস খাইতেসে। পর্ষী এদিক ওদিক তাকাই আমাকে খুঁজে ডাকতে লাগল, আম্মু… আম্মু… ওর খালামনি বলল, পর্ষী, এমন করে না সোনা। চল বাসায় যাবে।
– না…… আম্মু একটু আগেও আমার সাথে এখানে ছিল। আমার গাল নিয়ে আগের মতো খেলা করছিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। তুমি ম্যামকে জিজ্ঞেস করো। আম্মু… আম্মু…
– পর্ষী, তোমার আম্মু বেঁচে নেই মা।
– না, বেঁচে আছে। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। তুমি না আসলে আম্মু এখনো থাকতো। আমি তোমার কাছে দৌঁড়ে গিয়েছি বলে আম্মু আবার আমাকে ফেলে চলে গেছে। আম্মু……
পর্ষী কান্না শুরু কইরা দিল। ওর খালামনি জোর করে ওরে নিয়া চলে গেল। সে অনবরত আম্মু আম্মু করতেসে। ওরা চলে গেলে আমি বাইর হইলাম। সাহেদা বলল, মেয়েটাকে দেখে বড্ড খারাপ লাগতেসে। তুই এমন চোরের মতো পলাইলি ক্যান?
– যদি আমারে ওর আম্মু ভাইবা নিয়া যায়।
– হ, তার খালামনির মাথায় তো বুদ্ধি সুদ্ধি নাই। বাচ্চাটার মতো তোরেও ওর আম্মু ভাববে। তুই থাকলে ব্যাপারটা এখানেই ক্লিয়ার হয়ে যাইতো।
– আইচ্ছা আইচ্ছা, পরের বার ক্লিয়ার করমু। এখন চল। বাসায় যামু।
ওরে নিয়া বাসার দিকে রওনা দিলাম। পর্ষী বাচ্চাটার জন্য মন খারাপ লাগল। কিন্তু আমি আর কি করমু!?
চলবে…